আজকের শিরোনাম :

শেখ হাসিনার পাঁচ প্রস্তাব ও বাস্তবতা

  আবদুল মান্নান

০৯ জুন ২০১৯, ১১:২৮ | অনলাইন সংস্করণ

ত্রিদেশীয় সফর শেষ করে প্রধানমন্ত্রী ৮ জুন শনিবার দেশে ফিরেছেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের আমন্ত্রণে তিনি জাপান সফর দিয়ে ত্রিদেশীয় সফর শুরু করেন। জাপানের পর তিনি সৌদি আরব ও ফিনল্যান্ড সফর করেন। জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক সেটি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশটি বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও জাপান সরকার ও সে দেশের জনগণ মুক্তিকামী বাঙালিদের সব সময় নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে। কারণ যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে জাপানের চেয়ে অন্য কেউই ভালো জানে না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে এসে যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ বিধ্বংসী মারণাস্ত্র আণবিক বোমা ফেলে জাপানের দুটি প্রধান শিল্প শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকি ধ্বংস করে দিয়েছিল। তাত্ক্ষণিক হত্যা করেছিল কমপক্ষে দুই লাখ নিরপরাধ মানুষকে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে বঙ্গবন্ধু জাপান সফর করেন। তাঁর এই সফরের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাপান সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের প্রতি যে সমর্থন জানিয়েছিল তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানো। এর আগে তিনি ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। জাপান সফরের সময় তিনি যমুনা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের জন্য জাপানের কাছে সহায়তা চান। ১৯৭৪ সালে জাপান সরকার যমুনা নদীর ওপর সেতু বানানোর বিষয়টির ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা চালায়। পরবর্তীকালে সেই সেতু নির্মিত হয়েছে, যা বঙ্গবন্ধু সেতু হিসেবে বর্তমানে পরিচিত। এবারের সফর নিয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার তৃতীয়বার জাপান সফর। প্রথম সফরটি ছিল ২০১৪ সালের মে মাসে। সেবার প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে টের পেয়েছিলাম তিনি জাপানে কতটুকু সমাদৃত। তাঁর থাকার জন্য নির্ধারিত হয়েছিল দেশটির দুটি গুরুত্বপূর্ণ অতিথিশালার একটি ‘আকাসাকা প্যালেস’। তিনি ছিলেন এই প্রাসাদে অবস্থানকারী তৃতীয় সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ও বারাক ওবামা এই প্রাসাদে অতিথি হয়েছেন। একই বছর আগস্ট মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বাংলাদেশ সফর করেন। এবারের সফরের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল জাপানের সঙ্গে আড়াই শ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর করা (ওডিএ)। এটি ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে এ ধরনের ৪০তম চুক্তি। এবারের চুক্তি থেকে পাওয়া অর্থ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হবে।

জাপান সফরের শেষ দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সম্মেলনটির আয়োজক জাপানের ‘নিকে ইন্টারন্যাশনাল’  (Nikke International Conference) মূল বিষয় ছিল  ‘Seeking a New Global Order-overcoming the chao (বিরাজমান বিশৃঙ্খলাকে অতিক্রম করে নতুন বিশ্বের সন্ধান’। শেখ হাসিনার প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল   ‘The future of Asia (এশিয়ার ভবিষ্যৎ)’। এই সম্মেলনে বিশ্বের অনেক চিন্তক ও গবেষক উপস্থিত ছিলেন। আরো উপস্থিত ছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ডা. মাহাথির মোহাম্মদ, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন ও ফিলিপাইনের   প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে। শেখ হাসিনা তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, বিশ্ব বর্তমান সময়ে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে তা গত শতকের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ও  অপরিচিত। বর্তমান সময়ে এক দেশ নির্দ্বিধায় আরেকটি দেশ ধ্বংস করছে অথবা দখল করছে—কখনো নিরাপত্তার অজুহাতে, আবার কখনো তাদের পছন্দসই গণতন্ত্র রপ্তানি করতে। আর এই কাণ্ডটি যেসব দেশে ঘটছে তার সবগুলো তেল অথবা প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ দেশ, যেমন ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া অথবা ইয়েমেন। এসব অপকর্ম ও দখলদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে পশ্চিমের সম্পদশালী দেশগুলো। বিশ্বে বর্তমানে যত পরিমাণের খাদ্য উৎপাদন হয় তা বিশ্বের বর্তমান জনসংখ্যার জন্য যথেষ্ট। তার পরও বিশ্বের অনেক দেশে, বিশেষ করে আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে ও ইয়েমেনে প্রতিদিন শত শত মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা অনাহারে মৃত্যুবরণ করছে। এর অন্যতম কারণ রাজনৈতিক ও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা সৃষ্টি হয় বিশ্বের মোড়লদের স্বার্থে।

বিশ্বে ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থান এখন একটি বাস্তবতা এবং এর জন্যও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী পশ্চিমের উন্নত দেশগুলো। একই সঙ্গে অনেক দেশে নব্য ফ্যাসিবাদ ও বর্ণবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একসময় যেসব দেশ উদার ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করত সেসব দেশে উগ্র ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এর ফলে দেশের সাধারণ জনগণ হয়ে উঠছে বিভাজিত। একটি দেশের জনগণ যদি বিভাজিত হয় সেই দেশের উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে পড়তে বাধ্য। শেখ হাসিনা বলেন, একবিংশ শতকে এশিয়ার সামনে উন্নয়নের যে সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে তা কাজে লাগাতে হলে পাঁচটি কাজে হাত দিতে হবে। তাঁর মতে, এসব কাজের মধ্যে আছে এশিয়ার দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিতে আরো উদারতা নিয়ে আসা এবং একে অন্যকে সহায়তা করা, আর ন্যায়বিচার ও সৃজনশীলতার ওপর ভিত্তি করে দেশে দেশে বিরাজমান আস্থার ঘাটতির মোকাবেলা করা। দেশের জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাঁর প্রবন্ধের মূল ফোকাস  ছিল এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা এবং এসব  দেশের টেকসই উন্নয়ন ছাড়া আগামী দিনের উন্নত জীবনযাত্রা, শান্তি, প্রগতি ও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ নিশ্চিত করা যাবে না বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

শেখ হাসিনা তাঁর প্রবন্ধে যা বলতে চেয়েছেন তা ছিল তাঁর একটি স্বপ্নের এশিয়া, যা তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবতেন আর স্বপ্ন দেখতেন। শেখ হাসিনা যে এশিয়ার কথা বলেছেন, তা তাঁর স্বপ্নের এশিয়া। এ মুহূর্তে বাস্তবে সমগ্র এশিয়ায় তা অনুপস্থিত এবং সম্ভবও নয়। বরং তাঁর স্বপ্নটা এই সময়ের জন্য দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে বাস্তবসম্মত হবে। তুরস্ক থেকে জাপান পর্যন্ত এশিয়ায় ৪৮টি দেশ আছে। এর মধ্যে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স মিলে ধ্বংস করে দিয়েছে। এগুলো সবই তেল ও খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ দেশ ছিল। পাকিস্তান বর্তমানে একটি পতিত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত, যার একক কৃতিত্ব দেশটির সেনাশাসক ও আমলাদের। অথচ দেশটির সম্ভাবনা ছিল।

একবিংশ শতাব্দী শুরুর আগেই অনেক গবেষক একমত হয়েছিলেন, এই শতাব্দী হবে এশিয়ার। তারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যেহেতু বিশ্বায়নের কাল শুরু হয়ে গেছে তখন পুঁজি নিরাপত্তা আর দ্রুত গড় বৃদ্ধির সন্ধানে এশিয়ায় আসবে। তাঁরা এটাও বলেছিলেন, একসময় যে এশিয়ার অর্থনীতি কৃষিনির্ভর ছিল তা দ্রুত শিল্প ও সেবানির্ভর হয়ে উঠবে। একই সঙ্গে এশিয়ায় মধ্যবিত্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়বে। তারা নিজেরাই হয়ে উঠবে ভোক্তা পণ্য আর শিল্পপণ্যের ভোক্তা। কারণ তাদের হাতে বাড়তি অর্থ থাকবে। এটি হবে পশ্চিমের অনেক দেশ তাদের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে পণ্য উৎপাদনের জন্য এশিয়ার দেশগুলোকে বেছে নেবে। কারণ এখানে সস্তায় শ্রম পাওয়া যাবে। উৎপাদন ব্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যাবে এই অঞ্চলের মানুষের হাতে। বর্তমানে চীন হচ্ছে বিশ্বের জন্য পণ্য উৎপাদনের কারখানা, আর ভারত হচ্ছে বিশ্বের তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্বের যে পরিমাণে জমি আছে তার ৩০ শতাংশ এশিয়ার দখলে আর ৬০ শতাংশ মানুষ এশিয়ায় বাস করে। এর মধ্যে আবার বিশ্বের ৩৬ শতাংশ মানুষ বাস করে দুটি দেশে—চীন ও ভারতে। এশিয়ার অর্থনীতির পরিমাণ ৩১.৫৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (একত্রিশ দশমিক আটান্ন হাজার কোটি ডলার। সাধারণ হিসাবে) আর ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পিপিপি) হিসাবে ৬৫.৪৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এশিয়ার মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের নিচে, আর এই বিশাল স্বল্পবয়সী জনসংখ্যা হচ্ছে এশিয়ার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এদের ওপর নির্ভর করে আগামী দিনের এশিয়ার সমৃদ্ধি ও ভবিষ্যৎ। এরা বাস্তবায়ন করতে পারে শেখ হাসিনার প্রত্যাশার এশিয়া আর তার জন্য চাই এদের নিবিড় পরিচর্যা ও দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করার জন্য সঠিক পরিকল্পনার সঙ্গে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ।

কয়েকটি রাষ্ট্র এশিয়ার অগ্রযাত্রাকে পেছন থেকে টেনে ধরার জন্য সব সময় চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে মিয়ানমার। এই দেশটি এ সময় হিটলারের জার্মানির প্রতিভূ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সামরিক জান্তার নজিরবিহীন হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে দেশটির প্রায় ১২ লাখ মানুষ ভিটামাটি থেকে উত্খাত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই শতকের প্রথম গণহত্যার জন্য মিয়ানমারকেই দায়ী করা হয়। আর আছে উত্তর কোরিয়া, যার প্রেসিডেন্ট কথায় কথায় আণবিক যুদ্ধ লাগানোর হুমকি দেন। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে স্বীকৃত ভারত। ইদানীংকালে দেশটির  সরকার ও একশ্রেণির  জনগোষ্ঠীর নিজ দেশের একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর  প্রতি যে আচরণ করছে তা তার চলার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। শেখ হাসিনার প্রত্যাশিত এশিয়াকে পেতে হলে বিশ্বায়নের কয়েকটি অপরিহার্য বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে, যার মধ্যে আছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে মানুষের আর পুঁজির চলার নির্বিঘ্ন ও তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সব দেশে প্রত্যেক জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসন আর সহনশীলতাচর্চা ব্যতিরেকে অগ্রযাত্রা সম্ভব নয়। দুর্নীতি এশিয়ার অনেক দেশে ক্যান্সারের মতো জেঁকে বসেছে। এই রোগের প্রতিষেধকই সুশাসন। তার সঙ্গে থাকতে হবে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা। নিরবচ্ছিন্ন আঞ্চলিক শান্তি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে উঠতে পারে শেখ হাসিনার প্রত্যাশিত এশিয়া। শেখ হাসিনা নিজ দেশ ও এই অঞ্চল নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। তাই তিনি এখন আর শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন, হয়ে উঠেছেন একজন রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন তাঁর একার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। তাঁর সঙ্গে থাকতে হবে এই অঞ্চলের জনগণ ও সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের। ইতিহাস বলে যাঁরা স্বপ্ন দেখান তাঁরা সব সময় স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেন না। প্রার্থনা করি এটি যেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে না ঘটে।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

এই বিভাগের আরো সংবাদ