আজকের শিরোনাম :

এমন বন্ধু আর পাব না

  পঙ্কজ ভট্টাচার্য

০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:১৫ | অনলাইন সংস্করণ

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মহাপ্রয়াণে ভারতের জনগণের মতো বাংলাদেশের জনগণও গভীরভাবে শোকাহত। সুদীর্ঘকাল ভারতের রাজনীতিতে অনন্য স্বাক্ষর রেখেছেন এই ভারতত্ন। তিনি ভারতের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি। ভারতের জনগণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই রাজনীতিক বাংলাদেশের জনগণেরও অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেক বাংলাদেশি রাজনীতিবিদের সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্ক আমৃত্যু অটুট ছিল।

প্রণব মুখার্জি ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহার শহরের অদূরে মিরিতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ দশক ধরে প্রতাপের সঙ্গে রাজনীতি করা এ নেতার বাবাও ছিলেন একজন সংগ্রামী। তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ খোপাধ্যায় সিউড়ির বিদ্যাসাগর থেকে প্রণব পড়াশোনা শেষ করেন। হাওড়া জেলার বাঁকুড়ার বাঁকুড়া ইসলামিয়া হাই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা প্রণব ‘দেশের ডাক’ নামে একটি পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এই সময়ে তিনি বাংলা কংগ্রেসের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তবে স্থানীয় নেতাদের কারণে তিনি ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দিতে পারেননি। তিনি কংগ্রেস থেকে বের হয়ে আসা অজয় মুখার্জির বাংলা কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৯৫২-৬৪ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৯ সালের রাজ্যসভার নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী তাকে ন্যাশনাল কংগ্রেসের হয়ে ভারতের উচ্চকক্ষে মনোনয়ন দিলে তিনি নির্বাচিত হন। সেই থেকে টানা পাঁচবার তিনি রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলন। ১৯৭৩ সালে শিল্প উপমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভারতের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ১৯৮২-৮৪ সাল পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রণবের নাম বেশ জোরালোভাবে প্রকাশ পায়। কিন্তু তার স্থলে রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে ওই মন্ত্রিসভায় প্রণবের স্থান হয়নি। রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস প্রণব মুখার্জিকে দল থেকে বহিষ্কার করে। তখন তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের অবসান হলে আবারও কংগ্রেসে ফিরে আসেন। রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পর ভারতের নবম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পি ভি নরসিমা রাও দায়িত্ব নেন। তিনি প্রণব মুখার্জিকে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৫ সালে প্রণব মুখার্জিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন রাও।

২০০৪ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট কেন্দ্রে সরকার গঠন করে। ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রাজ্যসভার সদস্য হওয়ায় প্রণব মুখোপাধ্যায়কে লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতার দায়িত্ব পালন করতে হয়। ওই বছরই তিনি প্রথমবার জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে লোকসভায় নির্বাচিত হন। ওই সরকার প্রথমে তাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পরে ২০০৬ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়। ২০০৯ সালে মনমোহন সিংয়ের সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে তাকে আবারও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১২ সালে তাকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এ পদে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালে তিনি নিজের আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২’ প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জি এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বব্যাপী প্রচার আন্দোলনে দৃঢ় ভূমিকা রেখেছিলেন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের বিষয়েও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রণব মুখার্জির ব্যক্তিগত সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল এবং এজন্য নিজেকে ধন্য মনে করি।

তিনি একজন বিচক্ষণ বাগ্মী ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি একজন সহৃদয় মানুষ ছিলেন। তিনি সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। নিজের দলের কর্মীদের প্রতি তো বটেই, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদের প্রতিও তার মমত্ববোধ সবসময় বজায় ছিল। সবার সঙ্গেই তার গভীর সম্পর্ক ছিল। তিনি আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ভারতে যখন কোথাও সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে, তিনি সরব হয়েছেন। মর্মস্পর্শী ঘটনা যেখানেই ঘটেছে, সেখানেই ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি ভারতের সংখ্যালঘু, অনগ্রসর সম্প্রদায়, পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য অবিরাম কলম ধরেছেন, কথা বলেছেন, সংসদে প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। এটা আমাদের জন্য উদাহরণ হিসেবে থাকবে। তিনি ভারতের একজন শ্রেষ্ঠ পার্লামেন্টারিয়ানের সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। 

একই ধরনের সম্পর্ক ছিল বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পারিবারিক অভিভাবক মনে করতেন। ১৯৭৫ সালের শোকাবহ ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ভারতে আশ্রয় লাভ করেছিলেন। এসময় তারা অভিভাবকের মতো সহায়তা এবং পরামর্শ লাভ করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী অগ্রগতিতে তার সচেতন প্রয়াস ছিল। তিনি সবসময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রেখেছেন। ১৯৭৫ এর পর যারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করেছেন, তাদের প্রতি তিনি সবসময়েই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তার মতো দলের ঊর্ধ্বে উঠে সর্বদলীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ খুব কমই দেখা গেছে।

ভারতীয় রাজনীতিতে তার অবদান অপরিসীম। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে ভারতের উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রেখেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশের প্রতি তার গভীর মমত্ববোধের একটি বড় কারণ হলো তার স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জি। শুভ্রা বৌদি বাংলাদেশের নড়াইলের মেয়ে। নড়াইলে শ্বশুরবাড়ি হওয়ার কারণে প্রণবদা একাধিকবার ব্যক্তিগত সফরে বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে দ্বিধাহীনভাবে মেলামেশা করেছেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, সময় কাটিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতি তার মমতা, দরদ আমরা কোনোদিন ভুলব না।

আগেই উল্লেখ করেছি যে তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। আমি যখনই তার সাক্ষাৎ চেয়েছি, তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। স্বাধীনতার পর তার সঙ্গে আমার অর্ধডজনের বেশি সাক্ষাৎ হয়েছে। এমনকি সরাসরি তার বাসায় চলে গিয়েছি। তিনি সবকাজ ফেলে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। আমাদের সহযোগিতা করেছেন। ১৯৭৫ সালের পর আমাদের বেশকিছু মানুষ বর্ডারের ওপারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের জন্য সহযোগিতা তার কাছ থেকে পেয়েছি।

সর্বশেষ ছয়মাস আগে তার সঙ্গে দিল্লিতে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। আমাদের দেশের বেশকিছু লেখক, সাংবাদিক লিখেছেন যে ২০০৮ এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের সাক্ষাৎ হয়েছিল। বিশেষ করে মহিউদ্দিন আহমদ রচিত ‘এক-এগারো’ গ্রন্থে প্রণব মুখার্জির কিছু উদ্ধৃতির উল্লেখ ছিল। এসব উদ্ধৃতির ব্যাপারে আমার সন্দেহ ছিল। আমার মনে হয়েছিল, উদ্ধৃতির মধ্যে কিছু আতিশয়োক্তি আছে। আমি তাকে বইটি দেওয়ার পর তিনি ১০ মিনিটি সেটি নিয়ে নাড়াচাড়া করলেন। তারপর যা বললেন, তাতে আমার সন্দেহ সঠিক প্রমাণ হলো। তিনি বললেন, ‘আমার বাঙালি বন্ধুরা, বুদ্ধিজীবীরা বাড়তি কথাই বলেছেন। আমি যেসব কথা বলেছি, তাকে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। আমি শুধু বলেছিলাম যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে। ১৯৭১ এর পর এই ঐতিহাসিক সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে। যতই উত্থান-পতন ঘটুক না কেন, এ সম্পর্ক অটুট থাকবে।’ তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন নেতার খোঁজ নিলেন। আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, কাদের সিদ্দিকী, কমিউনিস্ট নেতা অজয় রায় প্রমুখের খোঁজখবর করলেন। কে মারা গেছেন, কে কোথায় গিয়েছেন, কে কোন দল করছেন, এসব কথা তিনি সাগ্রহে শুনলেন। তার সঙ্গে এ অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় কখনোই মনে হয়নি তিনি ভারতের কংগ্রেসের একজন বিশিষ্ট নেতৃত্ব। তখন মনে হয়নি যে তিনি একটি দলীয় গ-ির মধ্যে আবদ্ধ আছেন।

প্রণবদা উপমহাদেশের রাজনীতির একজন বিশিষ্ট দিকপাল ছিলেন। তার মৃত্যুতে আমরা ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। যেন এক শূন্যতা চারদিক দিয়ে গ্রাস করছে। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল অতুলনীয়। তিনি যেভাবে স্নেহসহকারে ব্যক্তিগত কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন, পারিবারিক খোঁজখবর নিতেন, ভারতীয় রাজনীতির এরকম বন্ধু আর পাব না মনে হয়। তার মতো মানুষ উপমহাদেশের রাজনীতিতে খুবই বিরল। ‘প্লেইং লেভেল ফিল্ড’-এর হাই থিঙ্কিং-এর একটা চমৎকার উদাহরণ ছিলেন তিনি। তার জীবন রাজনীতিতে নিবেদিত ছিল, জনস্বার্থে নিবেদিত ছিল। শুধু তাই নয়, তিনি দেশের কাজে যেমন নিবেদিত ছিলেন, তেমনি উপমহাদেশের কল্যাণেও নিবেদিত ছিলেন। তিনি অমর হোন, চিরঞ্জীব হোন এটা আমার প্রত্যাশা। প্রণবদার স্মৃতির প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা জানাই এবং তার আত্মার পরিপূর্ণ শান্তি কামনা করি।

লেখক : সভাপতি, ঐক্য ন্যাপ

সৌজন্যে : দেশ রূপান্তর

এই বিভাগের আরো সংবাদ