নাথান বম : ঢাবি’র চারুকলার ছাত্র থেকে পাহাড়ের ত্রাস

  হীরেন পণ্ডিত

২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৪৮ | অনলাইন সংস্করণ

হীরেন পণ্ডিত
নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের স্নাতক। এখন তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) প্রধান নেতা। চারুকলার ছাত্র থেকে পাহাড়ের ত্রাস সৃষ্টিকারী ব্যক্তি এখন নাথান বম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা ছাত্র নাথান বম একসময় বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও এখন তিনি পাহাড়ের ত্রাস হয়ে উঠেছেন সবার কাছে আতঙ্কের এক নাম।

রুমা উপজেলার এডেন পাড়ায় তার জন্ম ও বেড়ে উঠা।  প্রথমে তিনি নিজ এলাকায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি বেসরকারি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এখন তিনি আত্মগোপনে। এদিকে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণশিবির লক্ষ্য করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরুর পর কেএনএফের একটি ফেসবুক পেজে হুমকি দিয়ে বলা হয়, ‘ফিয়াংপাদুং পাড়ার পাশে আমাদের হেডকোয়ার্টারে কোনোভাবে যদি আক্রমণের চেষ্টা চালানো হয়, তবে সেটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে ১-২ মিনিটের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।’

জঙ্গিবিরোধী অভিযানে যুক্ত পাহাড়ি সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় যেখানে জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল, সেখানেও সমন্বিত অভিযান শুরু হয় গণমাধ্যমে এসব কথা উঠে আসে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমাকে টেক্কা দিতেই মূলত নাথান বম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। অথচ খাগড়াছড়ির চেঙ্গী স্কয়ারের পাশে সন্তু লারমার ভাস্কর্যটির অন্যতম কারিগর তিনি। বান্দরবানের দুই উপজেলায় ১৭ ঘণ্টার মধ্যে দু’টি ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা, অস্ত্র লুট ও অপহরণের ঘটনার পর থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলি করে এই সশস্ত্র গোষ্ঠী সম্প্রতি। বান্দরবানের বম জাতিগোষ্ঠীর কিছু ব্যক্তি এটি গড়ে তুলেছেন নাথান বম বলেই জানা যায়।

কেএনএফ সংগঠনের নামে ফেসবুকে একটি পেজ খুলে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম এই উপজেলাগুলো নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবি করার পর এরা আলোচনায় আসে। তাদের দাবি, তারা বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি এই ছয় জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে। তাদের কল্পিত সেই রাজ্যের মানচিত্রও তাদের পেজে দেয়।

তাদের দাবি, তাদের সামরিক শাখার শতাধিক সদস্য গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে পাড়ি জমান কয়েক বছর আগে। ২০২১ সালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল ফিরে আসে। চলতি বছর অনেকেই আত্মগোপনে যায়। তবে, কেএনএফকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও চলছে এই দাবি অনেকের। 

কেএনএফের ক্যাম্পে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসা শুরু হয়। পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফ টাকার বিনিময়ে জামাতুল আনসারকে প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছে এমন অভিযোগ রয়েছে কেএনএফ এর বিরুদ্ধে। কেএনএফের ক্যাম্পে শ্রশিক্ষণ শুরু হয় গণমাধ্যমের খবরে এমনটাই জানা যায় যে, ক্যাম্পে ৫০ এর অধিক জঙ্গি প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। দুর্গম পাহাড়ে কেএনএফ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণশিবির স্থাপন করে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। বান্দরবানে সেই শিবিরকে লক্ষ্য করেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত অভিযান পরিচালিত হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। কেএনএফ পাহাড়ে অপেক্ষাকৃত নতুন সংগঠন। বম জাতিগোষ্ঠীর একটা অংশের উদ্যোগে এটি গঠিত হলেও তাদের দাবি, ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা।

নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের ১৯টি জেলা থেকে ‘হিজরতের’ নামে ৫৫ জন তরুণ ঘর  ছেড়েছিলো কয়েক বছর আগে, সে সময় র‌্যাব আয়োজিত  এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিলো। ৫৫ জনের মধ্যে ৩৮ জনের পূর্ণ নাম-ঠিকানার একটা তালিকাও সে সময় প্রকাশ করা হয়। নিরুদ্দেশ বা নিখোঁজ থাকা এই তরুণদের অনেকে বান্দরবানের দুর্গম এলাকায়  কেএনএফের ক্যাম্পে স্থাপন করা প্রশিক্ষণশিবিরে আছেন এমনটি জানানো হয় সে সময়। 

এ ঘটনায় তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে জামাতুল আনসারের যে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে পাহাড়ের ওই জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। সেখানে এখনো জামাতুল আনসারের ৫০এর অধিক সদস্য ছিলো বলে ধারণা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে নিষিদ্ধ তিন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম, জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের কিছু নেতার উদ্যোগে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া যার বাংলা অর্থ: পূর্ববর্তী হিন্দের সাহায্যকারী দল গঠন করা হয়। ২০১৭ সালে এরা সংগঠিত হতে শুরু করলেও সংগঠনের নাম ঠিক করে ২০১৯ সালে।

আইন শৃংখলা রক্ষাবাহিনীর মতে, অতীতেও দেশের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন পাহাড়ে আস্তানা বা ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করেছে। কেউ জমি কিনে, কেউ ছোটখাটো মাদ্রাসা স্থাপন করে বা অন্য কোন প্রক্রিয়ায়। আবার কখনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা এনজিও এর আড়ালেও সে চেষ্টা করা হয়। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর আস্তানায় ধর্মভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ নেওয়ার এমন খবর গণমাধ্যমে আগে জানা যায়নি।

নতুন জঙ্গি সংগঠন নিয়ে আইন শৃংখলা রক্ষাবাহিনীর মতে, জামাতুল আনসার তাদের বাছাই করা তরুণদের ছোট ছোট গ্রুপে জ্যেষ্ঠ সদস্যের হেফাজতে রাখে। এরপর শারীরিক কসরতসহ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে উত্তীর্ণদের প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবানে কেএনএফের ক্যাম্পে পাঠানো হয়। কেএনএফের ক্যাম্পের এই জঙ্গিদের প্রশিক্ষণে একে-৪৭ রাইফেল, পিস্তল ও কাটা বন্দুক চালানো, বোমা বা আইইডি তৈরি এবং চোরাগোপ্তা হামলার অ্যাম্বুশ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মূলত টাকার বিনিময়ে কেএনএফ জঙ্গিদের এই সুবিধা দিয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়। 

জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, নতুন করে জঙ্গি তৎপরতার যে খবর এখন জানা যাচ্ছে, এই তৎপরতা আরও কয়েক বছর আগেই শুরু হয়। কারণ, কয়েক বছর আগে হরকাতুল জিহাদসহ বিভিন্ন সংগঠনের গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের কাছ থেকে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। বিশেষ করে কেএনএফের সঙ্গে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সংযোগ স্থাপন করেন। ২০২২ সালের প্রথম দিকে কেএনএফের নাম নজরে আসে, আসতে থাকে তাদের নানা তৎপরতার খবর। মূলত ফেসবুকে পেজ খুলে এই গোষ্ঠী তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। সঙ্গে ছিল সশস্ত্র তৎপরতা। বান্দরবানের বম জাতিগোষ্ঠীর কিছু ব্যক্তিই এটি গড়ে তুলে নেতৃত্ব দেন নাথান বম। 

রুমা উপজেলার ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন এলাকার সালাপৌপাড়ার কাছের কোনো স্থানে কেএনএফের আস্তানা ছিল বলে ধারণা করা হয়।  আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত বছর অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া ও  কেএনএফের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গত দুই বছরে নয়টি বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে কেএনএফ। গত বছর কেএনএফের সন্ত্রাসীদের চারটি হামলার ঘটনায় পাঁচ সেনাসদস্য নিহত হন। আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী ইউপিডিএফের একটি অংশের সঙ্গে সংঘর্ষে গত বছর রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাংপাড়া এলাকায় আটজন এবং রুমা উপজেলার একজন নিহত হন। 

এ ছাড়া গত বছরের ৮ মে রোয়াংছড়ি উপজেলায় এলাকায় আওয়ামী লীগের একজন নেতাসহ বম জনগোষ্ঠীর তিনজন এবং ২০২৩ সালের ২২ মার্চ একই উপজেলার রামথারপাড়ায় থংচুল বম নামের এক কারবারি বা পাড়াপ্রধানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০২২ সালের ২১ জুন রাঙামাটির বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় তিন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন জঙ্গিদের সঙ্গে কেএনএফের সম্পর্ক নিশ্চিত হয়ে অভিযান চালায়, তখন বিশেষ করে রুমা, থানচিসহ পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। ওই সব অঞ্চলে পর্যটন বন্ধ হয়ে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। বমদের কেউ কেউ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের মিজোরামে চলে যায়। বম জাতিগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েন। এ সময়টার সুযোগ নেয়  কেএনএফ। আর তখন নতুন করে বেশ কিছুসংখ্যক যুবককে তারা দলে ভেড়ায়। 

স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস, পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। তাদের সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী নামে পরিচিত ছিল। দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা এই সশস্ত্র আন্দোলন শেষ হয় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হওয়ার পর। সশস্ত্র লড়াইয়ের এ সময়ে গরম বাহিনীসহ পাহাড়ে ছোট ছোট কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টি হয়। তবে তারা বেশি দিন টেকেনি। চুক্তির পর চুক্তিবিরোধী পাহাড়ি তরুণদের একটি গোষ্ঠী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলে। তাদের সঙ্গে জেএসএসের সংঘাত আজও থামেনি।

এর মধ্যে ২০০৭ সালে জেএসএসের একটি অংশ মূল দল থেকে বের হয়ে জেএসএস লারমা গ্রæপ নামে আরেকটি সংগঠন গড়ে তোলে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময় ম্রো ন্যাশনাল পার্টি বা এমএনপি নামের একটি দল গড়ে ওঠে বান্দরবানের আলীকদমে। খুন, অপহরণসহ নানা সন্ত্রাসী কাজে জড়িয়ে পড়ে দলটি। এরপর ২০১৫ সালের নভেম্বরে দলটির ৭৯ জন সদস্য একযোগে আত্মসমর্পণ করে। এরপর দলটির তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। ওই বছরই আলীকদমে ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর কিছু তরুণ সদস্যকে নিয়ে আরেকটি সশস্ত্র দল গঠিত হয়। এর প্রধান রংজুমা ত্রিপুরা আত্মগোপনে আছেন। ওই দলেরও এখন কোনো তৎপরতাও নেই।

২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে আরেক দল গড়ে ওঠে। ইউপিডিএফের কর্মীদের হত্যা ও হামলার মধ্যে দিয়েই দলটির প্রকাশ ঘটে। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আগে বান্দরবানে মগ পার্টি নামে একটি সশস্ত্র  গোষ্ঠীর তৎপরতা শুরু হয়। মারমা জাতিগোষ্ঠীর কিছু সদস্য এ দল গঠন করে বলে স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে। 

কেএনএফের এই হামলার বড় ধরনের প্রভাব আছে। এর ফলে পাহাড়ে, বিশেষ করে কেএনএফ অধ্যুষিত এলাকাগুলোর শান্তি অনেকটা অনিশ্চিত হতে পারে বলে অনেকের আশংকা।  কেএনএফের সঙ্গে হয়তো বা পাহাড়ের আরো কোনো বড় সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে নতুন যোগাযোগ সৃষ্টি করতে পারে। কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতার সঙ্গে ভারতের মণিপুরের কুকিদের সঙ্গে স্থানীয় মেইতেইদের সঙ্গে চলমান সশস্ত্র বিরোধ, মিয়ানমারের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর অব্যাহত সংঘাতকে নিয়ে আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে।

তবে সশস্ত্র পথ পরিহার করে আত্মসমর্পণ করতে চাইলে, তাঁদের অবশ্য স্বাগত জানানো হবে। তাঁদের পুনর্বাসনের বিষয়টিও বিবেচনা করা হবে বলে জানান আইন শৃংখলার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনী। কেএনএফ সদস্যসহ এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয় একশো এর কাছাকছি সন্ত্রাসীকে। কেএনএফ প্রধান নাথান বম এখন কোথায় আছেন? এর উত্তর কেউ জানেনা। দলের পক্ষ থেকে দাবি, নাথান বম সুইজারল্যান্ডে আছেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, তিনি নেদারল্যান্ডসে আছেন। আবার সীমান্ত  পেরিয়ে নাথান বম ভারতের মিজোরামে আছেন বলেও কেউ কেউ মনে করেন। সব মিলিয়ে তাঁর অবস্থান নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা এখনো আছে।

নাথান বম

দলের অন্য সদস্যরা কোথায় লুকিয়ে আছে গণমাধ্যমের কাছেও সঠিক হিসেব নেই। দলটির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য এখন বাংলাদেশের ভেতরই আছে এমন ধারণা অনেকের। তবে এর  চেয়ে বেশিসংখ্যক সদস্য ছড়িয়ে থাকতে পারে মিয়ানমার ও মিজোরামের বিভিন্ন এলাকায়। কেএনএফ এর ধারণা কুকিচিন তথা বম, পাংখোয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো ও খিয়াং জনগোষ্ঠীর মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র। কিন্তু এই ভূখণ্ডে সরকার ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে তারা বঞ্চনার শিকার।

শান্তিপ্রিয় বমেরা অন্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করছে এটাও বলছে অনেকেই। তাদের আলাদা  কোনো দাবি নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থাপনাকেও পাল্টে দিতে চায় কেএনএফ। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম সুদীর্ঘকাল ধরে চাকমা, বোমাং ও মং সার্কেলে বিভক্ত। তিন সার্কেল প্রধান বা রাজা সরকারের হয়ে রাজস্ব আদায় করেন। বাংলাদেশের ৬১  জেলা থেকে ভিন্ন এখানকার ভূমি ব্যবস্থাপনা আর সেটা আইনত স্বীকৃত। কিন্তু কেএনএফ চায়, ভূমিতে সার্কেল প্রধান বা মৌজার হেডম্যানদের কোনো ক্ষমতা থাকবে না।
 
ভূমি পাহাড়ের অন্যতম সমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামে এ সমস্যার বড় কারণ ১৯৮০ এর দশকে তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় অন্তত চার লাখ সমতলের বাঙালির অভ্যন্তরীণ অভিবাসন। পাহাড়ি মানুষের যুগ যুগের আবাসস্থলে অনেক বাঙালির বসতি গড়ে তোলা হয়। এতে পাহাড়ের ভূমি সমস্যা জটিলতর হয়ে পড়ে। ভূমি কমিশন গঠনের দুই যুগ পরও একজনের ভূমি সমস্যারও সমাধান হয়নি। পাহাড়ের যেকোনো জাতিগোষ্ঠীর মানুষকেই ভূমির এই জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু কেএনএফ বলছে তাদের কল্পিত কেটিসিতে যেকোনো পাহাড়ি ও বাঙালি নতুনভাবে বসতি স্থাপন করতে পারবে। এমনকি দেশের যেকোনো অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বাঙালি এসে জমি কিনতে পারবে!

পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত নতুন এই সশস্ত্র সংগঠন কেন এমন বেপরোয়া হয়ে উঠল বা এই হামলার নেপথ্যের কারণ কি হতে পারে। কেএনএফ শুরুতে পাহাড়ে নতুন রাজ্যের দাবি থেকে সরে এসে এখন কেটিসির মতো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান চায়। এমন মৌলিক একাধিক দাবির ক্ষেত্রে পরিবর্তন হলেও একটি বিষয়ে তাদের অবস্থানের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি, তাহলো জেএসএস এবং আঞ্চলিক পরিষদ বিরোধিতা। পাহাড়ের প্রথম রাজনৈতিক দল জেএসএসের প্রতি তাদের বিদ্বেষ আগে যেমন ছিল এখনও তেমন আছে। সেই সঙ্গে আছে আঞ্চলিক পরিষদ ও চাকমা বিদ্বেষ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে বিশেষ দুই প্রতিষ্ঠান আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন জেলা পরিষদ গঠিত হয়। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্র্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এই দুই প্রতিষ্ঠান বিশেষ বলে মনে করেন স্থানীয় সরকারের বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির সম্পাদন প্রক্রিয়া সহজে হয়নি। পুনর্বাসিত বাঙালিদের অনেকে চুক্তির বিরোধিতা করে। পাহাড়িদের একটি অংশ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ নাম দিয়ে চুক্তির বিরোধিতা করে এবং পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে। এসব বিরোধিতার পরও চুক্তি হয়। চুক্তির পর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলেও সেই চুক্তি কিন্তু বাতিল করেনি।

তিন পার্বত্য জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক পদ হলো চিফশিপ এবং হেডম্যান। এদের বেশির ভাগই চাকমা, নয়তো মারমা সম্প্রদায়ের। ইউনিয়ন, উপজেলা এবং ব্যবসা, এনজিও, প্রশাসনিক সব পদে হয় চাকমা, নয় মারমা জনগোষ্ঠীর লোকজনের প্রাধান্য। এ নিয়ে চাকমা ও মারমা ছাড়া অন্য গোষ্ঠীগুলোর কিছুটা ক্ষোভও আছে।

কিন্তু আজ পর্যন্ত তিন জেলা পরিষদে কোনো নির্বাচন হয়নি। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন তাদের লোক জেলা পরিষদে বসে। আর জেলা পরিষদের নির্বাচন না হওয়ায় আঞ্চলিক পরিষদেরও নির্বাচন হয়নি। চুক্তির ফসল এই আঞ্চলিক পরিষদকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে বলে তাদের ধারণা। চুক্তির পর ভূমি, নিজস্ব পুলিশের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর কোনো সুরাহা হয়নি বলেও তাদের হতাশা রয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে কমিটির সভা স্থানীয় বাঙালি সংগঠনগুলোর প্রবল বিরোধিতায় একাধিকবার বানচাল হয়ে যায়। 
আঞ্চলিক পরিষদ, জেএসএস এবং চাকমা জাতিসত্তাকে সমান্তরাল বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার কেএনএফ হয়তো প্রকাশ্যে করেছে। কিন্তু এমন বিদ্বেষ পাহাড়ে নতুন নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে চাকমারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে তারা এগিয়েও। কেএনএফের তৎপরতা দেখে সবাই বুঝতে পারবে এর পেছনে আসলে কী বা কারা আছে। পার্বত্য চুক্তির মূল চেতনাকে নস্যাৎ করে দেওয়াই এসব গোষ্ঠীর মূল কাজ। 

বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি এসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে সংগঠনটি গঠিত হয়েছে কেএনএফ। জাতিগোষ্ঠীগুলোর বেশির ভাগ খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী। পাহাড়ে এখন সবকিছু দেখছে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন। কেএনএফ গত কয়েক বছরে সক্রিয় হয়ে উঠছে, শুধু বাংলাদেশের এসব এলাকা নয়, সেখানে আছে মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন প্রদেশ এবং ভারতের মিজোরাম ও মণিপুর রাজ্য। এসব এলাকায় কুকি-চিনের বড় প্রভাব আছে। চিন প্রদেশে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স বা সিডিএফ লড়াই করছে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে। সেই গোষ্ঠীর বেশির ভাগ হচ্ছে কুকি-চিন। আবার মিজোরামেও এখান থেকে অনেক কুকি চলে গেছে। সেখানে এ নিয়ে নানা ধরনের অস্থিরতাও তৈরি করছে। 
মণিপুরে মেইতেই গোষ্ঠীর সঙ্গে কুকিদের বড় সংঘাতও সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে। ফলে সীমান্তের ওপারে কুকি-চিনদের নানামুখী আন্দোলন ও তৎপরতার অনুপ্রেরণায় এখানে কেএনএফ গঠিত হয়েছে এবং সক্রিয় হয়েছে বলেই অনেকের ধারণা। তারা সেসব জায়গা থেকে অস্ত্র ও পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে বলেই অনেকের আশঙ্কা। তারা এখন বান্দরবানের বিশাল এলাকা নিয়ে স্বায়ত্তশাসন দাবি করছে। যদিও সেটির সঙ্গে সীমান্তের ওপারে কুকি-চিন নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর কথা এখন পর্যন্ত তারা বলছে না।

রুমা, থানচি ও আলীকদম তিন এলাকার দূরত্ব অনেক। অল্প সময়ের মধ্যে তিন জায়গায় হামলার ঘটনায় এটা প্রতীয়মান হয়, অনেকগুলো দলে ভাগ হয়ে সুপরিকল্পিতভাবে এসব হামলা চালিয়েছে কেএনএফ। তারা যে শক্তি দেখিয়েছে তাতে মনে হয় এলাকাটিকে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির শুরুতেই এই অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। চুক্তিতে এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করার কথাও বলা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পাহাড়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ, পাহাড় বিষয়ে গবেষকেরা বলছেন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের এক অনন্য নজির ছিল এই চুক্তি। চুক্তির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাধান হলে স্বশাসন ও বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্য অর্জিত হতো। ভূমির বিষয়টি চুক্তি অনুযায়ী জেলা পরিষদের কাছে ন্যস্ত করা। পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে অভিন্ন ভোটার তালিকা প্রণয়ন। জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে পুলিশের উপপরিদর্শক বা এসআই থেকে নিচের জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা। স্থায়ী বাসিন্দাদের ভোটার তালিকা ছাড়াই  তো নির্বাচনে জেএসএসের নেতারা ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও সংসদ নির্বাচনে লড়ছেন। জয়ীও হচ্ছেন। তাহলে সমস্যা  কোথায়? এটাও বলছেন অনেকে। জেএসএসের আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল বিকেন্দ্রীকরণ। চুক্তির মূল চেতনাও তাই। কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন নেই এটিও মনে করেন অনেকে। চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়েও ইতিবাচক ও নেতিবাচক বক্তব্য আছে সেগুলোকে মাথায় রেখে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট।

এই বিভাগের আরো সংবাদ