জো বাইডেনের সঙ্গে এক দুপুর

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৪, ১১:৪৩

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একমাত্র তিনি হারিয়েছেন। জো বাইডেন বলছেন আবার হারবেন ট্রাম্প। নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে লিখেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র

‘আমি আপনাকে দেখাব কোথায় বসে ট্রাম্প সেই বিপ্লব (নিজের পরাজয়) দেখেছিলেন’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কথাটি বলেছিলেন ইভান ওসনসকে। এ কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের ওভাল অফিসের ডেস্কের পেছনে থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। জানুয়ারি মাসের অস্থির বুধবার দুপুর তখন। উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য, আগাম জরিপে আবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে ছুটছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে এ পরিস্থিতিতেও শান্ত বাইডেন। ডেস্ক থেকে উঠে ব্যক্তিগত চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। করিডোরে থাকা দুই সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টকে চমকে দিলেন। তারা আশা করেছিলেন বাইডেন আরও কিছু সময় ডেস্কে থাকবেন। এজেন্টরা ওই কক্ষের হাতল ঘুরিয়ে বাইডেনকে যাওয়ার রাস্তা করে দিলেন। এ সময় তারা কিছু কথা বললে বাইডেন তার জবাব দিলেন।

ট্রাম্প যেখানে বসেছিলেন

সাংবাদিক ইভান ওসনস লিখছেন, জো বাইডেন প্রত্যাশার চেয়ে একটু লম্বা, নেভি স্যুট এবং উজ্জ্বল নীল টাই তার পরনে। তার অফিসে অতিরিক্ত শার্টের একটি র‌্যাক, জনসাধারণের পাঠানো নোটের একটি তাক এবং মননশীল ভঙ্গিতে জন এফ কেনেডির একটি প্রতিকৃতি রাখেন। ওসনসকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ওভাল অফিসের ডাইনিং রুমে চলে যান। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আট বছর দায়িত্ব পালনের সময় তিনি প্রায়ই লাঞ্চের সময় বারাক ওবামার সঙ্গে এখানে দেখা করতেন। ওই রুমের দেয়ালে গৃহযুদ্ধে জয়লাভের সময় লিংকন এবং তার সামরিক কমান্ডারদের নিয়ে আঁকা বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য পিসমেকারস’ শোভা পাচ্ছে। আরেকটি দেয়ালে ডোনাল্ড ট্রাম্প বড় টেলিভিশন বসিয়েছিলেন। ওই ঘরে বসে সেই টিভিতে নিজের বিপর্যয় দেখেছিলেন ট্রাম্প। যার কথা বলে বাইডেন সাংবাদিক ওসনসকে ওই ঘরে নিয়ে যান। এই টেলিভিশনের সামনে বসে ট্রাম্প দেখছিলেন তার সমর্থকরা ক্যাপিটল হিলে কীভাবে হামলা করেছে। দিনটি ছিল ৬ জানুয়ারি ২০২১-এর বিকেল। ট্রাম্প এক হাতে টেলিভিশনের রিমোট অন্য হাতে ডায়েট কোক নিয়ে ফক্স নিউজ দেখছিলেন। কখনো দ্বিতীয়বার দেখার জন্য রিওয়াইন্ড করছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ইতিহাসে যে সময়টিকে নির্বাচন কমিটি পরে বলেছিল, ‘১৮৭ মিনিটের অবহেলা।’

সেই প্রসঙ্গ স্মরণ করিয়ে বাইডেন বললেন, ‘এখানেই তিনি বসেছিলেন’। ওসনসের কাছে মনে হয়েছে বাইডেন আগের চেয়ে কিছুটা দুর্বল হয়েছেন। কারণ ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে ডেলাওয়্যার কাউন্টি কাউন্সিলের সময় বাইডেনের এক সহকর্মীর মত হলো, ‘ঘাসের ব্লেডের নিচে পনেরো মিনিট বক্তৃতা করতে পারেন বাইডেন। কিন্তু আশি বছর বয়সে রাষ্ট্রপতি হিসাবে তার চতুর্থ বছরে কথা বলতে বলতে থেমে যান বাইডেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি ঘরের চারপাশ ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আমি এখানে ইন্টারভিউ দিই না, কারণ এটি এত আরামদায়ক নয়।’ এরপর তিনি একটি বিষন্ন হাসি দিয়ে তার অফিস ঘরে ফিরে যান।

আবার মুখোমুখি

সাংবাদিক ওসনসের মতে, বেশিরভাগ আমেরিকান একে অকল্পনীয় মনে করেন যে, তারা আবার ট্রাম্প এবং বাইডেনের মুখোমুখি লড়াই দেখতে পারবেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প হেরে যাওয়ার পর, তার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন এবং আর্থিক জালিয়াতি, নির্বাচন বাতিলের চেষ্টা এবং সরকারি নথি ফেরত দিতে অস্বীকার করার অভিযোগ আনা হয়। তার ওপর এসব অভিযোগে আইনি চাপের প্রত্যুত্তরে তিনি বলে বেড়ান, শত্রুরা তার ওপর ‘প্রতিশোধ’ নিচ্ছে। রিপাবলিকানরাও ৬ জানুয়ারির সহিংসতার জন্য ট্রাম্পকে আগের মতো দায়ী করছে না। অপরদিকে বাইডেন আবার হোয়াইট হাউজে বসবেন এমন বিশ্বাসের লোকও কমে গেছে।

তবে বাইডেন আত্মবিশ্বাসী। সাংবাদিক ওসনসকে আবার নিজের অফিস ঘরে ফিরিয়ে আনেন তিনি। তার ওভাল অফিসের কাচের দরজা দিয়ে শীতের সূর্য দেখা যাচ্ছিল। তিনি বাইডেনকে জিজ্ঞেস করেন তার ওপর আস্থা নেই এমন ভোটারদের কাছে তিনি পৌঁছাতে পারবেন কিনা। তবে বাইডেন প্রশ্নটিকে ‘উস্কানি’ হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি বলেন, “আচ্ছা, প্রথমে মনে রাখবেন ২০২০ সালে আপনি আমাকে বলেছিলেন যে আমি কীভাবে জিততে যাচ্ছি, তাই না? এবং তারপর আপনি আমাকে ২০২২ সালে বলেছিলেন যে, কীভাবে এই ‘লাল তরঙ্গ’ (রিপালিকানদের স্রোত) তৈরি হতে চলেছে?” বাইডেন একটি ‘উত্তেজনাপূর্ণ’ হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমি আপনাকে বলেছিলাম, কোনো লাল তরঙ্গ হবে না। এবং ২০২৩ সালে আপনি আমাকে বলেছিলেন, আমরা আবার হেরে যাব? এবং আমরা সেখানে প্রত্যেকটি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছি। এরপর কিছুটা থেমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আবার বললেন, ‘২০২৪ সালে, আমি মনে করি আপনি একই জিনিস দেখতে যাচ্ছেন।’

কয়েক দশক ধরে জো বাইডেন সম্পর্কে মতামত হলো তিনি হালকা ওজনের। ভালো এবং খারাপ বিবেচনার ঊর্ধ্বের ব্যক্তিত্ব। তার কণ্ঠস্বর পাতলা এবং জমাট বাঁধা। তার অঙ্গভঙ্গি ধীর হয়ে গেছে। তবে ওসনস বলছেন, তার সঙ্গে কথোপকথনের সময় বাইডেনের মনোবল দৃঢ় বলে মনে হয়েছিল। তিনি ওই আলাপে কোনো তারিখ বা নাম ভুল বলেননি। যদিও বাইডেন সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ভুলো মনা, তার দিন-তারিখ, নাম মনে থাকে না। এর আগে ফ্রান্স ও জার্মানির রাষ্ট্রপ্রধানদের নাম ভুল বলেন তিনি। এমনকি মৃত রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের গল্পও শোনান প্রকাশ্যে। তবে ওসনস বলছেন, সে সমস্যা আলাপচারিতার সময় তার চোখে পড়েনি। তিনি আরও লিখেছেন, বাইডেন ট্রাম্পের সবচেয়ে উদ্বেগজনক কিছু মন্তব্য লেখা সাদা নোট কার্ড বের করেন। যেখানে ট্রাম্পের বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। যেমন সংবিধান বাতিল করার হুমকি; বাইডেন যাকে বলছেন, ‘প্রথম দিনেই স্বৈরশাসক হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার বক্তৃতা’, অভিবাসীদের সম্পর্কে ট্রাম্পের বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যগুলো কিছুটা পড়ে বাইডেন নোট কার্ডগুলো ছুড়ে ফেললেন ডেস্কে। তারপর বললেন, কী খারাপ অবস্থা!’ তিনি আরও বলেন, ধরেন দশ বছর আগে আমি আর আপনি এখানে বসে আছি, আর আমি আপনাকে ট্রাম্পের কথাগুলো বলছি, তখন আপনি আমাকে কী বলতেন? বলতেন, বাইডেনের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

ওসনস জানাচ্ছেন, তিনি ২০২০ সালে শেষ বাইডেনের সাক্ষাৎকার নেন। যেখানে তিনি নিজেকে ‘পরিবর্তনের প্রার্থী’ হিসেবে বলেছিলেন এবং প্রতিভাবান, তরুণদের প্রশংসা করেছিলেন। তবে অফিসে বসার পর তিনি উচ্চাভিলাষী আইন পাস, কভিড মহামারী মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এসবের ওপর ভিত্তি করে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বাইডেন।

ওসনস বাইডেনকে জিজ্ঞেস করেন যে, আবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য লড়ার বিষয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ কখনো দেখা দিয়েছিল কী? জবাবে তিনি বলেন, ‘না’। বাইডেন বলেন, আমি যে নীতিগুলো গ্রহণ করেছি এ সময়ে, তা দেশের জন্য সেরা ছিল। এটা যদি আমি না ভাবতাম, তাহলে আবার নির্বাচনে আমি লড়তাম না। আমি আবার প্রেসিডেন্ট পদে দৌড়াচ্ছি কারণ দুটি জিনিস। প্রথমত, আমি আমার কাজ নিয়ে সত্যিই গর্বিত এবং আমি এটি চালিয়ে যেতে চাই। আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। দ্বিতীয়ত, আমি নিজের দিকে তাকাই এবং বলি আমরা ঠিক আছি, যা করেছি তার বেশিরভাগই ভালো এখন কেবল চালিয়ে যাওয়া।

আত্মবিশ্বাসী

ওসনস লিখেছেন, আপনি যদি আজকাল বাইডেনের সঙ্গে সময় কাটান তবে দেখবেন, তিনি আবার জিতে আসার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী। ট্রাম্পের কাছে এবার হেরে যাবেন কি না এমন প্রশ্নে বাইডেনের জবাব, ‘না। আমি একমাত্র যে তাকে পরাজিত করেছি। এবং আমি তাকে আবার হারাব।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট পাল্টা বলেন, আমি একটি প্রশ্ন করব, আপনি হেরে গেলে যে জিতবে সে আমেরিকার প্রকৃতি পরিবর্তন করে ফেলবে, আপনি তখন কী করবেন?

স্বাভাবিক ব্যবস্থার মাধ্যমে, বাইডেনের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রে সহিংস অপরাধ প্রায় পঞ্চাশ বছরে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে, বেকারত্ব চার শতাংশের নিচে। আগের চেয়ে বেশি আমেরিকানের স্বাস্থ্যবীমা আছে এবং দেশটি তার ইতিহাসে আগের যে কোনো মুহূর্তের চেয়ে বেশি শক্তি (এনার্জি) উৎপাদন করছে। তার প্রতিপক্ষ ট্রাম্প ৯৯টি ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি। নির্বাচিত হলে তিনি প্রায় ৫০ হাজার বেসামরিক কর্মচারীকে বরখাস্ত করবে।

বাইডেন ট্রাম্পের তুলনায় তিন, চার বা পাঁচ পয়েন্ট এগিয়ে ছিলেন ভোটে। তবে ফেব্রুয়ারিতে এনবিসি জরিপ অনুসারে ট্রাম্প এগিয়ে। তার পক্ষে ভোট সাতচল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশ শতাংশ। ২০২০ সালেও দেখা গেছে, বাইডেন কোথাও বড় ভোটে ট্রাম্পকে হারাননি। কিছু ডেমোক্র্যাট ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন যে, বাইডেনের প্রচারাভিযান যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্র। তবে তারপরও বাইডেন আত্মবিশ্বাসী। ওসনস লিখছেন, একজন আমাকে বলেছিল, তিনি (বাইডেন) খারাপ ভোটের মাধ্যমে বা ডোনাল্ড ট্রাম্প যা করেছেন এমন কিছু পাগলামি দেখে বিমুখ হননি। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের একজন ব্রুস রিড বলেছেন, আমরা অস্বাভাবিক রাজনৈতিক সময়ে বাস করি, কিন্তু আমেরিকান জনগণ এখনো স্বাভাবিক মানুষ। স্বাভাবিক এবং পাগলের মধ্যে একটি পছন্দ দেওয়া হলে, তারা স্বাভাবিককে বেছে নেবে।

 

সৌজন্যে : দৈনিক দেশ রূপান্তর।

এই বিভাগের আরো সংবাদ