আজকের শিরোনাম :

তারুণ্যের বিদ্রোহ-ভালোবাসার কলকাতায় শেখ মুজিবুর রহমান

  সৌমিত্র দস্তিদার

১৮ মার্চ ২০২০, ২০:১৯ | অনলাইন সংস্করণ

মূলত কংগ্রেসের ভেতরের দক্ষিণপন্থি শক্তি ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু মহাসভার প্রবল আপত্তিতেই বাংলা ভাগ হয়েছিল। বিভক্ত বাংলার পূর্ব অংশ-বরিশাল, খুলনা, যশোর, ঢাকা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেমন শরণার্থী ঢেউ আছড়ে পড়েছিল এপারে। তেমনি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া দিনাজপুর বর্ধমান নানা জায়গা থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন মুসলিম জনতা। নিতান্তই বাধ্য হয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের বড় অংশ। জনশূন্য হয়ে গেল জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট বিডন স্ট্রিট মানিকতলা বাগমারি ঢাকুরিয়া বেলেঘাটার বিপুল এলাকা। জনশূন্য বললাম বটে, আসলে কথাটা হবে মুসলিমশূন্য। এভাবেই তারুণ্যের, বিদ্রোহ, ভালোবাসার কলকাতা থেকে চিরকালের মতো চলে গেলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

সময় পেলেই কলকাতার অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে একটা অদ্ভুত ঘোর লেগে যায়। মনে হয় এ যেন এক অচেনা কলকাতা। ইতিহাস এখানে যেন থেমে রয়েছে। জাফরি দেওয়া বড় বড় বাড়ি। মুঘল, পাঠান ও ব্রিটিশ স্থাপত্যের চমৎকার মিশেলে পুরনো অট্টালিকা। বুড়ো আতরওয়ালা, নামি, অনামি রেস্তোরাঁয় হান্ডি বিরিয়ানির খুশবু, ঠুনঠুন করে চলে যায় প্রাচীন রিকশা। জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট, কলুটোলা, পার্ক সার্কাসে, বেকবাগান, মার্কুইস স্ট্রিট, ওয়েলেসলি, রিপন স্ট্রিট, আলিমুদ্দিন-গলির গলিতস্য গলিতে হেঁটে ঘুরতে ঘুরতে আপনি আনমনে পৌঁছে যাবেন ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগের এক শহরে। যেখানে অবিভক্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের এক বিপুল প্রভাবশালী অংশের রোজনামচা লেখা হতো।

দেশভাগ, মুসলিম জাগরণ, দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতার জানা-অজানা বহু আখ্যানের জন্ম হয়েছিল একদা এই তথাকথিত কম চেনা শহরের অলিগলিতে। এখন কেউ ফিরেও তাকায় না হারিয়ে যাওয়া এই স্মৃতির শহরের দিকে। অথচ এক দিন মাত্র সত্তর-আশি বছর আগে এই মহল্লায় মহল্লায় ছিল মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলনের গড়। দেশভাগকে শুধু দ্বি-জাতিতত্ত্ব বা ধর্মীয় কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা বোধ হয় অতি সরলীকরণ হয়ে যায়। যদিও আমাদের চেনা ইতিহাস পাঠে বছরের পর বছর এই বিভাজনের রাজনীতিতে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিশ্লেষণে জায়গা পেয়েছে। কিন্তু এখন যখন নতুন করে ইতিহাসের পুনঃপাঠ জরুরি হয়ে পড়েছে, তখন একমাত্রিক দৃষ্টিতে না দেখে দেশভাগের পেছনে বহুমাত্রিক কারণ খোঁজার সময় এসেছে।

সময় হয়েছে স্বাতন্ত্র্যবোধের বিকাশ কেন ও কীভাবে হলো, তা নিয়ে গভীর গবেষণার। জমি বা ভূমিস্বত্ব নিয়ে বিশদে আলোচনার। জাতীয়তাবাদের রাজনীতি কোন কোন কারণে নিছক হিন্দু আধিপত্যবাদী রাজনীতির চেহারা নিল, তা বোঝার। মুসলিম লীগের রাজনীতির ভেতরকার দলাদলি, ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্ব সব নিয়েই নতুন নতুন গবেষণার সময় এসেছে। উপমহাদেশেই ধর্ম এখন এমন এক ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে, সেখানে কাজটা কঠিন কিন্তু তবু নতুন গবেষণা করতে গেলে নির্মোহ, পক্ষপাতহীন হতে হবে। ইতিহাস কখনো কারও নিজস্ব সম্পত্তি নয়। সে চলমান, জীবন্ত। ইতিহাসের দায় শুধু সত্যের কাছে।

এই ইতিহাসের খোঁজে বেরিয়েই তো যত বিপত্তি। এত ভ্যান ভ্যান করার বা ধান ভাঙতে শিবের গীত গাওয়ার দরকারই হতো না, যদি না অখণ্ড বাংলার রাজধানী কলকাতার মুসলিম জনপদগুলো, দেশভাগ নিয়ে ডকুমেন্টারি করব বলে চষে না বেড়াতাম। এক একটা বাড়ি দেখছি আর ভাবছি এইটাই কি, এ বাড়িতেই কি থাকতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী! কিংবা এখানেই ছিল আজাদ কাগজের অফিস! পাগলের মতো এক-এক দিন সক্কাল সক্কাল খুঁজতে যেতাম ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ভারতীয় উপমহাদেশের কুখ্যাত গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের উপদ্রুত এলাকাগুলোয়।

ইতিহাস তো শুধু রাজারাজড়া নবাব নেতানেত্রীদের কথা লেখে। বেলেঘাটার হায়দর মঞ্জিলে যাই। ও বাড়িতে গান্ধীজি অনশনে বসেছিলেন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা থামাতে। স্বাধীনতার আগ এবং স্বাধীনতার দিন। ১৫ আগস্ট। ১৯৪৭। কয়েক মাস আগে দুই বুড়ো মানুষকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা গান্ধীজিকে দেখেছিলেন কি না! দুজনেই বলেছিলেন, ছোটবেলায় মহাত্মা গান্ধীকে তারা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তাদের কাছে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছিলাম। ১. রোজ গান্ধীজির কাছে ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে বসে থাকতেন সোহরাওয়ার্দী। টকটকে ফর্সা সুন্দর অভিজাত সোহরাওয়ার্দীর নাম তারা পরে জেনেছিলেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর লাজুক নম্র বসার ভঙ্গিটি সেই ছোটবেলাতেই তাদের ভালো লেগেছিল। অথচ এই নম্র সোহরাওয়ার্দীর কোনো অস্তিত্ব পশ্চিমবঙ্গে নেই। এখানে তিনি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের এক ও অদ্বিতীয় ‘খলনায়ক’। বুড়ো দুজন আর যেটা বলেছিলেন, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্তত দেশভাগের ইতিহাসের উপাদানে। বলছিলেন ‘এই এলাকার প্রায় পুরোটাই তখন মুসলিম অধ্যুষিত। কিছু কিছু পাড়া শুধু দ্বীপের মতো জেগে ছিল হিন্দু মহল্লা হয়ে। কিন্তু আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না। মেলা মেশার তো প্রশ্নই নেই। পরস্পরকে চিনতাম না বলে এক ধরনের আতঙ্ক ছিল দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই। এ ওকে সন্দেহ করত আর ও ওকে। দূর থেকে আল্লাহ আকবর আওয়াজ উঠলেই হিন্দুপাড়ায় ভয় ধরত এই বুঝি হামলা হবে। আমরা তখন কত্ত ছোট কিন্তু বড়দের নির্দেশে নারায়ে তাকবির শুনলেই আমরাও জোরে চিৎকার করে উঠতাম বন্দেমাতরম বলে।

৪৬-৪৭ সালে যদি অবিশ্বাস ও ঘৃণা নিজেদের মধ্যে এ ধরনের হয়ে থাকে, তাহলে দেশভাগ আটকে রাখা যে অসম্ভব ছিল, তা বুঝতে কোনো পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই। গান্ধীজির কলকাতার বাসস্থান বা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর এলগিন রোডের বাড়ি কিংবা অখণ্ড বাংলার অন্যতম তাত্ত্বিক শরৎচন্দ্র বসুর বাসস্থান ও হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জীবনযাপনের সব নিদর্শন চাইলেই আপনি খুঁজে পাবেন। কিন্তু তন্ন তন্ন করে খোঁজ করলেও কোথাও চট করে পাবেন না সোহরাওয়ার্দী, আবদুল হাশিম কিংবা ফজলুল হকের স্মৃতি। কোনো অজ্ঞাত কারণে অদ্ভুতভাবে সম্পূর্ণ মুছে ফেলা হয়েছে ৪৬-৪৭ সালের বর্ণময় মুসলিম ইতিহাস।

অথচ দেশভাগের আগে ও পরের সময়টুকু বাদ দিলে শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক ক্ষমতা গড়ে উঠেছিল যে ইসলামিয়া কলেজে, তা অবশ্য আজও কলকাতার অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই ইসলামিয়া এখন হয়েছে মৌলানা আজাদ কলেজ। দেশভাগের আগে আগে অশান্ত সময়ে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ সাহেব। কখনো যেতে যেতে ইচ্ছা হলে অনুমতি নিয়ে ঢুকে পড়ুন ভেতরে। পুরনো লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখে নিতে পারেন বোর্ডে টাঙানো ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সম্পাদকের তালিকায় জ্বলজ্বল করছে ‘এম রহমানের’ নাম।

ওয়েলিংটন স্কয়ার থেকে রিপন স্ট্রিট, ওয়েলেসলি, আলিমুদ্দিন, মার্কুইস স্ট্রিট নিউ মার্কেটের কাছাকাছি বৃত্তের মধ্য থেকে গেছে এক ইতিহাসের নানা মাইলফলক। এখন এসব এলাকায় ছোট-বড় হোটেলে ভিড় করে থাকেন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার মানুষজন। রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, যশোর, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ঢাকার অসংখ্য মানুষ। কেউ আসেন ডাক্তার দেখাতে। কেউ বেড়াতে। তাদের মধ্যে খুব কম মানুষই থাকেন, যারা ফেলে আসা অতীতের খোঁজ নেন। একটু দূরে, হাঁটাপথে বেকার হোস্টেল। চারতলার ২৪ নম্বর ঘরে থাকতেন তরুণ ছাত্রনেতা মুজিবুর। হেঁটে ঘুরতে ঘুরতে কল্পনায় দেখতে থাকুন তরুণ মুজিবকে। ওয়েলেসলি লেনের ভেতরে সামান্য গেলেই এক নম্বর বাড়ি ছিল মুসলিম লীগের অফিস। সোহরাওয়ার্দীর ডেরা ছিল কাছাকাছিই। তরুণ মুজিবুর রহমান প্রায়ই যেতেন সেখানে। সামান্য দূরে রিপন স্ট্রিটের ৬ নম্বর বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন মুসলিম লীগের তাত্ত্বিক নেতা ও যুক্তবাংলার প্রবল সমর্থক আবুল হাশিম। পরে অবশ্য তিনি উঠে গিয়েছিলেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ভাড়া বাসায়। মন খারাপ নিয়ে পথ চলি। ফুটপাতের ওপর বৃদ্ধ বই বিক্রেতা সান্ত্বনা দেয়, যা যাওয়ার তা যাবেই বাবুজি। কিন্তু তুমি দেখবে ইতিহাস সব মনে রাখে।

শেখ মুজিবুর রহমানের ১০০ তম জন্মবার্ষিকী এবার।  কতভাবে তাকে স্মরণ করবেন পণ্ডিতরা। আমি নিতান্তই ইতিহাসের এক সামান্য প্রেমিক। ইতিহাসের টানেই ঘুরে বেড়াই অতীতের খোঁজে। শেখ সাহেব শুধু কোনো নাম নন, ব্যক্তি নন। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের এক শক্তিশালী চরিত্র। পার্শ্বচরিত্র থেকে কীভাবে তিনি রাজনীতির মহানায়ক হয়ে উঠলেন, তা সত্যিই রোমাঞ্চকর। কলকাতা তার মনন গড়ে দিয়েছিল। হয়তো ভবিষ্যৎ লক্ষ্যও। তরুণ মুজিবুর রহমানকে চিনতে গেলে তার সময়কে জানতে হবে। দেশভাগের নেপথ্যে কারণ, দাঙ্গা শেষ অবধি খণ্ডিত স্বাধীনতা পাওয়া।

এখন খুব কম লোকই কলকাতায় তরুণ মুজিবকে খোঁজ করেন। কলকাতায় তিনি ছিলেন নিতান্তই এক ছাত্রনেতা। আর পূর্ব পাকিস্তানে তার রাজনৈতিক জীবন বিকশিত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন। ফলে ওপারের উন্মাদনা এপারে আশা করাও অন্যায়। তবু একেবারে কিছু হবে না বা হচ্ছে না, তাও নয়। দূতাবাসে অনুষ্ঠান হবে। মুজিবুর রহমানের স্মৃতির বেকার হোস্টেল বা ইসলামিয়া কলেজেও নিশ্চিত হবে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান। মালা দেওয়া, ফুল দেওয়া এবং অবশ্যই গুরুগম্ভীর ভাষণ। উপমহাদেশের সর্বত্রই নানা আড়ম্বরের আড়ালে প্রকৃত মানুষটি কেমন যেন হারিয়ে যান। অন্তত আমার তাই মনে হয়। শেখ সাহেবের জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছিল ১৯৪৬ সালের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং বা বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যাই বলি না কেন! আমি তাই কল্পনায় হাঁটতে থাকি যে পথ দিয়ে এক দিন হেঁটে যেতেন মুজিবুর রহমান। শেখ সাহেবের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাতায় পাতায় লেখা আছে ওই সময় তার মানসিক যন্ত্রণার বিস্তারিত বিবরণ। পাশাপাশি বইটি পড়লে বোঝা যায় পশ্চিমবঙ্গের চেনা ইতিহাসে যেভাবে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের লোকরা দাঙ্গার জন্য দায়ী বলে চিহ্নিত হয়ে আছে, বাস্তবে তা মোটেও সত্যি নয়।

শেখ সাহেবের সময়ে, তার কোনো বন্ধু বা আত্মীয় অন্তত কলকাতায় আর বোধহয় কেউ নেই। ১০০ বছর বা তার কাছাকাছি কারও বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ঘটনাচক্রে ছিয়ানব্বই বছরের একজন এখনো আছেন যিনি বেকার হোস্টেলে কিছুদিন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। পাশাপাশি ঘরে। একই ধরনের চারতলায়। মুজিবুর রহমানের চব্বিশ নম্বর ঘরের পাশে। তিনি নীহার চক্রবর্তী। আতাউর রহমানের বিখ্যাত পত্রিকা চতুরঙ্গের অন্যতম মালিক। এই প্রবীণ বয়সেও আশ্চর্য সতেজ তার স্মৃতিশক্তি। কথা বলতেও ভালোবাসেন খুব। কথায় কথায় বলছিলেন

‘আমার সঙ্গে মুজিবুরের খুব যে একটা মাখোমাখো সম্পর্ক ছিল, তা নয়। তবে চিনতাম। ও যেবার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হয়, আমিও সেবার স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি হই। মুজিবুর মুসলিম লীগের ছাত্র শাখার। আর আমি বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের। তখন নানা সময়ে দেখাটেখা হয়েছে। দুটো আলাদা সংগঠনের লোক হলেও আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল। মুজিবুর রহমানের খুব প্রশংসা শুনতাম সিনিয়র দাদাদের কাছ থেকে। আর অন্যান্য কলেজের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকেও। শুনতাম ও খুব ভালো সংগঠক। দারুণ বক্তৃতা দেন। ভীষণ পরোপকারী ও অসাম্প্রদায়িক। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের রিহার্সাল মুজিবের হয়ে গিয়েছিল কলকাতায়। ৪৬-এর ভয়ংকর দাঙ্গার সময় মুজিব শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াননি, প্রাণবিপন্ন করে সাধ্যমতো পাশে থেকেছেন হিন্দু প্রতিবেশীদেরও। মুজিবুর রহমানের আর একটা মস্ত গুণ ছিল, যাকে একবার দেখেছেন, তাকে কখনো ভুলতেন না। নাম-ধাম ঠিক মনে রাখতেন। ৪৬-৪৭-এর পর মুজিবের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই। শুনতাম ওর রাজনৈতিক উত্থানের সব রোমাঞ্চকর কাহিনী। তারপর বাংলাদেশ হওয়ার পর মুজিব যখন কলকাতায়, তখন একবার একজন এসে বললেন, মুজিবুর রহমান আপনাকে দেখতে চেয়েছেন। অমুক জায়গায় আছেন। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছে আপনাকে যেভাবেই হোক ধরে নিয়ে যেতে।

আমি একটু কিন্তু কিন্তু করছিলাম। উনি এখন একটা দেশের রাষ্ট্রনায়ক, আমি গিয়ে কী কথা বলব! যা হোক, আমার ওজোর-আপত্তি শোনা হলো না। আক্ষরিক অর্থেই ধরে নিয়ে যাওয়া হলো শেখ সাহেবের কাছে, যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই-ই। চারপাশে লোকজন ওকে ঘিরে রয়েছেন। কে কত আপনজন, তা জানান দেওয়ার একটা যেন প্রতিযোগিতা চলছে। আচমকাই আমার ওপর চোখ গেল মুজিবুর রহমানের। উনি কিছু বলার আগেই বললাম চিনতে পারছেন? শেখ সাহেব হা হা করে উঠলেন কেন চিনব না! আমার স্মৃতি এত দুর্বল নয়। আমি আমতা-আমতা করে ওনার এক পুরনো বন্ধুর নাম বলতেই শেখ সাহেব চটে উঠলেন ওর নাম শুনতে চাই না। ওকে পেলে ফাঁসি দেব। পরে শুনলাম ওই পুরনো বন্ধুটির ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে খুব খারাপ ছিল। দু-একটা কথা বলে উঠে পড়লাম। শেখ সাহেব বিদায় দিতে দিতে বললেন, পরেরবার ঢাকায় দেখা হবে। দাওয়াত দেওয়া রইল। বুঝলাম, অন্তত এখনো শেখ মুজিবুর রহমান বদলে যাননি। আমাদের চেনা ছাত্রনেতাই থেকে গেছেন।’

ইসলামিয়া কলেজ ও বেকার হোস্টেল দুই জায়গাতেই দুটি সিঁড়ি আছে, যা এখন আর কলকাতায় কোনো বাড়িতে বিশেষ দেখা যায় না। ইসলামিয়া, যা এখন মৌলানা আজাদ কলেজের সিঁড়ি লোহার ঘোরানো আর বেকার হোস্টেলেরটা লোহার। সোজা। তবে বেশ উঁচু। একতলা উঠতেই হাঁফ ধরে যায়। এসব সিঁড়ি, লম্বা বারান্দা, হোস্টেল-লাগোয়া মসজিদ সবকিছুতেই যেন লেগে আছে শেখ মুজিবুর রহমানের ছোঁয়া। শুধু ‘অসাম্প্রদায়িক’ পশ্চিমবঙ্গের কোথাও দেশভাগের আগের লীগের কলকাতা আপনি খুঁজে পাবেন না। ৪০ নম্বর থিয়েটার রোডে গেলে আপনি বুঝতেও পারবেন না যে, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর এই বাড়ি এক দিন অবিভক্ত বাংলার রাজনীতির পীঠস্থান ছিল। সকাল থেকে রাত গমগম করত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ভিড়ে। ওই কর্মীদের ভিড়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আজকের ওয়েলেসলি ফাস্ট লেনে সোহরাওয়ার্দীর আর এক ঠিকানায় গেলেও সেই একই ধরনের জমাট বাঁধা অন্ধকার। উপমহাদেশের একদা গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের ছিটেফোঁটাও আর আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ৮৬-এ লোয়ার সার্কুলার রোডে মৌলানা আক্রম খাঁ প্রতিষ্ঠিত ১৯৩৬ সালের আজাদ পত্রিকার অফিস কিংবা শেখ সাহেবের সাধের মিল্লাত প্রেস সবই এখন শুধুই স্মৃতি। এভাবেই হারিয়ে গেছে ইতিহাসের নানা আকর। জীবন্ত এক অধ্যায় কোনো এক জাদুমন্ত্রে রাতারাতি হয়ে গেছে অদৃশ্য।

আমরা এপারের লোকজন শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করি ধর্মনিরপেক্ষ মহান এক বাঙালি বলে। ওপারের মতো এপারেও তিনি বঙ্গবন্ধু। অথচ শেখ সাহেবের রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দী আজও এখানে, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ও বাম রাজনীতিতে, এমনকি তথাকথিত সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী মহলেও হয়ে রইলেন ৪৬ সালের দাঙ্গার খলনায়ক। বেলেঘাটার যে বাড়িতে দাঙ্গা থামাতে মহাত্মা গান্ধী অনশনে বসে ছিলেন, সেখানে একটা খুব পুরনো ছবিতে সোহরাওয়ার্দীর ঠিক পেছনে বসা প্রায় কিশোর মুজিবুর রহমানকে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। রোগা-পাতলা সাধারণ চেহারা। একটু যেন বেশি লাজুক। তবে চোয়াল শক্ত করা মুখের দিকে তাকালে ভবিষ্যতের মুজিবের আদলটা চেনা যায়।

সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম, শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শঙ্কর রায় সবাই মিলে অখণ্ড বাংলার দাবি করলেন। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলা। শোনা যায়, মোহাম্মদ আলী জিন্নাও রাজি হয়েছিলেন বাংলা ভাগ না করতে। গান্ধীজি ঈষৎ দ্বিধায় ছিলেন। কিন্তু ঘোরবিরোধী ছিলেন না। আসলে ওই সময় ক্ষমতার বৃত্ত থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী।

মূলত কংগ্রেসের ভেতরের দক্ষিণপন্থি শক্তি ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু মহাসভার প্রবল আপত্তিতেই বাংলা ভাগ হয়েছিল। বিভক্ত বাংলার পূর্ব অংশ-বরিশাল, খুলনা, যশোর, ঢাকা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেমন শরণার্থী ঢেউ আছড়ে পড়েছিল এপারে। তেমনি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া দিনাজপুর বর্ধমান নানা জায়গা থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন মুসলিম জনতা। নিতান্তই বাধ্য হয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের বড় অংশ। জনশূন্য হয়ে গেল জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট বিডন স্ট্রিট মানিকতলা বাগমারি ঢাকুরিয়া বেলেঘাটার বিপুল এলাকা। জনশূন্য বললাম বটে, আসলে কথাটা হবে মুসলিমশূন্য। এভাবেই তারুণ্যের, বিদ্রোহ, ভালোবাসার কলকাতা থেকে চিরকালের মতো চলে গেলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক: ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক

[email protected]

এই বিভাগের আরো সংবাদ