আজকের শিরোনাম :

ভারতে চলমান কৃষক আন্দোলন ও একটি পর্যালোচনা

  দেবাহুতি চক্রবর্তী

২৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:৫৩ | অনলাইন সংস্করণ

দু'মাসের বেশি হয়ে গেল দিল্লি সীমান্তে ভারতীয় কৃষকদের অবস্থান আন্দোলন চলছে।  পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকদের সাথে বিভিন্ন রাজ্যের কৃষক ও পাঁচশো কৃষক সংগঠনের এই -"সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা "-- শান্তিপূর্ণ ভাবেই তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন এতদিন পরিচালনা করে এসেছে।  দিল্লির সিংঘু, টিকরি বিভিন্ন সীমান্তে অবস্থান গ্রহণের সময় বেরিকেড, কাঁদুনে গ্যাস, জলকামান, লাঠিচার্জ সব অগ্রাহ্য করেই বা মেনে নিয়েই সব বয়সী কৃষক নর-নারী আন্দোলনে শরিক হয়েছে । 

পাকিস্তানি , খালিস্তানি,  মাওবাদী, দেশদ্রোহী নানাভাবে তাদের  দেখানোর চেষ্টা চলছে। নানাভাবে বোঝানো হচ্ছে এরা সবাই ধনিক শ্রেণির কৃষক।  এদের সাথে সাধারণ মানুষের বা প্রান্তিক কৃষকের কোন সম্পর্ক নেই।  কোন কিছুতেই তবু আন্দোলন অবদমন করা যায়নি।  সরকার ও ধনকুবেরদের প্রতিভূ হয়ে তৃতীয় পক্ষ সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় মধ্যস্ততার জন্য। আদালত যথারীতি  পুনরায় আদেশ না দেওয়া অবধি কৃষিবিল স্থগিতের আদেশ দেয়। এবং পর্যালোচনার জন্য চার সদস্যের  কমিটি গঠন করে।  যে সদস্যদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ আগেই।   কৃষকদের সাথে এরমধ্যে এগারোবার সরকারের সাথে বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে। সরকারপক্ষ এক পর্যায়ে বিলের কার্যকারিতা কিছুদিন স্থগিতের প্রস্তাব দেয়। কৃষকরা অনড় তাদের দাবিতে। সে দাবি , বিল তিনটি বাতিল করতে হবে সর্বপ্রথম। পরে অন্য আলোচনা। এই বিল তিনটি ২০২০ র সেপ্টেম্বরে সংসদে ধ্বনিভোটে পাশ হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য, এই বিলগুলো নিয়ে কৃষক সংগঠনের সাথে পূর্ব আলোচনা দূরের, রাজনৈতিক দলগুলোর পর্যালোচনার সুযোগও  দেওয়া হয়নি। 

নির্বাচনের পূর্বে বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল, ২০২২ মধ্যে ভারতের কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  করোনাকালীন ভারতীয় অর্থনীতির যথেষ্ট বিপর্যয় মুহূর্তে এই বিলগুলো সমস্যা জর্জরিত দেওয়ালে পলেস্তারার কাজ করবে মনে করা হয় । কিন্তু তা হয়নি। দোষ চাপে কৃষকের ঘাড়েই। 

আধা সামন্ততান্ত্রিক - আধা ঔপনিবেশিক  ভারতীয় কৃষক সমাজ বিশ্ব অর্থনীতির মূল ধারা অনুধাবনে যথেষ্ট সক্ষম নয় বলে অনেকের অভিযোগ । বুঝতে হবে ভারতীয় অর্থনীতির জিডিপি তে কৃষি অবদান যাই থাকুক, প্রত্যক্ষ  বা পরোক্ষ ভাবে ৫৫ শতাংশ জনগণ কৃষিনির্ভর। এরমাঝে ২৩  শতাংশের অবস্থান  দারিদ্র্য সীমার নিচে। চলমান আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা মূলত ধনিক কৃষক। জাতীয় পুঁজি বৃদ্ধিতে এরা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া মুৎসুদ্দি বেনিয়া পুঁজিবাদের কাছে এদের হার মানতে হবে, এই শঙ্কা তাদের রয়েছে।  ৯০  দশক থেকে নানাভাবে কৃষিতে কর্পোরেট  সংস্থার অনুপ্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধিতে কৃষকরা পণ্যের ন্যায্যমূল্য হতে বঞ্চিত হচ্ছে। ২০১৭ তে  মধ্যপ্রদেশে বিক্ষোভরত ছজন কৃষক সরকারের গুলিতে নিহত হয়।  পরের বছর নাসিক থেকে মুম্বাই পায়ে হাঁটা লক্ষ কৃষক নর নারীর লং মার্চ  এবং পরবর্তী সর্ব ভারতীয় কৃষক সংগঠনের সম্মেলনের দাবি চলমান আন্দোলনের পটভূমি আগেই তৈরি করে। এরসাথে রয়েছে ১৯৯৫-২০১৫ অবধি ঋণভার জর্জরিত, হতাশাগ্রস্ত পাঁচ লাখ কৃষকের আত্মহত্যা।  যে ধারার অবসান হয়নি। ।এইসাথে নতুন বিল তিনটি কৃষকদের অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এখানে  উৎপাদিত কৃষিপণ্যর মূল্যের প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে যাচ্ছে জাতীয় আন্তর্জাতিক করপোরেট সংস্থা। যা কৃষকের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কৃষকরা চায় যথোপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ অধিকতর কার্যকরী ব্যবস্থা। করপোরেট মালিকানায় কৃষকরা খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসল বেশি ফলাতে বাধ্য হবে। মুনাফাখোর মজুতদারিত্বের আধিক্য পণ্যর গণবন্টন ব্যাহত করবে। যা সাধারণ মানুষের জীবনকেও প্রভাবিত করবে।  সাধারণ কৃষক আরও জমি হারাবে। প্রান্তিক কৃষক, খেতমজুর ঋণভার থেকে মুক্তি পাবে না।  আপাতদৃষ্টিতে এই আন্দোলন ধনী কৃষকের আন্দোলন বলে তাই পাশ কাটিয়ে যেতে পারছে না বিভিন্ন সংশ্লিষ্টজন।  তাই এই আন্দোলন শুধুই প্রাক পুঁজিবাদী  ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্ক  টিকিয়ে রাখার লড়াই না স্বাধীন স্বনির্ভর পুঁজির বিকাশের লড়াই  সে প্রশ্নও ক্রমশ শাণিত হচ্ছে ।  কৃষিবাজারে আন্তর্জাতিক পুঁজি যত প্রবেশের সুযোগ পাবে, নিচ থেকে স্থানীয় পুঁজি বিকাশ ততই বাধাগ্রস্ত হবে।  বীজ থেকে শুরু করে কৃষি উৎপাদনের যাবতীয় উপকরণ কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত যত হবে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য তত কম হবে। বিপণন ব্যবস্থার ও গণবন্টনের ওপর রাষ্ট্রের শিথিলতা সাধারণের স্বার্থ তত ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অন্যদিকে সস্তা শ্রমমজুরি অতি মুনাফার জন্ম দেবে।  

এই  কৃষক আন্দোলন  থেকে পূর্বেই ঘোষণা করা হয়, ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লিতে ট্রাক্টর র‍্যালি করার। দিল্লি পুলিশের সাথে এই র‍্যালি শান্তিপূর্ণ ভাবে করার জন্য কিছু চুক্তিতেও আসে তারা। সারা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখে সেদিনের সর্ববৃহৎ গণমানুষের জমায়েত ও র‍্যালি যা কৃষক প্রজাতন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত হয়। র‍্যালির পূর্বেই দিল্লি পুলিশের নাশকতা নিয়ে সাবধানতার বিষয়টি  আরও সতর্কতার সাথে আন্দোলনকারীদের পর্যালোচনা  উচিত ছিল। শাসকদের ইতিহাসের প্রতি আরও গুরুত্ব দিয়ে। হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী থাকা স্বত্বেও একপর্যায়ে  বাইরের মদদপুষ্ট কিছু দুষ্টচক্র র‍্যালিকে দিকভ্রষ্ট করে। কিছু হিংসাত্মক ঘটনা ঘটায় এবং লালকেল্লায় শিখ ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করে। যা এই দীর্ঘ আন্দোলনের মেজাজকে বিশৃঙ্খল করে।  দিল্লি সীমান্তের প্রায় বরফ জমা ঠাণ্ডায়, নিজস্ব ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের বাইরে এই দীর্ঘপথে আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা ও দুর্ভোগজনিত কারণে প্রায় দেড়শ জন আগেই মারা গেছে। একজন প্রবীণ আইনজীবীও আন্দোলনের প্রতি সরকারের আচরণের  প্রতিবাদে আত্মহত্যা করে। সেসব কষ্ট যন্ত্রণা মেনেই প্রজাতন্ত্র দিবসের এই র‍্যালি নিয়ে কৃষকদের বক্তব্য ছিল যে, তারা দিল্লি জয়ের জন্য নয়, তাদের আন্দোলনের প্রতি মানুষের হৃদয় জয় করার জন্যই এই র‍্যালির পরিকল্পনা করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ঘটনা শেষ অবধি কিছুটা  তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। একজন কৃষক মারা যায়। পুলিশ সহ অনেকেই আহত হয়। কিছু যানবাহন পোড়ানো হয়। পরে কৃষকরা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। মূল কৃষক আন্দোলনের র‍্যালি এরপরেও বলতে হবে যথেষ্ট সুশৃঙ্খল ভাবেই ফিরে এসেছে। এই নাশকতা পাকিস্তানি বা খালিস্তানি নয়। ক্ষমতার গোপন অন্দরমহলেই এর ছক রচিত হয়। আর তাদের পদলেহী কিছু যুবক এই বিপর্যয় ঘটানোর দায়িত্ব নিয়ে সফল হয়। বাধ্য হয়ে আসন্ন পার্লামেন্ট অধিবেশনের সময়কার পূর্ব ঘোষিত ট্রাক্টর  র‍্যালির পরিকল্পনা বাতিল করেছে আন্দোলনরত নেতারা।আন্দোলন   বিভাজনের অপচেষ্টা সক্রিয় রাখতে প্রতিপক্ষ চেষ্টা চালাচ্ছে, চালাবেই।  অনেক মামলা - হামলা জেল জুলুম অত্যাচার এখন  সামনে। ধনী কৃষকরা শ্রেণিগত ভাবে যতই দোদুল্যমান হোক, এই আন্দোলন এখনই শেষ হয়ে যাবে মনে করার কারণ নেই। সংগ্রামের গতিপথ এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নির্ণয় করবে। এই আন্দোলনের সাথে কৃষক বাদেও বহু গণসংগঠন সমর্থন দিয়েছে, দিচ্ছে। বিজেপি বিরোধী প্রায় সব রাজনৈতিক দল পাশে দাঁড়িয়েছে। আন্দোলনের প্রতি সরকারের আচরণের বিরুদ্ধে ১৬ টি রাজনৈতিক দল ইতিমধ্যে আসন্ন সংসদ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। এই আন্দোলন তাই এখন একা হয়েও যায়নি। 

নির্দ্বিধায় বলা যায়, মোদি সরকার তার শাসনামলের সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস পার করছে। এই আন্দোলনের ধর্মনিরপেক্ষ মেজাজ লালকেল্লায় ওড়ানো  ধর্মীয় পতাকা নষ্ট করবে না। ভারতের কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনে মান্ধাতা আমলের ভূমি আইনের যুগোপযোগী সংস্কার আবশ্যকীয় ।  পশ্চাদপদ কৃষিব্যবস্থা পরিবর্তনে ছোট ছোট ধাপে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ  নিতে হবে।  কৃষির আধুনিকায়ন  , কৃষি ভিত্তিক শিল্পবিকাশ,   বৃহৎ মানবসম্পদ কে কাজে লাগানোর জন্য অলৌকিক  কোন পথ কোথাও নেই।   এই পরিবর্তন কৃষকদের লক্ষ্য করে বিল পাশ করলে হবে না। মনে রাখতে হবে এই কৃষকসমাজ, ধনী, কমধনী, প্রান্তিক বা খেতমজুর যাই হোক এরাই মূলত পরিবর্তনের বাহন। তাদের সাথে আলোচনা ছাড়া, তাদের মূল্যায়ন ছাড়া , তাদের মতামতকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করে জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি ছাড়া ক্ষমতার চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত স্থায়ী হতে পারে না। 

"জুড়েঙ্গে, লড়েঙ্গে, জিতেঙ্গে "-- আন্দোলনের এই স্লোগান নিয়ে  ভারতের এই কৃষক আন্দোলন ইতিমধ্যেই ইতিহাসের অংশ হিসেবে পরিগনিত হয়েছে। ভবিষ্যৎ ইতিহাস বিনির্মাণে তাদের উপেক্ষা করার অবকাশ নেই। 

লেখক: আইনজীবী

এই বিভাগের আরো সংবাদ