আজকের শিরোনাম :

নির্বাচন ২০১৮

নতুন সরকার: ডাক দিয়ে যাই

  মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

০২ জানুয়ারি ২০১৯, ১৬:৪০ | আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০১৯, ১৬:৫০ | অনলাইন সংস্করণ

শুরুর কথা
৩০ ডিসেম্বর, ১৬ পৌষ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন জনবন্ধু শেখ হাসিনা। চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ, তবে অত্যন্ত কঠিন যাত্রাপথে তাঁকে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভকামনা জানাই। শেখ হাসিনার শাসনকালে সব কটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতির জনকের নিজ হাতে গড়া আওয়ামী লীগ ১৯৯১ সালে পঞ্চম, ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম ও ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে ভোট পেয়েছিল যথাক্রমে ৩৪, ৩৭, ৪১ ও ৪৮ শতাংশ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই পারিসংখ্যানিক প্রবণতায় ৬০ শতাংশ ভোট পাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। তবে অন্যবারের মতো এবার আমার নিজের হিসাব–নিকাশ ঠিক হয়নি। আওয়ামী লীগ ১৮০-১৯০টি আর বিএনপি ৯০-৯৫টি আসন পাবে বলে অনুমান বিপুলভাবে ভুল প্রমাণিত হয়ে গেল।


বিএনপি বনাম আওয়ামী লীগ
বিএনপির ভোট বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে (ক) প্রায় ১০ বছরের জনবিচ্ছিন্নতা; (খ) ২০১৪ সালের নির্বাচনে না গিয়ে প্রতিহত করার নামে মানুষ পোড়ানো ও সম্পত্তি নষ্ট করা; (গ) অবরোধ নাটক করা; (ঘ) শেখ হাসিনার অনন্য সাহসী ৫০-৫০ ফর্মুলার মন্ত্রিসভার কাঠামো প্রত্যাখ্যান করা; (ঙ) স্বাধীনতাবিরোধী, দেশদ্রোহী অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে মানবতা হত্যার অপরাধীদের সঙ্গে যতিবিহীন গাঁটবন্ধনে থাকা; (চ) পাকিস্তান তথা আইএসআইয়ের সঙ্গে প্রকাশ্য দহরম-মহরম; (ছ) পরিবারতন্ত্রে নেতৃত্বের সংকট; (জ) কার্যত কোনো উন্নয়ন কার্যক্রমের পরিকল্পনা না করাকে কারণ বলে মনে করা হয়। সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত সবল নেতৃত্ব, নজরকাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, হৃদয় উষ্ণ করা সামাজিক অগ্রগতি, সাংস্কৃতিক পুনরুত্থান এবং প্রায় দুই বছর ধরে সঠিক পথে নির্বাচনী প্রস্তুতি গ্রহণ আওয়ামী লীগের বিজয়, অর্থাৎ ২৫৯টি আসনে জয়ী হতে সহায়তা করেছে বৈকি। এই নির্বাচনের অন্যতম বিশাল সফলতা: দেশদ্রোহী, জঙ্গি, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতিরা কোনো আসনেই জয়লাভ করেনি।


শেখ হাসিনার অনন্য বিজয়গাথা
অকুতোভয়, চৌকস, দক্ষ, গতিময়, উদ্ভাবনী, জ্ঞানালোকে উজ্জ্বল এবং মানুষকে কাছে টেনে ভালোবাসার মোহনীয় ক্ষমতা শেখ হাসিনাকে এক জাদুকরি নেতৃত্বের উচ্চ আসনে নিয়ে গেছে। দেড় বছর পর তিনি ইন্দিরা গান্ধী, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, মার্গারেট থ্যাচার, ভিগদিস ভিনগোদি ও মেরি মেকলিসকে টপকিয়ে পৃথিবীর দীর্ঘতম সময়ের সফল সরকারপ্রধান হিসেবে বিরাজমান হবেন। বিশ্বসভা তাঁর নেতৃত্বকে মর্যাদা দেয়। তিনি মাদার অব দ্য আর্থ। শেখ হাসিনা মানবতার মাতা। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হয়েছে অনন্য কৃতিত্বের সঙ্গে। বোদ্ধারা বলছেন, আগামী ১২–১৪ বছরে বাংলাদেশ পৃথিবীর ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতি হয়ে উঠবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সমীক্ষা: নারীর ক্ষমতায়নে লিঙ্গসমতা সূচকে চারটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বসেরা আর সামগ্রিক সূচকে ১৪৯টি দেশের মধ্যে ৪৮তম স্থানে—দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের তুলনায় অনেক ওপরে। ১৯৭২ সালে হিউস্ট ফ্যালান্ড আর জ্যার্ক পারকিনসন ‘টেস্ট কেস’ বলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বে সন্দিহান হয়ে যে কটাক্ষ করেছিলেন, বিশ্বের তাবৎ অর্থনীতিবিদ, প্রতিষ্ঠান ও দেশ শেখ হাসিনার বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে তিনটি সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি বলে স্বীকৃতি দিয়ে তার জোরালোভাবে খণ্ডন করেছে। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচক এইচডিআইতে বাংলাদেশ এখন মধ্যম পর্যায়ে—৭২ বছরের গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ৩০–এর নিচে আসা, শিক্ষায় উচ্চহার, সুপেয় পানি ও বিজ্ঞানসম্মত পয়োনিষ্কাশনে অগ্রগতি এবং চমকপ্রদ সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের কাঠামোতে নাকি এ ক্ষেত্রে শক্তি জুগিয়েছে। শেখ হাসিনা মানুষকে ভালোবাসেন। শিশুদের আরও বেশি এবং শারীরিকভাবে হুমকির সম্মুখীনদের সবচেয়ে বেশি মমতায় তিনি আপন করতে পারেন বলেই আপামর জনসাধারণ তাঁর মনোনীত প্রার্থীদের ভোট বাক্স ভরে দিয়েছেন।


আত্মপ্রসাদ নয়
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সতর্কবাণী না শুনে নির্বাচন কমিশনের কিছুটা হলেও গাফিলতির ছিদ্র দিয়ে কতিপয় অতি উত্সাহী ৩০–৩৫টি সংসদীয় আসনে ৮৫ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিত করে আওয়ামী লীগের বিজয়ীদের ৯০ শতাংশ ভোটপ্রাপ্তি ঘটিয়েছেন। এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে যথাবিহিত ব্যবস্থা নিতে পারে। সার্বিক ফলাফলে এর কোনো প্রভাব নেই, তা মানতেই হবে। বলা বাহুল্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহিংসতা বাংলাদেশের অতীত অবস্থান ও সমসাময়িক বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় কম বৈ বেশি নয়। ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর তাণ্ডব এবং ২০১৪ সালে প্রতিহত করার উন্মাদনার কথা কে না স্মরণ করে!

 

আগামী পাঁচ বছরের করণীয়

বড় বিজয়, মজবুত নেতৃত্ব। যেখানে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা, সেখানে উন্নয়ন ধারণাই জনগণকে এ বিজয়কেতন ওড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছে। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সংস্কার করতে হবে। কোনো সংস্কারই সহজ না, সে জন্যই আসন্ন সরকারের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে সব না হলেও মুখ্য ঘরোয়া সংস্কারগুলোতে হাত দিতে হবে। জনমনে প্রত্যাশা, হাসিনা সরকার বিশাল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি ও নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে প্রবৃদ্ধি মডেল বদল করে ব্যাপক শিল্পায়ন ও বহুমুখিতা আনা সমীচীন হবে। শিল্পায়নে কর্মসংস্থান হবে, বাড়বে আয় রোজগার, কমবে দারিদ্র্য ও বঞ্চনা এবং হ্রাস পাবে আয়, সম্পদ ও সুযোগবৈষম্য। এটি করতে হলে অবকাঠামোগত অব্যাহত প্রবৃদ্ধি ঘটাতে হবে, প্রয়োজন হবে অধিকতর বিনিয়োগযোগ্য তহবিল। সরকারি খাতে দুর্নীতি হ্রাস ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্বৃত্ত তহবিল সঞ্চয় জরুরি। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির স্থিতাবস্থা দূর করতে হলে একদিকে যেমন আকর্ষণীয় পলিসি সংস্কার করে প্রণোদনা দিতে হবে, অন্যদিকে তেমনি করহার না বাড়িয়ে অনেক বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে। উপযুক্ত নীতি–কৌশলে মুদ্রা পাচার বন্ধ করা এবং রপ্তানিতে জোয়ার আনতে অর্থনীতির ক্ষেত্রে তথা ব্যাংকিং বিমা ও মূলধন মার্কেটে বহু বিলম্বিত সংস্কার এনে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও সততার পথ চালু করতে হবে।

সুশাসনে নৈতিকতা, আইন প্রয়োগে কৃতসংকল্পতা এবং জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা প্রয়োজন। নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণা অনুযায়ী, তারুণ্যের শক্তিকে বিকশিত করার জন্য ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে অবস্থানকারী তরুণ, তরুণী, যুবক ও যুব মহিলাকে বৃত্তিমূলক ও প্রযুক্তি শিক্ষায় পারদর্শী করে তুলতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের মতোই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ভর্তি অনুপাত বর্তমানের ৪৩: ৫৭ থেকে ৫০: ৫০–তে রূপান্তর করা প্রয়োজন। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবছর সামষ্টিক আয়ের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে ২০২৩ সালে শিক্ষাক্ষেত্রের বরাদ্দ জিডিপির শতকরা শূন্য ৫ ভাগে উন্নীত করা সমীচীন হবে। অনুরূপভাবে স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনাও প্রয়োজন। একটি নতুন ড্রাগ ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন বিভাগ স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে আরও সমৃদ্ধ করবে।

 

ভূমি ব্যবস্থাপনায় চাই লিজিংসহ নতুন চিন্তাধারা

ইশতেহারের ঘোষণা অনুযায়ী, দুর্নীতি দমনে আরও কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োজন। সুশাসনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতা কিছুটা বৃদ্ধি, ন্যায়পাল নিয়োগ ও সংবিধানের ৭০ ধারার প্রয়োগে সীমারেখা আনা যায় কি না, তা–ও দেখা যেতে পারে। ঢাকা মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট এবং বেশ কিছু মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানকে ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করা যায়। রেলপথ ও জলপথের গতিময় উন্নতি প্রয়োজন।

বস্ত্রশিল্প, পর্যটন, মত্স্য, দুগ্ধ, আসবাব, চামড়া, ওষুধ, খেলাধুলার সরঞ্জাম, মোটরযান সংযোজন, সিরামিকস ইত্যাদি শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে আগামী পাঁচ বছরে তৈরি পোশাক ও নিট আয়ের সমকক্ষ বিকল্প শিল্প খাত সৃষ্টির প্রয়াস নেওয়া যেতে পারে।

 

পরিশেষে

জাতির পিতার নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে কল্যাণরাষ্ট্রে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রযুক্তিনির্ভর, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, দুর্নীতি ও বঞ্চনামুক্ত সমতাপ্রবণ সোনার বাংলাদেশ গঠনে সর্ববলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়ার পথ খুলে দিয়েছে একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বৃহৎ ও মহৎ প্রতিবেশী ভারত, অর্থনীতির পরাশক্তি চীনসহ আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচনের বিজয়ে সাধুবাদ জানানোর লহরি সৃষ্টি করেছে ইতিমধ্যে। শেখ হাসিনার অসাধারণ নেতৃত্ব দৃঢ় পদক্ষেপে বাংলাদেশকে জনকল্যাণের একটি আদর্শ গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারবে, সে আশা অবশ্যই করা যাবে।

সূত্র : প্রথম আলো।

লেখক : ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য।

 

এই বিভাগের আরো সংবাদ