আজকের শিরোনাম :

চেতনা ও মননের মুক্তিতেই স্বাধীনতার সার্থকতা

  রূপক কুমার রক্ষিত

১৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:৩৯ | অনলাইন সংস্করণ

বাঙালির চেতনা ও মননের মুক্তির ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আর স্বাধীনতা অর্জন -এক আনন্দ বেদনার মিশ্র অনুভূতির জীবন্ত ইতিহাস। চেতনা ও মননে মুক্তির নেশায় পাগল প্রায় বীর জনতার জীবনোৎসর্গের জয়গান, শোষণের রাহুগ্রাস থেকে স্বদেশকে রক্ষা করার মানসে বাংলার জনপদের এক প্রতিশ্রুতিশীল চেতনার জাগরণ আর শোষিত মানুষের অগ্নিঝড়া আপোষবিহীন প্রতিবাদে জীবন পণে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অঙ্গীকার। এ ইতিহাস বড়ই গর্বের তবে গভীর আর্তনাদের। এ সংগ্রামে সম্পৃক্ত হয়ে বিজয়ের পথ সূচনায় আত্মত্যাগী ভূমিকা রেখে যারা স্বাধীন পতাকা নিয়ে এ দেশকে বিশ্বের মানচিত্রে দাঁড় করিয়েছে তাদের প্রতি জাতির আকন্ঠ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। জাতির কাছে তাঁরা আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ অর্জন মহাআনন্দের, এ বিজয় বিশাল গৌরবের। এ বিজয়ের গর্বে আন্দোলিত হয়ে মানসিক তৃপ্তি লাভ করা গেলেও স্বাধীনতার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন পরিপূর্ণতা লাভে সক্রিয় না হলে বিজয়ের গৌরব ম্লান হতে পারে। অর্জিত গৌরবকে বহুরূপে সম্প্রসারিত করতে বৃথা কালক্ষেপণ মোটেও সমীচীন নয়। দেশ এখন স্বাধীনতাত্তোর প্রায় অর্ধশতাব্দীর মুখোমুখী দাঁড়িয়ে। সময়ের অনুপাতে স্বাধীনতার লক্ষ্য বাস্তবায়নে হতাশাব্যঞ্জক বটে, তবে বর্তমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রা হতাশার মলিনতা কাটিয়ে জাতির হৃদয়ে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে বলা চলে। বাস্তবিক অর্থে দেশের উন্নতির হিসেব তো জনতার উন্নয়নের খাতায়। যে দেশের জনগণ যত বেশি নিজের উন্নয়ন সাধনে সক্ষম হয়েছে সে দেশ তত বেশি উন্নত। ব্যক্তির উন্নতিতে যেমন একটি পরিবার উন্নত হয় তেমনি উন্নত পরিবারের সমষ্টিতে সমাজ উন্নত হয়। আর সারা দেশের উন্নত সমাজ ব্যবস্থাতেই নিহিত থাকে দেশের সামগ্রিক উন্নতির মাপকাঠি। তাই দেশের উন্নয়ন কোন একক প্রক্রিয়া নয় যে, যে কেউ চাইলেই দেশ রাতারাতি উন্নত হয়ে যাবে। এখানে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কথা অনস্বীকার্য হলেও তা একমাত্র বিষয় নয়। মূল কথা জনগণের ইতিবাচক মননের বিকাশ এবং দেশ ও সমাজের কল্যাণে প্রতিশ্রুতিশীল কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে না।
বলাবাহুল্য স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণে স্বাধীন দেশের মানুষের চিন্তা চেতনার আশানুরূপ প্রতিফলন ঘটেনি। ফলে বিভিন্ন অসম অস্থিরতায় দেশ কাঙ্ক্ষিত উন্নত অবস্থানে পৌঁছতে না পারায় জনগণ মুক্তির স্বাদ পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেনি। পরীক্ষিত সত্য যে, একমাত্র স্বদেশপ্রেম ও দক্ষ জনশক্তির ইতিবাচক কর্মযজ্ঞ দেশের কল্যাণে আলোর মুখ দেখাতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ কাজে কাজী না হয়ে কথায় কাজী বনে বশে। ফলে কাজে ঝোঁক না থাকায় কার্য সাধন হয় না। বস্তুতপক্ষে নিজের জন্য নিজেকে প্রস্তুতি নিতে হয়, নিজের কাজের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব সৃষ্টি করতে হয়। এ প্রবণতাই মানুষের স্বীয় কীর্তির ভীত সৃষ্টি করে এবং সামগ্রিক কল্যাণ যজ্ঞে নিজের অংশগ্রহণের পথ সুগম করে। নিজেকে যথাযথ মর্যাদায় প্রস্তুত করতে না পারলে কোন বৃহৎ পর্যায়ে নিজকে যোগ্যরূপে উপস্থাপন করা যায় না, ফলে মহৎ উদ্দেশ্যে কোন সুবিধা গ্রহণ বা প্রদান কোনটাই সম্ভব হয়ে উঠে না। কর্মে অনাগ্রহ, পরশ্রীকাতরতা সর্বোপরি সুবিধার অপ্রতুলতার অজুহাত এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। দুর্বল চিত্তের মানুষ স্বীয় কর্মে পুরোপুরি লিপ্ত না হয়ে নিজেদের যোগ্য আসনে উপনীত করতে সমর্থ হয় না। অথচ ব্যর্থতার দায় হাস্যকর ভাবে সুবিধার অপ্রতুলতার উপর বর্তায়। নিজের উপর অনাস্থা ও সহজাত অস্তিত্বের প্রতি অশ্রদ্ধা মানুষকে ভুলপথে পরিচালিত করে যার ফলে জীবনে অযথা বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়। এ রূপ ভাবনা কেবল জয়ের পথকে কন্টকিত করে না বরং জীবনে ক্ষতিকর অধ্যায়ের সূচনা কওে যার ফলে দেশের কাঙ্ক্ষিত সফলতা বিঘ্নিত হয়। উপস্থিত প্রেক্ষাপটে সর্বজনীন বর্তমান অস্তিত্বের ইতিবাচক পথ ধরে নিজের উন্নতি বিধান করাই শ্রেয়। কাজের প্রতি আগ্রহ ভরে মনোনিবেশ ঘটিয়ে জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। সোনার বাংলার সোনার ছেলেরা ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে, ৭০ এর নির্বাচনে এবং ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ের স্বাক্ষর রেখেছে। সোনার দামাল ছেলেরা কখনও পিছু হটতে শিখেনি, যখন যা কিছু সাথে ছিল তা নিয়েই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং বিজয়ী হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিজয়ের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত আছে। অলীক চিন্তা, অভাব বোধ বা পরশ্রীকাতর ভাবনা কোন ভাবেই বাংলার সোনার ছেলেদের বিপথগামী করতে পারে না। তাই আলস্য নয় কর্মদক্ষতায় কর্মবীর হয়ে তারা দেশ মাতৃকার উন্নয়নে জোয়ার ঘটাবে। আত্মউন্নয়নের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে শরীক হয়ে দেশের উন্নয়ন সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকটা কর্ম-বিমুখতার চিত্র বর্তমান। কাজ না করেই বাহবা নেয়ার অভিপ্রায়ে অনেকে বিভোর থাকেন। কর্মে রত থেকে যে দেশসেবায় আত্মনিয়োগ করে সেই প্রকৃত কর্মবীর -সেই সোনার বাংলার সোনার ছেলে। দেশ সেই আদর্শ ছেলেকেই চায়। মূলত দেশপ্রেমটাই আসল কথা। দেশের যথার্থ কল্যাণের জন্য প্রকৃত দেশপ্রেমিকের প্রয়োজন। দেশের প্রতি সুগভীর অনুরাগ না থাকলে কর্মে মমত্ব অনুভব করা যায় না। আর দেশের কল্যাণ কর্মে মমতা অনুভব করা না গেলে তা সার্থক রূপে বাস্তবায়ন করা যায় না। এ মমত্ব বোধই মনুষ্যত্বের চেতনা বোধ। এ চেতনা বোধ থেকেই বীরের জন্ম হয়। দেশ ও জাতির অগ্রগতিতে কল্যাণ চেতনাই মানুষের নৈতিক দায়িত্ববোধের শামিল। কিন্তু অনুভূতি আর আবেদনের মধ্যে বিশাল ফারাক প্রত্যক্ষ রূপে বিরাজমান। দেশের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ দেশপ্রেমীর সংখ্যা যথেষ্ট না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত রূপে দেশের অগ্রযাত্রা সাধিত হয়নি। সত্যিকার অর্থে প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন এক-একটি শিল্প। স্বপ্ন যখন দেশপ্রেম বোধে পরিচর্যা পায় তখন তা সফল হয়ে শিল্পে পরিণত হয়। এরূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সফলতায় দেশে বৃহত্তর সফলতার বিপ্লব ঘটে । আর এটা সম্ভব দেশের কল্যাণকামী মানুষের কল্যাণময়ী ভূমিকায়। কল্যাণকামী ব্যক্তি মাত্রেই সত্যিকার দেশপ্রেমিক, তারা কর্মে আত্মনিয়োগের পথ ধরে এগিয়ে চলে। দেশের কল্যাণে যারা ব্রতী তারা নিজের কল্যাণ বোধে যেমন জাগ্রত তেমনি নিজের অর্জিত কল্যাণকে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদন করে দেশের কল্যাণ ভূমিকা রাখতেও পারদর্শী। তারা রাজনীতি বুঝে না, ধর্মনীতি বুঝে না, সমাজ নীতিও বুঝে না। কিন্তু জানে কেমন শ্রমে কেমন ফল – কেমন ধ্যানে কেমন সিদ্ধি। তারা বুঝে- ওভ ুড়ঁ রহাবংঃ ংড়সব ঃযরহম ুড়ঁ পধহ বধৎহ ংড়সবঃযরহম, রিঃযড়ঁঃ রহাবংঃরহম ধহুঃযরহম ুড়ঁ রিষষ বধৎহ হড়ঃযরহম ধহফ রভ ুড়ঁ রহাবংঃ ৎিড়হম ঃযরহম ুড়ঁ রিষষ মবঃ ৎবঃঁৎহ ৎিড়হম ংড়সবঃযরহম.চ
বাস্তবিকপক্ষে যাদের হৃদয়ে কল্যাণ চেতনা অনুপস্থিত তারা দেশপ্রেমিক নয়। অসুস্থ চেতনায় তারা দেশের উন্নয়নের পথে মূল অন্তরায়। দেশের সামগ্রিক কল্যাণ ও সমৃদ্ধিতে তারা হুমকি স্বরূপ। এ নীতিবিবর্জিত গোষ্ঠী সাধারণ মানুষের জীবনকে অস্থির ও কষ্টসাধ্য করে তোলে এবং সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে অরাজগতা সৃষ্টি করে। তারা সমাজের সর্বত্র বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং হীন স্বার্থে দেশের কল্যাণ বিকিয়ে দিতে দ্বিধা করে না। এ অবস্থায় সমাজ তথা দেশের শান্তি বিঘ্নিত হয়। তারা সত্যকে উপলব্ধি করতে না পেরে সত্যের উত্থানের দৃষ্টান্ত না হয়ে মিথ্যার পতনের সংঘভুক্ত হয়। ‘এদেশ সোনালী সম্ভাবনার দেশ’ – একথা বিশ্বনেতৃবৃন্দ আমাদের বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশের ঈর্ষণীয় সোনালী ভবিষ্যতে দেশের বিপথগামী লোক যাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে তার জন্য সতর্ক থাকা প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নযজ্ঞে দক্ষ জনশক্তিকে ইতিবাচকভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। কেবলমাত্র আত্মকেন্দ্রিক উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর না থেকে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সকলকে নিবেদিত হওয়া চাই। সকল স্তরের মানুষের চেতনা ও মননের মুক্তির স্রোতধারা সৃষ্টি করা জরুরি অন্যথায় স্বাধীনতার মূল্যবোধ অবোধ্য থাকবে। এলক্ষ্যে দেশপ্রেমে আত্মজাগরণ ঘটিয়ে কর্মে নিষ্ঠা ও গতি আনয়ন করা আবশ্যক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সফলতার মাঝে দেশের বৃহত্তর সফলতার ভীত সৃষ্টিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার স্বত:স্ফূর্ত ও দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই দেশের উন্নয়নের পথ বেয়ে স্বাধীনতার সফলতা সুনিশ্চিত হবে এবং সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা গৌরবগাথা হয়ে বিশ্বে অধিকতর সমাদৃত হবে। (দৈনিক আজাদী থেকে নেয়া)

লেখক : এজিএম, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড

এই বিভাগের আরো সংবাদ