দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ এবং সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা

  সুভাষ সিংহ রায়

৩১ মার্চ ২০২৪, ০৯:৪৪ | অনলাইন সংস্করণ

লেখার শিরোনামটি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার থেকে নেওয়া। ১৬ বছর আগের ইশতেহারে ঘোষিত এই অঙ্গীকার মনে করিয়ে দেয়, আওয়ামী লীগ সব সময় গণমানুষের কথা বলে। কবি নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতার লাইন আছে ‘কবি নজরুল পরাজিত হলে ক্ষতি কার?’ তেমন করেই বলা যায়, শেখ হাসিনা পরাজিত হলে ক্ষতি কার? যারা দেশের ও দশের ভালো চান, তাদের একটা বড় অংশ মনে করেন শেখ হাসিনাতে আশা এবং শেখ হাসিনাতে ভরসা। এ-কথা সবারই জানা আছে, দেশে ও দেশের বাইরের বাংলাদেশ-বিরোধী শক্তি ক্রমাগতভাবে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেই যাচ্ছে। ক’দিন আগে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানতে পারলাম ‘বিএনপির ৬২তম আলটিমেটাম, সরকারের মেয়াদ ৫ মাস।’ আইনের দৃষ্টিতে পলাতক বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী এই সরকারের মেয়াদ সর্বোচ্চ পাঁচ মাস বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে আগামী পাঁচ মাসও এ সরকার টিকবে না।’ যা হোক, বিএনপির কাজ বিএনপির করেছে। এ বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে প্রসঙ্গ করে আলাপ করা যাবে। আমাদের স্মরণে আসবে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করা মাত্র ৫০ দিনের মধ্যে ২৫ ফেব্রুয়ারি (২০০৯) বিডিআর ট্র্যাজেডির মতো বীভৎস ঘটনা দেখেছি। ওই ৫০ দিনে বিএনপির বক্তব্য-বিবৃতি নিয়ে কেউ কিন্তু আলোচনা করতে চান না। ওই বক্তব্য-বিবৃতিগুলো অধিকাংশই বিএনপির সর্বশেষ এই আল্টিমেটামের মতো। একটু আগেই বলেছি, ‘বিএনপির কাজ বিএনপি করেছে।’ আসুন আমরা সবাই দ্রব্যমূল্যের যৌক্তিকতা ও অযৌক্তিতা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করি। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় দ্রব্যমূল্যের অভিঘাত খুবই পীড়াদায়ক।
২০১৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। বিগত পাঁচ বছরে সেই লক্ষ্য কতটা পূরণ হয়েছে, তা নিয়ে আমাদের সবারই আলোচনার সুযোগ এবং প্রয়োজনও রয়েছে। মুক্ত অর্থনীতির সূচকে বাংলাদেশ সাত ধাপ এগিয়েছে বলে জানিয়েছে আমেরিকান অর্থনীতির থিংক ট্যাংক হিসেবে পরিচিত হেরিটেজ ফাউন্ডেশন। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সাত ধাপ এগিয়ে ১১৬তম স্থানে উঠে এসেছে। হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ২০২৪ সংস্করণটি সূচকের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ২০২৪ সালের অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে মুক্ত দেশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। অর্থনৈতিকভাবে সংকুচিত ক্যাটাগরিতে যথাক্রমে ১৫৭, ১৪৯ ও ১৪৭তম অবস্থানে থাকা মালদ্বীপ, শ্রীলংকা ও পাকিস্তান অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বৈশ্বিক  র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ২০২৪ সালের অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে মুক্ত দেশে হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভুটানের পরেই রয়েছে বাংলাদেশ। অবশ্য ২০২৪ সালের সূচকে স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৫৪ দশমিক ৪-এ অপরিবর্তিত রয়েছে, যা গত বছরের মতোই ছিল, যখন বাংলাদেশ ১২৩তম অবস্থানে ছিল। সিঙ্গাপুর বিশ্বের সর্বাধিক মুক্ত অর্থনীতি হিসেবে তার অবস্থান ধরে রেখেছে, তারপরে দ্বিতীয় স্থানে আছে সুইজারল্যান্ড এবং এরপর আছে আয়ারল্যান্ড, তাইওয়ান এবং লুক্সেমবার্গ।
আমাদের গণমাধ্যমেরও সীমাবদ্ধতা আছে, বৈশ্বিকভাবে জাতীয় অর্জনকে কোনো কোনা সময় তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়। যেমন- সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার পূর্ব পুরুষের জন্মস্থান কেনিয়াতে সফরে গিয়ে বলেছিলেন, তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি বিষয়ে কেনিয়ার উচিত বাংলাদেশকে অনুসরণ করা। এই বক্তব্য বিবিসি, সিএনএন গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করলেও আমাদের গণমাধ্যমে তখন এ বিষয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়ে ওঠেনি।

(২)
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ এবং বিশ্বমন্দার মোকাবিলায় সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং দ্রব্যমূল্য উপশিরোনামে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল : দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়মতো আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজুতদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে। ‘ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ গড়ে তোলা হবে। সর্বোপরি সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য কমানো হবে ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে।’ পাঠক লক্ষ করে দেখবেন, বিগত ১৫ বছরে এ ব্যাপারে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মোটামুটি ঠিকমতোই এগোচ্ছিল কিন্তু কোভিডের তিন বছর, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকট সবকিছু মিলিয়ে জটিল পরিস্থিতি।
২০০৮ সালের ইশতেহারেও ‘বিশ্বমন্দা’ উপশিরোনামে যা বলা হয়েছিল, তা এ রকম- “বিশ্বমন্দা : বিশ্বমন্দার প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য নীতি প্রণয়ন, পরামর্শ প্রদান, তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জরুরিভিত্তিতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। বিনিয়োগ, জ্বালানি নিরাপত্তা, মুদ্রামান সুরক্ষা ও রপ্তানি সহায়তা এবং জনশক্তি রপ্তানি অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।” আরেকটি বিষয় দেশবাসীকে ভাবিয়ে তোলে দুর্নীতির সর্বগ্রাসী থাবা। সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দলের যৌথ পরিবার সত্য-মিথ্যের মিশেল দিয়ে সব সময় সরব থাকে। যদিও একটি কথা জোর দিয়ে বলে থাকেন, তারা না-কি মন খুলে কথা বলতে পারে না। গণমাধ্যমের না-কি স্বাধীনতা নেই। তাহলে তাদের ভাষণ-বিবৃতি আমরা জানতে পারছি কেমনে?
যা হোক, এবার আসি দুর্নীতি প্রসঙ্গে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করতে পারি। “দারিদ্র্য ঘুচাও বৈষম্য রুখো : আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত কৌশল ও লক্ষ্যমাত্রা অনুসরণ করা হবে।” বলা হয়েছিল, “দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান কৌশল হবে কৃষি ও পল্লী-জীবনে গতিশীলতা। হতদরিদ্রের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বিস্তৃত করা হবে। ২০১৩ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসীমা ও চরম দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ২৫ ও ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। বর্তমানের ৬.৫ কোটি দরিদ্রের সংখ্যা ২০১৩ সালে কমে দাঁড়াবে ৪.৫ কোটি এবং ২০২১ সালে তা হবে ২.২ কোটি। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য অন্যান্য পদক্ষেপের সঙ্গে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত প্রকল্প- একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রয়ণ, গৃহায়ন, আদর্শ গ্রাম, ঘরে ফেরা, বাস্তবায়ন করা হবে। বয়স্ক ভাতা, দুস্থ মহিলা ভাতা, সুবিধাভোগীদের সংখ্যা কমপক্ষে দ্বিগুণ করা হবে। কর্মসংস্থান ব্যাংকে প্রয়োজনীয় মূলধন সরবরাহ করে তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হবে। বর্তমান দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র পুনর্মূল্যায়ন করে নতুন পিআরএসপি প্রণয়ন করা হবে।” মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘মানুষ পরিশ্রম করলেই এখন আয় করতে পারে।’ বাংলাদেশে এ অবস্থা ১৫ বছর আগে কল্পনাও করা যেত না।

(৩)
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আরেকটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, তা হচ্ছে- দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বিষয়ক। কী ছিল ইশতেহারের অঙ্গীকারে সেটি একটু দেখা যাক। ইশতেহারে ছিল- “দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা : দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।” গত ১৫ বছরে এ বিষয়ে কতখানি অগ্রগতি হয়েছে এবং কী কী কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা দেশবাসীকে অবহিত করা প্রয়োজন। আমাদের সমাজে প্রায় সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে থাকেন; কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে শামিল হন না।
আরেকটি বিষয় লক্ষ যায়, যারাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন তাদের ব্যক্তিজীবনে কোনো নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা করেন না। অক্টোবর বিপ্লবের মহান নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেলিন সোভিয়েত সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার প্রারম্ভিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘বিপ্লব মানেই হচ্ছে বিদ্যুৎ এবং বিদ্যুৎ মানেই হচ্ছে বিপ্লব।’ তাহলে স্পষ্টভাবে দেখতে পাই, রাষ্ট্রনেতারা বিদ্যুৎকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আজকের বাংলাদেশে বিদ্যুতের বহুমুখী ব্যবহার কতটা বিস্তৃত হয়েছে। এখন সারা বাংলাদেশে ৪১ লাখ ইজিবাইক চলে এবং তার জন্য প্রয়োজন হয় সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ১৫ বছর আগে কেউ ভাবেননি বাংলাদেশের চরাঞ্চলে সাবমেরিন কেবল দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু দেশবাসী লক্ষ করল, আবার আরেক দফা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পেল। মানুষ ভয় পায় বিদ্যুতের দাম যতটা বাড়ে, তার চেয়ে আরও বেশি হারে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। কেননা আমাদের তো অজুহাতের শেষ নেই। এ ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষ যেন মানুষের কষ্ট বিবেচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মূল্যবৃদ্ধির অযৌক্তিকতা ও অজুহাত যেন কোনোভাবে প্রশ্রয় না পায়। সবার কাছে যেন ভুল বার্তা না যায়, সে-ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা যেন মানুষের মনে আঘাত না লাগে সেদিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। 
এক্ষেত্রে বিশেভাবে লক্ষণীয়, বিদ্যুৎ যে বেশি ব্যবহার করবে, তাকে মূল্য বেশি দিতে হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার অংশ হিসেবে বিদ্যুতের নতুন মূল্যহার কার্যকর করা হচ্ছে। নতুন হারে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৩৪ থেকে ৭০ পয়সা বাড়তে পারে। বাংলাদেশে লাইফলাইন গ্রাহক আছে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ, তারা প্রতি ইউনিটে চার টাকা করে বিল দেন। এই গ্রাহকদের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না, তবে ওপরের দিকে যারা বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, তাদের বিদ্যুতের বিল সামান্য বাড়তে পারে। গণমানুষের দাবি সব কিছুরই যৌক্তিতা থাকে। যারা গরিবের পকেট কাটে, তারা যেন শাস্তির আওতায় আসে।

সুভাষ সিংহ রায় : রাজনৈতিক বিশ্লেষক; সাবেক সহ-সভাপতি- বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল, প্রধান সম্পাদক- সাপ্তাহিক বাংলা বিচিত্রা ও এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম।

এই বিভাগের আরো সংবাদ