আজকের শিরোনাম :

প্লাজমা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এ এ মামুনের সাক্ষাৎকার

‘অচিরেই কৃত্রিম সূর্য পৃথিবীতে তৈরি হবে’

  সনজিৎ সরকার উজ্জ্বল

০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬:৫৩ | আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬:৫৬ | অনলাইন সংস্করণ

প্লাজমা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এ এ মামুন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করা ড. মামুন ছাত্রজীবন থেকেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। এর ধারাবাহিকতায় কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রেুস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্লাজমা ফিজিক্সে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি একাধিক অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপের অধীনে জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে কমপ্লেক্স  বা ডাস্টি ফিজিক্সে অ্যাডভান্স রিসার্চ সম্পাদনের সুযোগ লাভ করেন। ‘প্লাজমা ফিজিক্স’ এ অসামান্য অবদানের জন্য তিনি  জুনিয়র ও সিনিয়র উভয় গ্রুপে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স স্বর্ণপদক ও একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে জামার্নির ব্যাসেল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ডসহ দেশে-বিদেশের অনেক খ্যাতনামা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। অধ্যাপক ড. এ এ মামুন দ্য ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সেসের একজন সম্মানিত ফেলো।

তিনি ‘ইন্ট্রোডাকশন টু ডাস্টি ফিজিক্স’ নামক বইয়ের অন্যতম লেখক যা বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যবই হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। দেশে-বিদেশের খ্যাতনামা জার্নালে এ পর্যন্ত তাঁর ৪১৭ টি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের প্রথম কোনো বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি গুগলে ১৭,৩৭৫ স্কলার্স সাইটেশনের মাইলফলক স্পর্শ করার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। তাঁর গবেষণার বিষয়ের মধ্যে রয়েছে প্লাজমা ফিজিক্স, কোয়ান্টাম ফিজিক্স ও মেডিক্যাল ফিজিক্স। পদার্থ বিজ্ঞানে অবদানের জন্য ড. মামুন ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে জামার্নির আলেকজান্ডার ভন হোমবোল্ট ফাউন্ডেশন থেকে  ফ্রেড্রিক উইলিয়াম ‘ব্যাসেল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেন। একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে তিনি এ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি জার্মানির হোমবোল্ট পোস্টডক ফেলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত জরিপে বিশ্বের শীর্ষ দুই শতাংশ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়ে আসছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এ এ মামুন। 

বিশ্বের অন্যতম সেরা প্লাজমা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এ এ মামুন এর বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাপ্তাহিক বাংলা বিচিত্রার নিজস্ব প্রতিবেদক সনজিৎ সরকার উজ্জ্বল। সাক্ষাৎকারটি এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম পাঠকদের জন্য নিচে হুবহু তুলে ধরা হল-

প্রশ্ন : স্যার, কেমন আছেন?
ড. মামুন: আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।

প্রশ্ন : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মায়ের আদেশ পালনে কলেজের চাকরিকে উপেক্ষা করে ভরা বর্ষায় রাতের আঁধারে সাঁতরিয়ে খরস্রোতা দামোদর নদ পার হয়ে বীরসিংহ গ্রামে পৌঁছান। শুনেছি আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন কেন?
ড. মামুন: মূলত মায়ের আদেশ পালন করতেই আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্¦বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। 

প্রশ্ন : একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে জার্মানির ‘ব্যাসেল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড’ এ ভূষিত হয়েছেন। পুরস্কার প্রাপ্তি সম্পর্কে কিছু বলুন।
ড. মামুন: হ্যাঁ, জার্মানির এই অ্যাওয়ার্ডটি অত্যন্ত সম্মানজনক। নোবেল প্রাইজের পরেই সম্মানীর দিক থেকে এটি সর্বোচ্চ। যে কোনো পুরস্কারই গবেষকদের দারুণভাবে উৎসাহিত করে। সাইটেশন ও পুরস্কার প্রাপ্তি সামনের দিকে এগিয়ে যাবার শক্তি যোগায়। আরও বড় স্বীকৃতি পাবার স্বপ্ন দেখায়।

প্রশ্ন : আপনি শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি, শিক্ষক প্রতিনিধি থেকে নির্বাচিত সিনেট সদস্য। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। একজন বিজ্ঞানীর শিক্ষক রাজনীতিতে সম্পৃক্ততাকে কিভাবে দেখছেন?
ড. মামুন: শিক্ষক রাজনীতিতে এসেছি ‘গুণগত মান’ পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণামুখী করে এগিয়ে নিতে চাইলে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। আপনি হয়তো জেনে থাকবেন- আইনস্টাইনও একসময় পলিটিক্সে সক্রিয় হয়েছিলেন। শুধু যে নিজে গবেষণা করব, গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করব না, সেটি ঠিক নয়।

প্রশ্ন : শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখতে একজন আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা কেমন হবে বলে মনে করেন?
ড. মামুন: যে থিওরি ১০০ বছর আগে এসেছে, সেটি তো পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়, সেগুলি আমাদের জানতে হবে। সাইন্স তো আজ যেটি বলে, কাল সেটির পরিবর্তন হতে পারে। শিক্ষকদের আপ-টু-ডেট হওয়া উচিত। এমন যে, প্রতি পাঁচ বছর পর পর কোর্স-কারিকুলামে পরিবর্তন আনা উচিত। ক্লাসে শিক্ষক যেটি পড়াবেন, সেটির বৈশ্বিক সর্বশেষ তথ্য সংযোজন করার চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি সময় দিতে হবে শিক্ষকদের। 

প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের গবেষণার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে কী করণীয় আছে?
ড. মামুন: ধন্যবাদ, এই সুন্দর প্রশ্নের জন্য। আসলে শিক্ষার্থীদেরকে স্বপ্ন দেখাতে হবে এবং একই সাথে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ দেখাতে হবে। আমাদের দেশে গবেষণার সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং এমনভাবে স্বপ্ন দেখাতে হবে যেন সেই সীমাবদ্ধতা তাকে আটকিয়ে রাখতে না পারে। আমি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণের জন্য বিদেশে যেতে উৎসাহিত করি। কেননা আধুনিক চিন্তাধারা ও জ্ঞান শিক্ষার্থীদের গবেষণার নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

প্রশ্ন : প্লাজমা বিজ্ঞান মানবকল্যাণে কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে? 
ড. মামুন: খুব সুন্দর প্রশ্ন। সূর্য পৃথিবীর শক্তির উৎস। এই সূর্যের ভিতরে আসলে প্লাজমা এবং প্লাজমা মাধ্যমের ভিতরে ফিউশন বিক্রিয়া হচ্ছে। আমরা যদি নিয়ন্ত্রিত ফিউশন বিক্রিয়া পৃথিবীতে তৈরি করতে পারি, যার অর্থ হলো একটা কৃত্রিম সূর্য তৈরি করতে পারি। তাহলে পৃথিবীতে এনার্জি সংকট বলে কিছু থাকবে না এবং সারাবিশ্বে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে। বিশ্বের প্লাজমা বিজ্ঞানীরা আশা করছে অচিরেই কৃত্রিম সূর্য পৃথিবীতে তৈরি হবে, ফিউশন রিঅ্যাক্টর তৈরি হবে পৃথিবীতে।

প্রশ্ন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে যদি বলতেন।
ড. মামুন: আমার বাবা ধামরাইয়ের কুশুরা আব্বাস আলী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। আমার বাবা আমার আদর্শ শিক্ষক। বাবার জন্যই আমরা ১১ ভাই বোন মানুষ হয়েছি। আমরা বাবার নামে একটা ট্রস্ট করতে চাই। যেখানে একটি হাসপাতাল থাকবে এবং হতিদরিদ্র শিক্ষার্থী ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা থাকবে। ট্রাস্ট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। আমার সম্পত্তি ও পুরস্কারের অর্থ (এক কোটি টাকার অধিক) মানবকল্যাণের জন্য ভালো একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে যেতে চাই। আমি ইউরোপ, আমেরিকা, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়াতে থাকার সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু যাইনি। আমি এ দেশেই মরতে চাই।  

প্রশ্ন : শিক্ষার্থীদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
ড. মামুন: অত্যন্ত সুন্দর প্রশ্ন। বলার সুযোগ দেবার জন্য ধন্যবাদ। একজন শিক্ষক যেমন তার ছাত্রের কাছে হেরে গিয়ে আনন্দ পায়, ঠিক তেমনি আমিও আনন্দ পাই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমার ছাত্ররা আছে, তারা অনেকে এখন বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, ভালো লাগে। তাই আমি বার বার আমার ছাত্রদের কাছে হেরে যেতে চাই। আমি মনে করি, ছাত্রের কাছে হেরে যেতে পারাটাই আসলে জিতে যাওয়া।

প্রশ্ন : স্যার, আপনার মূল্যবান সময় দেবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
ড. মামুন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

অধ্যাপক ড. এ এ মামুন ১৯৬৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ধামরাইয়ের কুশুরা আব্বাস আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তিনি স্বনামধন্য শিক্ষক মোঃ দরবেশ আলীর ৫ম সন্তান। একজন মানুষের কর্ম যখন তার দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যায়, তখন তিনি হয়ে উঠেন বিশ্বজনীন। তেমনি একজন মানুষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক প্লাজমা বিজ্ঞানী ড. এ এ মামুন।

 

সৌজন্যে : সাপ্তাহিক বাংলা বিচিত্রা।

এবিএন/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ