আজকের শিরোনাম :

“বাংলাদেশ পুলিশ; গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী”

  এডওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ

২৭ মার্চ ২০২০, ১২:০৭ | অনলাইন সংস্করণ

অবকথন: “Cops are always in the line of fire.” উক্তিটি মনে পড়লো বর্তমানে করোনা ভাইরাস তথা COVID-19 প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ পুলিশের অবস্থান দেখে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছেন বিভিন্ন স্তরের পুলিশ সদস্যরা। বিভিন্ন হাসপাতাল ও কোয়ারেন্টিনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত তারা, দায়িত্ব পালন করছেন বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন বন্দরের ইমিগ্রেশনেও। এ অবস্থায় প্রাণঘাতী এই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এসেছে।

তার আগে উল্লেখ করতে চাই কিছু পূর্বকথন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ বাহিনীর সৃষ্টি হয়। উদ্দেশ্য জনগণের যানমালের নিরাপত্তা দেয়া। বিংশ শতাব্দীতে এসে পুলিশ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৬২ সালে ইংরেজ শাসনামলে পাক-ভারত উপমহাদেশে পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয়। মধ্যযুগীয় সময়ে পুলিশি কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়না। তবে ভারত বর্ষের সুলতানী শাসনামলে একটি সরকারি পুলিশি স্থর বিন্যাস লক্ষ্য করা যায়। শহর অঞ্চলে কোতোয়াল পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন। মোঘল আমলের পুলিশি ব্যবস্থা সংক্রান্ত তথ্য আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে পাওয়া যায়। মধ্যযুগের পুলিশি ব্যবস্থা শেরশাহ শুরী দ্বারা প্রবর্তিত হয় যা স¤্রাট আকবরের সময়কালে আরও সংগঠিত হয়েছিল।

সম্রাট তার ফৌজদারী প্রশাসনিক কাঠামো তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন। (১) মীর আদাল অর্থাৎ সম্রাটের প্রধান প্রতিনিধি, (২) কাজী অর্থাৎ প্রধান বিচারক এবং (৩) কোতোয়াল অর্থাৎ বড় বড় শহরের প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা। এই কোতয়ালী পুলিশ ব্যবস্থার নামানুসারে বর্তমান রাজধানী ঢাকায় কোতয়ালী থানা আছে এবং দেশের অনেক জেলা শহরের সদর পুলিশ ষ্টেশনকে ‘কোতয়ালী’ থানা বলা হয়। মোঘল আমল পর্যন্ত যদিও একটি সুশৃঙ্খল পেশাদারী ব্রিটিশ পুলিশ সিস্টেম প্রবর্তিত হয়নি। তবুও সাধারণভাবে, এটি প্রতিষ্ঠিত ছিল মুসলিম শাসকদের রাজত্বের সময়ে এখানে আইন শৃঙ্খলা এবং অপরাধ প্রতিরোধমূলক প্রশাসন অত্যন্ত কার্যকর ছিল।

শিল্প বিপ্লবের কারণে ইংল্যান্ডের সামাজিক ব্যবস্থায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির ফলে স্যার রবার্ট পিল একটি নিয়মতান্ত্রিক পুলিশ বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৮২৯ সালে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে পুলিশ গঠনের বিল উত্থাপন করেন। এর প্রেক্ষিতে গঠিত হয় ‘লন্ডন মেট্রো পুলিশ’। অপরাধ দমনে এই পুলিশ বাহিনীর সাফল্য ইউরোপ-আমেরিকায় ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে। ১৮৩৩ সালে লন্ডন মেট্রো পুলিশের অনুকরণে আমেরিকা গঠন করে ‘নিয়ইয়র্ক সিটি নগর পুলিশ কর্তৃপক্ষ’।

১৮৫৬ সালে বৃটিশ সরকার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিকট হতে ভারত বর্ষের পূর্ণ শাসনভার গ্রহণ করে। এ সময় লন্ডন মেট্রো পুলিশের সাফল্যে অনুপ্রানিত হয়ে বৃটিশ সরকার ভারতে স্বতন্ত্র একটি পুলিশ ফোর্স গঠনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৮৬১ সালে “The commission of the Police Act” (Act V of 1861)" বৃটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয়। এই আইনের অধীনে ভারতের প্রতিটি প্রদেশে একটি করে পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়। প্রদেশ পুলিশ প্রধান হিসাবে একজন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এবং জেলা পুলিশ প্রধান হিসাবে সুপারিটেনটেন্ড অব পুলিশ পদ সৃষ্টি করা হয়। বৃটিশদের তৈরীকৃত এই ব্যবস্থা এখনও বাংলাদেশ পুলিশে প্রবর্তিত আছে।

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনীর নাম প্রথমে ‘ইষ্ট বেঙ্গল পুলিশ’ এবং পরবর্তীতে ‘ইষ্ট পাকিস্তান পুলিশ’ রাখা হয়। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এই নামে পুলিশের কার্যক্রম অব্যহত থাকে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা: ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ২৫ মার্চের কালো রাত্রে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীর উপর বর্বর হামলা শুরু করে। এ সময় তাদের প্রথম আক্রমনটি পরিচালনা করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশ সদস্যদের উপর। অকুতোভয় পুলিশ সদস্যরা দেশমাতৃকার টানে পাকিস্তানী বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে ২য় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বাতিল ৩০৩ রাইফেল দিয়ে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। রুখে দাড়ান অন্যায়ের বিরুদ্ধে নি:শঙ্ক চিত্তে। হানাদারদের ভারী অস্ত্রের গোলায় সেদিন ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল সবকটি পুলিশ ব্যারাক। অসংখ্য পুলিশ সদস্য শহীদের অমিয় সুধা পান করেছিলেন দেশের জন্য। কাপুরুষের ন্যায় এক পুলিশ সদস্যও সেদিন মাথা নত করেননি।

২৫ মার্চের দুপুরের পর থেকেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কট্রোল রুমে নানা ধরণের খবর আসতে থাকে। গোটা ঢাকা শহর তখন ছিল থমথমে। পাকিস্তানী বাহিনীর সাজোয়া যানের খবর পাওয়া পর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সদস্যরা নিজেদের করণীয় নিয়ে শলাপরামর্শ করে। পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ ঢাকা শহরে যে কয়টি পুলিশ পেট্রল পার্টি ছিল প্রত্যেকেই নিজেদের মত করে যুদ্ধের প্রস্ততি নিতে থাকেন।

রাত এগারটার পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানসমুহ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের চারিদিকে অবস্থান নিতে থাকে। পাকবাহিনীর এই আক্রমনের সংবাদ তাৎক্ষনিকভাবে সারাদেশের জেলা ও সাব ডিভিশনসমুহে পুলিশ বেতার মারফত প্রেরণ করা হয় । বেতারের ভাষাটি ছিল এরূপ: “‌base for all station of east Pakistan police, keep listening, watch, we are already attacked by the pak army. Try to save yourself, over”।

রাত ১১.৩৫ মিনিটে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা অস্ত্রাগারের ঘন্টা পিটিয়ে সবাইকে সতর্ক ও একত্রিত করেন। অস্ত্রাগারে কর্তব্যরত সেন্ট্রির রাইফেল থেকে গুলি করে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে নিজেদের মধ্যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিতরণ করা হয়। পুলিশ সদস্যরা তখন প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের চারিদিকে, ব্যারাক এবং বিভিন্ন দালানের ছাদে অবস্থান নেয়। প্রায় ৮০০ পাকিস্তানী সেনা সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত সাজোয়া যান রাজারবাগ পুলিশ লাইনের প্রধান গেটে এসে পৌঁছে রাত ১১.৪০ মিনিটে। এসময় বাঙালী পুলিশ সদস্যরাও কৌশলগত স্থানে পজিশন নেয়। এর মিনিট পাঁচেক পর পাকিস্তানী বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দক্ষিন -পুর্ব দিক (পুলিশ হাসপাতাল কোয়ার্টার সংলগ্ন) থেকে প্রথম গুলি বর্ষন করে। প্রায় সাথে সাথেই প্যারেড গ্রাউন্ডের উত্তর-পুর্ব দিক (শাহজাহানপুর ক্রসিং) থেকে আক্রমন শুরু করে। ব্যারাকের ছাদে অবস্থানরত বাঙালী পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানী সেনাদের লক্ষ করে গুলিবর্ষনের মাধ্যমে পাল্টা জবাব দেয়। শুরু হয় দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সশস্ত্র প্রতিরোধ। বাঙালী পুলিশ সদস্যদের মরনপণ প্রতিরোধে পাকিস্তানী ট্যাংক ও কামান সজ্জিত বাহিনীর গতি থমকে যায়। পরবর্তীতে হানাদার বাহিনী মর্টার ও হেভি মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষন শুরু করে। এতে পিআরএফ এর ৪টি ব্যারাকে আগুন ধরে যায়। পাক বাহিনী ট্যাংক বহরসহ প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রবেশ করে। এসময় বাঙালী পুলিশ সদস্যরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করে গেরিলা হামলার মাধ্যমে পাকিস্তানী বাহিনীর অনেক সদস্যকে হতাহত করেন। রাত সাড়ে তিনটার দিকে পাকিস্তানী বাহিনী রাজারবাগের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। প্রায় দেড়শ বাঙালী পুলিশ সদস্য বন্দি হন পাকিস্তানীদের হাতে। তার আগে পুলিশ বাহিনীর একটি বড় গ্রুপ অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে মালিবাগ ও চামেলীবাগ দিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত হয় মুজিব নগর সরকার। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর সরকারের শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান শেষে ঝিনাইদহের তৎকালীন সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার মাহবুবউদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম ঐতিহাসিক গার্ড অব অনার প্রদান করেন। মূলত ১৯৭১ সালের মার্চ মাস হতেই প্রদেশের পুলিশ বাহিনীর উপর কর্তৃত্ব হারিয়েছিল পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার। পুলিশের বীর সদস্যরা প্রকাশ্যেই পাকিস্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৩ হাজারেরও বেশি পুলিশ সদস্য পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য অস্বীকার করে নিজ নিজ কর্মস্থল ত্যাগ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। এসময় তাঁর সাধারণ মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়ারও ব্যবস্থা করেন। ৯ মাস জুড়ে চলা দেশব্যাপী সম্মুখ সমর তথা গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এবং পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন প্রবল প্রতিরোধ।

মুক্তিযুদ্ধের দলিল অনুযায়ী মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন ডিপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল, বেশ কয়েকজন এসপিসহ ১২৬২ জন পুলিশ সদস্য দেশের জন্য, দেশের পতাকার জন্য শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর পুলিশ বাহিনী “বাংলাদেশ পুলিশ” নামে সংগঠিত হয়। বাংলাদেশ পুলিশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পুলিশ বাহিনীর মতো আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনে প্রধান ভুমিকা পালন করে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ পুলিশের ট্রাডিশনাল চরিত্রে বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছেন। শুধু আইন পালন আর অপরাধ প্রতিরোধ বা দমনই নয়দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছেন। গত এক দশকে জঙ্গীবাদ দমন এবং নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পুলিশের সদস্যরা তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর পেশাদারিত্ব দিয়েঅপরাধ মোকাবিলায় প্রতিনিয়ত সৃজনশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন। ঘুষ দুর্নীতির কারণে একসময়েঅভিযুক্ত এই বাহিনী তার পেশাদারিত্ব আর জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে জনগণের গর্বের বাহিনীতে পরিণত হয়েছেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর বীরত্বগাঁথা অংশগ্রহণ স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁদের সেই স্মৃতি রক্ষার্থে রাজধানী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ টেলিকম ভবনের একটি কক্ষে ২০১৩ সালের ২৪ শে মার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর’। এতে যুদ্ধকালীন সময়ে পুলিশ সদস্যদের অমিয় সাহসিকতার চিত্র ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে। যাদুঘরটিতে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন অজানা তথ্য ও দুর্লভ দলিল যা মূহুর্তেই মনে করিয়ে দেয় যুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা। এতে স্থান পেয়েছেগৌরবময় স্মৃতিচিহ্ন ও বিভিন্ন স্মারক। রণাঙ্গনে পুলিশের ব্যবহৃত জিনিষপত্র ইতিহাসের সাথে নতুন প্রজন্মের একটি যোগসূত্র স্থাপনে সক্ষম হয়েছে।

১৯৮৯ সাল থেকে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে প্রতিনিধিত্ব করে আসছে অত্যন্ত সুনামের সাথে। নামিবিয়ায় শান্তি মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে আইভরি কোষ্ট, সুদান, দারফুর, পূর্ব তিমুর, ডি আর কঙ্গো, অ্যাঙ্গোলা, হাইতি, লাইবেরিয়া, কসাবো সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি বয়ে এনেছেন বৈদেশিক মুদ্রা।

বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী-মেট্রোপলিটন পুলিশ, রেঞ্জ বা জেলা পুলিশ, গোয়েন্দা শাখা (ডিবি), স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), ক্রিমিনাল ইনভেষ্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি), রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি), হাইওয়ে পুলিশ, ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (পিবিআই), স্পেশাল সিকিউরিটি অব প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন (এসএসপিবি), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ (এএপি), র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), সোয়াদ, কাউন্টার টরিজম ইউনিট, নৌপুলিশ, পর্যটন পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, ইমিগ্রেশন পুলিশ এর মাধ্যমে দেশের জনগণের নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করছেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী সর্ব প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। দেশের ক্রান্তিকালে তাঁদের বুদ্ধিমত্তা, দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও বীরত্বগাঁথা অবদান জাতি সম্মানের সাথে স্মরণ করবে গভীর শ্রদ্ধাভরে। আমরাও স্মরণ করছি। সেই সাথে হৃদয় নি:সৃত বিনম্র শ্রদ্ধা সকল শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনাসহ সকলের প্রতি যাঁরা দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছেন।

সমাজে পুলিশের অবস্থান: পুলিশ কোন যন্ত্র কিংবা বিশেষ প্রজাতির প্রাণী নন। তারা আমাদের সমাজেরই কারো ভাই, কারো বোন, কারো সন্তান, কারো বাবা মা, এই কথা কৌতুককারীদের খেয়াল থাকে না। একটি গ্যাসের বোতলে অর্ধেক পানি ভর্তি থাকলে নেতিবাচক ধারার লোকেরা বলবেন গ্যাস অর্ধেক খালি আর ইতিবাচক ধারার লোকেরা বলবেন গ্যাসতো অর্ধেক ভরা। এটা হলো দৃষ্টিভঙ্গি বা বোধের পার্থক্য।

আমাদের দেশে প্রতি ১২০০ জন মানুষের জন্য মাত্র একজন পুলিশ। এই হিসেবে গত ঈদের ছুটি পেয়েছিল মাত্র ৩০ ভাগ পুলিশ সদস্য। পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপনের স্বপ্ন বুকে লালন করলেও ৭০ ভাগ সদস্যই ছুটি পাননি। বাংলাদেশের সকল পেশাতেই ঘুষ দুর্নীতি অনিয়ম অসাধুতা লোক ঠকানো বা রাষ্ট্রের সাথে প্রবঞ্চনা এক ধরণের ওপেন সিক্রেট। পুলিশও তার বাইরে নয়। কিন্তু এমন আর কোনো পেশা নজির নেই যেখানে আনন্দ আয়োজন বা উৎসবের দিনগুলোতে এতো বেশি সদস্যকে কর্মস্থলে থাকতে বাধ্য করা হয়।

একজন সমাজ গবেষক হিসেবেই ট্রাফিক পুলিশের কাজকর্ম রাস্তায় গিয়েই দেখবার সুযোগ হয়।  ট্রাফিক নিয়ন্ত্রন পুলিশের অতিরিক্ত কাজ। আর সেখানে আমাদেরই ভাই-বন্ধুরা কাজ করেন। ঈদ যাত্রায় রাস্তার ভোগান্তির জন্য সড়ক বিভাগ, চালক বা যাত্রীসাধারণের দায়বদ্ধতা থাকলেও যুগ যুগ ধরে গালাগাল খেয়ে চলেন ট্রাফিক পুলিশেরা। কিন্তু পরিবার পরিজনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বাদ দিয়ে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বা ধুলোয় মাখামাখি হয়ে দিনরাত একটানা ডিউটি করে করে তাদের মন বেদনার্ত হলেও শৃঙ্খলা ভাঙ্গেন না তারা। পুলিশ নিজেদের পরিবারের মায়া ত্যাগ করে ছুটিছাটা আরাম আয়েশ ভুলে দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা দিয়ে যায় প্রতিটি উৎসব পার্বণেই।

তারপরও মানুষ বা মিডিয়ার সকল সমালোচনার ঝড় তাদেরকেই বিদ্ধ করে একচ্ছত্রভাবে। কিন্তু, ভুল ভ্রান্তির বাইরে কেউ আছেন এমনটা কারো বলবার সাধ্য নেই। তাই অনেক পুলিশ সদস্য নিদারুণ দুঃখবোধ নিয়েই বলেন, ‘কি বিচিত্র এক সমীকরণ! ঈদের নামাজ কিংবা পারিবারিক আনন্দ ত্যাগ করে দিন-রাত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে পুলিশ। তবুও পুলিশ অজনপ্রিয় থেকে যাচ্ছে। পুলিশের কষ্টের চূড়ান্ত ফল হিসাবে অর্জিত সাফল্য অদৃশ্য, কিন্তু ব্যর্থতাগুলো বোল্ড, আন্ডারলাইন্ড, কালারফুল হয়ে টিভি স্ক্রলে আস্তে আস্তে বাম দিকে দৌঁড়ায় এবং পত্রিকার প্রথম পাতার রসময় খবর হয়ে ফোটে উঠে।

আমাদেরই মতো মানুষ বলেই পুলিশেও খলচরিত্রের দেখা মেলে সহসা। এই যেমন ধরুণ রাজন হত্যাকারী কামরুলকে টাকা খেয়ে সৌদি পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া বা রাজনের মা বাবার অভিযোগের ব্যাপারে উদাসীনতা দেখানো পুলিশ আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে টাকার কুমির বনে যাওয়া অসংখ্য নীতিভ্রষ্ট পুলিশ আমরা চিনি। অনেক সময় টাকার বিনিময়ে নির্যাতিতের পক্ষে না থেকে ভয়ঙ্কর নির্যাতনকারীর পক্ষেই যায় পুলিশ। বিপথগামী অসাধু পুলিশের নেতিবাচক কর্মকান্ডে তাদের দুর্নাম বিস্তর। পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিধিবিধান অনুযায়ী অনেকের শাস্তিও হচ্ছে।

কিন্তু তাই বলে কি মানবিকবোধসম্পন্ন পুলিশদেরও একই কাতারে ফেলবেন? যারা সত্যিকারেই জনগণের পক্ষে থাকে তাদেরকেও গণহারে খারাপ পেশাজীবি বলে গালাগাল দিতে থাকবেন? জাতীয়তাবাদী-জামায়াতীদের আন্দোলনের সময় রাজশাহীতে শিবিরের গুন্ডা-পান্ডারা মাথা থেতলে দিলে যে পুলিশ সদস্যটি প্রাণ হারান তাঁর জন্য কি আপনারও প্রাণ কাঁদবে না? একবার কি ভাবনায় আসবে না, কক্সবাজারে যে পুলিশ সদস্যটি ছিনতাইকারীকে জাপটে ধরতে গিয়ে মারা গেলেন। তিনি কোন প্রেক্ষিতে নিজের জীবন বিপন্ন করে সরাসরি ছুড়িসজ্জিত ক্রিমিনালকে ধরতে গেলেন? তার মানে হলো, তাঁর কাছে এমন কোনো আধুনিক অস্ত্র বা আধুনিক প্রশিক্ষণ ছিল না, যা দিয়ে আসলে দূর থেকেই শত্রু ঘায়েল করা যায়। আপনি শুধু পুলিশের সেবাই চাইবেন তাঁকে সাপোর্ট দেবেন না তা কী করে হয়?

আপনি বিপদগ্রস্ত হলে কেন কিভাবে আসলে পুলিশ এগিয়ে আসবে, এখান থেকে উত্তর মিলিয়ে নিতে পারেন। পাবিলিকের টাকায় পুলিশ চলে একথা সত্য। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালন করতে গিয়ে বেপরোয়া তান্ডবকারী সেই পাবলিকের হাতে যখন নির্মমভাবে তাদের সদস্যরা প্রাণ হারান এবং সেই দৃশ্য টেলিভিশনে লাইভ দেখানো হয়, তা স্বচক্ষে দেখে পুলিশ হৃদয়ও কাঁদে বৈকি! তাদের মনেও প্রশ্ন জাগে, পুলিশ এভাবেই মরে, মৃত্যু তার প্রাপ্য! গভঃমেন্ট সার্ভিস হোল্ডারদের মধ্যে সমমর্যাদার অন্যদের চেয়েও সমবেতনেই অমানুষিক শ্রম দিতে হয় পুলিশদের। প্রয়োজনের তুলনায় এক চতুর্থাংশ পুলিশ সদস্যই ৩০ দিনের ১৮ দিনই পরিবার সংসার ভুলে ঘুমহীন রাত্রীকালীন ডিউটি করে যান ১৬ কোটি মানুষকে নিরাপদে রাখবার প্রয়াসে।

তেমন একটি বাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্যের কোন অপরাধ বা অক্ষমতার বিষয়টিকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাকে জনগনের বিপক্ষে দাঁড় করানো সমীচিন কিনা তা ভেবে দেখবার সময় এসেছে। যতই খারাপ ভাবি আর গালাগাল করি পুলিশ বাহিনী ছাড়া একটি সভ্য সমাজের অস্তিত্ব কি সম্ভব? আমরা পুলিশের নায়কদের কথা বেমালুম চেপে যাই বা ভুলে যাওয়ার বাহানা করি। কিন্তু অসাধু পুলিশের কুকীর্তিকে ফলাও করে প্রচার করে পুরো বাহিনীকেই নেগেটিভ ট্রেন্ড বানিয়ে ফেলি। কিন্তু এই অসাধুরা কি আমার আপনার পরিবারের বাইরের কেউ?

একবারও কেন জোর দিয়ে জানান দেই না, পুলিশের ব্যার্থতা ওভারকামের সূত্রটা আসলে কি? কোথায় তাদের অভাব? তার সম্পদ বা জনবলের সীমাবদ্ধতা কতটুকু? কি ভয়াবহ চাপ তাদের? আমরা নিশ্চয় পারি একজন অসৎ পুলিশের কর্মকান্ডের নিক্তিতে তাদের না মেপে বরং পুলিশের নায়কদের ত্যাগকে মহিমান্বিত করে মানবীয় বিবেক বোধসম্পন্ন, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল বাহিনী গড়ে উঠায় সাহায্য করতে।

একজন পুলিশের দিন শুরু হয় খুনোখুনির সংবাদ পেয়ে। তান্ডব বা রায়ট সামাল দিতে দিতেই দুপুরের খাবার পর্ব সারতে হয়। বৈকালিক নাস্তার সময় তার জন্য অপেক্ষা করে কোনো ধর্ষণের খবর। ছিনতাই বা ডাকাতির কাহিনী সামাল দিতে দিতে রাতের খাবার কোনো রকমে শেষ হয়। ভোরের দিকে আবার ওসির ফোন, সশস্ত্র দস্যুরা ৫ জনের লাশ ফেলে দিয়েছে, এখনি বের হতে হবে। এমন ধারার অপরাধ রাজ্যের মনোবিকারিক এক অবস্থার মধ্য দিয়েই চলে পুলিশের ২৪/৭ এর থ্যাংকলেস জব। পুলিশের কাছে রাত দিন বা যুদ্ধ শান্তিকালীন অবস্থা বলে কিছু নাই।

২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানী শাসন, স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়া এরশাদের সামরিক শাসন মিলে আড়াইশো বছর ধরে এই পুলিশ বাহিনী ব্যবহৃত হয়ে আসছে সাধারণ মানুষকে দমিয়ে রাখতে। সেই উদ্ভট ট্রাডিশন রাতারাতি দূর হয়ে যাবে বলে যারা অলীক স্বপ্ন দেখেন, তাদের নিজেদেরই আগে শোধরাবার সময় এসেছে।

সকাল বেলা ছোট্ট বাবুটির কপাল বা কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে যে পেশাজীবী মানুষটি ঘর থেকে বের হয়ে তাঁর কাজে যান। কাজ শেষে সন্ধ্যায় নিশ্চিন্তে সুস্থ্য শরীরে ঘরে ফিরবার অধিকার আছে তাঁর। আর সেই প্রতিশ্রুত অধিকারটি সমুন্নত হতে পারে কেবল ব্যক্তির ইতিবাচক ধারায় বদলে যাবার সদিচ্ছায়। আমাদের সবার মনে মানবপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম ও দেশাত্ববোধ জাগ্রত হোক। শান্তি গৃহের খুঁজে যেন কেঁদে কেঁদে বেড়াতে না হয় আমাদের। আমরা যেন জননীর চরণতলে বসে থেকে জননী বলে ডাকবার সুখ অনুভব করতে পারি। জয় হোক আমাদের দেশনায়কদের।

-লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

এই বিভাগের আরো সংবাদ