আজকের শিরোনাম :

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

হারজিতের গণতন্ত্র ও আমরা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০১৮, ১৩:৪৩

সমাজ ও রাজনীতি দুটোই বাস্তবিক সত্য, এদের মধ্যে পরস্পর নির্ভরশীলতাও রয়েছে, তবে চূড়ান্ত বিচারে সমাজ অধিক শক্তিশালী রাষ্ট্রের চেয়ে। ওদিকে আবার সমাজ ও রাজনীতি উভয়ই নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থনীতির দ্বারা। সাম্প্রতিক রাজনীতির যে ভয়াবহ চেহারা আমরা দেখছি সেই ভয়াবহতার কারণ হচ্ছে পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য। অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ বিরাজ করছে, এই পুঁজিবাদ উৎপাদনকে উৎসাহিত করে না, এর নির্ভরশীলতা লুণ্ঠন ও শোষণের ওপর। চরিত্রগতভাবেই পুঁজিবাদ মুনাফাবাদী। মুনাফার উদগ্র লিপ্সা, লুণ্ঠন ও শোষণ এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণবিহীনভাবে কাজ করছে।

পুঁজিবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের ব্যবধানটা খুবই স্পষ্ট। পুঁজিবাদ বিশ্বাস করে ব্যক্তিমালিকানায়, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা চায় সামাজিক মালিকানার। ঐতিহাসিকভাবে ব্যক্তি মালিকানার যুগ এখন শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে, ইতিহাস এবার মোড় বদল করবে সমাজতন্ত্রের দিকে। এটা অনিবার্য। নইলে আমাদের এই বিশ্ব মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। পৃথিবীব্যাপী এখন ব্যক্তিমালিকানার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জেগেছে ও লড়াই চলছে। শতকরা নিরানব্বই জন একজনের শাসন-শোষণ আর মানতে রাজি নয়। কিন্তু পুঁজিবাদ তবু টিকে আছে। কারণ তার আছে ছল, বল ও কৌশল। দুঃশাসনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে এখন সে আর কোনো মুখোশ রাখতে পারছে না; কনশেসন যে দেবে তাও সম্ভব নয়। সে এখন ফ্যাসিবাদী রূপ ধারণ করেছে। বর্তমানে ডোনাল্ড ট্রাম্প হচ্ছেন এর সবচেয়ে যোগ্য প্রতিনিধি। তিনি সকালে যা বলেন, দুপুরে তা বদলান, সন্ধ্যায় নতুন কথা আনেন। তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্রে প্রশংসা করবার মতো কিছুই নেই। কিন্তু তিনি নির্বাচিত হয়েছেন, এবং তাঁর দেশে এখনও তাঁর জনসমর্থন আছে। তিনি বর্ণবাদ, আমেরিকাকে মহৎ করার আদর্শ, আমেরিকা থেকে বিদেশীদের হঠানো ইত্যাদি বাণী প্রচার করছেন। গণমাধ্যম তার কথা প্রচার করছে, এবং আমেরিকার বর্ণবাদীরা তাঁর পক্ষে তৎপর রয়েছে।

বাংলাদেশেও সমাজ বদলের রাজনীতি যে মূলধারা হতে পারছে না সেটাও ওই পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্যের কারণেই। টাকাওয়ালারাই এখানে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। রাজনীতি চলে গেছে টাকার অধীনে। যাদেরকে বুর্জোয়া বলা হয় সেই ধনীরাই রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। গণমাধ্যম এদের মালিকানাধীন। সমাজতন্ত্রের পক্ষে যাঁরা দাঁড়ান তাঁরা রাষ্ট্রের হাতে নির্যাতিত হন, গণমাধ্যম তাদের কাজ ও আদর্শের প্রচার করে না। ওদিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষকে জীবিকার সন্ধান ও আয়োজনে সর্বক্ষণ ব্যস্ত রাখে, রাজনৈতিক ও সামাজিক যোগাযোগের পরিসরকে যতভাবে পারে সঙ্কুচিত করে দেয়। টাকার মালিকরাই বীর হিসেবে বিরাজ করে। তাদের আদর্শই আদর্শ হিসেবে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়।

পুঁজিবাদ যে কতটা বিবেকহীন ও নির্মম হতে পারে তার নিদর্শন হচ্ছে বর্তমান চীন। সমাজতান্ত্রিক চীন একদিন তার দেশের মানুষকে মুক্ত করেছিল। আগেরকালে চীন ঝিমাতো, সমাজতন্ত্র এসে তাকে কেবল জাগায় নি, হাসিতে আনন্দে মুখর করে তুলেছিল। চীন বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে অনুপ্রেরণা দিত, সমর্থন যোগাতো, সংশোধনবাদী সোভিয়েত নেতৃত্বের সমালোচনা করতো। পুঁজিবাদী উন্নতির আদর্শে দীক্ষিত হয়ে সেই চীন এখন নিজের দেশে মানুষকে উৎপাটিত করছে, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন শুরু করে দিয়েছে, জ্বালানী পুড়িয়ে ধরিত্রীকে উত্তপ্ত ও বিপন্ন করায় মনোযোগ দিয়েছে, দুর্নীতির দায়ে বড় বড় নেতাকে শাস্তি দিতে বাধ্য হচ্ছে, এবং জাতীয় স্বার্থে পৃথিবীকে দখল করে ফেলতে চাইছে। মিয়ানমারে গণহত্যা চলছে; চীন বলছে এটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, এ ব্যাপারে বিশ্বের কিছু করার নেই। অর্থাৎ গণহত্যা বৈধ, সেটা কোনো অপরাধ নয়। চীনের পুঁজিবাদী লক্ষণটা একাত্তরেও টের পাওয়া গেছে। একাত্তরে বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যা চলছিল, চীন বলেছিল সেটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

এটা একটা দৃষ্টান্ত। পুঁজিবাদীদের এটাই স্বভাব। বাংলাদেশের রাজনীতিও পুঁজিবাদীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তথাকথিত বুর্জোয়ারাই রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতিতে অপ্রতিহত ভাবে কর্তৃত্ব করছে। তারাই বীর, তারাই আদর্শ। ফলে এটা খুবই স্বাভাবিক যে বুর্জোয়াদের নোংরা ও হাস্যকর রাজনীতিই মূলধারা হিসেবে বিরাজ করবে, এবং সমাজতন্ত্রীরা কোণঠাসা হয়ে থাকবে। কিন্তু বুর্জোয়াদের রাজনীতি মানুষের মুক্তি আনবে না, সমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে, এখন যেমন যাচ্ছে।

নৈতিকতার দিক থেকে সমাজতন্ত্রীদের অবস্থান বুর্জোয়াদের তুলনায় অনেক উঁচুতে। বুর্জোয়াদের রাজনীতি ব্যক্তিগত মুনাফার লোলুপতা দ্বারা পরিচালিত, এর বিপরীতে সমাজতন্ত্রীরা চান সমষ্টিগত উন্নতি। বুর্জোয়ারা স্বার্থপর, সমাজতন্ত্রীরা সামাজিক। কিন্তু কেবল নৈতিক উচ্চতায় তো আন্দোলনে সাফল্য আসে না, আসবে না। প্রয়োজন জ্ঞানের উচ্চতাও। আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতারা যেমন নৈতিকতায় তেমনি জ্ঞানেও ছিলেন বুর্জোয়াদের চেয়ে অনেক উঁচুতে। বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের একটা বড় দুর্বলতা হচ্ছে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অব্যাহত ও অগ্রসরমান অনুশীলনের অভাব। কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, প্রয়োজন বাস্তবিক জ্ঞানও। যে সমাজে তাঁরা কাজ করছেন সেটির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সেখানে মানুষের স্বপ্ন, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব এগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার জন্য তাঁরা যথেষ্ট জ্ঞানের পরিচয় দিতে পারেন নি। এ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বামপন্থীরা ছিলেন চালিকা শক্তি, কিন্তু তাঁরা নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। নেতৃত্ব চলে গেছে বুর্জোয়াদের হাতে। এর মূল কারণ বামপন্থীদের নিজেদের ভেতর ঐক্যের অভাব, তাদের মস্কো ও পিকিং-এর ওপর নির্ভরতা, এবং প্রধান দ্বন্দ্বকে চিহ্নিত করণে অপারগতা। ব্রিটিশ আমলে যেমন পাকিস্তান আমলেও তেমনি জাতি সমস্যার সমাধান করাটা ছিল জরুরি কর্তব্য; ওই সমস্যার সমাধান না করে শ্রেণি সমস্যার সমাধানকে সামনে আনা সম্ভব হচ্ছিল না। ব্রিটিশ আমলে বিবদমান জাতীয়তাবাদীদের একপক্ষ এক জাতিতত্ত্ব অন্যপক্ষ দ্বিজাতিতত্ত্ব হাজির করেছিলেন; সমাজতন্ত্রীরা জানতেন যে উপমহাদেশে জাতি একটি বা দু’টি ছিল না, ছিল কমপক্ষে সতেরটি, এবং জাতীয়তার ভিত্তি ধর্ম ছিল না, ছিল ভাষা। বামপন্থীরা তাঁদের ওই জ্ঞানকে জনমানুষের সামনে নিয়ে আনতে পারেন নি। পাকিস্তান আমলে রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রধান দ্বন্দ্বটা দাঁড়িয়েছিল পাঞ্জাবী শাসকদের সঙ্গে শাসিত বাঙালীদের। এই সমস্যাটাকে জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন। বামপন্থীরা যে এ বিষয়ে অজ্ঞ ছিলেন তা মোটেই নয়, পূর্ববঙ্গের জন্য স্বাধীনতার দাবী তারাই প্রথমে তুলেছেন, তুলেছেন জাতীয়তাবাদীদের আগে; কিন্তু তারা এই দ্বন্দ্বকে যে তখনকার সময়ের প্রধান দ্বন্দ্ব বলে চিহ্নিত করবেন সেটা পারেন নি। ফলে জাতি সমস্যা সমাধানের নেতৃত্ব চলে গেছে জাতীয়তাবাদীদের হাতে, যারা ছিলেন পুঁজিবাদে দীক্ষিত। বাংলাদেশ যদি সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্বে স্বাধীন হতো তাহলে এর সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্র হতো সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অনেক উন্নত। সেটা ঘটে নি।

মুক্তিযুদ্ধের পরে ক্ষমতা চলে গেছে জাতীয়তাবাদীদের হাতে এবং স্বভাবতঃই তারা তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে বামপন্থীদেরকে। বামপন্থীদের মধ্যে যাঁরা মস্কোপন্থী ছিলেন তাঁরা জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে চলে যাওয়াটাকে সঠিক পন্থা ভেবেছেন; অন্যদিকে পিকিংপন্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছেন, জাতীয়তাবাদীরা তাদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে। সমাজতন্ত্রের আওয়াজটা তখন তুলে নিয়েছিলেন জাতীয়তাবাদীদেরই একাংশ, নিজেদেরকে যারা নাম দিয়েছিলেন জাতীয় সমাজতন্ত্রী বলে। এঁরা সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। যে কাজটা এঁরা করেছেন তা হলো সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষতিসাধন। ওদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন সমাজতন্ত্রীদের হতাশ করেছে। মস্কোপন্থীদের একাংশ যাঁরা আসলে মস্কোপন্থীই ছিল, কমিউনিস্ট ছিল না তাঁরা স্বেচ্ছা-বিলুপ্তিতে চলে গেছেন। একাত্তরের যুদ্ধে এমন বহু মানুষ শহীদ হয়েছেন জীবিত থাকলে যারা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দিতেন। মেধাবান অনেক তরুণ বিদেশে চলে গেছে, এদের বেশীরভাগই বামপন্থী আন্দোলনে থাকতো, যদি সে আন্দোলন বেগবান হতো।
এই মুহূর্তে দেশে যে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই এটা অধিকাংশ মানুষই টের পাচ্ছেন; আমিও পাচ্ছি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অত্যাবশ্যক হলো মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং আস্থাভাজন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। এই দু’টির কোনটিই নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নানা আইনী-বেআইনী পন্থায় খর্ব করা হচ্ছে। গণমামলা ও গণগ্রেফতার চলছে। মানুষ গুম ও খুন হচ্ছে। সরকার বিরোধীরা নির্বাচনী প্রচারের যথার্থ সুযোগ পাচ্ছে না। এগুলোর কোনোটাই নির্বাচনের জন্য নিঃশঙ্ক পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক নয়। আশা করবো যে পরিবেশ উন্নত করা হবে। কেননা সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।

জনগণ যে হারবে সেটা নিশ্চিত। আগেও তারা হেরেছে এবারও তারা হারবে। এর প্রধান কারণ তাদের নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক দল নেই। যারা জিতবে তারা সবাই দেখা যাবে টাকাওয়ালা; সবাই তারা পুঁজিবাদী আদর্শে দীক্ষিত এবং বড় দলের লোক। তাদের টাকা আছে। বস্তুত টাকাই তাদের প্রধান জোর, টাকা না থাকলে তাদের পক্ষে বড় দল থেকে নমিনেশন পাওয়াই সম্ভব হবে না, জেতা তো পরের কথা। নির্বাচন বাণিজ্যে যারা অর্থ বিনিয়োগ করবে তারা সে অর্থ বহুগুণে তুলে নেবে। ওই অর্থ জনগণের, যাদের শ্রমে দেশের অর্থনীতি টিকে আছে। নির্বাচনের পরেরদিন থেকেই দেখা যাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণ থেকে দূরে সরে গেছে, এবং নিজেদের স্বার্থে জনস্বার্থের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটাই তো বাস্তবতা।

বামপন্থীদের জোটটা আলাদা; আমরা সেভাবেই একে দেখতে চাই। অন্য জোটগুলোর উদ্দেশ্য একটাই। নির্বাচনে জেতা। বুর্জোয়াদের বড় যে দু’টি দল রয়েছে তাদের ভেতর সমঝোতা সম্ভব নয়, কারণ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তারা একে অপরের মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। এই দুই দলকে কেন্দ্র করেই বড় দু’টি জোট হয়েছে। জোট গড়ার প্রধান কারণ হলো বড় দুই দলের কারোই এমন নৈতিক ও জনসমর্থনগত জোর নেই যার ওপর ভরসা করে তারা একক ভাবে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারে। তাই তারা অন্যদেরকে কাছে টানতে চায়। এই অন্যরা ছোট ছোট দল। এদেরকে কিছু আসন ছেড়ে দিলেই চলবে। আর এই ছোট ছোট দলগুলোও এমন জনসমর্থন নেই যে তারা নিজেদের পায়ে দাঁড়াবে। দাঁড়ালে জামানত যে বাজেয়াপ্ত হবে এটা নিশ্চিত। তাই তারা জোটে আসছে। মিলনটা মোটেই আদর্শগত নয়, পুরোপুরি বৈষয়িক স্বার্থগত।

আশা করবো বামপন্থীদের জোটটা নির্বাচনী জোট হবে না। এই আশায় ভিত্তি হলো এই সত্য যে নির্বাচনে এরা যে জিতবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। এদের টাকা নেই, এদের পক্ষে কাজ করার প্রচার মাধ্যম নেই। এ দুটোই বড় অসুবিধা। বামপন্থীরা যদি নির্বাচনে যায় তবে যাবে কাজটাকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। নির্বাচনকে তারা তিনটি কাজে ব্যবহার করতে পারবে। এক. জনসংযোগ ও মতাদর্শ প্রচার। দুই. সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধি। তিন. নির্বাচনে যে জনগণ জেতে না, নির্বাচন যে আসলে কার হাতে পরবর্তী ৫ বছর ধরে জনগণ লাঞ্ছিত হবে সেটা বেছে নেবার একটা পদ্ধতি মাত্র, সেই সত্যটাকে উন্মোচিত করে দেওয়া। বামপন্থীদের দায়িত্ব সমাজ বিপ্লব সম্ভব করা। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমাজবিপ্লব ঘটবে না; তবে নির্বাচন সমাজবিপ্লবের কাজকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে।

বামপন্থীদের এমন জোট আগে কখনো হয় নি। জোট কাদের নেতৃত্বে এগুবে সেটা স্থির হয়ে যাবে আন্দোলনে কার কতটা ভূমিকা তার দ্বারাই।
দেশে রাজনীতির ধারা এখন দু’টি, একটি বুর্জোয়াদের অপরটি সমাজতন্ত্রীদের। এই দুই ধারা এক হবে না, এবং যতটা পরস্পর-দূরবর্তী থাকে দেশের জন্য ততটাই ভালো। বুর্জোয়াদের রাজনীতিই মূলধারা থাকবে, তবে সে রাজনীতি আরও কলহপ্রবণ ও নোংরা হয়ে উঠবে। কারণ বাংলাদেশের বুর্জোয়ারা ধন-দৌলতের দিক থেকে বুর্জোয়া হলেও, সাংস্কৃতিক দিক থেকে বুর্জোয়া নয়; বুর্জোয়াদের আপাত সৌজন্য ও সহনশীলতা তাদের নেই। তাছাড়া এটাও সত্য যে সারা বিশ্বেই বুর্জোয়ারা এখন আগের তুলনায় অনেক বেশী অসহিষ্ণু ও অভদ্র, তাদের রাজনীতি ক্রমশ ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের বুর্জোয়া রাজনীতিও এর বাইরে থাকবে না, বরং মানের দিক থেকে অধিকতর নিম্নগামী হয়ে পড়বে।

ভরসা তাই সমাজ-পরিবর্তনের রাজনীতিই। সে-রাজনীতির জন্য অবজেকটিভ পরিস্থিতি ক্রমশ পরিপক্ব হচ্ছে, এখন সাবজেকটিভ উপাদান কীভাবে এগোয় তার উপরই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সমাজ-পরিবর্তনের রাজনীতি এগুবে, কারণ মানুষ বিদ্যমান অবস্থাকে মেনে নেবে না, তাদের বাঁচার লড়াই সমাজ-পরিবর্তনের লড়াইয়ে পরিণত হবে। মুক্তির জন্য এদেশের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসটা মিথ্যা নয়; সংগ্রামের সেই অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসই বলছে যে মুক্তির সংগ্রাম এগুবে। ডান দিক থেকে সরে এসে তাকে বাম দিকেই এগুতে হবে। আমাদের সমষ্টিগত ভবিষ্যৎ এবং বাম আন্দোলনের ভবিষ্যৎ এক ও অভিন্ন।

শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। একটা আপাত ছোট কিন্তু আসলে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে গত ২৮ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদের অনুপস্থিতি। এমনটা পাকিস্তান আমলে ঘটা সম্ভব ছিল না, এমনকি ব্রিটিশ আমলেও নয়। দেশের রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীপরিষদের সদস্য, সরকারি দলের নেতা, সবাই বলেন ছাত্র সংসদ থাকা উচিত; হাইকোর্টও রায় দিয়েছেন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। এর অর্থ পরিষ্কার। ছাত্ররা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে জ্ঞানের চর্চা করুক। এ ব্যাপারে শাসক শ্রেণীর কোনো আগ্রহ নেই। এটা প্রতীকের মতো ঘটনা। শিক্ষাঙ্গনে যে প্রাণ নেই এ ঘটনা তার সাক্ষীও বটে। শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভাবে বিকশিত হচ্ছে না, শিক্ষাকে গ্রহণ করবার ক্ষমতাও তারা হারিয়ে ফেলছে। তাদের জীবনে সুস্থ বিনোদন নেই। ছেলেমেয়েরা হতাশায় ভুগছে। তারা মাদকে আসক্ত হচ্ছে। অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। বুর্জোয়াদের যখন যে দল রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পায় তখন তাদের ছাত্র সংগঠন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় আধিপত্য ও সন্ত্রাস কায়েম করে। ভিন্ন মত প্রকাশের সুযোগ তারা লুপ্ত করে দেয়।

ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য পথ তৈরি করা হচ্ছে না। তবে সে পথ অবশ্যই তৈরি হবে। তরুণ প্রজন্ম পথের রুদ্ধ দশাকে মেনে নেবে না। তারা পথ তৈরি করে নেবে; নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় যেমন করে তৈরি করে নিয়েছিল। তারা রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যাধি সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু সমাজ তো বদলাবে না যদি না মেহনতী মানুষকে সংগঠিত করা যায়। তরুণরা সেটা বুঝবে বলেই আশা করি। বিশেষ ভাবে বুঝবে তারা অবস্থার ক্রমবর্ধমান চাপেই।  (দৈনিক আজাদী থেকে সংগৃহীত)

লেখক : শিক্ষাবিদ, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরো সংবাদ