আজকের শিরোনাম :

এত বড় অভিযোগে রাজনৈতিক জীবনে কালি পড়ে যাওয়ার কথা

  প্রেমাংশু চৌধুরী

২২ জুলাই ২০২১, ২১:০৩ | অনলাইন সংস্করণ

নেতা ও নাগরিকদের ফোনে কেন্দ্রীয় সরকারের বেআইনি নজরদারির অভিযোগ ওঠার পর তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিবাদ, কলকাতা।
নরেন্দ্র মোদী সে দিনও মৌনী ছিলেন। নরেন্দ্র মোদী আজকেও মৌনী। সে দিন মানে— ২০১৩-র শেষবেলা। সামনে ২০১৪-র লোকসভা ভোট। নরেন্দ্র মোদী বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। গোটা দেশ জুড়ে প্রচার করছেন। ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন বিলি করছেন। ঠিক সেই সময়ই অভিযোগ ওঠে, গুজরাতের পুলিশ-প্রশাসন ৩৫ বছর বয়সি এক মহিলার ফোনে আড়ি পাতছিল। আর্কিটেক্ট মহিলা ও তাঁর ব্যবসায়ী পিতা, দু’জনের সঙ্গেই নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত পরিচিতি ছিল। অভিযোগ ছিল, অমিত শাহের নির্দেশে রাজ্য পুলিশের অ্যান্টি-টেররিস্ট স্কোয়াডের এসপি (অপারেশনস) গিরিশ সিঙ্ঘল ও তাঁর বাহিনী ৬২ দিন ধরে ওই মহিলার ফোনে আড়ি পেতেছিল, প্রতি মুহূর্তের গতিবিধির উপরে নজর রেখেছিল। সিঙ্ঘল তাঁর সঙ্গে অমিত শাহের কথাবার্তা রেকর্ড করে রেখেছিলেন, সে রেকর্ডিং ফাঁস হয়ে যায়। দেখা যায়, অমিত শাহ তাঁর এক ‘সাহেব’-এর কথায় সিঙ্ঘলকে নজরদারি চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন।

অভিযোগ উঠেছিল, এই ‘সাহেব’ আর কেউ নন, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর নির্দেশেই ফোনে আড়ি পাতা হয়। প্রধানমন্ত্রীর গদিতে সাত বছর পার করে দেওয়ার পরে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ফের ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ।

ভোটের প্রচারে মোদী মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তুলছেন। মনমোহন সিংহকে ‘মৌনমোহন’ বলে কটাক্ষ করছেন। কিন্তু নিজের রাজ্যে সরকারি ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ফোনে আড়ি পাতার ব্যাখ্যা মোদী দেননি। বিরোধীরা প্রশ্ন তুললেও তিনি নীরব ছিলেন।

নরেন্দ্র মোদী এখন প্রধানমন্ত্রী। অমিত শাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দেশের শীর্ষ আদালতের রায়ে ব্যক্তি-পরিসরের অধিকার, নিজের তথ্য গোপন রাখার অধিকার এখন সংবিধান-প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। সেই অধিকার রক্ষার নৈতিক দায়িত্ব সরকারের উপরে বর্তায়। কারও ফোনে বেআইনি ভাবে আড়ি পাতার অভিযোগ উঠলে সরকারেরই নৈতিক দায়িত্ব, তদন্তের নির্দেশ দেওয়া। অথবা স্পষ্ট ভাবে জানানো, সরকারি নির্দেশেই দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে।

পেগাসাস স্পাইওয়্যার কেলেঙ্কারিতে মোদী সরকার এর কোনওটাই করছে না। তাই প্রশ্ন ওঠে, রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বিরোধীদের ফোনে আড়ি পেতে মোদী-শাহ কি ভোটে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টা করছিলেন? তার আইনগত বা সাংবিধানিক দিক নিয়ে প্রশ্ন তো পরের কথা, প্রথম প্রশ্ন হল, এ কাজ কতখানি নৈতিক?

দ্বিতীয় প্রশ্ন, মোদী-শাহ কি রাহুল গাঁধী, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এতই ভয় পান? মোদী সাধারণত সরাসরি রাহুল গাঁধীর নাম বলেন না। গুরুত্ব দিতে চান না। অমিত শাহ ‘রাহুলবাবা’ বলে অবজ্ঞা করেন। ৫৪৩ আসনের লোকসভায় বিজেপির হাতে ৩০০-র বেশি আসন, কংগ্রেসের মাত্র ৫২। একার জোরে মাত্র তিনটি রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় টিকে রয়েছে। তার পরেও সেই দলের নেতার ফোনে কেন নজরদারি? পশ্চিমবঙ্গে ভোটের প্রচারে গিয়ে মোদী-শাহ ‘ভাইপো’-র কথা তুলতেন বটে, কিন্তু তাঁরা যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এতটাই ভাবিত, তা আঁচ করা যায়নি।

আড়ি পাতার কোনও অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু মোদী সরকার ফোনে আড়ি পাতার কথা স্বীকারও করছে না, অস্বীকারও করছে না। বিরোধীদের ফোনে সরকারই আড়ি পেতেছে, সে কথা বলছে না। সরকার আড়ি না পাতলে অন্য কে পেতেছে, তা নিয়ে তদন্তের নির্দেশও দিচ্ছে না। তাঁর বা তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠলে প্রধানমন্ত্রী বরাবরই নীরব থেকে পরিস্থিতি পাল্টানোর অপেক্ষায় থাকেন। এ বারেও বোধ হয় সেই কৌশল।

এ দেশে ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ নতুন নয়। তবে একেবারে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে এ ভাবে বেপরোয়া হয়ে নিজের মন্ত্রী, বিরোধী নেতাদের ফোনে আড়ি পাতার চেষ্টার অভিযোগ আগে ওঠেনি। চন্দ্রশেখর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন রাজীব গাঁধীর দশ জনপথের বাড়ির সামনে দুই পুলিশকর্মী মোতায়েন করে নজরদারির অভিযোগ উঠেছিল। তার জেরেই কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করে চন্দ্রশেখর সরকার ফেলে দেয়। সেখানেও ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ ছিল না।

মনমোহন জমানাতে সিবিআই টু-জি মামলার তদন্তে ‘কর্পোরেট লবিস্ট’ নীরা রাডিয়ার ফোনে আড়ি পেতেছিল। রাডিয়ার সঙ্গে দেশের প্রথম সারির শিল্পপতি, রাজনীতিকদের কথাবার্তার রেকর্ড ফাঁস হয়ে যায়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ মৌন থাকেননি। শিল্পমহলের সামনেই তিনি বলেছিলেন, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে, আয়কর ফাঁকি বা আর্থিক নয়ছয় রুখতে ফোনে আড়ি পাতার ক্ষমতা থাকা দরকার। কিন্তু তার অপব্যবহার হতে দেওয়া যায় না। তদন্তের নির্দেশ দেন মনমোহন।

নিয়ম ভেঙে তদন্তের স্বার্থে কারও ফোনে আড়ি পাতা আর বেআইনি ভাবে নির্বাচনের সময় বিরোধী শিবিরের নেতাদের ফোনে আড়ি পাতা— দুইয়ের মধ্যে অবশ্য আকাশপাতাল ফারাক। ভোটের সময় বিরোধী নেতাদের ফোন হ্যাক করার অর্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখানোর চেষ্টা। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে সে অভিযোগ উঠছে বলে গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমেই মোদী সরকার সমালোচিত হচ্ছে। সরকারের সমালোচনা হলেই বিজেপি-আরএসএস নেতারা তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে ফেলে দেন। এ বার মোদী সরকার তথা বিজেপির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কারচুপি করার অভিযোগ। বিজেপি তাই দাবি করছে, এ হল দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা। কিন্তু কারসাজি যে হয়নি, গণতন্ত্র যে অক্ষত, তা প্রমাণ করার নৈতিক দায়িত্ব সরকারেরই।

ভোটের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কথাবার্তায় আড়ি পাতার চেষ্টার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমেরিকার ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন নির্বাচনের মুখে প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির দফতরে আড়ি পাতার চেষ্টা করেছিলেন। সেই কেলেঙ্কারি ফাঁস হতে তদন্ত শুরু হয়। বিপদ টের পেয়ে নিক্সন প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেন। এ দেশেও আশির দশকে কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী, জনতা পার্টির নেতা রামকৃষ্ণ হেগড়ের বিরুদ্ধে কংগ্রেস নেতাদের ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ ওঠে। হেগড়েকে পদত্যাগ করতে হয়। তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পদের দাবিদার হয়ে ওঠার পথেও সেখানেই কাঁটা পড়ে যায়।

এতেই স্পষ্ট, কেউ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর ফোনে আড়ি পাতলে, গণতন্ত্রে কালির ছিটে পড়ুক বা না পড়ুক, যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কালি পড়ে যায়। বিজেপি বলছে, সরকার বা বিজেপির যোগ থাকার কোনও প্রমাণ মেলেনি। অমিত শাহের দাবি, বিরোধীরা পেগাসাস কাণ্ডের ফোন হ্যাকিং নিয়ে হইচই বাধিয়ে উন্নয়নের দিক থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা করছেন। প্রশ্ন হল, বিরোধীরা কি তাঁদের ফোন থেকে নির্বাচন কমিশনার, মায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ফোন হ্যাক করার চেষ্টা হচ্ছিল জেনেও চোখ-কান-মুখ বুজে থাকবেন?

দেশে বিরোধী শিবিরের এখনও অনেকটাই কোমরভাঙা অবস্থা। আমজনতার কোনও সমস্যা নিয়েই বিরোধীরা তেমন ভাবে সরকারকে চেপে ধরতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী কোনও সাংবাদিক সম্মেলন করেন না। কোনও প্রশ্নের মুখোমুখি হন না। এত দিন তাঁর সম্পর্কে বলা হত, তিনি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে ভয় পান। তাই শুধু নিজের ‘মন কি বাত’ বলেন। এ বার তাঁর বিরুদ্ধে অন্যের ‘মন কি বাত’ শোনার অভিযোগ। তিনি কি এর উত্তর দেবেন? না দিলে এই দুর্বল, ছত্রভঙ্গ বিরোধীদেরও মোদী-শাহ জুটি ভয় পান, সেটাই হয়তো প্রমাণ হবে।

সৌজন্যে: আনন্দবাজার

এই বিভাগের আরো সংবাদ