আজকের শিরোনাম :

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরার পথ জানা নেই

  মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় ও ব্র্যাড অ্যাডামস

২১ জুন ২০১৯, ০২:০৩ | অনলাইন সংস্করণ

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানরা দশকের পর দশক ধরে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। তবে ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের ওপর যে সহিংসতা চালিয়েছে তার সঙ্গে আগের নিপীড়নের কোনো তুলনাই হয় না। ওই বছর ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের পুলিশ ও সেনা ঘাঁটিতে হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি। এর জবাব দিতে গিয়ে হাজারো রোহিঙ্গাকে হত্যা, শত শত নারীকে ধর্ষণ এবং গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দাবি করে, তারা দেশকে জঙ্গিমুক্ত করতে ‘নির্মূল অভিযান’ চালিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, তারা মিয়ানমারের বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করেছে—রোহিঙ্গা মুসলমানদের জাতিগত নিধন।

আগে থেকেই বাংলাদেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছিল। অতীতে সামরিক অভিযানের পর তারা পালিয়ে আসে। সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখ। এখন মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাদের চেয়ে বাংলাদেশে অবস্থানকারী শরণার্থী রোহিঙ্গার সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। এদিকে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি রাখাইন রাজ্যে তাদের ফিরিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এখনো রাখাইনের অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের ভীতি প্রদর্শন অব্যাহত রাখলেও এই গোষ্ঠীর শরণার্থীদের দুর্দশার প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ কমে আসছে। বাংলাদেশের ক্যাম্পে থাকা বহু রোহিঙ্গার আশঙ্কা, বিশ্ব শিগগিরই তাদের ভুলে যাবে।

এ ঘটনার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে দায়ী করে নিরাপত্তা পরিষদের ব্যবস্থা নেওয়ার রাস্তা বহুদিন থেকেই রুদ্ধ করে রেখেছে চীন ও রাশিয়া। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও নিরাপত্তা পরিষদের বাকি সদস্যরাও ন্যায়বিচার পেতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে শিগগিরই মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারবে না রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশের ক্যাম্পেই থেকে যেতে হবে তাদের। বাংলাদেশ সরকারের উচিত ক্যাম্পগুলোকে আরেকটু বাসযোগ্য করে তুলতে তাদের সাধ্যের মধ্যে সম্ভব সব কিছু করা। বাংলাদেশের ভার লাঘবে দাতাদেরও সচেষ্ট থাকতে হবে।

কয়েক দশক ধরেই বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। ১৯৯০-এর দশক, ২০১২ এবং ২০১৬ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নামে। ২০১৭ সালের আগে বাংলাদেশ সরকার মাঝেমধ্যেই এসব শরণার্থীকে পুশব্যাক করত। এদের সহযোগিতার জন্য আন্তর্জাতিক গ্রুপগুলোকেও বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে বাঁধভাঙা স্রোতের মতো শরণার্থীরা আসতে শুরু করলেই এই চর্চায় ছেদ পড়ে। রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে বাংলাদেশের জনগণ। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তাদের সহায়তা করে বহু গোষ্ঠী। সরাকরি নীতিতেও পরিবর্তন আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য ও সম্পদ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

তবে ঘটনার এক বছর পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ হাসিনা জানান, বাংলাদেশের পক্ষে স্থায়ীভাবে এই শরণার্থীদের গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এ বছর মার্চে পররাষ্ট্রসচিব শহিদুল হক নিরাপত্তা পরিষদকে জানান, মিয়ানমার থেকে আসা আরো শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। রোহিঙ্গারা ক্ষণিকের অতিথি হবে—এমন ধারণা থেকে প্রাথমিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল সরকার। বাংলাদেশ আশা প্রকাশ করে, অবরোধের হুমকি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিচারের ভয় দেখিয়ে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করা সম্ভব। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি ভয়াবহ। আশ্রয়শিবিরগুলো ভিড়ে ঠাসা এবং শরণার্থীরাও নানা অপরাধ ও সহিংস বিরোধের মধ্যে সময় পার করে। পুরো দেশে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা তাদের নেই। কাজ, শিক্ষা বা সামাজিক সুবিধাগুলোও তারা পায় না। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত জানুয়ারিতে জানায়, বাংলাদেশের নাগরিক না হওয়ায় রোহিঙ্গা শিশুদের স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে।

ভিড়ে ঠাসা এই ক্যাম্পগুলোর জন্য একটি মাত্র প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ—যা গ্রহণযোগ্য নয়, বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপ ভাষানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলছে ঢাকা। বহু বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা, ভাষানচরে শরণার্থীরা ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক প্লাবনের ঝুঁকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের দাবি, চরটি নিরাপদ। ঘূর্ণিঝড়ের জন্য ভালো আশ্রয়কেন্দ্রও সেখানে রয়েছে। বহু বাংলাদেশির কপালেই এমনটা জোটে না। এ দাবি সত্য হলেও শরণার্থীদের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। বাংলাদেশ বলছে, যারা স্বেচ্ছায় যেতে চায় তাদেরই নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু এই এক লাখ রোহিঙ্গাকে আশপাশের এলাকাগুলোয় কাজের সুযোগ দেওয়া হবে কি না সে বিষয়টি নিশ্চিত করেননি কর্মকর্তারা।

মিয়ানমারে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো স্পষ্টতই কোনো সমাধান নয়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে চীনের মধ্যস্থতায় একটি প্রত্যাবাসন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। তখন মিয়ানমার প্রতি সপ্তাহে দেড় হাজার করে শরণার্থীকে ‘যথাযথ যাচাই করে’ ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়। কিন্তু কোনো শরণার্থী মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হয়নি।

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নেতাদের বিশ্বাস করে না। তার যথার্থ কারণও আছে। এক শরণার্থী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, ‘ফিরে গেলেই আমাদের খুন করবে ওরা।’ জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধানী মিশন গত বছর এক প্রতিবেদনে জানায়, রাখাইন রাজ্যে জেনোসাইড ও মানবাধিকারবিরোধী অপরাধগুলোর যথাযথ তদন্ত ও বিচার হলে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়া নিরাপদ হবে। কিন্তু প্রমাণ থাকার পরও মিয়ানমারের নেতারা  (নোবেল বিজয়ী অং সান সু চিসহ) কোনো ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সময়ক্ষেপণের উদ্দেশ্যে তারা অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে, যা চোখে ধুলা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।

বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন আলোচনায় অংশ নিলেও কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দিহান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বহুবার বলেছে। তবে প্রয়োজনীয় পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি।’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শান্ত রাখতে মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলছে মিয়ানমার। এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোনো ইচ্ছা তাদের নেই।

মিয়ানমারকে রাজি করাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও জোরালো পদক্ষেপ নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে রোহিঙ্গা ইস্যু তোলার ব্যাপারে সবুজ সংকেত পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ র‌্যাপর্টিয়ার ইয়াংগি লি বলেন, রোহিঙ্গারা ‘আন্তর্জাতিক নিষ্ক্রিয়তার বলি হতে পারে না।’ 

সূত্র : ফরেন অ্যাফেয়ার্স

লেখক : মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক, ব্র্যাড অ্যাডামস হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক পরিচালক।

ভাষান্তর : তামান্না মিনহাজ

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ