আজকের শিরোনাম :

ভারতীয় পণ্য বয়কট: ইতিহাসের কথা

  সুভাষ সিংহ রায়

২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:২৪ | অনলাইন সংস্করণ

প্রায় দুই মাস আগে হঠাৎ করে ইউটিউবে একটা সংবাদ নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। যেটাকে বলা হয় ‘ভাইরাল’। আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও ভারতপন্থি বাংলাদেশি ও পাকিস্তানপন্থি বাংলাদেশি অবস্থান দিনে দিনে খুবই স্পষ্ট হচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা নেই। বাংলা ভাষায় ‘কৃতজ্ঞ’ শব্দের অর্থ হলো, যারা উপকারীর উপকার স্বীকার করে। অন্যদিকে ‘কৃতঘ্নতা’ শব্দের অর্থ, যারা উপকারীর অপকার করে। আমাদের সংস্কৃতিতে অনেক ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ঘাটতি আছে; কিন্তু ‘কৃতঘ্নতা’ কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা তো দেখছিই। আমাদের দেশে একটা মুখচেনা গোষ্ঠী কারণে-অকারণে ভারতবিরোধী চেতনা ধারণ করে। তাদের মধ্যে একটা অংশ বেশ কৌশলী। তারা খুব কায়দা করে বলে থাকেন, ‘এর চেয়ে তো পাকিস্তানই ভালো ছিল।’ সে রকম একটা ঘটনার কথা বলছি। মানবিকতা প্রদর্শনে পাকিস্তানও অনেকখানি এগিয়ে, তা বলার সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চান না। একজন যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় ঢাকা থেকে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদগামী সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের একটি বিমান পাকিস্তানের বন্দরনগরী করাচিতে জরুরি অবতরণ করেছে। এর আগে বিমানটি ভারতে নামার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেটি অবতরণের অনুমতি দেয়নি। উড্ডয়নের একটু পরই ৪৪ বছর বয়সী আবু তাহের নামে এক বাংলাদেশি যাত্রীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। সে সময় উড়োজাহাজটি ভারতের আকাশসীমায় অবস্থান করছিল। সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের সূত্র বলেছে, ফ্লাইটটি মাঝ আকাশে থাকাকালে ওই যাত্রীর উচ্চ রক্তচাপের পাশাপাশি বমি শুরু হয়। তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। এ সময় যাত্রীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় পাইলট বিমানটি মুম্বাইয়ের দিকে ঘুরিয়ে দেন এবং জরুরি অবতরণের জন্য মুম্বাইয়ের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের (এটিসি) কাছে অনুমতি চান। মুম্বাই এটিসির পক্ষ থেকে অসুস্থ যাত্রীর জাতীয়তা এবং অন্যান্য তথ্য জানতে চাওয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে মুম্বাইয়ে অবতরণের অনুমতি না মেলায় বাধ্য হয়ে বিমানের গতিপথ বদলে পাকিস্তানের করাচি শহরের দিকে যান পাইলট। পাকিস্তানের আকাশসীমা থেকে করাচির এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের কাছে বিমানটির জরুরি অবতরণের অনুমতি চান তিনি। অনুমতি মেলায় সকাল ৭টা ২৮ মিনিটে করাচির জিন্নাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে সৌদিগামী ওই বিমান। বিমানটি অবতরণের পরপরই পাকিস্তানের সিভিল এভিয়েশন অথরিটির (সিএএ) মেডিকেল টিম বিমানবন্দরে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বিমানবন্দরের চিকিৎসকরা তাৎক্ষণিকভাবে ওই রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং চিকিৎসাসেবা দেন। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে নিয়ে ফ্লাইটটি রিয়াদের উদ্দেশে রওনা হয়। ওপরের অংশটিও অপ্রচলিত একটি অনলাইন পত্রিকা থেকে নেওয়া এবং পত্রিকাটির ওই প্রতিবেদনটির পাঠক সংখ্যা তাদের যে কোনো প্রতিবেদন থেকে অনেক বেশি। তা হলে বলা যায়, ওই সংবাদটি যে খ্যাতনামা সাংবাদিক প্রথম ইউটিউবে নিয়ে এসেছিলেন, তিনি বুঝেশুনেই তা দর্শক-পাঠকদের সামনে এনেছিলেন।

সন্দেহ নেই, ভারতবিরোধী মনোভাবের বাজার লক্ষ্য করেই এ রকম কনটেন্ট তৈরি করা হয়। মাঝে মাঝেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে কলাম প্রকাশিত হয়। যেমন—মো. তৌহিদ হোসেনের ‘বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক: রোল মডেল বনাম মাঠ বাস্তবতা’ (প্রথম আলো, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩), ড. আসিফ নজরুলের ‘বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব কেন? কিংবা টাইমস অব ইন্ডিয়া’র একটি প্রতিবেদন বাংলা তর্জমায় মানবজমিনের একটি প্রতিবেদন (২৫ নভেম্বর ২০২৩) ‘বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব কেন বাড়ছে?’ আমাদের যাপিত জীবনে মানুষের অভিমত খুবই গুরুত্ব বহন করে। প্রশ্ন থেকে যায়, ওই ঘটনার কোনো সরকারি ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। আর সত্যাসত্য যাচাইয়ের সুযোগ না থাকলে বিভ্রান্তি বিস্তৃত হয়। একদিকে বলা হচ্ছে, ভারতবিরোধী মনোভাব ক্রমান্বয়ে বাড়ছে আবার অন্যদিকে ভারতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। নাকি দুটোই একসঙ্গে বাড়ছে। বোঝা বড় দায়। একটি রাজনৈতিক জোট প্রকাশ্যে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছে। ৫৩ বা ৫৬টি দল ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ভায়তীয় চাদর ছুড়ে ফেলে ফটোসেশন করেছেন। এই ভদ্রলোক ‘অসহযোগ আন্দোলন’ (?) ঘোষণা করে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন।

কভিডের দু-তিন বছরে কলকাতার নিউমার্কেটের হোটেল-দোকানগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার একটি প্রতিবেদন পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্ক হৃদয়ের, ভালোবাসার। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ১৬ লাখ মানুষ ভিসা নিয়ে ভারতে যাচ্ছে। এ সংখ্যা কখনো কখনো বাড়েও। বাংলাদেশের মানুষ ভারতে চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কারণে যাচ্ছেন। এজন্য বাংলাদেশে ১৫টি ভিসা সেন্টার খোলা রয়েছে। যমুনা ফিউচার পার্কে যে ভারতীয় ভিসা সেন্টারটি রয়েছে, তা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভিসা সেন্টার। প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজারের ওপরে ভিসা ইস্যু করা হচ্ছে। এ সংখ্যা বাড়ছেই। সবই করছি সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে। দুদেশের মধ্যে যে সম্পর্ক, তা অসাধারণ ও অনন্য। কিন্তু যারা প্রগতিশীল মানুষ তাদের অনেকে আমাকে বলেছেন, ভারত সরকারের নানাবিধ কার্যকলাপেও ভারতবিরোধী মনোভাবের মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। যারা সড়কপথে ভারতে যান, তাদের ভারত অংশে ইমিগ্রেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অকারণে অপেক্ষায় থাকতে হয়। সেখানে ভারতের ইমিগ্রেশন অফিসারদের আচার-ব্যবহার অনেক খারাপ। বাংলাদেশ অংশে বেশ তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলেও ভারত অংশে অপেক্ষাকৃত অনেক সময় লাগে। গত কয়েক বছর ধরে আখাউড়া-আগরতলা সীমান্ত বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কেননা আগরতলা থেকে দিল্লি, চেন্নাই, মুম্বাই, বেঙ্গালুরুর ভাড়া বেশ কম। কিন্তু সেখানেও ইমিগ্রেশনের ভারতীয় অংশের ধীরগতির কারণে অনেকে দিল্লি-চেন্নাই ফ্লাইট মিস করেন। ভারতীয় রাজনীতিবিদরা ও আমলারা এ বিষয়গুলো বিবেচনায় আনেন?

দুই. সীমান্তে হত্যা নিয়ে দেশের মানুষ খুবই বিরক্ত। ফেলানী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বারবার মানুষের আলোচনায় চলে আসে। বিএনপি ও এক-এগারো সরকারের আমলে সীমান্তে হত্যা হয়েছিল ৭৫০ জন আর আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে তুলনামূলকভাবে অনেক কমে এসেছে। কিন্তু মানুষের কথায় যুক্তি আছে। বলা হচ্ছে—এখন দুদেশের মধ্যে সম্পর্ককে অভিহিত করা হচ্ছে ‘সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়’ হিসেবে, তাহলে সীমান্তে মানুষ হত্যা হবে কেন? অনেকবার বলা হয়েছে, দুদেশের লক্ষ্য একটি মানুষও সীমান্তে মারা যাবে না। চোরাচালানে কি শুধু বাংলাদেশের নাগরিকরা যুক্ত? ভারতীয় নাগরিকরা যারা চোরাচালানে যুক্ত তাদের বিচার ভারতীয় কর্তৃপক্ষ করে; কিন্তু তারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় না। বেশ কয়েকটি কারণে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধাপরাধী দলের অবস্থান রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে ওই এলাকার মানুষজনকে জামায়াতিরা বিভ্রান্ত করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে।

বস্তুত, এবার লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন বিজেপি ৭৬ পৃষ্ঠার নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে। বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে রয়েছে— ভারত-চীন, ভারত-পাকিস্তান, ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে ‘শক্তিশালী অবকাঠামো’ গড়ে তোলা হবে। লক্ষণীয়, এখানে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কথা নেই। কোনো কোনো বিশ্লেষক বলেছেন, এই সীমান্তে ইতোমধ্যে কাঁটাতারসহ যথেষ্ট ‘শক্তিশালী অবকাঠামো’ নির্মাণের পর আর কঠোর হওয়ার সুযোগই নেই। আবার এটাও হতে পারে, ইশতেহারের এই প্রতিশ্রুতি ‘বাংলাদেশ কার্ড’ না খেলার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সম্পর্কিত। চীন যখন প্রধান প্রতিপক্ষ, পাকিস্তান যখন চিরবৈরী, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ যখন বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকে, নেপাল ও ভুটান যখন দোদুল্যমান, তখন বাংলাদেশই একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী। আমাদের দেশে পাকিস্তানকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করে এ রকম লোকের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু পাকিস্তানি পণ্য বর্জন করার কথা কেউ কখনো বলেনি। চীনা পণ্য বর্জনের কথা কেউ কখনো বলেছে? বরং কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে চীনা ভিসা প্রসেসিং সেন্টার খোলা হয়েছে।

তিন. ১৯৭২-৭৩ সালে শুধু খাদ্য বা ভোগ্যপণ্য নয়, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মেরামত এবং পুনর্গঠনের জন্য ও শিল্প-কারখানায় কাঁচামাল সরবরাহেও ভারত ব্যাপক সহায়তা প্রদান করে। ভারত নিজে তেলের আমদানিকারক হয়েও বাংলাদেশের জ্বালানি তেল শোধনাগারের (রিফাইনারি) জন্য অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করে জরুরি সহায়তা করেছিল। ভারত বেসামরিক বিমান ও জাহাজ সরবরাহ করে। নতুন দেশটির জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল খাদ্য। ১৯৭২-এর শুরুতে বাংলাদেশ একদিকে যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতি এবং আরেক দিকে পরপর দুবার শস্যহানির কবলে পড়ে। ভারত সহায়তা হিসেবে শুধু ৪ লাখ টন খাদ্যশস্যই দেয়নি, খাদ্যশস্য পরিবহনেও সহায়তা করে। প্রথম ছয় মাসে মোট প্রাপ্ত খাদ্য সহায়তার ৭৪ শতাংশই ভারত দিয়েছিল। ১৯৭১-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২-এর জুনের মধ্যে ২০ কোটি মার্কিন ডলার দান হিসেবে এবং পণ্য আমদানি ও প্রকল্পের জন্য অত্যন্ত সহজ শর্তে ৪.২ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করে। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪-৭৫ সময়ে ভারত ৩০.৮ কোটি মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫৭.৭ কোটি মিলিয়ন মর্কিন ডলার সহায়তার পর দাতাদের মধ্যে এটাই ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সহায়তা। [তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কিছু কথা: অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, ইউপিএল]

পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা নিয়ে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো টুঁ শব্দটিও করে না। এক হিসাব অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি ২১-২৩ বিলিয়ন ডলার বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে অবকাঠামোগত পুঁজি (Physical Capital) দাঁড়ায় ২০ বিলিয়ন ডলার এবং মানব পুঁজি (Human Capital) ৩ বিলিয়ন ডলার। এসএ চৌধুরী ও এসএ বাশার, “দি এনডিওরিং সিগনিফিক্যান্স অব বাংলাদেশ’স ওয়ার অব ইনডিপেনডেন্টস: অ্যান অ্যানালাইসস অব ইকোনমিক কস্টস অ্যান্ড কল্পিকোয়েন্সেস”, ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটি, কানাডা (অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি), ২০০১। ১৯৭৪ সালে দুদেশের পারস্পরিক কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার ও সম্পর্ক স্থাপন করার পরের দিনগুলোতে এ বিষয়ে দেন-দরবার অব্যাহত থাকে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর ১৯৭৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সফরের সময় এ বিষয়টি উল্লেখ করে দুপক্ষের মনোমালিন্য ও অসন্তুষ্টির কারণ ঘটিয়েছিল। এমনকি ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের আগেও বাংলাদেশ এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা ও সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার জন্য ইসলামাবাদে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের পাঠানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। বলা হয়, এরপর যখন ঢাকায় ভুট্টো ও শেখ মুজিবের বৈঠক হবে তখন এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। এর উত্তরে পাকিস্তান জানায়, ইসলামাবাদে এমন আগাম বৈঠকের প্রয়োজন নেই এবং তারা নিশ্চয়তা দেয় যে, ভুট্টোর ঢাকা সফরকালে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিতে আলোচনা করা হবে এবং সিদ্ধান্তেও পৌঁছানো সম্ভব হবে। ভুট্টোর সফরের সময় বাংলাদেশ যা যা প্রস্তাব করে: (ক) পাকিস্তান নীতিগতভাবে সব সম্পদ ও দায় সমানভাবে ভাগ করে নেবে, (খ) একটি যৌথ কমিশন এ বিষয়ে বিস্তারিত পরীক্ষা করে দেখবে এবং (গ) পাকিস্তান দুই মাসের মধ্যে কিছু অর্থ তার সদিচ্ছার প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশকে প্রদানের উদ্যোগ নেবে। প্রথম কিস্তিতে সহজে হিসাবযোগ্য সম্পদ দিয়ে পরিশোধ করা হবে, যেমন—স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা, বেসামরিক বিমান ও জাহাজ। এই প্রতীকী অর্থ প্রদানের পরিমাণ ২০০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ধার্য করা হয়। এটি ছিল সমগ্র পরিশোধ ও বণ্টনযোগ্য সম্পদের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তা ছাড়া অন্যদিকে বাংলাদেশ এরই মধ্যে পাকিস্তানের বৈদেশিক দায় ভাগ করে নিয়েছিল। এই প্রতীকী টাকা প্রদানের বিষয়টি ছিল ১৯৭২-পূর্ব সম্পদ বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার অঙ্গীকারকে নিশ্চিত করা। এর ফলে পরবর্তী আলোচনায় এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সদিচ্ছার ওপর বাংলাদেশের বিশ্বাস সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ এটাও প্রস্তাব করে যে, যদি পাকিস্তানের টোকেন দায় মেটাতে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার সংগ্রহ না থাকে, তেল উৎপাদনকারী বন্ধু দেশ (যারা বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনাকালে দুদেশের বিবাদ মীমাংসা করে দেওয়ার জন্য উৎসাহ দেখিয়েছে) পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে সহযোগিতাদানে প্রস্তুত।

বাস্তবে ভুট্টো সম্পদ ভাগ করে নেওয়ার কোনো রকম আলোচনায় রাজি হননি। প্রস্তাব মেনে নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তিনি যুক্তি দেন যে, সঙ্গে কোনো বিশেষজ্ঞ তিনি নিয়ে আসেননি। অথচ তিনিই আগে কথা দিয়েছিলেন যে, সফরকালে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবেন। এর ফল হিসেবে দুদেশের সম্পর্ক উন্নত ও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে—এমন ঘোষণা করে কোনো সরকারি যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে এটি ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এ ইস্যুর কারণে দুদেশের সম্পর্ক সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি এবং কূটনৈতিক সম্পর্কও পুরোপুরি স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সব আন্তর্জাতিক ফোরামে এ বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দেন, তাতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের (বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল ইসলামাবাদ যাবে, এমন প্রস্তাবসহ) প্রসঙ্গে এ বিষয়টি উত্থাপন করেন। ১৯৭৫ সালে কমনওয়েলথ রাষ্ট্রের প্রধানদের কনফারেন্সেও তিনি এই ইস্যু উত্থাপন করেন। এমনকি ১৯৭৫-এর জুলাই মাসে ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনেও প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়।

১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসের কমনওয়েলথ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক ইশতেহারে এসব অনিষ্পন্ন ইস্যুতে আলোচনার আহ্বান করা হয়। এতে সম্পদের ভাগাভাগি না হওয়া, যা সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলার প্রস্তাব ছিল। ১৯৭৫-এর জুলাইতে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে কামাল হোসেন প্রস্তাব করেন যে, এ ব্যাপারে আরব দেশগুলো (সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত) মধ্যস্থতা করতে পারে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, এরা সবাই অথবা যে কোনো দেশ ‘মধ্যস্থতাকারী’র কাজটি করতে পারে। তারা দুপক্ষের প্রাসঙ্গিক আলোচনা পরীক্ষা করে ‘সমাধানের সূত্রগুলো’ প্রস্তাব করতে পারে। বাংলাদেশ এ বিষয়ে আগাম আশ্বাস দিয়ে রাখতে রাজি যে, সে মধ্যস্থতাকারীর প্রস্তাব মেনে নেবে। বাংলাদেশ এর আগেও পাকিস্তানের কাছে বন্ধু আরব আমিরাতের নাম মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রস্তাব করে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় রাজি ছিলেন না। বাংলাদেশের উদাত্ত আহ্বানে তারা সাড়া দেননি। ইসলামাবাদ ফিরে পাকিস্তান সরকার এ বিষয়ে উত্তর জানাবে বলে আশ্বাস দেয়। সেই উত্তর কখনো আসেনি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্র ক্ষমতা দখলের পর এ বিষয়টি হিমাগারে পাঠানো হয়েছিল। বরং খুনিচক্র ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। এখন ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়, যখন রমজান মাসে ভারতীয় পেঁয়াজের খুবই প্রয়োজন হয়। গুগলের নির্বাহী প্রধান একজন ভারতীয় নাগরিক সুন্দর পেল্লাই; বর্জনকারী কি গুগল বর্জন করবেন?

পুনশ্চ: আমাদের দুর্ভাগ্য মুক্তিযুদ্ধের কথা, বাঙালি সংস্কৃতির কথা, মঙ্গল শোভাযাত্রার কথা, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললে ট্যাগ দেওয়া হয় ‘র’-এর এজেন্ট। আবার ন্যায্য কথা বললে, কারও স্বার্থে আঘাত লাগলে সেখানেও ট্যাগ দেওয়া হয় ‘রাজাকার’।


সুভাষ সিংহ রায় : রাজনৈতিক বিশ্লেষক; সাবেক সহ-সভাপতি- বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল, প্রধান সম্পাদক- সাপ্তাহিক বাংলা বিচিত্রা ও এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম।

এই বিভাগের আরো সংবাদ