আজকের শিরোনাম :

খেদাপাড়ায় বিরাট রাজার তিনটি প্রত্নঢিবি: একটি অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষণ

  আমিরুজ্জামান পলাশ

২৭ এপ্রিল ২০১৯, ১৮:৩৯ | অনলাইন সংস্করণ

যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া ইউনিয়নের খেদাপাড়া গ্রামে তিনটি ঢিবির অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ করে বর্তমান আলোচনায় ঢিবি তিনটিকে প্রত্নঢিবি হিসেবে চিন্থিত করা হয়েছে।  স্থানীয়ভাবে ঢিবিগুলোকে খেদাপাড়াঢিবি, ধনপোতাঢিবি, স্বরূপরাজারঢিবি বা বিরাট রাজার ঢিবি বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। খেদাপাড়ায় ‘ধনপোতা’ ঢিবিটি প্রাচীনকালের প্রতাপশালী বিরাট রাজা’র সুরম্য অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ হিসেবে স্থানীয়ভাবে পরিচিতি নিয়ে আজও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অবস্থান: যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক ধরে অথবা যশোর-ঝিকরগাছা সড়ক পথে বাস, টেম্পু ও ভ্যানযোগে খুব সহজেই খেদাপাড়া বাজরে পৌঁছা যায়। যশোর জেলা সদরে অবস্থিত মুড়লী মোড় থেকে এ প্রত্নস্থলের দুরত্ব প্রায় ১৪ কি. মি. এবং মনিরামপুর পৌরসভার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত আকরাম মোড় থেকে খেদাপাড়া ঢিবির দুরত্ব প্রায় ৮ কি.মি.। খেদাপাড়া বাজার থেকে সোজা পূর্ব দিকে মেঠোপথ ধরে মাত্র ১ কি.মি. অগ্রসর হলেই বৃক্ষ, লতাপাতায় আচ্ছাদিত বাগানের মধ্যে সুউচ্চ ঢিবি তিনটির অবস্থান ।

ভূমি সংক্রান্ত তথ্য: ঢিবির নিকটবর্তী বাসিন্দাদের নিকট থেকে জানা যায় ৪৯ নং খেদাপাড়া মৌজার ২ নং শীটে দাগ নং ২০৯০ ও ৪১৭৫ তে তিনটি ঢিবিই ব্যক্তি মালিকানা সম্পত্তি। শ্রী নেপাল চন্দ্র বিশ্বাসের নামে রের্কডীয় সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে মালিকানা লাভ করেন শ্রী দুলার চন্দ্র বিশ্বাস, শ্রী কমল চন্দ্র বিশ্বাস এবং শ্রী হরিপদ বিশ্বাস, রবিন বিশ্বাস, অমল বিশ্বাস ও মাখনলাল বিশ্বাস।

জনশ্রুতি ও ঐতিহাসিক বিবরণ: স্থানীয়ভাবে বিরাট রাজার ঢিবি নামে পরিচিত এ ঢিবি সম্পর্কে স্থানীয় অনেক সনাতন ধর্মালম্বী জনশ্রুতি রয়েছে, মহাভারতের ‘বিরাট পর্ব’ এর পঞ্চপান্ডব বনবাস থেকে যে বিরাট রাজার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ওই কাহিনির বিরাট রাজার বাড়িটির ধ্বংসাবশেষ হলো খেদাপাড়ার ঢিবিগুলি।  ভূমি মালিক মাখনলাল বিশ্বাস জানান যে, বংশ পরম্পরায় তারা এই সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। তাদের পূর্ব পুুরুষদের কাছ থেকে শুনে আসছেন যে ঢিবিটি হাজারো বছর আগের প্রতাপশালী বিরাট রাজার বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ। ধনপোতা ঢিবিটিতে বিপুল পরিমাণ গুপ্তধন রয়েছে বলেও তারা শুনেছেন।  ‘মহাভারত’-এর বিরাট পর্বে শকুনি মামার চক্রান্তে পড়ে পাশা খেলায় হেরে যাবার শর্তানুযায়ী পঞ্চপান্ডব (যুধিষ্টির, ভীম, অর্জুন, নকূল ও সহদেব ৫ ভাই) ১২ বছর বনবাস অবস্থানসহ শেষের একবছর যে অজ্ঞাত স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন সে কাহিনীর সাথে খেদাপাড়ার বিরাট রাজার অনেকাংশে মিল খুঁজে পাওয়া যায় বলে স্থানীয় সনাতন ধর্মালম্বীদের বিশ্বাস।  

জানা যায়, ওই পর্বে নাম পরিচয় গোপন করে পঞ্চপান্ডব ও তাদের একমাত্র স্ত্রী ধ্রুপদী বিরাট রাজার বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং মহাভারতের বিরাট পর্ব উল্লেখ আছে স্বরূপ নদীর তীরে বিরাট রাজার বাড়িতে পঞ্চপান্ডব ও তাদের একমাত্র স্ত্রী ধ্রপদী আশ্রয় নেন। পঞ্চ পান্ডব তাদের তীর, ধনুকসহ অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র শিব আশ্রিত গাছে রেখে যান। মহাদেব শিব তাদের অস্ত্র আচ্ছাধন করে রাখেন। মহাভারতে যে স্বরূপ নদীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা বিরাট রাজার অর্থাৎ ওই ঢিবি থেকে ৫০ গজ উত্তর পূর্ব কোনায় স্বরূপদহ্ বিল রয়েছে। স্বরূপদহ বিলটি স্বরূপনদী থেকে উৎপত্তি বলে স্থানীয় অনেকের ধারণা। কারণ ‘দহ’ কথার অর্থ হচ্ছে গর্ত বা দোহা। অর্থাৎ নদীর স্রোতের কারনে দোহা বা গর্তের সৃষ্টি হয়।

স্থানীয় অনেকে বলেন, তাদের পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে শুনে আসছেন এই স্থানটি একসময়  প্রবাহমান স্রোতস্বিনী নদী ছিল যার বুক দিয়ে বড় বড় নৌকা চলাচল করত। আর শিব আশ্রিত যে গাছের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা ওই ঢিবি থেকে ২’শ গজ পশ্চিমে এবং খেদাপাড়া বাজার (পূর্বে ভবানীপুর লাহা ষ্টেট অনুসারে) থেকে ১’শ গজ দক্ষিণে বর্তমান বৈদ্যনাথ তলার ধামে একটি প্রাচীন গাছের অবশিষ্টাংশের সাথে মিল খুঁজে পান স্থানীয় অনেকে।  প্রায় ২’শ ৫০ বছর আগে স্বপ্নযোগে রোগ মুক্তি কামনায় কুঞ্জ বিহারী নামে একজনসাধক ওই প্রাচীন গাছের কাছে ধ্যান মগ্ন হয়ে জটিল রোগ থেকে মুক্তি পান।  পরবর্তীতে সেখানে একটি ধাম গড়ে ওঠে, যেখানে আজও শিব পূজাসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠানাদি হয়ে আসছে। তবে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের অপ্রতুলতার কারণে স্থানীয় এসকল জনশ্রুতি ও মিথের বিশ্লেষণ বা পর্যালোচনা করা যায়নি।

ঢিবির বিবরণ : খেদাপাড়ার তিনটি ঢিবিকে পৃথকভাবে অবস্থান পরিচিতির জন্য ভিন্ন নামেও চিন্থিত করা হয়ে থাকে। যথা : ক. ধনপোতাঢিবি ,খ. বাঁশতলার ঢিবি  এবং  গ. ধনপতি রাজার কাচারীবাড়ী ।

ক. ধনপোতাঢিবি : পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমি থেকে এ ঢিবিটির শীর্ষদেশের উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। ঢিবিটির আয়তন পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ২০০ ফুট এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৫০ ফুট। ঢিবিটি ৫৭ শতাংশ ভূমি নিয়ে অবস্থিত।  মাঠ পরিদর্শনকালে ঢিবিতে স্থাপত্যিক কাঠামোর ধ্বংশাবশেষের চিন্থ পরিলক্ষিত হয়েছে।  এছাড়াও প্রচুর পরিমানে ইট, ইটের টুকরা ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ লক্ষ করা গেছে।  ঢিবিটি বিভিন্ন প্রজাতির গাছে আবৃত রয়েছে।স্থানীয়রা জানান তাঁরা বাপ দাদার কাছ থেকে শুনে আসছেন এটি বিরাট রাজার বাড়ি।

খ. বাঁশতলার ঢিবি : ধনপোতা ঢিবি  থেকে কয়েক গজ দুরে বাঁশতলায় পার্শ্ববর্তী মাঠে সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১২/১৩ ফুট উঁচু একটি ঢিবি রয়েছে। ঢিবিটির উপরে প্রাচীন কালের তৈরি ইটের টুকরা ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ লক্ষ্য করা গেছে।  

গ. ধনপতি রাজার কাচারীবাড়ী: ধনপোতা ঢিবি থেকে আনুমানিক ২’শ গজ পশ্চিমে অনূরূপ আরও একটি ঢিবি রয়েছে।  যার উচ্চতা ধনপোতা ঢিবির চেয়ে কিছুটা কম।  ওই ঢিবি বিরাট রাজার বিচারালয়ের কার্যাদি বা কাচারী বাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলে স্থানীয়দের ধারণা। এখনো ওই ঢিবিটিতে ছোট ছোট কূপ আকৃতির চিহ্ন রয়েছে।  এছাড়াও এখানে প্রচুর পরিমানে প্রাচীন কালের তৈরি ইটের টুকরা ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ লক্ষ্য করা গেছে।  

পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনা : বক্ষমান নিবন্ধে বর্ণিত জনশ্রুতি সম্পর্কে  ঐতিহাসিক তথ্য- উপাত্তের অপ্রতুলতার কারণে বিরাট রাজার মিথের সাপেক্ষে ঢিবির সম্পৃক্ততা পর্যালোচনা করার সুযোগ পাওয়া যায়নি। তবে খেদাপাড়ার এ ঢিবি তিনটির আকৃতি, ভূপৃষ্ঠীয় সংগ্রহ (যথা: ইটের টুকরা ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ), ঢিবির পারিপাশ্বিক অংশগুলিতে স্থাপত্যিক কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ পরিদৃষ্ঠে ধারণা করা যায় উক্ত ঢিবি তিনটির অভ্যন্তরে লুকিয়ে আছে গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি।  খেদাপাড়া ঢিবি তথা বিরাটরাজার ঢিবিগুলি প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে উন্মোচিত ও গবেষণা করা গেলে বাংলাদেশের দক্ষিন অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস পূর্ণগঠনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সংযুক্ত হবে বলে ধারণা করা যায়। তাছাড়া যশোর জেলার মনিরামপুরের দমদম পীরস্থানে প্রাপ্ত প্রাক-মুসলিম যুগের স্থাপত্যিক কাঠামো এবং কেশবপুরের ভরত ভায়নাতে ইতোপূর্বে আবিস্কৃত আনুমানিক ৫ম শতকের বৌদ্ধ স্থাপত্যিক কাঠামোর সাপেক্ষে তুলোনামুলোক পর্যালোনার মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে প্রত্নতাত্ত্বিকগণের বিশ্বাস। এ লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খেদাপাড়ার বিরাট রাজার ঢিবিগুলিকে ১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি আইনের ১০ ধারা মোতাবেক সংরক্ষিত ঘোষণা এবং ২৫ ধারা মোতাবেক প্রত্নতাত্ত্বিক খননের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

এবিএন/রাজ্জাক/জসিম/এআর

এই বিভাগের আরো সংবাদ