আজকের শিরোনাম :

করোনা ভাইরাস: প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ!

  ফাহমিদা হক

০৩ এপ্রিল ২০২০, ১৪:৪৪ | অনলাইন সংস্করণ

উন্মাদের মতো ছুটে চলছে পৃথিবীর মানুষের কর্মযজ্ঞ আর জীবন। নিজেদের প্রয়োজনে আমরা ভুলে গেছি, প্রকৃতি, পরিবেশেরচাহিদা।আমরা ভুলে গেছি প্রকৃতির  চাহিদা তথা নিরবতার কথা। আমরা ভুলে গেছি, যে প্রকৃতি আমাদের উজার করে দিয়েজীবন বাঁচাতে সাহয্য করে তাকে অন্তত একটু স্বস্তি দেয়া দরকার। 

তবে কি কারণ এটাই! বিশ্ববাসীকে করোনাই শিক্ষা দিচ্ছে? যুদ্ধ-বিগ্রহের পাশাপাশি নানা সামাজিক মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনেমানব জাতি। উন্নতি, অগ্রগতি আর নিজেদের হিসেবে যা ভালো, তাই করি। সাম্রাজ্যবাদ আর পুজিবাদের কারণে সঠিক বেঠিকভুলে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে প্রকৃতির উপর করা অত্যাচারের এমনতর প্রতিশোধ।    

আসলে করোনা কি শিক্ষা দিচ্ছে মানব জাতিকে? এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব কারো কাছে নেই। পরিস্হিতি আর প্রেক্ষাপট হিসেবকরলে যে যাই বলুক, যে যেভাবেই হিসেব মিলাতে যাক এই বৈশ্বিক ইকোসিস্টেম চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া বা অন্য যে কোন দেশের  অপব্যবহারের ফলই   ভোগ করতে হচ্ছে সবাইকে।  এই করোনা যেখান থেকেই ছড়াক না কেনতা পরিবেশ ধ্বংসের অনিবার্য ফল।       

মার্কিন এক স্বাস্হ্য সাময়িকীতে জন হপকিন্স নিশ্চিত করে গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায় গবেষকদের বরাত দিয়েবলেছেন, চীনে এমন একটি ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে যা বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। পরিবেশের ক্ষতি সাধন থেকেশুরু করে ব্যাপক প্রানহানি ঘটাবে। বর্তমান পরিস্হিতিতে তাদের ভবিষ্যত বাণী বাস্তবে রুপ নিয়েছে। এখন  সন্দেহ দানা বেঁধেছেযে, তারা এতো নিশ্চিত আশন্কা কেনো করেছিলো? তা হলে এটা পূর্ব পরিকল্পনার অংশ নয় তো! এমন সম্ভবনাকেও একেবারেউড়িয়ে দেয়া যায় না। চীনের এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি স্হান, যেখানে সকল কল কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, খনিজ সম্পদ সহঅর্থনৈতিক বিপুল অংশের সমাহার সেই স্হান আক্রান্ত হওয়া মানেতো পুরা চীন আক্রান্ত হওয়া। আর এই সূত্র ধরে, চীনেরগুরুত্বপূর্ণ কিছু সংবাদে এটাকে আমেরিকান কর্ম বলে ধারনা করছে।

চীনের উহান শহরে একটি সি ফুড থেকে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি বলে এখন পর্যন্ত বলা হয়েছে।প্রাথমিক অবস্হায় আক্রান্তসবাই ওই বাজারের সাথে জড়িত ছিলেন। গত ১ জানুয়ারি ঐ বাজারটি বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে এর পরে শুধু উহানেই সীমাবদ্ধথাকেনি করোনা। চীনের বহু প্রোভিন্স  হয়ে এখন সারা বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে গেছে। চীন ই ভ্রমন বা বিভিন্ন ভাবেকরোনা ছড়িয়েছে দাবী করা হলেও কিছু কিছু দেশে আক্রান্তদের সাথে চীনের কোনরকম আগেপিছে সংশ্লিষ্টতা ছিলো না বলেজানাগেছে। নানা ষড়যন্ত্র তত্ব থেকে শুরু করে মানবসৃষ্ট দূর্ঘটনা বলেও অনেক অনুমানভিত্তিক তথ্য নেট দুনিয়ায় ভেসেবেড়াচ্ছে।

করোনা ভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস যা আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯ - এনসিওভি বা নভেল করোনা ভাইরাস। এটি এক ধরনের করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে।কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৬ টি মানব দেহে সংক্রমিত হতে পারে। তবে নতুন এই করোনা ভাইরাসের কারণে সেই সংখ্যা এখন হবেসাতটি। ২০০২ সাল থেকে চীনে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স(পুরো নাম সিভিয়ার এ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) নামেযে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল আর ৮০৯৮ জন সংক্রমিত হয়েছিল, সেটিও ছিলো এক ধরনেরকরোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাসের বৈজ্ঞানিক নাম SARS - coV -2. বিজ্ঞানীরা এই করোনা ভাইরাসে দুই প্রকার জেনেটিকবৈশিষ্ট- আলফা ও বিটাকরোনা ভাইরাসের জেনেটিক তথ্যের গঠনগত ও তুলনামূলক বৈশিষ্ট বিশ্লেষণ করে, জৈব- রাসায়নিকপরীক্ষার মাধ্যমে প্রমান করতে সক্ষম হয়েছেন , এটি কোন কৃত্রিম জীবাণু নয়,বরং করোনার বিবর্তিত  রুপ।

১৭ ই মার্চ নেচার মেডিসিনে প্রকাশিত ‘দা প্রক্সিমাল অরিজিন অফ SARS - CoV -2' গবেষনায় দেখা যায়, এই ভাইরাসেরজিনের প্রোটিনে যে ছয় রকম এ্যামিনো এসিড সন্বলিত ‘রিসেপটর বাউন্ডিং ডোমেইন’ বা আরবিডি পাওয়া যায়, তা এইভাইরাসের বাহক। যা মানুষের ACE2 রিসেপ্টরের সাথে SARS -CoV- 2 -এর স্পাইক প্রোটিনের যুক্ত হওয়ার প্রবনতা কেবলপ্রাকৃতিক কারনেই সম্ভব বলে ধারণা করা হচ্ছে।তাছাড়া অন্যান্য করোনা ভাইরাসের মতো এই করোনা ভাইরাসের প্রোটিনস্পাইকের সাব ইউনিটে পাওয়া পলিবেসিক ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট প্রাকৃতিক নিয়মে ভাইরাসকে তার বাহক খুঁজতে সাহায্যকরে। 

গবেষনায় দেখা গেছে, এই ভাইরাস মানুষকে আক্রমণ করার আগে অন্য কোন প্রাণীকে প্রাথমিক আধার হিসেবে ব্যাবহার করে  এবং পরে ঐ প্রানীর মাধ্যমে মানুষে সংক্রমিত হয়। এক্ষেত্রে যেসব প্রানীর মানুষের মতো ACE2 রিসেপ্টর আছে, কেবল সেই সবপ্রানীকেই প্রাথমিক বাহক হিসেবে ব্যবহার করে। মানব দেহে এরা বেশ কিছুদিন সুপ্ত অবস্হায় থাকতে পারে। নতুন ভাইরাসেরসংস্পর্শে আসার পরেই এই প্রাথমিক বা সুপ্ত ভাইরাসটি তার সক্রিয় রুপে আবির্ভূত হয়। এখানে তার কর্তৃত্বেই মানবদেহে পূর্ণকরোনা ভাইরাস হিসেবে প্রকাশ পায়।

গত ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটে।এই ভাইরাসে চীনে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।আর মারা গেছে প্রায় তিন হাজার মানুষ। যদিও এই তথ্য নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে।তারপর থেকে প্রতিনিয়ত বাড়ছে এইভাইরাস আক্রান্তের দেশের সংখ্যা। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৯৭টি দেশে করোনা ভাইরাস আক্রমণ করেছে। মারা গেছে প্রায় ৬০ হাজারমানুষ। ইতালী, ফ্রান্স ,আমেরিকা, স্পেন, জার্মানী, চীন, ইরানসহ বিভিন্ন দেশে মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই বেড়ে চলছে। কোথায় থামবেকেউ জানে না। সবচেয়ে ভয়ংকর এই ভাইরাসের আক্রমণ যতো দ্রুত বাড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভাইরাসটির বৈশিষ্ট্।এত দ্রুত বৈশিষ্ট পরিবর্তনের কারণে বিজ্ঞানীরা আজ পর্যন্ত তার সম্পর্কে সঠিক তথ্যটাই নির্ধারণ করতে পারছেনা। পারছেনাকোন ঔষধ বা প্রতিরোধ করার মতো কোন টিকা আবিষ্কার করতে।

সবচেয়ে ভয়ংকর কথা বলছে বিশেজ্ঞরা, তাদের ধারণা দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলির অবস্হা আরো ভয়াবহ আকার ধারন করবেকরোনার আক্রমণে। কারণ এখানে লোকসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশী, যার কারনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশংকা অনেক।ইতোমধ্যে মুম্বাইয়ের সবচেয়ে বড় বস্তি ধারাবীকে করোনা আক্রমণ করেছে। ধারাবী, এশিয়ার সবচেয়ে বড় বস্তি যেখানে এরই মধ্যেআক্রান্ত দুইজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। আমরা জানি এসব বস্তিতে আইসোলেশন করার মতো কিছু নেই। গায়ে গায়ে লেগে থেকেএদের বসবাস। থাকা, খাওয়া পয় নিস্কাশনের ব্যবস্হাই করোনা দ্রুত ছড়ানোর জন্যে যথেষ্ট । ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র , তাদের সাথে আমাদের আবহাওয়া থেকে যোগাযোগ ব্যবস্হা পর্যন্ত এতো কাছের যে, তাদের যে কোন সংক্রমন আমাদের দেশকেওচরম হুমকির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে।

সন্দেহ নেই তথ্য ভারাক্রান্ত এই সময়ে নানান দিকের নানা কথা আমাদেরকে উদভ্রান্ত করে তুলছে। দুষিত এই ঢাকা শহরে আমরাএমনিতেই এই সময়ে বিপদজনক সময়ের মধ্য দিয়ে পার করছি।এই সময়টাতে এমনিতেই সর্দি, কাশি, ঠান্ডা, জ্বর, শ্বাসকষ্ট লেগেইথাকে। ডেঙ্গুর আতংক আছে ভয়ানকভাবে। তার মধ্যে আবার করোনা নামক ভাইরাস, মানে মরার উপর খাড়ার ঘা।

আমরা করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি চাই। আমরা চাই না এই ভাইরাসের দানবীয় থাবায় পরতে। দুনিয়া জুরে প্রাণঘাতী এইভাইরাস ছড়িয়ে পরছে আর বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে চ্যালেন্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে, তছনছ করে দিচ্ছে তাদের উন্নত  চিকিৎসাব্যবস্হা; ভেঙ্গে পরছে তাদের স্বাস্হ্য সেবা, হিমশিম খাচ্ছে সরকার।দিশেহারা অবস্হায় এরা বাধ্য হচ্ছে প্রয়োজন আর অরস্হাবুঝে বয়স্কদের বাদ দিয়ে কমবয়সীদের বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিতে। কল্পনা করা যায় না পরিস্হিতি মানুষকে কতটুকু অসহায় করলেএমন মানবিক সেবাদানকারীরা এমন অমানবিক সিদ্বান্ত নিতে পারে। কতখানি অসহায়ত্ব নিয়ে প্রত্যেকটা দেশের সরকারপ্রধানরা পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করছেন, তা প্রত্যক্ষ  করি  আমরা প্রতিনিয়ত বিদেশী টিভি নিউজগুলোর দিকে তাকিয়ে।

সবশেষে বলতে চাই , বেঁচে থাকতে চাইলে এসব প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করেই বাঁচতে হবে। লড়াই করার  জন্যে ইমিউনিটিঅর্জন করতে হবে। আর এই শক্তির মূল উৎস প্রকৃতি।সব কিছুই আমরা পর্যাপ্ত পরিমানে পাই প্রকৃতিতে, যেই প্রকৃতি তার দানেরঅপার ভান্ডার অবারিত করে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের , সেই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে, যত্ন করতে হবে।কোনভাবে ধ্বংস করা যাবেনা। প্রকৃতি বিরুপ হলে আমরা বাঁচবো না।

অবাক হলেও এটাই চরম সত্যি, বিশ্বময় করোনার তান্ডবে মানুষ যখন অসহায় হয়ে ঘরে বন্দী, প্রকৃতি তখন ফেলছে স্বস্তিরনি:শ্বাস।সমুদ্রের নীল জলে উচ্ছসিত প্রাণীকূল। বাতাসে হু হু করে কমছে দূষন। পাহাড়েও বইছে সমীরণ। আকাশে নেই কার্বন, মেঘ মুক্ত খোলা আকাশ। গাছে গাছে ফুল ফুটছে, প্রকৃতি যেন বহুকাল পরে আপন আলোয় ফিরেছে।

ইংরেজীতে কঠিন করে বলা শব্দ ‘রিভেন্জ অফ নেচার’ না বলে আমরা বিশ্বাস করি, প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে নয় বরং প্রতিরক্ষাকরতেই হয়তো আমাদের বৃহত্তর ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়ে ক্ষুদ্রতর  ক্ষতি করে শিক্ষা দিয়ে দিলো। প্রকৃতিকে রক্ষা করলে  রক্ষাপাবে মানুষ।প্রকৃতি ধ্বংস করলে বিভিন্ন ভাবে মানুষ করোনার মতো লক্ষ কোটি জীবাণু দ্বারা বিপর্যস্ত হবে। মানবজাতি ধ্বংস হয়েযাবে।

লেখক: নিউ মিডিয়া কো অর্ডিনেটর, সিজিএস; পরিচালক, সিসিএন

এই বিভাগের আরো সংবাদ