মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর সিদ্দীকের সাক্ষাৎকার

‘বুঝলাম মরি-বাঁচি দেশের জন্য যুদ্ধ করাই আমার কর্তব্য’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪, ১৪:৪২ | আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৩:০০

মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর সিদ্দীক (এবি সিদ্দীক)। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা একজন বীরযোদ্ধা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায়ই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন তাকে অনুপ্রাণিত করতো। বাঙালির প্রতি পাকিস্তানী শাসকদের বিমাতাসূলভ আচরণ তাকে কষ্ট দিতো। তাই শৃক্সক্ষলিত বাহিনীর সদস্য হয়েও বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ও বাঙালির প্রতি নির্দেশ তাকে জাগ্রত করেছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তার কাছে একটা আলাদা বার্তা বহন করতো। তারপর লড়াই করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তÍ। সেনাবাহিনীতে কর্মরত এ বি সিদ্দীক ’৭১ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা থেকে পালিয়েছিলেন পাঞ্জাবি সেনাদের নজর এড়িয়ে। মা ও বাবাকে দেখতে রাজশাহীর নওগাঁয় নিজ গ্রামে পৌঁছান ন’দিন পর। যেতে যেতে পথে সাধারণ মানুষ থেকে বিচিত্র সব মানুষের দেখা পেয়েছেন। সেসময় কতশত ঘটনা মোকাবেলা করেছেন- তাও একধরনের যুদ্ধ। এরপর মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ, কয়েকবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন; যুদ্ধশেষে বিজয় পতাকা নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। যুদ্ধদিনের অভিজ্ঞতা তার কাছে জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আশি ছুঁই ছুঁই এবি সিদ্দীক মুক্তিযুদ্ধের গল্প করতে গিয়ে যেন ফিরে গেলেন সেইসব দিনগুলোতে। যা স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। তিনি কখনো হেসেছেন আবার কখনো তার চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে; কিন্তু দেশপ্রেম, লড়াই ও দৃঢ় মনোভাব তার প্রতিটি উচ্চারণে। আগামী প্রজন্মকে এটাই সঞ্চারিত করে যেতে চান এ বি সিদ্দীক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- বনশ্রী ডলি


বনশ্রী ডলি: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রেক্ষাপট বলবেন কবে, কীভাবে গেলেন? 
এবি সিদ্দীক: তখন আমি ইপিআর সদস্য, ঢাকায় কর্মরত। সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়ায় ব্যারাকেই হোক বা কাজের জায়গায়, রাজনীতির খবর ও যুদ্ধ প্রস্তুতির বিষয়ে জানা ও কথা বলার নিয়ম নেই। কিন্তু একদিন সকালে সহকর্মী পাঞ্জাবি সেনারা বলছে, বাঙালি সেনাদের মেরে ফেলা দরকার এবং তাই করবো- এটুকু শুনে দেরি করিনি। কাউকে কিছু না বলে অফিস থেকে বের হই, ২৩ মার্চ। আগে রাজশাহীর নওগাঁয় মায়ের সঙ্গে দেখা করবো, তারপর যা হয়। সিগারেটের রাংতা কাগজে মুড়িয়ে আইডি কার্ডটা আর এক টাকা ছিল, সঙ্গে নিয়েছি। পেছনের দেয়াল টপকে নিচে পড়লাম। জায়গাটা ঢাকার উত্তরা। জায়গাটি তৈরী হয়নি তখনও, একোয়ার করা হয়েছে, ঝোঁপ জঙ্গল ভরা। কিছুক্ষণ পরেই তল্লাসী চৌকি থেকে করে গুলি করে কিন্তু আমার গায়ে লাগেনি। একটা খাল পার হয়ে উত্তরখানে পৌঁছলাম রাত ১০টায়। একটি বাড়িতে ডাকাডাকির পর বৃদ্ধা বের হয়ে আসেন। মা, এমন অবস্থায় এসেছি, রাতটা থাকতে চাই। বাবা, তালা দেওয়া ঘরটাতে থাকতে পারো তবে খাবার নেই। সাদা ধুতি বের করে দিলেন, কাদামাখা ভেজা শার্ট আর লুঙ্গি ছেড়ে ধুতি পরে নিই। সকালে টঙ্গী ব্রিজের পূর্ব দিকে নদীর পারে গিয়ে দেখি, নৌকা নেই। আরও একজন আছে। একটা তালপাতার মতো পাতার ভেলার নৌকায় দু’জনে হাত দিয়ে পানি ঠেলে পার হচ্ছি। টঙ্গী ব্রিজ থেকে পাঞ্জাবিরা গুলি করে। ভেলার এক পাশে গুলি লাগে। ওই লোকটা পানিতে ঝাঁপ দেয় আর ভেলা উল্টে গিয়ে আমি ভেলার নিচে। কোমর পানি, হেঁটে পার হয়ে বোর্ড বাজারে যাই, বেলা তিনটা কি চারটা হবে। দুই আনার ছোলা ও মুড়ি কিনে খেয়ে আবার হাঁটছি। কাশিমপুর জমিদার বাড়ির সামনে গেছি, তখন রাত আটটা। নীরব নিস্তদ্ধ অবস্থা, কুপি বাতির টিম টিম আলো দেখা যাচ্ছে। কেউ আছেন? সারা দেয়নি কেউ। এর কিছুটা দূরে একটা মেসে ছাত্রদের কাছে কারখানায় শ্রমিক পরিচয়ে আশ্রয় নিই। রাতে টেংরা মাছের ঝোল, ডাল ও ভাত খেয়ে মাটিতেই ঘুমিয়ে যাই। পরদিন বাউনিয়ায় বন্ধুর বাড়িতে গেলাম। ওই পাড়ায় কালী মূর্তি কারিগরের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমার কথা শুনে আমাকে ১০টি টাকা দিলেন এবং সেখানেই থেকে যেতে বললেন তিনি। সেই সময় এমন মানুষও পেয়েছি। মনে হলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। নিতে চাইনি, বললাম, কেন এটা দিলেন, আপনিও তো ধনী মানুষ নন, আপনার বাচ্চারা আছে। বলছেন, আপনি এখন একজন অসহায় মানুষ, চলে যাবেন। কোথায় কি দরকার হয়। টাকাটা হাতে দিয়ে বললেন, যদি গ্রহণ করেন, আপনার উপকারই হবে। সত্যি উপকার হয়েছে। বন্ধুর বাড়ি থেকে পরদিন সকালে বের হয়ে যাই। আমি সামরিক বাহিনীর লোক, বেকার এভাবে বসে থাকবো? দেশের জন্য তো কিছু করা দরকার। 
গাজীপুরের চান্দ্রার মোড়ে ছোট ছোট বাস, হেলপার ডাকছে টাঙ্গাইল, টাঙ্গাইল। ভাড়া লাগবে না। জান বাঁচাতে চলে যাচ্ছি আপনিও আামাদের সঙ্গে চলেন। করোটিয়া পর্যন্ত যাওয়ার পর বলছে, আর যাওয়া যাবে না। কেন? শহরে পাঞ্জাবি নেমেছে, অপারেশন করবে, দখল করবে। নেমে যাই! টাঙ্গাইল হেলিকপ্টার পোর্টের রাস্তা ধরে হাঁটছি, সন্ধ্যা হয় হয়। শহরের বাজারে রাস্তায় পাক সেনাদের জিপ। ওষুধের দোকানে ঢুকে নিজেকে আড়াল করি, ওরা পাস করে চলে যায়। 
নগরবাড়ি ঘাটে পৌঁছেছি অনেক রাতে, মানুষজন নেই। সারাদিন খাইনি, দুই আনার ছোলা ও মুড়ি খেয়েছি। রাস্তা চিনি না, কীভাবে যাবো? চরের এক কৃষক পথ চিনিয়ে নিয়ে যায়। কলাগাছ ঘেরা ভাঙ্গাচোড়া বাড়ি দেখিয়ে রাতটা থেকে যেতে বলে। থাকিনি, হাঁটছি। দুই পাশে কালোজিরার ধান ও গোয়ামুড়ির ক্ষেত সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। জোসনা রাত, বালুর চর, বিস্তীর্ণ এলাকা, শস্য ক্ষেত, ভালই লাগছে। বাজারের কাছে যেতেই এক লোক হাঁটছে আর গল্প করছে। বলছে, একা একা এই পথে যাও, তোমাকে যদি কেউ মেরে ফেলে? আমার সাথে আসো। রাত প্রায় ১১টা, এত রাতে আর কোথাও যেতে পারবা না। আমার বাড়ি থাকো। পাটখড়ির বেড়া দেয়া বাইরের ঘরে খড়ের ওপর চাদর বিছিয়ে বসতে দিল। হাত-মুখ ধোয়ার পানি দেয়। সুন্দর ব্যবহার করছে, খারাপ মনে করিনি। চিনা চাউলের ভাত আর ডিম ভাজা খেতে দিল; ভাতটা  খেতে পারিনি, ডিমটা খেয়েছি। খাওয়ার পর কাছে বসে বলে, আমার নাম জয়নাল ডাকাত। এই যে দেখো তলোয়ার। আমি গরিব মানুষ, রাতে পথে ডাকাতি করি। চাইলে যা দেয় নিয়ে নেই, যদি না দিতে চায় তলোয়ার দিয়ে একটা কোপ দিই। হয় হাত কাটি নয়তো একটা পা কেটে দিই; বেশি কোপ দিই না। আজও বের হয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে ভাই ডেকেছো। তোমার কষ্ট শুনে ডাকাতি করার কথা আর ইচ্ছে হলো না। 
পরদিন সকালে পুরান চালের ভাত, আলু দিয়ে কবুতরের মাংস ও মুগডাল খেতে দেয়। জয়নাল বলে, আমার বিবিসাব কারো সঙ্গে কথা বলে না, সামনেও আসে না। বেড়ার ওই পাশে সে আসছে, কথা বলো। জয়নালের স্ত্রীকে বললাম, এখানের রাস্তা চিনি না, যাবো সিরাজগঞ্জ, মায়ের কাছে যাবো নওগাঁয়। সব শুনে জয়নালকে সে বলে, ভাইকে যতটা সম্ভব দিয়ে আসো, একলা যেতে দিয়ো না। 
বন-বাদাড়, পথ পাড়ি দিয়ে একটা জায়গায় এসে জয়নাল বলে, আমার এলাকা এপর্যন্ত, আর যাবো না। এখন তোমাকে একাই যেতে হবে। নদীর ঘাটে যেতে ঘণ্টা দুই সময় লাগবে। এখন বর্ষা নেই, চর পরেছে। কপাল ভাল থাকলে নৌকা পেতে পারো, বলবে আমি জয়নালের ভাই, পার করে দিবে। যদি না পাও সাঁতরে পার হবে। তখন বিকাল ৪টা।
উলু খাগড়ার ক্ষেত সারি সারি। ঘাটে পৌঁছে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পরও কোনো নৌকা পাইনি। যমুনা নদী, পানি কম থাকলেও চওড়া দুই কিলোমিটার। আল্লাহর নাম নিয়ে নদীতে নামলাম। কোথাও এক বুক, কোথাও কোমর পানি আবার কাথাও গভীর পানি। চোখ বুজে সাঁতার কাটছি। হঠাৎ গায়ে কি যেন লাগে, চেয়ে দেখি একটা লাশ আমার গা ঘেঁষে ভেসে গেল। সোহাগপুর গ্রামে থামলাম। জলে পড়ে থাকা একটা বড় গাছের ডাল ধরে উঠে দেখি বাজার, কয়েকটি দোকান খোলা। রাত তিনটা। ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করায় সব জেগে গেল. আমকে ঘিরে ধরেছে; বললাম, আমি ডাকাত নই, বিপদগ্রস্ত মানুষ। নদী পার হয়ে এসেছি। খুব কাঁপছি দেখে ওরা আগুন জ্বলিয়ে দেয়, সেলাই ছাড়া লুঙ্গি দিল পরতে। আমার ভেজা লুঙ্গি ও শার্ট মেলে দিল ওরা। খিচুড়ি খেয়ে চটের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে ওরা কখন যে সব গুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে টের পাইনি। কয়েকটি বাচ্চা ছেলের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। তখন ভাবছি ওদের দেয়া লুঙ্গি কী করি! পরে এটা পথেই আরেকজনকে দিয়েছি। এতকিছুর পরেও আইডি কার্ড হারিয়ে যায়নি। সিগারেটের রাংতা কাগজে মুড়িয়ে রেখেছিলাম। 
পা ফুলে গেছে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ দেখি একটি ঘোড়ায় পিঠে দুই দিকে দুইটা বস্তা নিয়ে লোক হাঁটছে। বলে, আপনার পা তো ফুলে গেছে, হাঁটতে পারছেন না। বললাম সব। আমাকে ঘোড়ার ওপর বসিয়ে দিল লোকটি; তার গলায় তুলশির মালা দেখে বুঝেছি তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের, কাছেই তার বাড়ি কিন্তু সে তাদের চেয়ারম্যান তারাপদ ঘোষের বাড়ি নিয়ে যায় আমাকে। থানার নামটা সাথিয়া। চেয়ারম্যান বৈঠকখানায় বসতে বলে চিড়া, দই ও মিষ্টি নিয়ে আসেন। তাদের রান্না খাবো নাকি স্বজাতির রান্না খাবো জানতে চান। বললাম, স্বজাতি বা বিজাতি কিছু নেই! খাবো। পাশের গ্রামে ব্রাহ্মণ বন্ধু দুলালের বাড়িতে সবসময় গেছি, খেয়েছি। আমাকে নিয়ে আসা লোকটি বাড়ি চলে গেছে। রাতে ইলিশ মাছের ঝোল আর মাস কলাইয়ের ডাল দিয়ে ভাত খেলাম পেট ভরে। চেয়ারম্যান বললেন, আপনার কথা পরে শুনবো, আমারও কিছু কথা আছে। ভাবলাম কোন ভেজালে পড়বো কে জানে। পরদিন সকালে খেয়ে চলে যাবো সময় চেয়ারম্যান বললেন, আপনি সামরিক বাহিনীর লোক জানি। কেমন করে? যে নিয়ে এসেছে সে বলেছে। এখানে কিছু ছেলে পেলে আছে; আমার কাছে কয়েকটি রাইফেল আছে ওরা অস্ত্রগুলো নাড়াচাড়া করে, তবে চালাতে পারে না; ্ দুই দিন থেকে ওদেরকে শিখিয়ে দিয়ে যান। বিপদে আছি, কখন যে কী হয়। এখানে থাকতে পারবো কি না জানি না। শিখে রাখলে কাজে আসবে। পরে উলু খাগড়ার বনের ভিতর ওদের কয়েকজনকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিলাম। 
পাঁচ দিন ছয় রাত হয়ে গেল, এবার আমার বাড়ি যেতে হবে। যাবেন? মায়া হয়েছে। থেকে যান আমাদের কাছে। আমরা গেলে আপনিও যাবেন। বললাম না, মায়ের সঙ্গে দেখা না করা পর্যন্ত কোথাও যাবো না। চলে আসার সময় চেয়ারম্যান লজ্জিত হয়ে বলছেন, হাতে নগদ টাকা নেই তো দিতে পারছি না, সত্যি কথা বলি, সব পাঠিয়ে দিয়েছি। লাকসাম যাবো সেখান থেকে বর্ডার পার হয়ে ভারত চলে যাবো সন্তানদের নিয়ে। ওখানে আত্মীয় আছে, সেখান থেকে আগরতলা। কাউকে বলবেন না, আমরা তো এখন শত্রু, কে কখন এসে আক্রমণ করে।
সেখান থেকে সাত কিলোমিটার দূরে সিরাজগঞ্জ গিয়ে বিকেলেই দেখা করি এসডিও এজি ইসলামের সঙ্গে। তিনি ময়মনসিংহের নুরুল আমীনের নাতি। এসডিও বলেন, আপনি ফৌজি মানুষ, এখানের ডিগ্রি কলেজের ছাত্ররা বিশৃংখল হয়ে আছে, বুঝতে পারছে না কী করবে। আপনি সামরিক বাহিনীর লোক, গেলে সুবিধা হবে, ওদেরকে গুছিয়ে দিন। সেখানে গিয়ে ওদের কথা বার্তা শুনে, চলাফেরা দেখে বুঝেছি আমার কথা-বার্তা ওখানে চলবে না। এক কথা দুই কথায় আমার সঙ্গে ঝামেলা করে তাই চলে আসি। 
বাঘাবাড়ি যেতে গিয়েও যাইনি। স্টেশনে এসে হোটেলে ভাত খাওয়ার সময় শুনেছি, ধানগড়া গিয়ে নদী পার হয়ে শেরপুরে যাওয়ার মহাসড়ক পাবো। হাঁটছি, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, শেরপুর কাছেই, দেখছি উল্টো দিক থেকে মানুষ দৌঁড়ে আসছে। পানওয়ালা বলছে, বলার সময় নেই, শেরপুরে পাঞ্জাবীরা আগুন দিয়েছে। কোথায় যাবো জানি না। আসেন আমাদের সঙ্গে। একটু দূরেই জমজম গ্রামে তার মুসলমান বন্ধুর বাড়ি নিয়ে গেল। পরদিন পথে এক মৌলবী জানান, তার একটা ছেলে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীতে নতুন গেঁছে, ইসলামাবাদে আছে। তার বাড়িতে রাতটা থেকে সকালে আবার হেঁটে নয়দিনে বাড়ি পৌঁছলাম। মা ও বাবা আমাকে পেয়ে মহাখুশি। প্রথম দিন খাওয়া গল্প হলো। পরদিনই মা বলছেন, ‘বাবা বাড়িতে বা গ্রামে তোমার থাকা হবে না। তোমার খোঁজে পাঞ্জবিরা দুই বার এসেছে। ভারতে চলে যাও।’  

 

বনশ্রী ডলি : আপনি কোথায় যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, কোথায় কোথায় সরাসরি যুদ্ধ করেছেন? রণাঙ্গনের বিশেষ স্মৃতি মনে পড়ে?  
এবি সিদ্দিক: সেদিন এক মাকে বাড়িতে রেখে দেশ মাতৃকাকে পাকিস্তান বাহিনীর হাত থেকে স্বাধীন করতে সেদিন বাড়ি ছাড়ার সময় পণ করেছিলাম ‘মরি বাঁচি দেশের জন্য যুদ্ধ করাই আমার কর্তব্য।’  
মা বলার পর আরও সাহস পেলাম। পরদিনই আমার চাচাতো ভাই সাত্তার, গ্রামের যুবক রবিন ও তার চাচাত ভাই এনামুল হক মঞ্জু, বকুল ও আলেমকে নিয়ে ভারতে রওনা দিই। নিখলি গ্রামে রবিনের ফুফার বাড়িতে রাতটা থাকি; পরদিন লংলা হয়ে ঝামরহাট, রাতে তেলভাঙ্গায়; পরদিন হিলি বর্ডার থেকে ১০ কিলোমিটার ভারতের ভিতরে কামারপাড়া বাজারে পোঁছাই; সেখান থেকে বাসে চড়ে বালুরঘাটে গিয়ে ওরা গেল হোটেলে, আমি কামারপাড়া ফিরে আসি। বাজারের একটা খোলা ঘরে এক লোক স্ত্রী ও বোবা মেয়ে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, আমিও সেখানে বটগাছের শিকড়ে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন সকালে পরিচিত এক চেয়ারম্যান জানতে চান, ফৌজি মানুষ এভাবে ঘুরছি কেন? তিনি বিএসএফ ক্যাম্পে যেতে বললেন। বালুরঘাট বিএসএফ ক্যাম্পে যাই, সেখান থেকে গোঁবরা ক্যাম্প; তখন কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার। দেখা করার পর তিনি বললেন, তুমি আমার সঙ্গে এখানেই জয়েন করো। সেখানেই যোগ দিই।
হ্যাঁ, ইপিআর সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ থাকে। আমার প্রথম আক্রমণ (হিট) ছিল কামার পাড়ায়, আনোয়ার সাহেবও ছিলেন সেদিন। এরপর কোম্পানি আমাকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠায় দিনাজপুরের মোহনপুরে। একদিন একটা ব্রিজের এপারে পজিশন নিয়েছি, ওপারে পাক সেনাদের পজেশন। আমরা টানা গুলি করছি, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মারা গেছে কি-না জানি না। এক সময় চুপচাপ, ফিরে আসি কামারপাড়ায়। ওরাও চলে যায়। ফুলবাড়ি রেলস্টেশন থেকে দিনাজপুর যাওয়ার হাইরোডের পাশে একটা জায়গা আছে, সেখানে এর আগে ইপিআর সব সদস্য মারা গেছে; আমরা সেখানেই ক্যাম্প করে অপারেশন করি। ওপেন ফায়ার করে গোলা ছুঁড়ি ক্যাম্পের ভিতরে, যা দেয়াল ভেদ করে ঢুকে যায়। গোলার তোড়ে ওরা সব পালিয়ে যায়। ফুলবাড়ি স্টেশন দখল করে আনসারদের হাত দায়িত্ব দিয়ে চলে যাই কামারপাড়ায়। এর কিছুটা দূরে স্বাস্থ্য বিভাগের একটা ঘর ছিল। ওখানেও একটা অপরাশেন করবো, কিন্ত দেখা গেল অপারেশন করতে গেলে কাউন্টার পার্টে পড়ে যাই। তখন সে জায়গাটা ভেদ করে চলে আসি শরণার্থী ক্যাম্পে। সেদিন আমার প্লাটুনে ইপিআর সদস্য ইদরিস মিয়া (সম্ভবত নোয়াখালি বাড়ি) ছিল। এলএমজিতে তিন প্রকার গুলি থাকে একটা ডাইরেক্ট হিট করে, আরেকটা আকাশে উড়ে গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় হিট করে, আরেকটা সিগনাল দেয়, শুধু ধুয়া ছড়ায়, একশন হয় না। এমন একটা গুলিতে ইদিরস মারা গেল। ক্যাম্পে নিয়ে তাকে পুকুরের পাড়ে কবর দিলাম। শোক করার সময় নেই! 
এরপর সাঁতারকুল জায়গাটিতে অপারেশন করি; খুব বেশি কিছু করতে হয়নি, পাঞ্জাবিরা চলে গেল। ফিরে আসি কামারপাড়া, গাড়ি তখন রেডি, বালুরঘাটে এসে চলে গেলাম রায়গঞ্জে। বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার মধ্যে ছিল এটি। রায়গঞ্জে গিয়ে ব্যাটলিয়ন অর্গানাউজ হলো; য যেখানে ছিল, এক জায়গায় করা হলো। আমরা ছয়টি কোম্পানি। অর্থ্যাৎ, আলফা,  ব্রাভো, চার্লি, হেডকোয়ার্টার, পাঁচটা কোম্পানি নিয়ে একটি ব্যাটেলিয়ন হয়। এস্টাব্লিসমেন্ট হলো ২২৫০ জন। ছয়শো জনে ভাগ হলো, হওয়ার কথা সাতশোজন; ছাব্বিশ জন শর্ট হলো। আমি ৯ প্লাটুনের হাবিলদার সার্জন হিসেবে তখন ক্যাপ্টেন আনোয়ারের আন্ডারে কর্মরত। ১৫ দিন সেখানে থেকে সেখানে কোট করলাম, বারুদের কোট। 
এরপর আমরা যার যার ক্যাম্পে চলে যাই। হঠাৎ খবর এলো, সকালে রওনা হতে হবে। সবাই রেডি, কোথায় যাবো জানি না। রেলে চড়ে একদিন একরাত পর গৌঁহাটিতে গিয়ে খেয়ে বিশ্রাম নিই। খাঞ্চারি স্টেশনে নেমে ট্রাকে উঠে গেলাম মেঘালয়ে ১২ কিলোমিটার ভিতরে তেলডলায় ক্যাম্পে। 
মুক্তিযুদ্ধের সময় জেড ফোর্স নামে একটা ব্যাটেলিয়ন ছিল, ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার ছিলেন জিয়াউর রহমান (যিনি বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তিনি দেশ শাসন করেছিলেন)। ওখানে এক কমান্ডারের সঙ্গে আমার উত্তপ্ত কথবার্তার জন্য আমাকে কমান্ডোতে পোস্টিং দেয়। আমার কাজ বাংকার তৈরি করা। আমার সঙ্গে ছিল নায়েক কর্পোরাল সাত্তার, বাড়ি নোয়াখালী; মোহসিন আহমদ, মোয়াজ্জেম হোসেন টাঙ্গাইল, কমান্ডার সুবেদার সিনিয়র আলী নেওয়াজ সাহেব। 
আরেকদিন জামালপুরের ইসলামপুরে রলওয়ে ব্রিজ অ্যাকশন করতে হবে। অনেকটা হেঁেট নৌকাতে দুই ঘণ্টা চলার পর পাট খেতের ভিতর দিয়ে লোকাল গাইড মুজাহিদ নিয়ে গেছে, কিন্তু নেমে দেখি পাকবাহিনী ডিফেন্স করে আছে, বাংকার করা। আমরা দেখছি কিন্তু আলোর নিচের দিকটায় অন্ধকার, সেখানে কী হছে বলা যাছে না। ডিসি স্লাব, বারুদ ভরতি হ্যাভারস্যাক নিয়ে পানিতে নেমে পড়ি, তখন রাত। কচুরিপানা মাথায় দিয়ে আস্তে আস্তে ব্রিজের পিছনে গিয়ে প্রথমেই তার দিয়ে এ মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত লাগিয়ে  রেল লাইনের ফাঁকে ডিসি স্লাব ঢুকিয়ে ফিউজ লাগানো হলো। পিলারের মাঝে মাঝে লাগিয়ে দিই। ফিউজের অংশ তারের সঙ্গে যা যুক্ত তা নিয়ে পাট খেতে গিয়ে তিনশ গজ দূরে বসেছি; ৪টা বা ৫টা হবে ভোর, ব্যাটারি টিপে দিয়েছি। ওখান থেকে হেঁটে আসি বাহাদুরাবাদ। দু’দিন পর আসি ক্যাম্পে। আবার চিঠি আসে বাহাদুরাবাদে অপারেশনে যেতে হবে। গাইড নিয়ে যাচ্ছে, নৌকায় তিন ঘণ্টার বেশি ছোট্ট খালে ঢুকেছি, পানি কম, লোকজনও কম। কিন্তু মাঝারি ধরনের স্টিমারে পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্রসহ ঘুরছে। আমার কাছে তখন পাঁচশ গজ দূরে হিট করবে, এমন প্রায় একশো গোলা আছে; এটা দশ ইঞ্চি লোহার বডি ভেদ করে ভিতরে ঢুকে যেতে পারে। এটা ফায়ারিং করে সেখান থেকে ব্যাক করে চলে আসি ক্যাম্পে। 
আরেকদিন আনোয়ার সাহেব বললেন, যেতে হবে কোদলকাঠি চরে। সকালে রওনা দিয়ে বিকেলে পৌঁছাই কচ্চিমারি বাজার, সেখান থেকে রৌমারি তিন কিলোমিটার, থানা হেড কোয়ার্টার। চর বেড়াই চরে সবাই পজিশন নিয়েছি। পাঞ্জবিরা তখন চিলমারি থেকে ১২ কিলামিটার রেঞ্জে আমাদের উপর ফায়ার করতে থাকে। বাংকারে আমার এক নায়েকের পায়ে মর্টারের শেল এসে লাগে, তাকে পাঠিয়ে দিই ক্যাম্পে; এরপর অর্ডার মতো মেঘালয়ের শিলং যাই, নভেম্বরের শেষ ২২ বা ২৪ তারিখ হবে। প্রচ- শীত। একদিন এক রাত থেকে আমার কোম্পানি নিয়ে চলে যাই ভারতের চেলাখান নদীর পারে সীমান্ত এলাকায়। পাহাড় থেকে আসা এই নদীতে হাঁটু পানি আর পাথর। গাইবান্ধা ফুলছড়িতে ছোট অপারেশন করতে হবে। 
পাঁচতলা নামক জায়গায় প্লাটুন নিয়ে ক্যাম্প করি। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দোয়ারা বাজারে আপরারেশন করবো। আমাদের মোহাম্মদ আলী রেকি করেছে কিন্তু তা রং সাইড হয়ে যায়। পাঞ্জবিদের যে অলটারনেটিভ ডিফেন্স ছিল তা সে আর খেয়াল করেনি। দোয়ারা বাজারে অপারেশনে কয়েকজন পাক সেনা নিহত হয়। আমাদের সঙ্গে ছিল রংপুরের যুবক সৈনিক মুজিবর রহমান, হোসেন আহমদ, সাত্তার, হাবিলদার ফজলুল হক; কমান্ডার ছিল নায়েক সুবেদার আবু আলী। রাত তখন সাড়ে তিনটা, নদীর পার হয়ে বাজারে উঠেছি। কিন্তু এক কোণায় পাকবাহিনীরা রয়েছে। ওখান থেকে টেংরাটিলা- ছাতক রোড। আমরা পড়ে গেলাম বিপদে। আমাদের একজন পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত হলো। নিহত সহযোদ্ধাকে ফেলেই হাঁটছি যতটা পারি জোরে, মুজিবর সামনে আর আমি পেছনে। হঠাৎ টের পাই, আমার কলার ধরেছে পাঞ্জাবি সেনা; বলছে, বন্দুক দিয়ে যাতাহে, তোম ভি মুসলামান হাম ভি মুসলমান, আও না মেরে সাথ; এই কথা বলার সাথে সাথে আমাদের নায়েক সুবেদার ভয়ে হোক আর না হোক অতর্কিতে (স্টেনগান ও ম্যাগজিনও লোড ছিল, ওপেন করা )  হাতের আঙ্গুল লেগে ব্রাশ ফায়ার শুরু হয়। মুহূর্তেই সে এবং আরও তিনজন চলে গেল দুনিয়া ছেড়ে। বাকি মুক্তিযোদ্ধারা নদীতে ঝাঁপ দিলাম। পাকিস্তান বাহিনীরা বোমা ছুঁড়ছে; আমাদের একজনের বুকের ওপর বোমা পড়ে, আমার লগেনি। বেঁচে যাই! আমাদের সঙ্গে ক্যাপ্টেন মোহসিনও ছিল। সেদিন কে কোথায় গেল জানি না। মোহসিন একটা কথা শুধু বলেছিল যে, যার যার জান বাঁচাও। ফজলুকে পাওয়া যায়নি, আজও জানি না তার খবর! মোহসিনকে হয়তো ওরা মেরে ফেলেছিল। আমাদের ২৬ জন মারা যায়। শেষ পর্যন্ত ফিরে দেখি ৫২ জনের ২৬ জনই নেই।   
তামাবিলে সাঁতরে আসার সময় আমার সারা শরীরে জোঁক জাপটে কামড়ে ধরে আছে। কোনোটা রক্ত খেয়ে ঢোল হয়ে পড়ে গেছে। এক বাড়িতে উঠতে চাইলাম, দেখি লুঙ্গি কোথায় গেছে বলতে পারি না। কাপড় নেই গায়ে, বুক পানিতে দাঁড়িয়ে আছি। বুড়ি মানুষ জানতে চায়, বাবা তোমরা কে, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। তোমাদের রাখতে পারবো না, আমাদের বিপদ হবে। চলে যাও জান নিয়ে।  আরেক বাড়ির লোকেরা কাপড় দেয়। শীতে কাঁপছি, আগুন জ্বেলে দিল। বাবা, বাজার ঘাট নেই, কিচ্ছু নেই। আতপ চালের ফেন ভাত হলুদ মরিচ ও লবণ দিয়ে খেতে দিল, ডিম ভেজে দিয়েছে। 
ক্যাম্পে ফিরে আসি, আমার হাতিয়ার তো নেই। কমান্ডার বললেন, আমি হাতিয়ার চাই, জন দরকার নেই। হাতিয়ার থাকলে জন পাওয়া যাবে। শুনে তো আমার মেজাজ খারাপ, খুব রাগ হলো আমার। এক-দুই কথায় ঝগড়া, বিশৃংখলা সৃষ্টি হলো। আমাকে বদলি করে দিল হেডকোয়ার্টারে। সেদিন ভারতীয় এক কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ‘বরাহ’ ঘোড়ায় করে আসলেন; সব শুনে বলেন, ‘কুচ পরোয়া নেহি হ্যায়। আদমি আ জায়গা। মানুষ তো আসবেই, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করো কেন। ঠিক হ্যায়, বাচ্চু, কুচ পরোয়া কোরা ন্যাহি। আপ লোক হো বাঁচ কো, তো ফির তোম মুল্লক তোমারি হ্যায়।’ তুমি যদি বাঁচো, লড়ো, কেউ তোমাকে হাতে ধরে দিবে না। তোমার দেশ তোমার থাকবে। আমরা তো সহকারি। 
এরপর সেখান থেকে শিলং ক্যাম্পে গেলাম, আবার ছাতক, সবুজ গ্রাম। রাতে অপারেশন। ওরা কীভাবে যেন টের পেয়ে যায়, বিমান বন্দরের নর্থ সাইডে আমাদের আরেকটা কোম্পানি ছিল, পাক সেনারা তাদের ওপর অ্যাটাক করে। আমাদের অ্যাটাক করেনি বরং আমরা গুলি করছি বেদম। এর আগে ব্রাশ ফায়ারে একটা ব্যাটলিয়ন শেষ হয়ে গেল। 
আরেকটি ঘটনা ভোলা যায় না। আমরা মেঘালয় থেকে ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, বশিরহাট অপারেশনে গেছিলাম। সেখানে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মারা যান রেকি করতে গিয়ে। কর্নেল তাহের সাহেবের তিনশ সৈনিক মারা যায় সেখানে। আমার প্লাটুনের দুই জন ওখানে গুলি খেয়েও বেঁচে যায়, আহত হয়। ডিফেন্সে এমনটা হয়, যারা মাঝে মাঝে চেঞ্জ করে ট্রেন্স করে বাংকারে তারা এমন ফায়ারে পড়তে পারে। 

 

বনশ্রী ডলি:  ১৬ ডিসেম্বর কোথায় ছিলাম?  দেশ স্বাধীন করার পর কেমন লেগেছে? 
এবি সিদ্দীক: সেকি আনন্দ! এটাই তো চেয়েছি, মরবো গুলি খেয়ে তব্ওু দেশ স্বাধীন হোক। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি, ৫৩ বছর আগে। কত আর মনে থাকবে। তবে মনে আছে, ১৫ ডিসেম্বর আদেশ হলো ছাতকে শালুকি বিমান বন্দরে যেতে হবে। আমাদের জন্য সিগনাল রেডিও ছিল। ১৬ তারিখ রেডিওতে খবর দিল, নিয়াজী জানিয়েছেন, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। আপনারা ধৈর্য্য ধরুন, তখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি এখন থেকে পাক বাহিনীকে আর গুলি করবো না? ক্যাপ্টন বলেছেন, গুলি করবো, যদি তারা গার্ড হয়ে দাঁড়ায় তখন গুলি করবো। অবশ্যই শুট করতে হবে। সেদিন অস্ত্র ওপেন করে এয়ারপোর্র্ট গেলাম। কিন্তু সিলেটে ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। পোর্ট সেক্টরে সারেন্ডার করানো হয়েছে, মেজর তখন সি আর দত্ত। 

বনশ্রী ডলি: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কবে প্রথম দেখা হয়েছে আপনার. কখনো কথা হয়েছে?   
এবি সিদ্দীক: দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার স্মৃতি মনে আছে। 
১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আসার দিন রাস্তায় ডিউটিতে ছিলাম। এয়ারপোর্টে দেখা হয়, কথা বলা যায়নি। পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে রাষ্ট্রীয় রেসিডেন্স পদ্মায়। তখন বলেছিলেন বাবা, কোন আবদার করলে এখন তো দিতে পারবো ন। দেবার সময় আসেনি। দায়িত্ব যখন পালন করবো তখন যদি আসো দিব।
আর কিছু চাওয়াও হয়নি কখনো। তখন রাজনৈতিক নেতাদের ভিড়ে আমরা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচির অবস্থা। রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা মনে পড়ে, ‘কাঁদতে কাঁদতে গেলাম রাচি/ তবু বলে ছেড়ে দে মা কেদেঁ বাঁচি।’ 
তবে মনে আছে একবার বাহাদুরাবাদে বঙ্গবন্ধু আমাকে একটা কম্বল দিয়েছিলেন। জাতির পিতা বেশিদিন দেশ পরিচালনা করতে পারেননি। পাঞ্জাবিরা আমাদের বাঙালিদের বলতো, বাঞ্চোত কা বাচ্চা। গালি দিয়ে কথা বলতো। অসভ্যের বাচ্চা। এত বাঙালিকে মেরেও ক্ষান্ত হয়নি এরা, শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ছাড়লো! এরপর অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা বিপদে ছিল অনেক বছর। ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ দেশ পেয়েছি সেটা ঠিক। এরপর থেকে রাজনৈতিক নেতাদের নানারকম বিশৃঙ্খলায় খুব হতাশ হয়েছি.্ মন খরাপ হয়েছে বার বার। একী কা-, দেশ স্বাধীন করলো কারা, আর সুবিধা ভোগ করে কারা। 
বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেয়েছে, পাচ্ছে। আগে মনে হয়েছে কোথা থেকে  যেন আমরা এসেছি, এক বড় ঝামেলা। মানুষের মনে এমন ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছিল। এখন শতকরা ৭৫ ভাগ ঠিক হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার দেশ স্বাধীন না করলে আজ কেউ উকিল ব্যারিস্টার ডাক্তার হতো না। এত উন্নত জীবন পেত না। বিচারক হতো না। 
অনেক আগেই সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছি। এখন তো সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে বসবাস করি। আওয়ামী লীগ দল করি। অবসর নেয়ার পর যশোরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি। ছোটখাটো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে যতটা পারি মানুষের কাছাকাছি থাকি। 
আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা এখনো বেঁেচ আছি যুদ্ধের সত্যি প্রমাণ বলতে পারছি; বলতে পারো জীবন্ত প্রমাণ। যদি এই কাহিনী নিয়ে বই লেখো তাহলে মা নাম দিও, ‘জ্বলন্ত জীবনের জীবন্ত প্রমাণ’। 

বনশ্রী ডলি: আপনাকে অভিবাদন, রণাঙ্গানে লড়ায়ের কথা বলার জন্য ধন্যবাদ 
এবি সিদ্দীক: আমি তোমার অভিবাদন গ্রহণ করলাম। ধৈর্য ধরে এই কাহিনী শোনার জন্য তোমাকেও ধন্যবাদ মা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।  

এই বিভাগের আরো সংবাদ