আজকের শিরোনাম :

চিরদিনের অভিভাবক - সুফিয়া কামাল

  দেবাহুতি চক্রবর্তী

২০ জুন ২০২১, ০৯:৪১ | আপডেট : ২০ জুন ২০২১, ০৯:৪৬ | অনলাইন সংস্করণ

সুফিয়া কামাল
প্রায় গোটা একটা শতক ধরেই সুফিয়া কামালের জীবন।তাঁর  জন্ম-১৯১১ মৃত্যু-১৯৯৯। মানবসমাজের ইতিহাসে এই বিংশ শতক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বিশ্বজুড়েই এই শতকে ভাঙা গড়ার ঘনঘটা।উপমহাদেশে বৃটিশবিরোধী তীব্র আন্দোলন, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ,মহামারী, ৪৭' এর দেশভাগ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ , বৃহত্তর অঙ্গনে  দু'দুটো বিশ্বযুদ্ধ,  হিরোশিমা -নাগাসাকিতে পারমানবিক বিস্ফোরণ, রুশ বিপ্লব,  সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের পতন, জাতিসংঘের জন্ম, দেশে দেশে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লব - বিদ্রোহ,  বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব জয়যাত্রা ইত্যাদি অগুণতি ইতিবাচক এবং নেতিবাচক ঘটনার সমাহার পুরো বিংশ শতক জুড়ে। এর মাঝেই সুফিয়া কামালের জন্ম এবং নিজেকে নিজের মতো বুঝে নেবার লড়াই শুরু। লড়াইটা শুরু হয় পরিবার থেকেই। তখনকার অভিজাত বনেদি পরিবারের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে দীর্ঘসময় তিনি লড়াই করেন। এই লড়াইগুলো কত কঠিন তা বাইরে থেকে অনুমেয় নয়।  বাংলায় জন্মে বাংলাভাষা শেখার জন্যই প্রথম লড়াই শুরু। তারপর আবার সাহিত্য চর্চা, পত্রিকায় নাম প্রকাশ, বরিশালে বোরখা পরিহিত অবস্থায় স্বদেশী আন্দোলনে অংশ নেওয়া, মহাত্মা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ, স্বামীর সাথে প্রথম বাঙালি মুসলিম নারী হিসেবে উড়োজাহাজে ভ্রমণ কোনোটাই পরিবার ও সমাজ ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু সহযোগিতা করেন, পাশে থাকেন স্বামী নেহাল আহমেদ। তাঁর  সহযোগিতায় অল্প বয়সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  সাথে সাক্ষাৎ  করেন ও আশীর্বাদ ধন্য হন।কাজী নজরুল ইসলাম সহ অনেকের সাথে  পরিচয় ঘটে। সুফিয়া কামালের বাল্যবিবাহ হয়। সেই সংসার জীবন মাত্র ছয় বছরের। এক কন্যা নিয়ে অকাল বৈধব্যের শিকার হন সুফিয়া কামাল।  তবু ভেঙে পড়েননি। কলকাতার এক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সাথে কাব্যচর্চাও নিয়মিত চলতে থাকে।বাড়তে থাকে  সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ। কয় বছরের মধ্যে দ্বিতীয় বিয়ে হয় কামালউদ্দিন খানের সাথে। সরকারি চাকুরিজীবী, সাহিত্যপ্রেমিক এই মানুষটিও সুফিয়া কামালের ইপ্সিত চলার পথে হাত বাড়িয়ে দেন, হাতে হাত মেলান।  সাধারণত সংসারে স্বামীর কাছ থেকেই নারীর  প্রতিবন্ধকতা বেশি হয়ে থাকে।   কবি  সেই ক্ষেত্রে তাঁর জীবনের আলোকবর্তিকা রোকেয়ার মতই সৌভাগ্যের অধিকারী। এর দুটো কারণ হতে পারে। এক, বাইরে থেকে ক্ষীণকায়া এই নারীর তেজময় ব্যক্তিত্ব। অন্যটা সেইসময় ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত পুরুষ সমাজের কেউ কেউ নারীর মানবাধিকারকে তুলনামূলক ভাবে সম্মান করতে শেখেন। সুফিয়া কামাল পরবর্তী জীবনে  সেকাল আর একালের কথায় বলেন যে তাঁদের সময় অগ্রসরমান নারীর জন্য পুরুষের ভূমিকা ছিল সহযোগিতামূলক। একালে সেটা প্রতিযোগিতামূলক। কথাটা অনুধাবনের। অনেক প্রশ্নের উত্তর এই সহজ কথাটার মধ্যে রয়ে গেছে। 

 ১৯৪৬ এর কলকাতার দাঙ্গার ভয়াবহ রূপ তিনি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন। দাঙ্গাপীড়িত মানুষের সেবায় দুয়ারে দুয়ারে ঘোরেন। দেশভাগ পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে তিনি পরিবার সহ ফিরে আসেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে। পাকিস্তানকে স্বাগত জানান। কায়েদ-ই-আজম এর প্রশস্তিমূলক কবিতা লেখেন। অনেকের মতই হয়তো মনে  হতে পারে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ।   অথবা নিজের জন্মভূমিতে ফিরে আসাটাই আকাঙ্ক্ষার  হতে পারে। যেটাই হোক,  সুফিয়া কামাল   ধার্মিক ছিলেন।কিন্তু সাম্প্রদায়িক ছিলেন না কখনই। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চেহারা অল্পদিনের মধ্যেই সকলের সামনে প্রকাশ পেতে থাকে। ধর্মের নামে, ভাষার নামে পাক শাসকদের নগ্ন চেহারা ক্রমশ  এই ভূখণ্ডের মানুষের পাকিস্তান প্রীতির মোহভঙ্গ ঘটাতে শুরু করে। সুফিয়া কামালের গার্হস্থ্য জীবন স্বামী সন্তানাদি পরিজন নিয়ে যখন ভরপুর,  হাসিমুখে সেই   দায়িত্ব পালন করতে করতে  তখনই  তিনি জড়িয়ে যান নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে। পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি, ঢাকা শিশু রক্ষা সমিতি, ওয়ারি মহিলা সমিতি, ছায়ানট, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ,  মহিলা  সংগ্রাম পরিষদ, কচি কাঁচার মেলা সর্বত্রই তিনি আর তিনি। এর বাইরে ৫২ র ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন।  দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে  ১৯৫৫ সনে ঢাকার রাজপথে নারীদের বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেন। এদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণার পর   তাঁর ছায়াতলে, তাঁর বাড়ি হয়ে ওঠে দেশের সামাজিক -সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূতিকাগার। কোনোরকম রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে বলেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার জীবনে উপাসনার নামান্তর। "--ছোটখাট একটা শান্ত মানুষ কত কঠিন, কত নির্ভীক হতে পারেন তার প্রমাণ প্রবল পরাক্রান্ত পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এক সভায় বাঙালিদের জানোয়ার '- বলে গালি দেওয়ায় উঠে দাঁড়িয়ে তিনিই বলতে পারেন, -- আপনি সেই জানোয়ারদের প্রেসিডেন্ট। ৬৯/৭০ এর গণ আন্দোলনের সাথে তিনি একাত্ম থাকেন। একাত্তরে চেষ্টা করেও পাক বাহিনী তাদের অনুকূলে কোনো বিবৃতিতে তাঁকে দিয়ে সই করাতে পারেনি। কবি - সাহিত্যিক সুফিয়া কামাল দেশ বিদেশে পরিচিত একটি নাম। তাঁকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে একবারই তিনি বাধ্য হয়ে বেতারে আসেন এবং জানান দেন তিনি বেঁচে আছেন।স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রী সংস্থার সাথে সম্পর্কিত হন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপ্রধান হিসেবে দাবি দাওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। যুদ্ধাহত ও অসহায় নারীদের পুনর্বাসনের জন্য, প্রাকৃতিক দূর্যোগে বিধ্বস্ত মানুষের জন্য, বিভিন্ন সময় দাঙ্গা প্রতিরোধে ও দাঙ্গাপীড়িত মানুষের জন্য,  যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য, স্বৈরাচারী শাসকের পতনের জন্য,গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য, নারী মুক্তির জন্য সকল আন্দোলনে সংগ্রামে বলিষ্ঠ ও পুরোধা ভূমিকায় থাকেন। ৭২ সনেই তিনি যুদ্ধাহত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণার দাবি জানান। যা এখনো চলমান প্রক্রিয়া।   এই বৃহৎ  জীবনের নানা রঙের বৈচিত্র্যময় ক্যানভাস স্বল্প পরিসরে  তুলে ধরা সম্ভব নয়। একটা মানুষ লেখায় - কবিতায়,  সংসারে, সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে একেবারেই  যেন দশভুজা। কিন্তু রণরঙ্গিণী মূর্তিতে নয়।  যাকে কাছে টানার কাছে টেনেছেন, যাকে দূরে ঠেলার দূরে ঠেলেছেন। সব মিলিয়ে এক নির্মোহ বৈরাগ্য জীবনাচারণে। তিনি আমাদের বলতেন, মহিলা পরিষদে কেউ নেত্রী নয়, সবাই কর্মী । "-- ছোট বড়, ধর্ম বর্ণ কোনো ভেদাভেদ  তিনি কখনো করেননি। কবি হিসেবে আমরা তাঁকে বেশি জানি।  কর্মবহুল জীবনের মাঝেও কাব্যচর্চা থেকে দূরে সরে যাননি। নিজের কবিতা নিয়ে বলেন,  --" আমার কবিতা-সাজানো বাগানের ফুল নয়, গুণে গুণে কোনোটির পর কোনোটির কথা আমি মালীর হাতে তৈরি  ফুলের তোড়ার মতো সাজাইনি,ও বিদ্যা আমার নেই। আমি বন্য, আমি অরণ্য, আমি নামহীন। "-- কবি জানতেন, এই নামহীন বুনো ফুলের সুঘ্রাণ  কতদূর ছড়াতে পারে! 

তাঁর জীবনের প্রথম সাহিত্য চর্চা শুরু হয় গদ্য দিয়ে। প্রথম প্রকাশিত কেয়ার কাঁটা -- গ্রন্থে নারী হিসেবে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে,  --" যে নারীকে তুমি অপমান করে এলে, ক্ষমা না পাওয়া পর্যন্ত তুমি সারা নারী জাতির যে অপমান করেছ তার ক্ষমা আমার কাছে নেই। " --

অন্যত্র তাঁর  লেখায় দেখি, --"আমি আমার স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্তা। কেন আমার স্বামীই কী আমার দ্বারা পরিত্যক্ত হতে পারেন না?  এতে লজ্জা বা গ্লানির কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। "---

 কথাগুলো এখনও এই একুশ শতকের নারীর কন্ঠ থেকে কন্ঠে  ধ্বনিত হয়ে ফিরছে। অথচ কুন্ঠা এখনও ঘোচেনি, এটাই সত্য।  অবাক হই সেই একই রচনায় তিনি কতটা সাহসের সাথে বলেন, --" আমি ফ্রয়েডবাদী মেয়ে নই - তবুও দেহের দাবি আমি অস্বীকার করব না। কারণ, আমার মনেও সাধ ছিল - আমি মাতা হব - সু- মাতা,পত্নী হব - আদর্শ পত্নী। এত দেহের দাবি দিয়েই পাওয়া, তাছাড়া কি করে মাতা পত্নী হওয়া যায়?  কিন্তু সে সাধ আমার ফুরিয়েছে, কারণ শুধু নারীর ইচ্ছায় ওটা সম্ভব নয় জেনেই। ****যতদিন না পুরুষের মত্ততা কমবে কোনো নারীরই সু-মাতা বা পত্নী হওয়ার আশা বিড়ম্বনা মাত্র। "--- জীবনের প্রথম অধ্যায়েই  তাঁর  উপলব্ধিতে আসে যে, নারীর মানবাধিকারের লড়াই নারী পুরুষের সম্মিলিত লড়াইয়ের অংশ। বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়।   এই উপলব্ধি স্পষ্টত প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার উপলব্ধি। সরাসরি রাজনৈতিক দল তিনি করেননি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রচণ্ড আস্থা ও ভালবাসা থাকা স্বত্ত্বেও বাকশাল কর্মসূচিতে যোগ দেননি। কিন্তু সমসাময়িক কালে শুধু সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামে নয়, সকল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনেও তিনি অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন।সংস্কৃতি চেতনাবিহীন রাজনীতিতে তাঁর  বিশ্বাস ছিল না। তাঁর  ভাষায়, --" যতদিন পর্যন্ত রাজনীতি বলতে মানবতাবোধের পুনরাধিষ্ঠান,সমতার অধিকার, মানুষের ভালো থাকা এবং ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনের ওপর তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা বোঝায়, আমার কবিতা আর রাজনীতি একই সূত্রে গাঁথা। "--

 লাতিন আমেরিকার বিপ্লবীরাও এভাবেই বলে গেছেন, একটা কবিতার অর্থ একটা বিপ্লব।সেই বিপ্লবের তত্ত্বগত ধারণা থেকে সুফিয়া কামাল কথাগুলো বলেননি। কথাগুলো একজন মানবিক মানবের, একজন প্রকৃত সততার সাথে কাব্যচর্চা করা কবির জীবনদর্শন ও হৃদয়ের সহজাত উপলব্ধি। তাঁর জীবন আদর্শের প্রথম গুরু তাঁর মা। দ্বিতীয়   কর্মগুরু, দর্শন গুরু  উপমহাদেশের প্রথম নারীবাদী নারী রোকেয়া। 

আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সুফিয়া কামাল ছিলেন মাতৃসমা। তিনি নিজেই লেখেন,  ১৯৯১ এ দল নির্বাচনে হারার পরে দলের সভাপতির পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন।  বহুজনের বহু অনুনয় বিনয় তাঁকে টলাতে পারেনি। খবর পেয়ে সুফিয়া কামাল ফোন করে বলেন, --" তুই পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার কর।এই দল, এই দেশের মানুষ ছেড়ে কোথায় যাবি? তোকে সভাপতি থাকতে হবে। "--  বর্তমান  প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়েই দলে কাজ করার কথা বলতেই ধমক দিয়ে বলেন, --" আমি যা বলছি তাই তোকে মানতে হবে। "-- পরে একই কথা চিরকূট দিয়েও তিনি বলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর  কথা ফেলতে পারেননি। সম্ভব ছিল না এই অমিততেজী ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করা।  --" সকলকে বললামও যে ফুপু ( সুফিয়া কামাল) বলেছেন বলেই দায়িত্ব নিলাম। "--- বলেন শেখ হাসিনা। 

কত দূরদর্শিতা থাকলে এবং কতটা ব্যক্তিত্ব থাকলে এভাবে বলা যায় এবং মুজিবতনয়াকেও কথা মানানো যায়, সেটা  এই ঘটনাতেই সহজে অনুমেয়। ১৯৯৭ সনে মহিলা পরিষদের সম্মেলনে হুইল চেয়ারে করে সুফিয়া কামাল আসেন। মঞ্চে থাকেন।  প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা সেই সম্মেলনে 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি "-- ঘোষণা করেন। প্রাণভরে অভিনন্দন জানান সুফিয়া কামাল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে।

  দুঃখের বিষয় সেই নীতি  বাস্তবায়ন থেকে আজও আমরা অনেক দূরে রয়ে গেছি। রাষ্ট্রধর্ম  ঘোষণার সময় থেকেই সুফিয়া কামাল বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী ও নারীর মানবাধিকার অর্জনের বিরোধী বলে প্রতিবাদ করেন,  অথচ সেগুলো আরও  দৃঢ়ভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে আমাদের সংবিধানে।  জীবনের শেষদিক এসে সুফিয়া কামাল নিজেও একটু  হতাশাগ্রস্ত, একটু বেদনাতুর হয়ে পড়েন। কাজী রোজীর স্মৃতিচারণ করেন এভাবে --" আচ্ছা রোজী,আড়াই তিন বছরের কন্যাশিশু যে পাষণ্ডরা ধর্ষণ করে তাদের কথা শোনার জন্য আমি এখনো বেঁচে আছি!  আমার কেন মৃত্যু হয় না, এ ধরণের অসম্ভব উচ্চারণ শোনার আগে। এ দেশে এখন কী হচ্ছে!  এ ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদের কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে? "--মৃত্যুর বছরখানেক আগে একই বেদনা থেকে তিনি বলেন, --" একুশ শতক আমি যেন না দেখি।একুশ শতকের মানুষেরা যদি মানবধর্ম পালন না করে, তাহলে একুশ শতকের কোনো মূল্য নেই। "--- একুশ শতক তাঁকে দেখতে হয়নি। নানাভাবে এই শতকের অতিক্রান্ত প্রথম দুই দশকেই আমরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি অনেক ক্ষেত্রে। আমাদের প্রাপ্তি যেমন অনেক, তেমনি  নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত ভাবে। মৌলবাদ খামচা দিয়ে ধরেছে সংবিধান, পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত। দূর্নীতি আজ সর্বগ্রাসী।  সততার সাথে, সাহসের সাথে মানব ধর্ম পালনের যে নীতিতে সুফিয়া কামাল অনড় অটল ছিলেন তা আজ অনেক দোদুল্যমান।  আজ যেন আমরা অনেক বেশি অভিভাবক শূন্য।  আজ এই জাতির বিবেককে তেমন করে ধমক দেওয়ার কেউ যেন কোথাও নেই। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে তবু এই দেশের নারী সমাজ, সাধারণ মানুষ ফিরে আসে সুফিয়া কামালের কাছেই। ---" বাঙালি জীবনে একুশ শতক আসছে। নারী ও শিশুর উপর আর নির্যাতন হবে না -- তা এই জনগণ প্রতিষ্ঠা করবে,এটা আমার বিশ্বাস। "--- আর, যে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনমুক্ত হতে পারে সে দেশে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হতেই হবে। তাই সেই বিশ্বাসে আমরা আস্থা স্থাপন করতে হবে। সব ত্রুটি বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে নারী পুরুষের সমতাপূর্ণ গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ  গঠনের লড়াইয়ে সুফিয়া কামাল আজও সবাইকে ডেকে বলে যাচ্ছেন, --" ওঠো জাগো, সমাজ ও দেশের জন্য কিছু কাজ করো। মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করো। সবার মঙ্গল করো। "

লেখক : আবোল-তাবোল শিশু সংগঠনের সভাপতি।

এই বিভাগের আরো সংবাদ