আজকের শিরোনাম :

বাঙালির বিজয় দিবস

  পবিত্র সরকার

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১২:১৩ | অনলাইন সংস্করণ

যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন, বিংশ শতাব্দীতে এই দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সবচেয়ে বড় ঘটনা কী ঘটেছিল, তা হলে অনেকেই হয়তো বলবেন, ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা বা দেশভাগ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একটা ভালো (!) দিক এই যে, তা সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যুঘণ্টা বাজাল, আর তারই ফলে, ভারতীয় উপমহাদেশ তার বহুবাঞ্ছিত ‘স্বাধীনতা’ লাভ করল। এই উজ্জ্বল ঘটনার উল্টো পিঠে ছিল, চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠের মতো দেশভাগ, ধর্মনির্ভর জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ভারতের ভূমি ভাগ করে দু’টি পৃথক রাষ্ট্রের নির্মাণ— ভারত ও পাকিস্তান।
কিন্তু তার পরেই হয়তো অনেকের মনে হবে, তাই তো! ‘স্বাধীনতা’র চব্বিশ বছর পরেই তো ঘটে গেল আর-এক ‘স্বাধীনতা’, দেশভাগের পরে আর-এক দেশভাগ— তা হল শেখ মুজিবর রহমানের শৌর্যময় নেতৃত্বে বাংলাদেশের জন্ম, ১৯৭১ সালে। পৃথিবীর মানচিত্র খুঁড়ে একটি নতুন দেশের জন্ম হল। আমরা যদি এবার প্রশ্ন করি, ‘কীভাবে?’ তার উত্তরে আমাদের যে ঘটনায় পৌঁছতে হবে সময়ের উজান পেরিয়ে, তার নাম ‘ভাষা-আন্দোলন’। রাজনৈতিক আন্দোলনের এই নতুন মাত্রা আগেকার পৃথিবী মনে হয় কোথাও তেমন করে প্রত্যক্ষ করেনি। এবং ভাষার আন্দোলন থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হবে, এ ঘটনাও পৃথিবীতে অভিনব, হয়তো আর কখনও ঘটবে না। আর, আমরা আরও লক্ষ করব, পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলন শুধু মুক্তিযুদ্ধের গন্তব্যে পৌঁছে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে ক্ষান্ত হয়নি, সারা পৃথিবীর কাছ থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছে।
একুশের আগেকার কথা
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ একটি ঐতিহাসিক দিন, তবে আরম্ভের আগেও তো আরম্ভ থাকে, কত আগে সেই আরম্ভ তা ঠিক করতে সমস্যা হয়। সংক্ষেপে বলি, বাঙালি হিন্দুর যেমন মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় লেখা নিয়ে সমস্যা ছিল (বাংলায় কাব্য লিখলে এগারো হাজার বছর রৌরব নরকে ঠাঁই হবে), বাঙালি মুসলমানদেরও সমস্যা ছিল বাংলায় লেখা নিয়ে। ভাষার উপর ধর্মের এই আধিপত্য দ্বিজাতিতত্ত্বের এক প্রাচীন সূত্র। বিশ শতকে মহম্মদ আলি জিন্না তারই উপর ভিত্তি করে ভারত-পাকিস্তান ভাগ করতে সফল হলেন। ভাষা নিয়ে বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা বেশিরভাগই বাংলার পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানপন্থী মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছিলেন, তাঁদের মতামতের উপর ভরসা করে পাকিস্তানের কর্তারা উর্দু রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করলেন। অবাঙালিরা, যেমন ভারতের মুসলিম লিগের চৌধুরী খালেকুজ্জামান বা আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ জিয়াউদ্দিন আহমেদ আগেই তেমন দাবি তুলেছিলেন। তবে পূর্ব পাকিস্তানে (তখন পূর্ববঙ্গ) বেশ কিছু বাঙালি বাংলার পক্ষেও এগিয়ে আসেন, যেমন আবদুল হক (দৈনিক ইত্তেহাদ, ২৯ জুন, ১৯৪৭) প্রশ্ন তোলেন, ‘আমরা কেন আমাদের দেশে ইংরেজি-উর্দু-হিন্দি বলতে বাধ্য থাকব?’ আবুল কাসেম, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ আরও অনেকে এই স্বরে কণ্ঠ যোগ করেন এবং তমদ্দুন মজলিস ১৯৪৭-এর অক্টোবরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনেও উর্দুর পক্ষে মত প্রকাশ করা হয়। এই বিতর্কের মধ্যে মুসলিম লিগ পন্থীরা নানা জায়গায় হাঙ্গামাও তৈরি করে।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণ-পরিষদের অধিবেশনে কুমিল্লার কংগ্রেস সাংসদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। পরে এমন ঘটবে যে, এই ‘দুষ্কর্মে’র জন্য ১৯৭১-এ পাক বাহিনী তাঁর চোখের সামনে তাঁর পুত্রকে দুঃসহ নির্যাতন করে হত্যা করবে, এবং তাঁকেও নির্মমভাবে হত্যা করবে। কিন্তু সেই অধিবেশনেই পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন তার বিরোধিতা করে বলেন যে, পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ লোক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। উর্দুপন্থীদের যুক্তি ছিল, রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম, আর ইসলামের সংস্কৃতিকে বহন করে উর্দুভাষা। এক রাষ্ট্র, এক ধর্ম, এক রাষ্ট্রভাষা। আমাদের দেশেও ভাষার নাম বদলে, এই ধরনের স্লোগান আজকাল শোনা যাচ্ছে।
এর পর, ওই তমদ্দুন মজলিস, আর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লিগের কাউন্সিলের সদস্য শেখ মুজিবর রহমান এবং তাঁর সহকর্মীরা ১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখের এক বিবৃতিতে ‘যুক্ত রাষ্ট্রভাষার’ দাবিতে ১১ মার্চ তারিখে এক সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন। পাশাপাশি ধর্মঘটের বিরুদ্ধেও চক্রান্ত চলতে থাকে। কিন্তু ঢাকায় ছাত্রদের বিপুল সংখ্যায় যোগদান, ব্যাপক পিকেটিং, সরকারি ও বেসরকারি অফিস-আদালত অবরোধ, সচিবালয়ের সামনে রাস্তায় শুয়ে পড়ে প্রতিবাদ এবং তাকে স্তব্ধ ও নিষ্ক্রিয় করতে পুলিসের ব্যাপক অত্যাচার ও গ্রেপ্তার, তার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল সমাবেশের মধ্যে সারা দেশের যুবশক্তি উত্তাল হয়ে ওঠে। এমনকী সেদিনের পুলিস-প্রহারের শিকার ছিলেন অখণ্ড বাংলার ‘প্রধানমন্ত্রী’ এ কে ফজলুল হকও। তীব্র প্রতিক্রিয়া অব্যাহত রইল। ১৩ মার্চ ঢাকার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হল। অশান্তি এড়ানোর জন্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন একটি চুক্তি করেন, যাতে এ পর্যন্ত ভাষা-আন্দোলনে বন্দিদের মুক্তি, শাস্তি মকুব ইত্যাদি দাবি তিনি মেনে নেন। কিন্তু ছাত্রদের বিক্ষোভ চলতেই থাকে, আর এই সময়ে শেখ মুজিবকে নেতৃত্বের ভূমিকায় এগিয়ে আসতে দেখা যায়।
১৬ মার্চ ঢাকায় এলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ আলি জিন্না এবং সেখানেও তিনি শাসকপক্ষের কথারই পুনরাবৃত্তি করেন, ‘Urdu, and only Urdu will be the state language of Pakistan!’ (উর্দু, কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা!) শুনে ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়, কিন্তু ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন উপলক্ষে তিনি এই একই কথা বললে ছাত্ররা ‘নো, নো’ চিৎকার দিয়ে প্রতিবাদ জানায়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনায় বসেও জিন্না নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং ছাত্রদের দেশদ্রোহী, ভারতের গুপ্তচর ইত্যাদি বলতে ছাড়েন না। যাই হোক, ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ সালে জিন্নার মৃত্যুতে ভাষা-আন্দোলন কিছুটা পিছনে সরে যায়। কিন্তু নাজিমুদ্দিন সাহেব তাকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার চেষ্টায় ক্ষান্ত দেন না। এই বছরের শেষ, আর ১৯৪৯ বছরের প্রথম দিনে কার্জন হলে যে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন হয় তার সভাপতি ডঃ ম্হুম্মদ শহীদুল্লাহ-র এই কথাগুলি স্মরণীয় হয়ে আছে— ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙ্গালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপী-লুঙ্গী-দাড়িতে ঢাকবার জো নেই।’
পাকিস্তানের চেষ্টা অব্যাহত থাকে। যেমন ১৯৪৯-এর গোড়াতেই (ফেব্রুয়ারি) পাকিস্তান সরকার চেষ্টা করে বাংলা লেখার জন্য প্রচলিত বর্ণমালাকে সরিয়ে তার বদলে আরবি হরফ প্রবর্তনের। তার পরেই ৯ মার্চ ১৯৪৯ তারিখে প্রাদেশিক সরকার ‘পূর্ব বাঙলা ভাষা কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, রীতি, লিখনপদ্ধতি ইত্যাদি ‘সরলীকরণ’-এর লক্ষ্যে কাজে এগয়। কেন্দ্রীয় সরকারের নানা কমিটিও একই সুর বাজাতে থাকে। বছরখানেক পরে স্কুলশিক্ষকদের আরবিতে বাংলা লেখার ট্রেনিং দেওয়ার প্রস্তুতিও চলে। সমগ্র পূর্ববঙ্গে তার তীব্র প্রতিবাদ হয় এবং একটি প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং ডঃ শহীদুল্লাহ। এই সময়ে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রচুর গণ-আন্দোলনও গড়ে উঠতে থাকে, তাতে ছাত্ররা যোগ দেওয়ায় ছাত্রদের জরিমানা, বহিষ্কার, জেল ও নানারকম শাস্তি হতে থাকে। তারও পাল্টা প্রতিবাদ চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে। নতুন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামি মুসলিম লিগ, যা পরে প্রদেশের রাজনীতিতে, ‘মুসলিম’ চিহ্ন বর্জন করে, এক দুর্জয় শক্তি হয়ে উঠবে। নবগঠিত বাম মনোভাবের পূর্ব পাকিস্তান যুব লিগ তাদের ২৭-২৮ মার্চের সম্মেলনে ঘোষণা করে— আমরা মনে করি, উর্দু ও বাংলা একত্রে রাষ্ট্রভাষা হলে পাকিস্তান দুর্বল হবে না এবং আরবিতে শিক্ষাদানের সুপারিশ আসলে দরিদ্র কৃষকদের নিরক্ষর রাখার প্রকল্প। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনের কর্মচারীদের আন্দোলনে অংশ নিয়ে শেখ মুজিবের জেল হয়, তাঁর মুক্তির আন্দোলন, আর অন্যান্য নানা আন্দোলনে পাকিস্তানের এই অংশ বিক্ষুব্ধ থাকে।
এই ভাষা-বিতর্কে আর একটি মাত্রা এর মধ্যে যুক্ত হয়েছিল। তা হল, বর্ণমালায় যাই হোক— এতদিনে সরকার বুঝে গিয়েছে যে, তা বদলানোর চেষ্টা করা বৃথা— তবে পুব বাংলার বাংলাটা হোক ইসলামি বাংলা, তাতে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ এনে তাকে পশ্চিমবাংলার বাংলা থেকে বেশ অন্যরকম করে ফেলা হোক। সাহিত্যের ভাষা থেকে সংস্কৃত তথা হিন্দু অনুষঙ্গ পুরোপুরি ছেঁটে ফেলা হোক। ‘মহাশ্মশান’ না লিখে ‘মহাকবরস্থান’, ‘জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না’-র বদলে ‘কেয়ামতের দিন পর্যন্ত ভুলিব না’, ‘রামধনু’র বদলে ‘রংধনু’ ইত্যাদি। একটি ছোট দল, এয়মন আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ এই বিষয়ে সুপারিশ করলেন, কেউ কেউ পুরনো পুথির ভাষাকে অনুকরণের কথা বললেন। কেউ কেউ বললেন সাহিত্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়, আন্তর্জাতিক ইসলামের প্রসঙ্গ বেশি বেশি আসুক। কবি ফাররুখ আহমেদ কবিতাও লিখলেন সেইমতো। আবার কেউ কলকাতার মান্য চলিত ছেড়ে পুরনো সাধু ভাষায়, এমনকী ঢাকাই ভাষায় সাহিত্য রচনার সুপারিশ করলেন। কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি বুদ্ধিজীবী এ সব কথায় কান দিলেন না। পুব পাকিস্তানের সাহিত্যের গদ্য আর পদ্যভাষায় কোনও বৃহৎ আর মৌলিক পরিবর্তন ঘটল না।
সাল ১৯৫২:
একুশে ফেব্রুয়ারির দিকে

এর মধ্যেই পূর্ববঙ্গের মানুষ বুঝতে শুরু করেছিলেন যে, তাঁদের বাসভূমি পাকিস্তানের জাতীয় আয়ের বেশিরভাগটা জোগান দিলেও পশ্চিমিরা এই অঞ্চলকে তাদের উপনিবেশ হিসেবেই মনে করে। তাঁরা নানা ক্ষেত্রে অবহেলিত হচ্ছেন। ফলে দ্রব্যমূল্য, নুনের আকাল, মানুষের নানা দুর্দশার কোনও প্রতিকার ঘটছে না— ক্ষোভে তাঁরা নানাভাবে প্রতিবাদ শুরু করলেন। শতকরা ৬২ জনের ভাষাকে উপেক্ষা করে শতকরা ৭ জনের ভাষা উর্দুকে (তা মূলত শাসকগোষ্ঠীর ভাষা, পশ্চিম পাকিস্তানের ‘ভূমিভাষা’ নয়) রাষ্ট্রভাষা করার বাতুল সংকল্প থেকে নেতারা বিরত হলেন না।
এর মধ্যে ২৭ জানুয়ারি, ১৯৫২ তারিখে ঢাকার পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষণে (একমাত্র উর্দু, আর তার বিরোধিতা ইসলাম ও দেশের বিরোধিতা) বাঙালিদের ক্ষোভ আরও তীব্র করে তুলল। ২৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতীকী ধর্মঘট পালন করল, ৩১ জানুয়ারি তারিখে তৈরি হল মুসলিম লিগ ছাড়া সমস্ত রাজনৈতিক দলের মিলিত সংস্থা ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’। মৌলানা ভাসানিকে সভাপতি করে। মুজিব তখন জেলে— নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবির সঙ্গে তাঁর মুক্তির দাবিও জানানো হল। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার স্কুল-কলেজে ধর্মঘট ডাকা হল। সেদিন কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ঘরে বসে থাকেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দশ-বারো হাজার ছাত্রছাত্রীর এক বিশাল মিছিল বেরল, অন্যান্য স্কুল-কলেজের মিছিল তার সঙ্গে যুক্ত হল— পূর্ববাংলায় সর্বপ্রথম এত বেশি সংখ্যায় ছাত্রীদের মিছিলে হাঁটতে দেখা গেল। ঢাকা পেরিয়ে সারা প্রদেশেই স্কুলকলেজে ধর্মঘট ও মিছিল হল। সাধারণ মানুষ, এমনকী লিগপন্থী রক্ষণশীলরাও, ক্রমশ বাংলার দাবির সমর্থনে এগিয়ে এলেন।
৪ ফেব্রুয়ারির সভাতেই স্থির হয়েছিল, ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে সারা পূর্ববঙ্গে হরতাল, সভা আর বিক্ষোভ মিছিল করা হবে। আর ওই দিনটিকে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবেও পালন করা হবে। সেই লক্ষ্যে প্রায় প্রতিদিনই সভা, সমাবেশ হতে লাগল। এর মধ্যে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ৬ ফেব্রুয়ারি একটি সভায় ১১ আর ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালন, ধারাবাহিক আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ অভিযানের উদ্দেশ্য ঘোষণা করে। জেলে অনশনরত শেখ মুজিব আর তাঁর সঙ্গীদের মুক্তির দাবিও পাশাপাশি চলতে থাকে। উল্লেখ্য, শেখ মুজিব বন্দি অবস্থায় থেকেও নানা বার্তায় ২১ ফেব্রুয়ারির প্রকল্পের জন্য ক্রমাগত নির্দেশ দিতে থাকেন।
যা আশঙ্কা করা গিয়েছিল, সেই হিসেব মতোই ২০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে দিল। সাধারণ মানুষ, বিশেষত ছাত্ররা এতে ক্ষিপ্ত ও ক্ষুব্ধ হল। রাষ্ট্রভাষা পরিষদ একটি জরুরি সভা ডেকে ওই ধারা অমান্য করার প্রস্তাব নিল, পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও একই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর আগেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন জানায় এবং এ নিয়ে পুস্তিকা প্রচার করে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলগুলিতে হাজার হাজার পোস্টার লেখা হল।
সেই তারিখ
সকালবেলাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল (হস্টেল)-গুলির ছাত্ররা বাইরে থেকেও আসতে থাকে, দু-তিনজন করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এসে জড়ো হয় তারা, পুরো এলাকা গমগম করতে থাকে। সভাতে ‘দেখতে চাই নুরুল আমিন সরকারের অস্ত্রাগারে কত বুলেট জমা আছে’ বলে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়। মেডিক্যাল কলেজ হস্টেলের একটি কক্ষে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে মাইকে ঘোষণা করা হতে থাকে। স্থির হয়, দশ, আট, পাঁচ—এই রকম দলে দলে ভাগ হয়ে তাঁরা ১৪৪ ধারা ভাঙবেন। তৃতীয় দলে কয়েকজন ছাত্রীও ছিলেন। প্রথম দলগুলিকে পুলিস ভ্যানে তুলে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, কিন্তু পরে এই শৃঙ্খলা থাকে না, বন্যার স্রোতের মতো ছাত্ররা একযোগে এগিয়ে আসে এবং পুলিস গ্রেপ্তারের পাশাপাশি কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে আর লাঠিপেটাও করতে থাকে। উত্তেজিত ছাত্ররা দলে দলে মেডিক্যাল কলেজের প্রাঙ্গণে হাজির হয় এবং মাইক লাগিয়ে বক্তৃতা করতে থাকে। একটা অংশ পুলিসের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়ে।
ঘটনার তীব্রতা বাড়ে প্রদেশের সেচমন্ত্রী হাসান আলির গাড়ি সচিবালয়ে যাওয়ার সময় ওই পথে এসে পড়ায়। লাঠি, টিয়ারগ্যাস, ইট-পাটকেলের মধ্যে উত্তেজিত ছাত্ররা ওই গাড়ি আটকায়, তার চাকার পাম্প খুলে দেয়, জানলার কাচ ভাঙে। তখন ‘নাকি’ ঢাকার অবাঙালি ম্যাজিস্ট্রেট গুলি চালানোর সতর্কবাণী দেয়, যা ছাত্ররা বুঝতে পারেনি। লাঠিধারী পুলিসেরা হঠাৎ পিছনে চলে যায়। বিকেল তিনটে দশ মিনিটে গুলি চলে। গুলি চলে মেডিক্যাল কলেজ হস্টেল, মেডিক্যাল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের দিক থেকে। তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয় সালাউদ্দিনের। যাঁর মাথার খুলি ফাটিয়ে গুলি বেরিয়ে গিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত আর রিকশচালক আবদুল জব্বার হাসপাতালে রাত আটটার মধ্যে মারা যান। এক প্রেসমালিকের সন্তান রফিকুদ্দিনের মৃত্যু হয় রাত বারোটা নাগাদ। হাসপাতালে আরও ১৭ জনের মতো আহত ছিলেন। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মীরা সকলে ছুটে এসে প্রাণপণ সেবায় যুক্ত হন, নার্সদের মধ্যে অনেকেই চোখের জল মুছতে মুছতে কাজ করতে থাকেন। তাৎক্ষণিক একটি ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত দেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়।
কতজন সেদিন শহিদ হয়েছিলেন সেই সংখ্যা নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। ঢাকাতে ওই দিন চারজনের বেশি শহিদ হয়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে রাত তিনটেয় পুলিস এসে হাসপাতাল থেকে তাঁদের শব তুলে নিয়ে আজিমপুরের কবরস্থানে গোপনে কবর দেয় বলে যথার্থ সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর আর্ত কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’-র প্রথম তিনটি ছত্র বলে— ‘ওরা চল্লিশজন, কিংবা তারও বেশি/যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়/ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য, বাংলার জন্য’ যেন বাঙালির মনে একটি সংখ্যা উৎকীর্ণ করে দিয়েছে।
অনুবৃত্তি
ভাষা আন্দোলনই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন হয়ে উঠবে, তা প্রথমে ভাবা না গেলেও পরে তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ঐতিহাসিকরা একমত যে, ১৯৭১-এর এক বড় স্তম্ভ ১৯৫২। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে—তার মধ্যে দিয়ে ওই রক্তাক্ত ইতিহাস সারা পৃথিবীর নতমস্তক স্বীকৃতি লাভ করল, সেও বাঙালির এক ‘বিজয় দিবস’।
জানি না, এখনকার প্রজন্ম কী চোখে এই বিজয়কে দেখবে, নিজেদের ভাষা সম্বন্ধে কী সিদ্ধান্ত নেবে। ভাষাকে যতটা ভালোবাসলে প্রাণ দেওয়া যায় সেই ভালোবাসা কি আমাদের মধ্যে এখনও অব্যাহত আছে?
(ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম বর্তমান থেকে সংগৃহীত)

এই বিভাগের আরো সংবাদ