বঙ্গবন্ধু : সময়ের - চিরকালের

  শেখ ফয়সল আমীন

১৭ মার্চ ২০২৪, ১২:৩৮ | আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৪, ১৬:৩৬ | অনলাইন সংস্করণ

শেখ ফয়সল আমীন
বর্তমানের পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিকূল প্রেক্ষাপটে সকলের মতো জাতিসংঘও শান্তির অন্বেষণে রয়েছে। সে-লক্ষ্যে নানা তত্ত্ব ও শর্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম চালায়নি সংঘটি। অতঃপর ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’- বঙ্গবন্ধুর এই পররাষ্ট্র দর্শনটিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ‘ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অব ডায়ালগ অ্যাজ আ গ্যারান্টি অব পিস, ২০২৩’ রেজুলেশনের ১৪তম প্যারায় সর্বসম্মতিক্রমে যুক্ত করেছে। কারণ তারা বুঝতে পারছে যে, Only omnipotent countries do not clutch a monopoly on welfare thoughts. মার্কিন প্রভাবশালী গণমাধ্যম নিউজউইক ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল ‘Poet of Politics’ শিরোনামে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল সেখানে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে পত্রিকাটির একটি মূল্যায়ন ছিল, ‘তিনি রাজনীতির কবি- প্রকৌশলী নন...।’ আমরা জানি কবিরা অকৃত্রিম, সহজাত, স্বতঃস্ফূর্ত। তারা অবলীলায় মিশে যায় মাটির সাথে, মানুষের সঙ্গে। আর বঙ্গবন্ধু যেভাবে তার কথা ও কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ ও এই বঙ্গভূমির কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন সেই প্রভূত প্রকাশকে উপলব্ধি করে ‘নিউজউইক’ তাকে অবিহিত করে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে। তবে আমরা দেখছি বর্তমানের বিশ্বনেতারা রাজনীতি, অর্থনীতি, সর্বোপরি বিশ্বনীতির এক একজন প্রকৌশলী হয়ে উঠছেন। শর্তযুক্ত শান্তির ফর্মুলা দিচ্ছেন। কিন্তু শান্তি তো শর্তহীন, শান্তি স্বতঃস্ফূর্র্ত। শান্তি স্বাধীনতায়, সংহতিতে, সৌহার্দ্যে। শান্তি বঙ্গবন্ধুর সর্ববন্ধুত্ব-নীতিতে। একটি আধিপত্যমুক্ত বিশ্বব্যবস্থা হয়তো জাতিসংঘ নিশ্চিত করতে পারছে না, তবে এ কথা স্বীকার্য যে, টেকসই শান্তির জন্য সংঘটি একটি মসৃণ মত ও পথের অনুসন্ধানী। সে-সূত্রেই বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতিকে তারা প্রায়োগিক অর্থে গ্রহণ করেছে।

‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ প্রাপ্তি উপলক্ষ্যে বিশ্বশান্তি পরিষদে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্বশান্তি আমার জীবনদর্শনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত, শান্তি ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যে কোনো স্থানেই হোক না কেন, তাদের সাথে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক। বৃহৎ শক্তিবর্গ, বিশেষভাবে আগ্রাসী নীতির অনুসারী কতিপয় মহাশক্তির অস্ত্রসজ্জা তথা অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফলে আজ এক সংকটজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা চাই, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়োগ করা হোক, তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে।’ কথাগুলো বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আজ থেকে ৫১ বছর আগে ১৯৭৩ সালে। তবে কথাগুলো আজও সমূহ প্রাসঙ্গিক, কথাগুলো সমকালীন। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। তিনি বিশ্বাস করতেন, মুক্তিকামী মানুষের ন্যায়সংগত সংগ্রাম অস্ত্রের জোরে স্তব্ধ করা যায় না। আজ ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সংকট যে গভীরতর পর্যায়ে পৌঁছেছে সে-বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ৫১ বছর আগেই বিশ্ব দরবারে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করি অন্যায়ভাবে আরব এলাকায় ইসরায়েল কর্তৃক জোরপূর্বক দখলে রাখার বিরুদ্ধে।’ তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন বিশ্বশান্তি, নিরস্ত্রীকরণ ও মানবকল্যাণের সকল মহৎ প্রচেষ্টাকে, যা আজও বড়ো প্রয়োজন। মহাত্মা গান্ধীর একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে- Be the change that you wish to see in the world. বঙ্গবন্ধু এ-কথার প্রোজ্জ্বল উদাহরণ। তার শাসনামলে ‘বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণা’ স্থায়ী শান্তি ও মানবকল্যাণে গৃহীত উদ্যোগের একটি উজ্জ্বল স্বাক্ষর, যা এই বিপ্রতীপ সময়ে ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আজও অনুসরণযোগ্য। 

বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের সংবিধানকে শুধু বাংলাদেশ ও দেশের সরকার এবং জনগণের জন্য প্রণয়ন করেননি। এই সংবিধানের অন্যতম অনুশাসন ছিল আন্তর্জাতিক শান্তি ও সংহতিকে সুদৃঢ় করা। যেমন- জাতিসংঘ প্রণীত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র, ১৯৪৮-এর ২৫টি ধারার মধ্যে ২৩টি ধারাকে বঙ্গবন্ধু এ সংবিধানে একীভূত করেছিলেন। তিনি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মিথস্ক্রিয়ায় এমন একটি শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন, যা বিশ্বব্যবস্থায় নতুন ধারণার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এমন একটি রাষ্ট্রধারণার সৃষ্টি করেছিলেন, যা যুগপৎভাবে নিজের দেশের মানুষের জন্য কল্যাণরাষ্ট্র এবং বিশে^র অন্যান্য রাষ্ট্র ও নাগরিকের জন্য নিরাপদ ও বন্ধুবৎসল রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হবে। আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘We have embodied these principles in our Constitution and are committed by the Constitution to support the just struggle of the oppressed people against colonialism, imperialism and racialism throughout the world.’

ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং শান্তির প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু সব সময় ছিলেন উদার ও আন্তরিক। যে-উদ্যোগে শান্তি আসবে সে-উদ্যোগকে তিনি স্বাগত জানাতেন সাড়ম্বরে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে একটি Zone of Peace হিসেবে গড়তে এবং এ অঞ্চলে Freedom and Neutrality নিশ্চিত করতে তিনি জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে তার সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছিলেন। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকেও Zone of Peace হিসেবে গড়তে তিনি কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। দক্ষিণ-এশীয় অঞ্চলের স্বার্থের দ্বন্দ্ব দিন দিন বিভেদের রেখাকে প্রশস্ত করে চলেছে। মানবাধিকার আর জীবনাধিকার বিঁধে আছে সীমান্তের কাঁটাতারে। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, ভারত-চীন সীমান্ত সংকট, ভারত-পাকিস্তান ভূ-রাজনৈতিক বিরোধ একটি অশান্ত সময়ের সাক্ষী হয়ে বেড়াচ্ছে। তাই প্রয়োজন Zone of Peace সৃষ্টি করা। প্রয়োজন Freedom and Neutrality নিশ্চিত করা। 

এটি মানবসভ্যতার জন্য সত্যই পীড়াদায়ক যে, বর্ণভেদবাদের প্রাগৈতিহাসিক রূপ ও চরিত্র আজও বিশ্বের নানা প্রান্তে ক্রিয়াশীল। আজও অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত দেশসমূহে বর্ণবাদী আক্রোশ ও আক্রমণের শিকার হয়ে প্রাণ হারায় কৃষ্ণাঙ্গ কিংবা বাদামি চামড়ার মানুষেরা। একটি শান্তি-সুন্দর ধরিত্রীর পথে বর্ণভেদবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ বড়ো ধরনের বাধার স্বরূপ। বঙ্গবন্ধু বিশ্বশান্তি পরিষদে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে নিন্দা করি দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের সকল স্থানের বর্ণভেদবাদী নীতির। অথচ আজ যখন জর্জ ফ্লয়েড, ডন্টে রাইটরা বর্ণবাদী হামলায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তখন সেদেশের সরকারপ্রধানকে কোনো টেকসই সমাধান বা উদ্যোগের পথে হাঁটতে দেখা যায় না। শক্তিধর বিশ্বনেতাদের এমন নির্লিপ্ত ভূমিকা অসহিষ্ণু পরিস্থিতিকে আরও প্রকট করে তুলছে।

বঙ্গবন্ধুর জীবননীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও বিশ্বনীতিকে সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করলে একটি সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণের প্রত্যয় ও প্রচেষ্টা খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে ন্যায্যতা, মানবিকতা, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের অনুষঙ্গগুলো প্রণিধানযোগ্য হয়ে ওঠে। তাই বঙ্গবন্ধুর সত্তার নিরন্তর অন্বেষণ হওয়াটা খুব জরুরি। সে-জন্য প্রয়োজন মৌলিক গবেষণা। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও নীতিবিষয়ক গবেষণা গ্রন্থগুলোর অনুবাদ করে বিশ্ব অঙ্গনে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, বঙ্গবন্ধুকে যত বেশি জানা যাবে এবং জানানো যাবে, বিশ্বব্যবস্থায় ও বিশ্ব-নাগরিক মানসে তত বেশি সাম্য ও সম্প্রীতির বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে। অধিকার ও ন্যায্যতার জায়গায় জবাবদিহির বৈশ্বিক-সংস্কৃতি চালু হবে। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধের জেগে উঠবে সদাচারের স্লোগান। শান্তির প্রতি সৃষ্টি হবে বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি। আজ আমাদের বঙ্গবন্ধু যিনি বিশ্ববন্ধু হিসেবে সমধিক নন্দিত, তার জন্মদিন। জাতির পিতার জন্মদিনে একটি শোষণমুক্ত, যুদ্ধমুক্ত, সর্বমানবিক বিশ্বের প্রত্যাশা করি।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।

এই বিভাগের আরো সংবাদ