আজকের শিরোনাম :

১৭ মে : প্রলয়ের বদ্বীপে বঙ্গবন্ধুকন্যার সৃজনের সংগ্রাম

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ মে ২০১৮, ২৩:০০

সাদ্দাম হোসেন, ১৬ মে, এবিনিউজ : ‘আমাদের সকল ভরসার স্থল জাতির জনক আজ নেই। জনতার মুক্তির দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনাপর্বে তিনি বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় প্রতিক্রিয়ার হিংস্র চক্রান্তে। কিন্তু মহামানবের মৃত্যু নেই, মুক্তির দিশারী বেঁচে থাকেন মুক্তিসংগ্রামের প্রাণশক্তিরূপে। তিনি আমাদের কর্ম ও চেতনার হাতিয়াররূপে নির্মাণ করে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর এই কর্মসূচীকে আমরা বহন করে চলেছি মানুষের মুক্তির মিছিলে। আর এই মিছিলের অগ্রসেনানী শেখ হাসিনা।’

বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ‘বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক’ সম্বোধন করে ছাত্রলীগের প্রচারপত্রে সেদিন আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল ‘জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করবে এ প্রত্যাবর্তন।’

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ ঘাতকেরা স্তব্ধ করে দিয়েছিল সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় মুক্তির দুর্বার আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নদ্রষ্টাকে। ১৭ মে, ১৯৮১ শেখ হাসিনা পিতার রক্তসিক্ত প্রিয় পলিমাটি স্পর্শ করেই বাংলাদেশের জনগণকে জানান দিলেন, স্বপ্নের মৃত্যু নেই, শহীদের রক্ত অপরাজেয়।

১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সম্মেলনে শেখ হাসিনা প্রবাসে থাকাকালীনই সভাপতি নির্বাচিত হন ইতিহাসের অমোঘ অনিবার্যতায়। তাঁর নেতৃত্বে আসীন হওয়া আরোপিত ছিল না, গণসংগঠনের কর্মীদের প্রত্যাশার রুপায়নের মাধ্যমেই রাজনীতিতে তার হিরণ্ময় উদ্বোধন।

অন্য রাজনীতিকদের সাথে যে পার্থক্য শেখ হাসিনা তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্যবার প্রমাণ করেছেন, সে মৌলিকত্ব ছাপ রেখেছে প্রারম্ভেও। রাজনৈতিক দলের গতানুগতিক ব্যাকরণের বৃত্ত ভেঙ্গে, দলীয় পরিচিতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আরম্ভ থেকেই তার পদচারণা বৃহত্তর জাতিসত্তার আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের সংগ্রামে, তিনি মিতালি অনুভব করেছেন জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রবাহমানতায়, নিছক দলীয় রণকৌশলে নয়। দলীয় সভানেত্রী তাঁর পরিচিতিসূচক পদবী ছিল, সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে তিনি ছিলেন জননেত্রী। দল-মত-নির্বিশেষে প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মীদের পাশে তিনি ছিলেন তাদেরই একজন হয়ে, চলতি হাওয়ার পন্থী হওয়া নেতার মত নয়, কালোত্তীর্ণ নেতারা যেমন হন।
‘দেখে সে উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ, হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায় বৃথা যায়।’ - এমনই ছিল ১৯৮১র বাংলাদেশ। গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটিও ঠুকে দিয়ে সামরিক স্বৈরাচারের সে কী দোর্দণ্ড প্রতাপ! বাঙালি জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অপাংক্তেয় করে দিয়ে কৃত্রিম পরিচয়ের সাতচল্লিশীয় অনুসন্ধান চলছে জোরেশোরে! আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের অপরিহার্য অনুষঙ্গ, মানবিক রাজনৈতিক দর্শন, প্রাগ্রসর রাষ্ট্রচেতনা ধর্মনিরপেক্ষতাকে খোলনলচে বদলে ফেলার আয়োজনের কমতি নেই। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে কতিপয়ের অর্থ বানানোর মেশিনারিজে পরিণত করার কী সুনিপূণ কর্মকৌশল! মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম, জনগণের সার্বিক মুক্তির ন্যূনতম প্রয়াসও যখন ক্ষমতার অধিকারীদের কাছে অপরাধ, সে সময় সাংবিধানিক ‘দায়মুক্তি’ নিয়ে জনকখুনীরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কী অশ্লীলভাবেই না আস্ফালন করছিল! জনগণের ভোট ও ভাতের পবিত্র অধিকারের সাথে বেঈমানী করে গণশত্রুরা অব্যাহত রাখে তাদের ক্ষমতা-ক্ষমতা খেলা!

ফ্রান্সের মিউজ নদীর তীরের দঁরেমি গ্রামের জোয়ান অব আর্ক ইংরেজদের সঙ্গে শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন, নিশ্চিত করেন শৃঙ্খলিত ফরাসি জাতির মুক্তি; তার সংগ্রামের সাথে তুলনা চলে শেখ হাসিনার। বাংলাদেশে তিনি ফিরে আসেন পরাজিত বিশ্বাসের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে আবদ্ধ মানচিত্রকে মুক্ত করার পণ নিয়ে, জনগণের স্বপ্ন-মূল্যবোধ-বিশ্বাসকে গণপ্রজাতন্ত্রের কেন্দ্রে স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে। সাদা রঙের ওপর কালো ডোরাকাটা তাঁতের শাড়ী আর চোখে মুখে শুভবোধের শুভ্রতা নিয়ে যখন কুর্মিটোলায় নামেন, স্বজনহারা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের মানুষই অভয় দেন- ‘শেখ হাসিনা ভয় নাই, আমরা আছি লাখো ভাই’। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা আর বাঙালি জাতির গ্লানিমুক্তির জন্য তিনি বিশ্বাস রাখেন কোন দর্পী জলপাই রঙের শোষকের কাছে নয়, জনগণের কাছেই। অশ্রুভেজা চোখে বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। বর্তমান সরকারের কাছে আমার কোন প্রত্যাশা নেই। আমি বিচার চাই আপনাদের কাছে, জনগণের কাছে।’

শুধু অতীতের প্রতিই যাদের সীমিত দায়বদ্ধতা থাকে, শেখ হাসিনা তো তাদের দলে নন, যুগান্তরের সন্ধিক্ষণে উত্তীর্ণ হওয়াই তাঁর বিধিলিপি। তাই তিনি আস্থা রাখেন ভবিষ্যতে, শপথ নেন সৃজনের, গঠনের, জনগণকে গভীর বিশ্বাসে বলেন, ‘আপনারা আমার সাথে ওয়াদা করুন, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করব। বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি।’

এ বদ্বীপের দুঃখী মানুষের আনন্দ-বেদনা-সংকট-সম্ভাবনা সহজিয়া লোকজ সুরে যখন শেখ হাসিনার কণ্ঠে অনুরণিত হয়, তখন যেন মানবিকতার তুমুল তরঙ্গে নিঃশব্দের ভেতর থেকে জেগে ওঠে এক শব্দকোকিল।

বৃষ্টিসিক্ত সেদিনের ঢাকায় বঙ্গবন্ধুকণ্যাকে এক পলক দেখার জন্য ঢাকা যেন পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। কুর্মিটোলা থেকে মানিক মিয়া এ্যভিনিউ পৌঁছাতে সময় যেন ইতিহাসের স্বর্ণখণ্ড হয়ে মহাকালের ফ্রেমে স্থায়ীভাবে গাঁথা হয়ে যায়। ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলেছিল, ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, শেখ হাসিনা, আমরা আছি তোমার সাথে।’ সত্য, সুন্দর আর ন্যায়ের প্রতি নিঃশর্ত ভালবাসা জানিয়ে, সংগ্রামের যূথবদ্ধতার অঙ্গীকার করে শেখ হাসিনার বিপ্লবী অভিযাত্রাকে এভাবেই অভিবাদন জানিয়েছিল এদেশের গণমানুষ। প্রতীকী অর্থে, সেদিনের মতোই ঝড়ের সাথে শেখ হাসিনার নিবিড় ঐকতান।

বাংলার মানুষের সমাজ-রাজনীতির যৌথজীবনে ঝড়ো হাওয়া যতবার তাড়া করেছে, সাহসের দ্বীপশিখা হয়ে জনতাকে ততবার পথ দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা, আশার পিদিম জ্বালিয়ে বিশ্বাসী সারথী হয়ে জনগণও পাশে থেকেছে তাদের প্রিয় নেত্রীর। ভয়কে জয় করাই যার ব্রত, সে অকুতোভয়কে দমিয়ে রাখে সাধ্য কার? ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ আরেক জেনারেল যখন সামরিক আইনের ঘেরাটোপে বৃত্তবন্দী করে, অব্যাহত রাখে কালো শাসনের পৌনঃপুনিকতা, সামরিক শাসনের দু’দিন পরে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার, সামরিক স্বৈরশাসন অবসানের ইস্পাতদৃঢ় প্রতিজ্ঞা। ১৯৮৩তে ছাত্রদের রক্তভেজা মধ্যফেব্রুয়ারীর বিক্ষোভের পরপরেই বৃহত্তর গণআন্দোলনের লক্ষ্য নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ১৫ দলীয় ঐক্যজোট।

এভাবে আশির দশকের পরতে পরতে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের দিনগুলি বঙ্গবন্ধুকণ্যার সংগ্রামের অজেয় প্রতিলিপি। জাহানারা ইমামের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলনের ভরসাও ছিলেন শেখ হাসিনা। রাষ্ট্র যখন চোখ রাঙ্গিয়েছে, শেখ হাসিনা অভয় দিয়েছেন আন্দোলনকারীদের, সাহসের সাথে এগিয়ে যেতে বলেছেন। কিছুতেই দমে যাননি। জাহানারা ইমামের কণ্ঠধ্বনিত ‘জনগণের চেয়ে বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জয় আমাদের হবেই’ যেন জননেত্রীরই বিশ্বাসের স্ফূরণ! গণতন্ত্রের আবরণে আবার যখন মানুষের তার প্রতিনিধি বাছাইয়ের অধিকারকে অবদমিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, জনগণকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকণ্যা নিশ্চিত করেছেন ‘জনগণের ক্ষমতায়নের’ ধারণাকেই। বাংলাদেশ অভিযাত্রার এসব বিজয় হল, ১৭ মে, ১৯৮১তে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ছিল দোলায়মান; অনৈক্য, অবিশ্বাস, আপসমুখীনতা ক্রমাগত এসব রোগে ক্ষয়ে যেতে যেতে শক্তিবৃদ্ধি ঘটছিল অপশক্তির। নেতৃত্ব ছিল ভঙ্গুর, কর্মীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার অঙ্গীকারের প্রতি প্রতিকূলতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে সহযোগী প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মীরা ছিল বিভ্রান্ত, শক্তিহীন, কখনো কখনো সামরিক সরকারের আশির্বাদপুষ্ট। আন্তর্জাতিক শক্তির লক্ষ্য ছিল তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ হাসিল করা, জনগণতান্ত্রিকতার প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা ছিল সুস্পষ্টভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ। শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বেই বাংলাদেশ এসবের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। ফিনিক্স পাখির মতোই ধ্বংসের স্তূপ থেকে জন্ম নিয়ে তার ডানায় ভর করে আজও উড়ে চলেছে বাংলাদেশের স্বপ্ন।

মানুষকে আলো উপহার দেয়ার 'অপরাধে' প্রমিথিউসের উপর ক্ষিপ্ত ছিলেন জিউস। তেমনি বাংলাদেশের দুঃখী মানুষকে আলোকের ঝরণাধারায় নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসের জন্য শত্রুর বুলেট আর গ্রেনেড অনেক বার তাড়া করেছে তাঁকে। জনগণ মানবঢাল নির্মাণ করে প্রমাণ করেছে কতটা ভালোবাসে তারা বাংলার নয়নমণিকে। আমাদের সময়ের প্রমিথিউস গ্রিক পূরাণের মতই বাঙালি জাতিকে সরবরাহ করেছেন, ‘সাহস, শক্তি আর দ্রুতি’, শিখিয়েছেন ‘কিভাবে সোজা হয়ে হাঁটতে হয়’। অজেয়, স্পর্ধী, স্বাপ্নিক বাংলাদেশের রূপকার হলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। ১৭ মে, ১৯৮১ তাঁর আগমনধ্বনিই শুনিয়েছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত প্রিয় মাতৃভূমিকে।

চেক উপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা লিখেছিলেন, ‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম।’ ১৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্মারকগুলোকে পরাজিত হতে দেখেছে। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছে ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জনগণ ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম জারি রাখবে। সে সংগ্রামে বিজয়ীর নাম বাংলাদেশের জনগণ, শেখ হাসিনার মাঝেই যারা তাদের স্মৃতিকে খুঁজে পেয়েছে।

লেখক : সাদ্দাম হোসেন
আইন বিষয়ক উপ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ

এই বিভাগের আরো সংবাদ