আজকের শিরোনাম :

পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও মারাত্মক এই করোনাভাইরাস

  গাজীউল হাসান খান

২১ মার্চ ২০২০, ০৯:৩৪ | অনলাইন সংস্করণ

নীরব ঘাতক করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও সম্ভবত তার প্রকোপ কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষকে। তারা হচ্ছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও তাঁদের কর্মী বাহিনী। ভারতে এনআরসি কিংবা সিএএ অর্থাৎ নাগরিকত্ব আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীরা এখন লাগাতার গণজমায়েত ও মিছিল-মিটিংয়ের ব্যাপারে বেশ কিছুটা গা ঢিলে দিয়েছে। কারণ গণজমায়েতে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ ছোঁয়াচে বালাই দ্রুত বিস্তার লাভ করার ঝুঁকি রয়েছে বলেই সমাবেশের ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা ভাটা পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বিরোধীদলীয়, বিশেষ করে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে। তারা সাম্প্রতিককালে তাদের দলনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এখানে-সেখানে দু-একটি মানববন্ধনে কিংবা ছোটখাটো গণজমায়েতের ব্যাপারে উদ্যোগী হলেও এখন মনে হয় তাতেও ভাটা পড়েছে। ঢাকার প্রেস ক্লাব ও তার আশপাশে দু-চারজন নেতাকর্মীকে দেখা গেলেও ইদানীং কোনো মানববন্ধন কিংবা ছোটখাটো গণজমায়েতও খুব একটা দেখা যায়নি। সাংবাদিকদের, বিশেষ করে মাঠপর্যায়ের রিপোর্টারদের ওপরও যে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েনি; তা নয়। তবে মহানগরী ঢাকায় নির্মীয়মাণ মনোরেল প্রকল্পের জন্য অনেক জায়গায় আজকাল গণজমায়েত, এমনকি মানববন্ধনও করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রেস ক্লাব কিংবা হাইকোর্টের সামনেও অব্যাহত গতিতে চলছে মনোরেলের কাজ। তাতে আজকাল এসব জায়গায় গণজমায়েত কিংবা মানববন্ধন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। ফলে বিএনপির কোনো কোনো নেতাকে প্রেস ক্লাবের সামনের বাগানের কোনায় মাঝেমধ্যে ব্রিফিং করতে দেখা যায়।

এ রকম একটি বিরাজমান পরিস্থিতিতে দেশের সরকার ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা করোনাভাইরাস কিংবা তার প্রভাব ও বিস্তার রোধ সম্পর্কে জনগণকে হুঁশিয়ার করার কিংবা তাদের কাছে যাওয়ার কোনো হেতু খুঁজে পাচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা মনে করে, করোনাভাইরাস সম্পর্কে তাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। এ ব্যাপারে জনগণের উদ্দেশে কিছু বলা কিংবা তাদের পাশে দাঁড়াতে হলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে প্রয়োজনীয় অর্থাৎ জনগণের চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসক কিংবা স্বাস্থ্যকর্মীর যথেষ্ট অভাব। সাংবাদিকরা এ বিষয়ে যে পরিমাণ প্রবন্ধ লেখা প্রয়োজন, তথ্যের অভাবে অর্থাৎ পরিষ্কার জ্ঞানের অভাবে তেমন কিছুই করছেন না। অপরদিকে চিকিৎসকরাও দু-একটি টেলিভিশন টক শোতে মাঝেমধ্যে যা বলেন তা নিতান্তই সীমিত গণ্ডির মধ্যে ঘুরাফেরা বলে মনে হয়। এ ব্যাপারে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিতভাবে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে যে প্রতিবেদন পাওয়া যায়, তাই একমাত্র ভরসা। গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসের বিস্তারকে একটি বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তারা বলেছে, ইউরোপ, আমেরিকা, চীন ও জাপান এ ভাইরাসের প্রতিষেধক বের করতে এখন প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। একযোগে চলছে করোনাভাইরাস নিয়ে তথ্য বিনিময় এবং সর্বাত্মক গবেষণা। তাতেও করোনাভাইরাসের কার্যকরী প্রতিষেধক হাতে আসতে এক থেকে দেড় বছর সময় লেগে যেতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারে সফল হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। এর মধ্যে বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই এ ভাইরাস কমবেশি ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানা গেছে। চীনের চেয়েও বিশ্বের অন্যত্র এ ভাইরাস ১৩ গুণ বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। এটি এখন প্রায় অপ্রতিরোধ্য গতিতেই ছড়াচ্ছে বলে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান মনে করছে। এর বিরুদ্ধে যতটুকু সম্ভব ব্যবস্থা নিতে তারা উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে।

করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে বিশ্বব্যাপী নেতৃস্থানীয় বিমান সংস্থাগুলো বিভিন্ন রুটে তাদের আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো ক্রমেই এখন স্থগিত করার ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র আপাতত এক মাসের জন্য ইউরোপীয় যাত্রীদের ভ্রমণ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। সে কারণে জাতীয় সংস্থা বাংলাদেশ বিমানসহ অন্য এয়ারলাইনগুলো ভারতের বিভিন্ন স্থানে তাদের ফ্লাইট বাতিল করে চলেছে। করোনাভাইরাসে সরকারিভাবে বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজারের বেশি আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর কথা ঘোষণা করা হলেও এ ক্ষেত্রে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। ধরে নেওয়া হয়েছে, করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা কিংবা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ১৭ মার্চ থেকে ‘মুজিব জন্মশতবার্ষিকী’ উদ্যাপনের অনুষ্ঠান বিভিন্ন পর্যায়ে অভাবনীয়ভাবে বাতিল ঘোষণা করেছে। সরকারি এবং বিভিন্ন দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে যে মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরে অর্থাৎ চলতি বছরের সুবিধাজনক সময়ে পালন করা হবে। সে কারণে ১৭ মার্চ ঘোষিত বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান বাতিল এবং কিছু কিছু অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্তভাবে পালন করা হয়েছে। এতে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বাংলাদেশ সরকার করোনাভাইরাসের প্রকোপকে একটি মহামারি হিসেবে গ্রহণ করেছে। এবং এ মারাত্মক ভাইরাস প্রতিরোধে সাধ্যানুসারে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এক অর্থে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এটি আমাদের জন্যও একটি দুর্যোগ হিসেবে এসেছে, যা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।

মনে পড়ে ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ওপর নিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের কথা। তখন তৎকালীন পাকিস্তানের সর্বত্র চলছিল সাধারণ নির্বাচনের প্রচারাভিযান কিন্তু সে প্রলয়ংকরী ঝড়ে কল্পনাতীত বিপর্যয়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন নির্বাচনী প্রচারাভিযান বন্ধ করে দিয়ে ত্রাণকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তখনকার অশীতিপর বৃদ্ধনেতা মওলানা ভাসানী ছুটে গিয়েছিলেন ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত এবং বিপন্ন মানুষের কাছে। সে ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে। সে দুর্যোগের সঙ্গে বর্তমান দুর্যোগের কোনো তুলনা চলে না। তবে সে দুর্যোগ ছিল আকস্মিক। সেদিনের সে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব ছিল সাময়িক। কিন্তু মৃতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অসামান্য। তার তুলনায় করোনাভাইরাসের মতো মহামারির প্রকোপ কত দিন, কত মাস স্থায়ী  হবে, তা কেউ জানে না। এ ঘাতক মহামারিতে শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী কত মানুষ প্রাণ হারাবে তা কেউ বলতে পারছে না। বাংলাদেশেই বা কত মানুষ আক্রান্ত হতে পারে তাও কেউ জানে না। সুতরাং এ বিষয়টিকে সহজভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ মুহূর্তে প্রয়োজন করোনাভাইরাস সম্পর্কে দেশব্যাপী জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে আমাদের সীমিত পরিমাণ চিকিৎসক কিংবা স্বাস্থ্যসেবা দানকারীরা যথেষ্ট নয়। এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তিকে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের বিশাল জনসংখ্যার মধ্যেই বসবাস করে। তারা পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে এ করোনাভাইরাস সম্পর্কে হুঁশিয়ার করতে পারে। জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে। সেদিন আমার এক সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধু আমাকে বলছিলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে কি আমাদের রাজনীতিকদের কিছুই করার নেই? সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে তারা যেমন বিপন্ন মানুষের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, আজও তেমন একটি অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। করোনাভাইরাস সর্বত্র নীরবে-নিভৃতে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের মধ্যে মানুষের যাতায়াত ক্রমে ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। জনসমাবেশ থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

বর্তমান বিশ্ব দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে। দেখেছে বহু প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও দুর্যোগ। মহামারি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মানুষ দেখেছে কলেরা, বসন্ত, টাইফয়েডসহ অনেক রোগের প্রকোপ। কিন্তু করোনাভাইরাসের মতো একযোগে এত সবগ্রাসী বিস্তার এর আগে তেমনভাবে আর দেখা যায়নি। পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রোগবালাই মহামারি আকারে বিস্তারের কথা উল্লেখ রয়েছে। সে কারণে দেশের মসজিদগুলোতে গত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে বিশেষভাবে মোনাজাত করা হচ্ছে আল্লাহর সাহায্যের জন্য। মানুষকে হুঁশিয়ার করা হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্যসচেতন হওয়ার জন্য। এখন শোনা যাচ্ছে, বিশ্বের কিছু কিছু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে জুমার নামাজের জামাতও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে। ক্রমে ক্রমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তারপর কি বন্ধ হয়ে যাবে অফিস-আদালত ও সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা? অকার্যকর হয়ে যাবে সব বিশ্বব্যবস্থা। অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের অর্থনীতি ও বাণিজ্যব্যবস্থা এক মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এবং তার অশুভ প্রভাব পড়েছে বিশ্বের অন্যান্য শিল্পসমৃদ্ধ দেশ ও অর্থনীতিতে। ইউরোপ এবং ব্রেক্সিট-পরবর্তী ব্রিটেন এক দারুণ অর্থনৈতিক সংকটে এখন থরথর করে কাঁপছে। বন্ধ হয়ে গেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সব আস্ফাালন। বিশ্ব এখন বিস্ময়ে হতবাক।

একটি অণুসম ভাইরাস কিভাবে বিশ্বকে অচল করে দিতে পারে, তা বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে বিশ্ববাসী। কিভাবে করোনাভাইরাস নামক একটি মারাত্মক জীবাণু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে অপ্রতিরোধ গতিতে—তাও দেখছে বিশ্বের মানুষ। এসবের কাছে আমরা অর্থাৎ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী মানুষ কত অসহায় তা আবার প্রমাণিত হলো। ক্ষুদ্র করোনাভাইরাসের কাছে পারমাণবিক শক্তিও অচল ও অসহায়। এ মারাত্মক ভাইরাসের প্রতিষেধক কবে নাগাদ সাধারণ মানুষের হাতে এসে পৌঁছবে তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। এ সম্পূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন রাখতে হবে। এ পর্যায়ে এসে অসহায়ের মতো তাকিয়ে তা থেকে বিশেষজ্ঞদের মতো রাজনীতিকদেরও একটি ভূমিকা রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

লেখক: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

মেইল : [email protected]

এই বিভাগের আরো সংবাদ