শ্লথ নামক নিরীহ প্রাণীটি আমাদের কী শিক্ষা দেয়?

  ওয়ালিদ ইসলাম

২১ মার্চ ২০২৪, ১০:০৩ | অনলাইন সংস্করণ

ওয়ালিদ ইসলাম
ইউরোপিয়ানরা যখন শ্লথ নামক প্রাণীটি খুজে পেলো তখন তারা শ্লথকে দুনিয়ার সবচেয়ে অকর্মা প্রাণীর খেতাব দিলো। তারা কখনোই খুজে পেলোনা এই শ্লথ নামক প্রাণীটি জগতে কখনো কারো কোন কাজে আসে। এমনকি এর দুর্গন্ধ, শরীরের ময়লা ও গাছে থাকা স্বভাবের কারণে এই প্রাণীকে পোষ্য হিসেবেও কেউ নিতে চায়না। তার একমাত্র উপযোগিতা হলো তার চলাচলের স্টাইল ও ধীরগতি নিয়ে মানুষের মজার খোরাক হওয়া। কিন্তু, একবিংশ শতাব্দীতে এসে দক্ষিণ আমেরিকার একদল গবেষক শ্লথকে নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করলে তারা জানতে পারলো শ্লথ সেখানকার রেইন ফরেস্টের জন্য কতোটা জরুরী। শ্লথ যেহেতু, রেইন ফরেস্টের গাছের উপর দিকের পাতাগুলো খেয়ে ফেলে সেহেতু, ঘন রেইন ফরেস্টের ভেতর আলো ঢুকতে পারে। আর এই আলোই রেইন ফরেস্টের সকল প্রাণী এমনকি কিছু কিছু খুদ্র নৃগোষ্ঠীকেও সেখানে বাচিয়ে রাখে। শ্লথ গাছ থেকে নিচে নেমে গাছের শিকড়ের কাছে মলত্যাগ করে যা ওই গাছের জন্য উপযুক্ত সার হিসেবে কাজ করে। আবার শ্লথের দেহেই শ্লথ এমন একটা ইকোসিস্টেম গড়ে তোলে যেখানে প্রজাপতির ডিম থেকে লার্ভা, এমনকি বিটল পোকার মতো অনেক নামি-দামি পোকা শ্লথের শরীরে ডিম পাড়ে। আবার, শ্লথ যদি গাছের চিকন ডালে ভর করে না থাকে তাহলে তা বিগক্যাট যেমন চিতা বা জাগোয়ারের জন্য খুবই সহজলভ্য শিকার।

কখনো কি ভেবে দেখেছেন আমরা অধিকাংশ মানুষই হচ্ছি শ্লথ এবং সমাজটা হচ্ছে শ্বেত চামড়ার ইউরোপিয়ান (কখনো কখনো জাগোয়ার বা চিতা)। আপনি যতোই যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ হন না কেন সমাজ আপনার পেছনে লেগে থাকবে আপনাকে অকর্মা, নিকর্মার তকমা দিয়ে বসে থাকবে যতোক্ষণ না পর্যন্ত আপনি নিজেকে প্রমাণ করবেন। সমাজের বিবেচনায় একদম ছোট লেভেলের চাকরি থেকে, প্রাইভেট যতো বড় পোস্টই হোক না কেন বা পাব্লিক সার্ভিসের উপরি পর্যায়েও এই শ্লথ এবং ইউরোপিয়ানদের উপস্থিতি আছে। একদল মানুষ থাকবেই আপনাকে অকর্মা প্রমাণের জন্য। আপনার মেধা, আপনার শ্রম সবকিছুর বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সেই মানুষগুলো আপনাকে নিয়ে মজা নেয়ার জন্যই আছে।

আমার মোস্ট ট্যালেন্টেড বন্ধুদের মধ্যে একজন স্কুল শিক্ষক। নিজ এলাকায় পোস্টিং, সেখানেই সে প্রাইভেট পড়ায়, মাছ-মুক্তা চাষ করে, গরুর খামার করে। তার মাসিক ইনকাম আমার সারা বছরের ইনকামের চেয়ে বেশি। তবুও, গতকাল কথা বলতে বলতে কেদে ফেললো ছেলেটা। সে যা ই করুক না কেন ভালো সরকারি/প্রাইভেট চাকরি করেনি বলে মানুষ তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। এসএসসি-এইচএসসিতে গোল্ডেন, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ডিপার্টমেন্টে পড়ে স্কুল শিক্ষক হয়েছে বলে তাকে নিয়ে হাসি তামাশার অন্ত নেই। আমার এক বন্ধু আজীবনই যশোর পুলিশ লাইন স্কুল, যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে সবজায়গায় সবকিছুতে প্রথম হয়ে এসেছে। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি, পরে মস্কোর একটা ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে এসে করোনাকালীন সময়ে কিছু করতে পারেনি। যখন নতুন করে শুরু করতে গেলো তখন আমাদের সমাজটা তার প্রতি ওই বিগ ক্যাট চিতা বা জাগোয়ারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। শেষ পর্যন্ত ছেলেটা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলো।

রেইন ফরেস্ট ইউরোপে না থাকায় তাদের অধিকার নেই শ্লথকে বিবেচনা করার তেমন আপনাকে বিবেচনা করারও সমাজের কোন অধিকার নেই। আপনি কি, আপনার কি যোগ্যতা বা ট্যালেন্ট আছে তার নির্ধারক আপনি, সমাজ নয়। আমি যদি রিক্সা চালিয়েও আমার জীবন নিয়ে সুখে থাকি তাতে সমাজের কি? সমাজ কেন এসে বিবেচনা করবে আমি সফল না বিফল। আর তারা করলেই বা কেন আমাকে গায়ে মাখতে হবে। 

আর আপনার সাফল্যের পথ একটু ধীরগতির হলেতো কথাই নেই। হাসিঠাট্টা করার মানুষের অভাব থাকবে না। আপনার ধারণা হলো প্রজাতন্ত্রের কর্মে যারা নিয়োজিত সেখানে শ্লথ এবং ইউরোপিয়ান কারো উপস্থিতি নেই। কিন্তু, বিষয়টা একদমই ঠিক নয়। সেখানেও আপনাকে শ্লথ বানানো সমাজ আছে এবং থাকবে। ইউরোপিয়ানদের মতো সমাজের উপস্থিতি আপনি সবখানেই পাবেন। কাজেই কে কি বললো বা কে কি নিয়ে হাসিঠাট্টা করলো এর জন্য মন খারাপ করার কিছুই নেই। দেখবেন সাউদ আমেরিকানদের মতো একদল মানুষ আপনার পাশে পাবেনই। আপনাকে সান্ত্বনা দিয়ে, আপনার উপযুক্ত যোগ্যতা মোতাবেক আপনাকে মেপে একদিন মানুষের কাছে তারা প্রমাণ করবেই আপনি যোগ্য। আপনার যা আছে, আপনি যেমনই থাকেন না কেন যদি সুখে থাকেন নিজের গতিতে, নিজের যোগ্যতা নিয়ে এগিয়ে যান। সমাজকে (যারা কখনো ওই ইউরোপিয়ান কখনো বা বিগক্যাটের ভূমিকায় অবতীর্ণ) পাত্তা না দিয়ে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকুন, আত্মবিশ্বাসী থাকুন, নিজের যোগ্যতাকে গুরুত্ব দিন। সমাজ আপনার প্রয়োজনীয়তা, আপনার উপযোগিতা নিজেই একদিন বুঝতে পারবে। ইউরোপিয়ানদের যেমন অধিকার নেই সাউদ আমেরিকার রেইন ফরেস্টের শ্লথ নিয়ে কথা বলার, সমাজেরও কোন অধিকার নেই আপনাকে বিবেচনা করার।

লেখক: ইরানে বাংলাদেশের দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং বিশ্বের তৃতীয় লিঙ্গের প্রথম কূটনীতিক। 

এই বিভাগের আরো সংবাদ