আজকের শিরোনাম :

আনিসুজ্জামান ছিলেন আমার শিক্ষক

  মিল্টন বিশ্বাস

১৫ মে ২০২০, ১১:৪৮ | অনলাইন সংস্করণ

করোনা ভাইরাস সৃষ্ট মহামারির বৈশ্বিক বিপর্যয়ের মধ্যে আমার শিক্ষক আনিসুজ্জামান স্যারকে চিরবিদায় জানাতে হলো। যখন আমরা লকডাউন ও কোয়ারেন্টিনে থেকে সংক্রামক ব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধ করছি ঠিক তখন এই মহাপ্রস্থান মেনে নেয়া খুব বেশি কষ্টকর হয়ে উঠেছে গোটা জাতির জন্য। কারণ বাংলাদেশে তাঁর মতো বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের মানুষ বিরল। অথচ তাঁকে বিদায় জানাতে হচ্ছে জনগণের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো ব্যতীত, শহিদ মিনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মরদেহ রেখে পুষ্পার্ঘ্য প্রদান ছাড়াই। তিনি জন্মেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭ সালে আর প্রয়াত হলেন মুজিববর্ষে ১৪ মে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি ছিলেন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বিকশিত প্রগতিশীল মুসলিম জনগোষ্ঠীর উজ্জ্বলতম দিকপাল। আর পাকিস্তানি শাসকদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা জ্বলন্ত শিখা। এজন্য ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯) এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ তাঁর ক্ষেত্রে একটি অনিবার্য ঘটনা হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি শাসকদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্র-সংগীত পাকিস্তানের জাতীয় ভাবাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে বেতার ও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার বন্ধ করতে বলা হয়। এর প্রতিবাদে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বিবৃতিতে আনিসুজ্জামান স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন এবং সেটা বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপতে দেন। তিনি ছিলেন মধ্যবিত্ত বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রগণ্য পথিকৃৎ। দেশের প্রতিটি সংকটকালে তাঁর বক্তব্য, মন্তব্য এবং ভূমিকা দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করা কিংবা বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা সংস্করণে তাঁর অবদানের ঘটনা সর্বজনবিদিত। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর পরিচিতি অনেক বিশ্বখ্যাত মানুষের কাছে ছিল ঈর্ষণীয়।
২.
জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান পরলোকবাসী হলেন ৮৩ বছর বয়সে। কিন্তু ৮০ বছর অতিক্রম করার পর তিনি একটি পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘অনেক দিন বাঁচলাম। এখন তো বাড়তি সময় জীবন যাপন করছি। এই বাড়তি সময় যেন অর্থপূর্ণ হয়।’ একথা ঠিক তিনি অর্থপূর্ণ করে তুলেছিলেন নিজের জীবনকে। তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষক। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ কর্মসহচরী ও কলমযোদ্ধা। তিনি ছিলেন ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপন কমিটির অন্যতম পুরোধা। সংবাদপত্রের পাতায় তিনি বহু বিশেষণে বিভূষিত হতেন। বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক, ভাষাসংগ্রামী, মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী, সংবিধানের অনুবাদক, দেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রবর্তী ব্যক্তি কিংবা জাতির বিবেক প্রভৃতি। তাঁর মৃত্যুর পর ‘আনিসুজ্জামান ছিলেন সমাজের চেতনার বাতিঘর’ বলেছেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। কারণ সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিভাবনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রগামী।
আনিসুজ্জামান ছিলেন আমাদের শিক্ষক, একজন সমাজ-মনস্ক মানুষ, প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী অনন্যসাধারণ ব্যক্তি। তাঁকে আমরা পেয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে এবং দেখেছি সেখানকার ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবেও। তিনি চাকরির নির্দিষ্ট বয়সসীমা অর্থাৎ ৬৫ বছর অতিক্রম করেছিলেন। কিন্তু গবেষণা ও শিক্ষায় খ্যাতনামা হওয়ায় তাঁকে ইমেরিটাস অধ্যাপক পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসীন করে। তিনি ছাড়া ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী আমাদের পরিচিত মুখ। এরপর আনিসুজ্জামান ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। জাতীয় অধ্যাপক বাংলাদেশের বিশেষ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা যা বাংলাদেশ সরকার কতৃর্ক শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণার জন্যে দেশের বিশিষ্ট পণ্ডিত, চিন্তাবিদ এবং শিক্ষকগণকে প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে এই সম্মাননা প্রবর্তিত। সাধারণত পাঁচ বছর মেয়াদের জন্যে কোনো ব্যক্তি জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্তি পেয়ে থাকেন, তবে ক্ষেত্রবিশেষে সেই মেয়াদ বাড়ানো হয়। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৭৫ সালের ১৭ মার্চ জাতীয় অধ্যাপক পদে তিন জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। তারা হলেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং পরিসংখ্যানবিদ অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনিসুজ্জামানকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেন।
৩.
তখন আমরা এম এ ক্লাসের শিক্ষার্থী। তার আগে স্নাতকের তিন বছর আনিসুজ্জামান স্যারকে দূর থেকে দেখেছি। তাঁর অবিচল কিন্তু মন্থর গতি এবং পায়জামা-পাঞ্জাবি তথা পোশাকের স্বাতন্ত্র্য আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ক্যাম্পাস কিংবা ক্যাম্পাসের বাইরে তাঁর সভাপতিত্বে কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে দেখেছি তিনি খুব অল্প কথায় মূল বক্তব্য বলে শেষ করতেন ভাষণ। হৈচৈ করা কিংবা উৎসবে উচ্ছ্বসিত হয়ে ফাঁকা কথা আওরানো ছিল তাঁর অভ্যাসের বাইরে। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন না। কিন্তু তারা তাঁর সঙ্গে বলতে গেলে পরামর্শ দিতেন আনন্দিত চিত্তে। বিভাগে দেখেছি তাঁর আচার-আচরণ ছাত্রীদের কাছে ছিল দেবতা সুলভ। আমার পরিচিত জনৈক জুনিয়র ছাত্রী তাঁকে দেবতার মতোই ভক্তি করত। এম এ ক্লাসে আনিসুজ্জামান স্যারকে আমরা খুব অল্প সময়ের জন্য পেয়েছিলাম। কারণ ১ বছরের কোর্স আসলেই খুব দ্রুত শেষ হয়েছিল। সেসময় সনজীদা খাতুন আপা, রফিকুল ইসলাম স্যার, মনিরুজ্জামান স্যার, হুমায়ূন আজাদ স্যার ছিলেন এম এ ক্লাসের অন্যতম শিক্ষক। এই খ্যাতনামা শিক্ষকদের কাছে আমাদের পাঠ গ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। আর এঁদের মধ্যে মিতবাক আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন আলাদা।        
রবীন্দ্রনাথের গোরা (১৯১০) উপন্যাস পড়াতে গিয়ে আনিসুজ্জামান স্যার স্বল্পভাষণে তখন আমাদের এম এ ক্লাসে যেসব কথা বলেছিলেন, তার মর্মবস্তু আমাদের কাছে আরো বেশি স্পষ্ট হয়েছিল তাঁর একটি প্রবন্ধ পাঠ করে। ‘বাঙালির আত্মপরিচয়’ অন্বেষণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেনÑ উপন্যাসের নায়ক নিজেকে সগর্বে হিন্দু বলে প্রচার করে বেড়িয়েছিল যতক্ষণ না সে জানতে পারে যে আসলে সে আইরিশ পিতা-মাতার সন্তানÑ ভারতের সকল মন্দিরের দ্বার তার কাছে রুদ্ধ। প্রচণ্ড হতাশার মধ্যেও খানিকটা স্বস্তি লাভ করে গোরা তখন ঘোষণা করে : ‘আমি যা দিনরাত্রি হতে চাচ্ছিলুম অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তাই হয়েছি। আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।’ উপন্যাসে যদিও কথাটা সেভাবে বলা নেই, গোরা আরেকটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারত, সে এখন প্রকৃতপক্ষে যা হয়েছে, তা ভারতবর্ষীয় নয় বা কেবল ভারতবর্ষীয়ই নয়, বরং জাতধর্ম- দেশকালের সীমানা পেরোনো মানুষ- বিশ্ববাসী।
আনিসুজ্জামান নিজেও দেশকাল সীমানা পেরোনো মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। তাঁকে আমি দেখেছি ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে খালেদা জিয়ার পুলিশ বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন করলে প্রতিবাদে তিনি রাজপথে নেমে এসেছেন। শেখ হাসিনার ওপর ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলা কিংবা তার আগে হুমায়ূন আজাদকে হত্যার চেষ্টা প্রভৃতি ঘটনায় তিনি প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেছেন। মিডিয়াতেও কথা বলেছেন ধিক্কার জানিয়ে অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে। ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর বিএনপি-জামায়াতের সাম্প্রদায়িক হামলা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলেও তাঁকে আমরা দেখেছি। অর্থাৎ তিনি কেবল অধ্যাপক নন তিনি মুক্তিকামী মানুষের সাহসী নেতাও ছিলেন। তিনি আপাতমস্তক অসাম্প্রদায়িক ছিলেন যদিও কাজ করেছিলেন মুসলিমদের সাহিত্য কর্ম নিয়ে। আসলে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্যে আলোকিত।    
৪.
বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া এবং সংবাদপত্রের সূত্র অনুযায়ী, আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম এ টি এম মোয়াজ্জেম। তিনি ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিণী হলেও লেখালেখির অভ্যাস ছিল। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। আনিসুজ্জামানরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। তিন বোনের ছোট আনিসুজ্জামান, তারপর আরেকটি ভাই। বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন। অর্থাৎ পারিবারিকভাবে তাঁরা ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের রসবোদ্ধা সন্তান।
আনিসুজ্জামান দেশভাগের পর বাংলাদেশে চলে আসেন এবং এখানে বেড়ে ওঠেন কিন্তু হরহামেশায় পশ্চিমবঙ্গে ছুটে যেতেন না। বরং তিনি ভারত-বাংলাদেশের বাইরে ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এখানে তৃতীয় শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর বাংলাদেশে চলে আসেন এবং খুলনা জেলা স্কুলে অষ্টম  শ্রেণিতে ভর্তি হন। এক বছর পর পরিবারের সাথে ঢাকায় এসে প্রিয়নাথ হাইস্কুলে (বর্তমান নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে এ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৩ সালে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৫৭ সালে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সেসময় বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও শিক্ষক ছিলেন মুনীর চৌধুরী। ১৯৫৮ সালের ফেব্রুারিতে তিনি বাংলা একাডেমির গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন। একইবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা ১৭৫৭-১৯১৮ বিষয়ে পিএইচডি শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনায় যোগদান করেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস : ইয়ংবেঙ্গল ও সমকাল বিষয়ে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন।
আনিসুজ্জামান ২২ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৯ সালের জুনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে(১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত) বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করেন এবং পরবর্তীতে ভারত গমন করে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। একইসময় যুদ্ধকালীন গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন।
১৯৮৫ সালে আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম থেকে নিজের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। ২০০৩ সালে এখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে আবার যুক্ত হন। তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। এছাড়াও তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগে তিনি শিল্পকলাবিষয় ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘যামিনী’ এবং বাংলা মাসিকপত্র ‘কালি ও কলম’-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শিক্ষা ও গবেষণা কর্মধারার বৈচিত্র্য তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতি এনে দেয়। ভিজিটিং ফেলো হিসেবে বৈশ্বিক জ্ঞানভাণ্ডারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাঁর পৃথিবীর বিখ্যাত সব ব্যক্তির সঙ্গে। 
৫.
আনিসুজ্জামান ২০টিরও বেশি গবেষণা গ্রন্থের রচয়িতা। মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪), মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৯), মুনীর চৌধুরী (১৯৭৫), স্বরূপের সন্ধানে (১৯৭৬), Social Aspects of Endogenous Intellectual Creativity (১৯৭৯),Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Official Library and Records(১৯৮১), আঠারো শতকের বাংলা চিঠি (১৯৮৩), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৮৩), পুরোনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪), মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯৮৮), Creativity, Reality and Identity (১৯৯৩), Cultural Pluralism (১৯৯৩), Identity, Religion and Recent History (১৯৯৫), আমার একাত্তর (১৯৯৭), মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর (১৯৯৮), আমার চোখে (১৯৯৯), বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে (২০০০), পূর্বগামী (২০০১), কাল নিরবধি (২০০৩)। এছাড়া তিনি বিদেশি সাহিত্য অনুবাদে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। অস্কার ওয়াইল্ড ও আলেক্সেই আরবুঝুভ তাঁর প্রিয় নাট্যকার ছিলেন।
 তিনি কখনো একক আবার কখনো বা যৌথ সম্পাদনা করেছেন একাধিক গ্রন্থের। তাঁর অন্যতম একক সম্পাদিত গ্রন্থ হলো- ‘রবীন্দ্রনাথ’ (১৯৬৮)। আর অন্যান্যদের সঙ্গে মিলে সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিবর্গের রচনাসমগ্র। এর মধ্যে বিদ্যাসাগর-রচনা সংগ্রহ (১৯৬৮), মুনীর চৌধুরী রচনাবলী ১-৪ খণ্ড (১৯৮২-১৯৮৬), নজরুল রচনাবলী ১-৪ খণ্ড (১৯৯৩), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলী (১ ও ৩ খণ্ড, ১৯৯৪-১৯৯৫), আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী (১ম খণ্ড, ২০০১) অন্যতম। এছাড়াও Culture and Thought (১৯৮৩), বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড (১৯৮৭), SAARC: A People's Perspective (১৯৯৩), আইন-শব্দকোষ (২০০৬) তাঁর অন্যতম সম্পাদিত গ্রন্থ।
আমাদের ছাত্র জীবনে তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থটি রেফারেন্স হিসেবে বেশ কাজে লেগেছে। পরে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস কিংবা অন্যান্য রচনাবলি গবেষণা প্রবন্ধ কিংবা গবেষণা গ্রন্থের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছি। তবে তিনি বিখ্যাত ছিলেন পুরানো বাংলা গদ্য সম্পর্কে স্বতন্ত্র বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য। কারণ বাংলা গদ্যের উদ্ভব উনিশ শতকে এই ধারণা তাঁর গবেষণার ফলে পাল্টে গিয়েছিল। তিনি দেখিয়ে দিলেন চিঠিপত্র ও দলিল-দস্তাবেজের গদ্য বাংলা গদ্যের প্রাথমিক রূপ তথা নিদর্শন। এজন্য বাংলা গদ্য ইংরেজি সাহিত্য থেকে এসেছে- এ ভাবনা অমূলক।
৬.
আনিসুজ্জামান জীবদ্দশায় অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। তিনি প্রবন্ধ-গবেষণায় অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি থেকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ১৯৭০ সালে। এর আগে পেয়েছেন নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৬), দাউদ পুরস্কার(১৯৬৫)। পরবর্তীতে একুশে পদক (১৯৮৫), আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক প্রদত্ত আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৩), রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি. লিট. ডিগ্রি(২০০৫), শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ভারত সরকার প্রদত্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণ পদক(২০১৪), সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার(২০১৫), ‘বিপুলা পৃথিবী’ বইয়ের জন্য দ্বিতীয়বার আনন্দ পুরস্কার(২০১৭), বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক(২০১৮), সার্ক কালচারাল সেন্টার থেকে সার্ক সাহিত্য পুরস্কার(২০১৯) উল্লেখযোগ্য।

৭.
মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অবদান রেখেছেন ড. আনিসুজ্জামান। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান বাংলা ভাষায় অনুবাদের যে কমিটি ছিল সেটার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। এছাড়া ১৯৯১ সালে জননী সাহসিকা জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণ-আদালতের একজন অভিযোগকারী ছিলেন তিনি। তখনকার বিএনপি আমলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া মোটেই সহজ কাজ ছিলো না। এভাবে তিনি সাহসের পরিচয় দিয়ে গেছেন। অর্থাৎ তাঁর প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্য মানুষের জন্য নিবেদিত ছিল এটা স্পষ্ট।আর এজন্যই আনিসুজ্জামান স্যার বাঙালি সমাজের কাছে চির-স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। 

লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস,  বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected])

এই বিভাগের আরো সংবাদ