আজকের শিরোনাম :

পাশ্চাত্যের সঙ্গে কেন আপোষ করে চলে ইরান?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২১, ১১:০৩

ইলাস্ট্রেশন: দ্য ইকোনমিস্ট
ইরান, পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র শিয়া প্রধান অনারব মুসলিম দেশ। ভৌগলিক অবস্থান, ধন সম্পদ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে বরাবরই পূর্বতন পারস্য (বর্তমান ইরান) বৈশ্বিক অঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বিবর্তনের সাথে সাথে বৈশ্বিক রাজনৈতিক সমৃদ্ধি এবং জটিলতা যতটা বৃদ্ধি পেয়েছে, ইরানের সম্পৃক্ততাও তার সাথে সমানুপাতিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্য হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। আর এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ইরান অন্যতম প্রধান কর্মক হিসেবে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে পেরেছে সেই ঐতিহাসিককাল থেকেই।  বর্তমানে ইরানের বৈদেশিকনীতি বা এর লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে তা হলো পাশ্চাত্যের সঙ্গে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত হওয়া ইরানের পরমাণু চুক্তি, যা ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন বাতিল করে দিয়েছিলো। মূলত ১৯৯০ সালের পর থেকে ইরানের পরমাণু কর্মসূচী এবং একে ঘিরে পাশ্চাত্যের মনোভাব ও সিদ্ধান্তের উপরেই দেশটির পররাষ্ট্রনীতির গতি নির্ভর করে চলেছে। যেকোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে সে দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রভাব থাকবে, যেটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ইরানের ক্ষেত্রে দেশটির ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি শুধু প্রভাবই বিস্তার করে না বরং সমুদয় নীতিতে নিয়ন্ত্রণও করে। দেশটির সরকার কাঠামোয় একজন শিয়া মতাবলম্বী সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা অবস্থান করেন। মূলত তিনিই দেশের পররাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ সকল নীতি নির্ধারিত করে থাকেন। এছাড়া যেকোনো নীতির ক্ষেত্রে তার অনুমোদন আবশ্যক। দেশটির বর্তমান সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হলেন ৮১ বছর বয়সী আয়াতুল্লাহ আলি খামেনী। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর তিনি ইরানের দ্বিতীয়তম সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বয়স ও শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে খামেনীর উত্তরসূরি কে হবেন তা নিয়ে ইতোমধ্যেই যথেষ্ট জল্পনা কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। ৫৩ বছর বয়সী খামেনী পুত্র মোজতাবা কিংবা ৬০ বছর বয়সী বিচার বিভাগের প্রধান ইব্রাহিম রাইসির মধ্যে এই দৌড়ে কে এগিয়ে থাকবেন তা সময়ই বলে দিবে। তবে এই দৌড়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও নাম লেখাতে পারেন বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করে। তো যাইহোক, ধর্মীয় নেতার উত্তরসূরি কে হবেন সে বিষয়ে আলোচনার চেয়ে বর্তমান ধর্মীয় নেতা খামেনী এবং প্রেসিডেন্ট রুহানীর পররাষ্ট্রনীতি ও লক্ষ্য এবং তা বাস্তবায়নে তারা যা কৌশল অবলম্বল করে চলেছে সেটাই বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৯৭৯ সালের পূর্বে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র, এমকি ইসরায়েলের সম্পর্ক ছিলো বন্ধুত্বপূর্ণ। পঞ্চাশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়ই ইরান সর্বপ্রথম তার পারমাণবিক কর্মসূচীর অনুষ্ঠানিক সূচনা করে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের দরুণ ইরানের শেষ শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির পতনের মাধ্যমে পাহলভি সম্রাজ্যের ইতি ঘটে এবং ইসলামী শিয়া নেতৃত্বাধীন ইরানের সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। এই টানাপোড়েন বেশিরভাগ সময়ই সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে এবং এখনো নিয়ে থাকে। তবে ইরান বা পশ্চিমাদের ভূমিতে নয়, বরং অন্য কোনো তৃতীয় ভূখণ্ডে এই সংঘর্ষগুলো হতে দেখা যায়।
 
নব্বইয়ের দশকে ইসরায়েল ঘোষণা দেয় ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা বিশ্বের জন্য হুমকির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মূলত এরপর থেকেই পশ্চিমারা ইরানকে সম্পূর্ণরূপে একঘরে করে রাখার নীতি গ্রহণ করে। ইরানের পারমানবিক কর্মসূচী যাতে বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক হয়ে না পড়ে, সে জন্য ইরানের উপর পশ্চিমা দেশগুলো লাগাতার আর্থনৈতিক অবরোধ দিতে থাকে, যাতে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে ইরানের গণ্যমান্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের টার্গেট করে হত্যাকাণ্ড তো চালিয়েছেই। যাদের মধ্যে গেলো বছরের শুরুতে কুদস ফোর্সের প্রধান ও অঘোষিতভাবে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পরেই যার অবস্থান, কাশেম সোলাইমানী হত্যা এবং নভেম্বরে বিজ্ঞানী মোহসিন ফাখরিজাদেহ হত্যা ইরানের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে। তবে জবাবে ইরানও বসে থাকেনি। মার্কিন ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়েছে দুই দফা। এছাড়া পশ্চিমা বিরোধী বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলা ও অর্থায়নেও মনোযোগ দিয়েছে ইরান অনেক আগে থেকেই। ফলে সরাসরি ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে না জড়ালেও পশ্চিমাদেশ বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সুন্নি প্রধান সৌদি আরবের সাথে প্রায়ই প্রক্সি যুদ্ধে জড়িয়েছে ইরান। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি, সিরিয়ার আসাদ বাহিনী, কিংবা গাজার হামাস সবখানেই ইরানের পদচারণা রয়েছে। পারমাণবিক সক্ষমতা বা অস্ত্র অর্জন করে ফেললেও ইরান খুব ভালোভাবেই বোঝে পশ্চিমা জোটের কাছে তারা কতটা অসহায়। মূলত একারণেই সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা না করে বা দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে বিভিন্ন বিদ্রোহী মনান্তরে সন্ত্রাসী দলগুলোকে সমর্থন দিয়ে অনেকটা গেরিলা কৌশলে এগিয়েছে দেশটি বছরের পর বছর ধরে।

তবে সাম্প্রতিককালে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় দেশটি নিদারুণ সংকটের মুখে পড়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপে মন্থরগতির বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাব ইরানকে আরো বেশি গ্রাস করে চলেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ইরানের হাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় রপ্তানি খাতে পতন দেখা দেওয়ায় গত বছর তা মাত্র ৪০০ কোটি ডলারে নেমে আসে। নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এবং করোনা মহামারি দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে এবং এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে পৌঁছেছে প্রায়  ৫০ শতাংশের কাছাকছি। এর মধ্যে ২০১৯ সালে সরকার একতরফাভাবে পেট্রোলের দাম বাড়ালে দেশটির অন্তত একশ শহরে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলো। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি এ সময় অন্তত তিনশ মানুষকে হত্যা করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। এছাড়া বেকারত্বের চাপে সরকারের প্রতি অসন্তোষও বেশ বেড়েছে। এখন এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হয়ে আসার ক্ষেত্রে ইরানের সামনে একমাত্র পথ হলো, পশ্চিমারা যেনো দেশটির উপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেয় সেটা নিশ্চিত করা।

২০১৫ সালের ১৫ জুলাই নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাধারী পাঁচ রাষ্ট্র (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স) ও জার্মানির সঙ্গে ইরানের স্বাক্ষরিত হয় "জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ একশন" নামে বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত একটি চুক্তি, যা পি৫+১ চুক্তি নামেই পরিচিত। চুক্তির উদ্দেশ্য ছিলো ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা যেনো বিশ্ববাসী তথা পশ্চিমাদের জন্য হুমকির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক অবরোধে নাকাল হয়ে পড়া ইরানও রাজি হয়েছিলো চুক্তির মাধ্যমে আবরোধমুক্ত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক কর্মসূচী চালিয়ে যেতে। কিন্তু পরের বছর ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে ২০১৮ সালে চুক্তি বাতিল করে পুরনায় ইরানের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করলে আবারো পশ্চিমাদের সাথে ইরানের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। চুক্তি বাতিলের জের ধরে অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে ট্রাম্প প্রশাসনকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো।

তবে আশার কথা হলো এ বছরের শুরুতে জো বাইডেন ক্ষমতায় বসার সাথে সাথেই তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেন ইরানের সাথে "শাক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী" পারমাণবিক চুক্তিতে ফেরার ঘোষণা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত এপ্রিলে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় শুরু হয় ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তিতে ফেরার উদ্দেশ্যে বিশ্বশক্তিদের সাথে দেশটির আলোচনা, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত অনেকটা পরোক্ষভাবেই অংশগ্রহণ করেছে। ইরান চায় চুক্তিতে প্রবেশের সাথে সাথে যেনো পশ্চিমারা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বা সীমিত করে নেয়। কিন্তু মার্কিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, অবরোধ তুলে নেয়া নির্ভর করবে চুক্তি বাস্তবায়নে ইরানের রাজনৈতিক আচরণের উপর। একথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র হয়ত সহসাই অবরোধ শিথিল করবে না।  তবে যুক্তরাষ্ট্র অবরোধ তুলে নেয়ার ব্যাপারে সময়সীমা যা-ই ধরুক না কেনো, ইরানের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে চুক্তিতে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প আপাতত নেই। তাই পশ্চিমাদের সাথে দর কষকাষির শেষ পর্যায়ে ইরানকে চুক্তিতে ফিরতেই হবে।

তবে ইসরায়েল কোনোভাবেই চায়না ইরানের সাথে পশ্চিমাদেশগুলো কোনো ধরণের চুক্তিতে আবদ্ধ হোক। সেই ২০১৫ সাল থেকেই, যখন ওবামা প্রশাসন পি৫+১ চুক্তিতে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলো তখন থেকেই ইসরায়েল এই চুক্তির বিরোধিতা করেছে। পরবর্তীতে ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলের মনের বাসনা পূরণ করলেও নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা ইসরায়েলকে আবারও দুঃশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। 

ট্রাম্প পেন্টাগনের ক্ষমতায় থাকতে থাকতেই বিজ্ঞানী ফাখরিজাদের হত্যার ঘটনা ঘটে। ইরান এই হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলকে দায়ী করেছে এবং ইসরায়েল এই দায় অস্বীকারও করেনি। আবার একই বছর ইরানের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নাতাঞ্জে পর পর দুইবার রহস্যময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় ইরানের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ইসরায়েলের হামলায় নাতাঞ্জ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ–সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেন্ট্রিফিউজ। এ হামলার কারণে আরও বড় বিপদও ঘটতে পারত। ইরানের অভিযোগ স্বীকার করে ইসরায়েলের গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, 'ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এ হামলা চালিয়েছে'। বোঝাই যাচ্ছে, ট্রাম্পের ক্ষমতার শেষ সময়ে ইরানের উপর এমন সব আঘাত হানার উদ্দেশ্য ছিলো ইরানকে চূড়ান্তভাবে উস্কে দিয়ে কোনো ভুল করে বসার পথ খুলে দেয়া; যেন ইরানের সেই ভুলের সুযোগ নিয়ে ট্রাম্পের নির্দেশে মার্কিন বাহিনী দেশটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তবে এখানে ব্যাপক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে ইরান। প্রতিশোধ নেয়া হবে এমন হুমকি দিলেও বড় ধরণের কোনো সামরিক সিদ্ধান্তে যায়নি তারা।

অন্যদিকে, আঞ্চলিক চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবও পূর্বে চায়নি ইরানের সাথে পশ্চিমাদের কোনো সমঝোতা হোক। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ইরানের প্রতি নমনীয়ভাব প্রদর্শন করেছেন। ইরানকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে সম্বোধন করে পারস্পারিক স্বার্থের ভিত্তিতে কাজ করা ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার উপর জোর দিয়েছেন তিনি।

রাশিয়া ও চীনের সঙ্গেও ইরান সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে। তবে রাশিয়ার সাথে ইরানের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে পাহলভি যুগের পর থেকে। পশ্চিমা বিশ্বের লাগাতার অবরোধের মধ্যে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরানের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হামলা এবং কাশেম সোলাইমানি ও ফাখরিজাদেহ হত্যার ঘটনায় ইরান রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে কিছুটা সহানুভূতিও পেয়েছে।

তবে সম্প্রতি ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের গোপনীয় এক অডিও সাক্ষাৎকার ফাঁস হয়েছে, যেখানে উঠে এসেছে বেশকিছু চমকপ্রদ তথ্য। অডিও সাক্ষাৎকারে জাভেদ জারিফকে বলতে শোনা যায়, ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে ইরান যাতে রাজি না হয়, তার জন্য যা যা করা সম্ভব তার সব চেষ্টাই করেছিলেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। জারিফের ভাষ্যমতে, মস্কো কখনও চায়নি যে, পশ্চিমের সঙ্গে ইরানের একটা সমঝোতা হোক। তার এই মন্তব্য সত্যিই বিস্ময়কর। কারণ সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে রাশিয়া ও তেহরান বেশ ঘনিষ্ট মিত্র।

এছাড়া কাশেম সোলাইমানির সমালোচনা করে জারিফ বলেন, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার বৈঠকের সময় সোলাইমানি চাইতেন তিনি একটা বিশেষ অবস্থান নিন। জেনারেল সোলাইমানি কার্যত ইরানকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে টেনে নিয়ে গেছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। কারণ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চেয়েছিলেন, সিরিয়া সরকারকে সমর্থন করে রাশিয়া যে বিমান হামলা চালাবে তাতে সহায়তার জন্য ইরানি বাহিনী যেন স্থলযুদ্ধে অংশ নেয়।

এই টেপ ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটেছে এমন একটা সময়ে যখন ভিয়েনায় পরমাণু চুক্তি পুনরুদ্ধারের এক আলোচনা শুরু হয়েছে ইরান ও বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে। টেপ ফাঁস হওয়ার পর এখন চুক্তির ব্যাপারে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব ও সেই সাপেক্ষে শর্তগুলো কেমন হবে তা খানিকটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ইরানের জন্য। হয়ত একারণেই মার্কিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ব্যাপারে ইরানের রাজনৈতিক আচরণের উপর জোর দিয়ে যাচ্ছেন।

তবে যাইহোক না কেনো, দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ইরানকে শর্ত মেনে নিয়ে চুক্তিতে ফিরতে হবে। কেনোনা, পশ্চিমা জোটের বিরুদ্ধে লড়াই করার মত সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তি কোনোটাই নেই ইরানের। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে জন অসন্তোষও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বর্তমান কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা আলি খামেনীর সঙ্গে রুহানি প্রশাসন এবং খামেনী পরবরর্তীতে তার উত্তরসূরি ও এ বছরের আসন্ন নির্বাচনে রুহানির উত্তরসূরি হিসেবে যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেনো, তাদেরও পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য হবে পশ্চিমাদের সাথে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই চুক্তিতে প্রবেশ এবং তা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করা।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

এই বিভাগের আরো সংবাদ