আজকের শিরোনাম :

সু চি : হিরো থেকে ভিলেন

  দি ইকোনমিস্ট’র নিবন্ধ

১৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:২১ | আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:২৩ | অনলাইন সংস্করণ

১৯৯১ সালে অং সান সু চিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করেছিল যে কমিটি, সেটি তাকে বর্ণনা করেছিল ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অপরিহার্য এক প্রতীক’ এবং ওইসব মানুষের জন্য একটি প্রেরণা যারা ‘গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও জাতিগত বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে লড়াই করছেন।’


তবে গত সপ্তাহে দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতের (আইসিজে) কোর্টরুমের বাইরে যেসব প্রতিবাদকারী জড়ো হয়েছিলেন, তাদের কাছে তিনি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু- সামরিক বাহিনীর বর্বরতার একজন আত্মপক্ষসমর্থনকারী, জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী এবং গণহত্যায় উৎসাহদানকারী।

‘অং সান সু চি, তোমাকে অভিশাপ’ স্লোগান দিচ্ছিল তারা। তার গাড়িবহর যত এগিয়ে যাচ্ছিল, ঘরের দরজাগুলো তত বিবর্ণ হচ্ছিল, চড়া সুরে টিটকারী ও উপহাস করা হচ্ছিল।

২০১৬ সাল থেকে কেবল পদ-পরিচয় ছাড়া মিয়ানমারের সবকিছুর সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হওয়া সু চি আইসিজেতে গিয়েছিলেন গণহত্যার দায় থেকে নিজের দেশকে আত্মরক্ষা করতে। উল্লেখ্য, গাম্বিয়া মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসির পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ দাখিল করেছে।

মামলাটিতে বিবেচনার বিষয় হল, মুসলিম সংখ্যালঘু গ্রুপ রোহিঙ্গা ১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর থেকে নানা ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটির পশ্চিমপ্রান্তে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোর ওপর উন্মত্তভাবে হামলে পড়ে আর্মি চেকপোস্টে ক্ষুদ্র একটি রোহিঙ্গা গেরিলা গ্রুপের হামলার জবাবে।

আদালত গণহামলা ও মানুষের গলা কেটে দ্বিখণ্ডিত করার আতঙ্কগ্রস্ত বর্ণনা শুনেছেন, যেখানে জ্বলন্ত বাড়িঘরের মধ্যে শিশুদের নিক্ষেপ করা, নারীদের গণধর্ষণ ও লজ্জাস্থানে ছুরিকাঘাতের মতো বর্বর বর্ণনাও এসেছে।

এসব বর্ণনা চলার সময় চুলে তাজা ফুল গুঁজে শান্ত ও স্থির হয়ে বসেছিলেন সু চি। যেভাবে তিনি বহু বছর ধরে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করেছেন নাছোড়বান্দা হয়ে, অনেকটা সেভাবেই বসেছিলেন।

একজন ভদ্রমহিলা যাকে বার্মিজ সামরিক বাহিনী ১৫ বছর বন্দি করে রেখেছিল, তিনিই কিনা সেই সামরিক বাহিনীর সমর্থনে বিশ্ব চষে বেড়াচ্ছেন এখন- এটি অনেককেই বিস্মিত করেছে। এক অর্থে জেনারেলদের সঙ্গে তার লড়াই অব্যাহত রয়েছে।

বেসামরিক সরকারের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য তার কোনো জবাবদিহিতা নেই। ২০১৫ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়ার আগে সামরিক বাহিনী নিজেদের পক্ষে যে বিধি-বিধান বানিয়েছে, তাতে সামরিক বাহিনীর জন্য পার্লামেন্টে এক-চতুর্থাংশ আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।

এটি সংবিধানের যে কোনো সংশোধনীতে ভেটো দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সু চির অনেক ভক্ত রোহিঙ্গা নিপীড়নের দায় থেকে তাকে মুক্তি দিতে চেষ্টা করেছেন এ কথা বলে যে, এটি বন্ধ করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ক্ষমতাহীন এবং এটি করার মাধ্যমে তাকে কেবল দুর্বল ও অসহায় হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।

সু চির দ্য হেগ সফরে ওই বিতর্কের জবাব পাওয়া গেছে। যদিও এটি নিন্দনীয়, তবে বিবেচনায় নেয়ার মতো একটি বাস্তবতা যে, সামরিক বাহিনীর পক্ষাবলম্বনে তারা নীরবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে একে অপরের কাছে প্রকাশ্যে ফিরে গেছেন।

যে কোনো বিবেচনায়, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এ মামলায় সু চির ভূমিকা ছিল নিষ্প্রভ। বিকল্প হিসেবে, তিনি বেশ জোরেশোরে নিজের ভ্রমণের বিষয়টি প্রচার করেছেন, আর বোঝাতে চেয়েছেন, খুবই কম বার্মিজেরই রোহিঙ্গাদের প্রতি সমবেদনা রয়েছে- যাদের তারা ভুলভাবে বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে দেখে থাকে এবং মনে করে তারা মিয়ানমারের বৌদ্ধ চরিত্রের জন্য একটি হুমকি।

দ্য হেগ থেকে ফিরে আসার পর সু চিকে অভিনন্দন জানানোর জন্য মিয়ানমারজুড়ে সমাবেশ হয়েছে, যাতে দেশজুড়ে আনন্দের সঙ্গে তাকে একজন অকুতোভয় রক্ষাকারী হিসেবে অভিবাদন জানানো হয়। এ উপসংহারে না পৌঁছানো কঠিন যে, সু চি রোহিঙ্গা ইস্যুকে ব্যবহার করছেন ২০২০ সালের নির্বাচনে তার সম্ভাব্য বিজয়ের জন্য।

যখন সু চির সামনে সময় এলো, তখন তিনি বিস্ময়করভাবে নিশ্চুপ রইলেন। যারা আশা করেছিলেন সু চি নিজেকে তুলে ধরবেন, তাদের তিনি মোহমুক্ত করলেন। সবার সামনে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে, তার কর্তৃত্বাধীন অনেকের মতো তিনিও রোহিঙ্গারা কোনো নিপীড়নের শিকার হয়নি এমন সাফাই গেয়ে এবং এ ব্যাপারে কোনো দুঃখ প্রকাশ না করে ভিলেনে পরিণত হলেন।

এমনকি রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার ব্যাপকতা এবং এটা যে সেনাবাহিনীই চালিয়েছে, তাও তিনি স্বীকার করেননি। উল্টো তিনি যুক্তি দিয়েছেন, গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়া এবং ভোগান্তির শিকার ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার প্রতিবেশী বাংলাদেশ পালিয়ে যাওয়াকে বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর চলমান সংঘাতের দুর্ভাগ্যজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখতে হবে।

যেখানে সেনাদের নৃশংস কর্মকাণ্ডের প্রমাণ ছিল স্পষ্ট, সেখানে তিনি দাবি করেছেন, কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে। যদিও তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেনাবাহিনীকে বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে তার সরকারের কর্তৃত্বের ঘাটতি রয়েছে। তা সত্ত্বেও সু চির যুক্তি অনুযায়ী, তার সরকারের গণহত্যা সংঘটনের কোনো মনোভাব ছিল না।

এটি অবশ্য সামরিক বাহিনীকে রক্ষা করা বা তাদের ক্ষমা করার জন্য অনুরোধধর্মী কিছু ছিল না। অনেক সম্ভাবনার ক্ষেত্রে এ ব্যর্থতা সু চির জন্য এ সত্য তুলে ধরে যে, তিনি স্পষ্টভাবে একজন জাতীয়তাবাদী। তিনি নিজের দেশকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে দেখে দুঃখবোধ করেন।

তিনি স্পষ্টতই মনে করেন, তার দেশের সব প্রতিষ্ঠান ভালো কাজ করেছে। তবে এটি স্পষ্ট যে, তাদের নিজেদের ঘাটতির ক্ষতি পূরণের জন্য বাইরের হস্তক্ষেপকে সমর্থন করতে তিনি তৈরি নন। সু চি সামরিক বাহিনীর জন্য পুরোদমে ক্ষমাপ্রার্থী নন।

কিন্তু সর্বোচ্চ পর্যায়ে সেটি করার ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাসও করেন না। ভিন্নভাবে বলতে গেলে, তার আত্মবিশ্বাসের একগুঁয়ে অবস্থান, যা কিনা মিয়ানমারকে সামরিক শাসন থেকে বের করে আনতে সহায়তা করেছে, সেটিই এখন দেশটির সবচেয়ে দুর্বল অধিবাসীদের ন্যায়বিচারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ : সাইফুল ইসলাম

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ