আজকের শিরোনাম :

‘‍কেন জানি আমরা উন্নয়ন বলতে কেবল ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নকে বুঝছি’

  সাবিদিন ইব্রাহিম

০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:১৪ | অনলাইন সংস্করণ

সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী
মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী. সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল। এর আগে তিনি অর্থ সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। অর্থ সচিবের আগে তিনি অর্থ বিভাগের উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিসটিংকশন নিয়ে ফাইন্যান্স ও অ্যাকাউন্টিংয়ে মাস্টার অব সায়েন্স (এমএসসি) ডিগ্রি অর্জন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। নতুন বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির নানা চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম।

প্রশ্ন : আমাদের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কী কী অর্থনৈতিক ঝুঁকি দেখছেন?

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী : যেকোনো অর্থনৈতিক পলিসি অবশ্যই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বিদেশী বিনিয়োগকারীর কথা যদি বলেন তারা তো মুনাফা করতে আসে। তারা চায় ব্যবসা ও মুনাফা করার উপযোগী পরিবেশ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তাদের এ আশ্বাস দেয় যে বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তার পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক রিটার্ন পাওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ বা এফডিআই আসে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা মাথায় রেখে। কাজেই স্থিতিশীলতার ঘাটতিজনিত অনিশ্চয়তা বিনিয়োগ ঝুঁকি সৃষ্টি করে। যেমন ইদানীং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন যা ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ, বিদেশী বিনিয়োগকারীর মূলধন ও মুনাফা ডলারের অংকে সরাসরি অবমূল্যায়িত হয়ে গেছে। বিনিয়োগের জন্য তাদের সামনে তো অনেকগুলো অপশন রয়েছে। যেখানে উপযোগী বিনিয়োগ পরিবেশ পাবে সেখানে চলে যাবে তারা। এ কারণে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃত অর্থে, আমরা যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কথা বলি, তা হচ্ছে জনগণের সম্মতিতে প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক সরকার। এ রকম সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে যেমন ভূমিকা রাখে, তেমনি বিদেশী বিনিয়োগও আকর্ষণ করে। 

প্রশ্ন : রেমিট্যান্স আমাদের আয়ের একটি বড় উৎস। ভারত, শ্রীলংকা ও ফিলিপাইন যেখানে দক্ষ জনশক্তি পাঠাচ্ছে সেখানে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের মানবসম্পদকে কীভাবে বিশ্ববাজারে দক্ষ জনবল হিসেবে পাঠাতে পারি?

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী : সবার আগে যেটা প্রয়োজন তা হলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে গুরুত্বারোপ করা। আমাদের যে ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট বা কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের সিলেবাস ও পাঠদান পদ্ধতি পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্তরোত্তর উৎকর্ষ ও ব্যবহার বৃদ্ধি অনেক পুরনো পেশা ও কাজকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে, সিলেবাসের আধুনিকীকরণ হতে হবে, সরঞ্জাম আনতে হবে এবং দক্ষ প্রশিক্ষক আনতে হবে। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের দক্ষ প্রশিক্ষক না-ই থাকতে পারে। প্রয়োজনবোধে শুরুর দিকে বাইরের দেশ থেকে প্রশিক্ষক আনতে হবে। 

আমরা যদি কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার দিকে তাকাই তাহলে বলতে হয়, আমাদের যথেষ্ট দক্ষ প্রশিক্ষক নেই। বিশেষ পলিসি গ্রহণ করে প্রয়োজনীয়তার নিরিখে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক এনে নতুন প্রযুক্তি ও নতুন দক্ষতা আয়ত্ত করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে নতুন ধরনের কাজে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এখন যেসব প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে সেগুলো রি-স্কিলিং। কিন্তু প্রযুক্তি যেভাবে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে সেখানে কোনো খাতেই রি-স্কিলিং দিয়ে হবে না। দশক আগের কথাও যদি বলেন রি-স্কিলিং হলেও চলত কিন্তু এখন রীতিমতো আপস্কিলিং জরুরি। যেমন মেডিকেল খাতের কথাই বলুন না, সেখানে এমআরআই মেশিন, এক্স-রে মেশিন, পেড স্ক্যান মেশিন ইত্যাদি ব্যবহার হচ্ছে। সেসব মেশিনের একটা ভার্সন থেকে আরেকটা ভার্সনে এলে সংশ্লিষ্ট টেকনোলজিস্টকে সপ্তাহখানেকের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ চালানো যেত। কিন্তু এখন যেসব মেশিন আসছে বা আসবে সেগুলোয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হচ্ছে, মেশিন লার্নিং আছে। সেগুলো রি-স্কিলিং করে চালানো যাবে না, আপস্কিলিং করতে হবে। তা না হলে মেশিন নিজেই হয়তো বলে দেবে, ‘আপনি আমাদের ঠিকভাবে চালাতে পারছেন না।’ এ কারণে আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়ন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সাধারণ উচ্চ শিক্ষাকে সিলেক্টিভ করে ফেলতে হবে। এখন যেভাবে আমরা উপজেলা পর্যায়ে অনার্স কোর্স চালু করছি তার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা সে প্রশ্ন আসা উচিত। দেখা গেছে, এ রকম অনার্স ও ডিগ্রি কলেজগুলোয় শিক্ষক চার-পাঁচজন, যোগ্যতার ঘাটতি তো বলাই বাহুল্য। সেখানে যা পড়ানো হচ্ছে সেগুলোর প্র্যাকটিক্যাল কোনো ব্যবহার নেই। যেমন অ্যাকাউন্টিংয়ে এখন অনেক কিছুই মানুষের করতে হয় না। প্রযুক্তি এখন ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্ট বানিয়ে ফেলছে। ব্যাংকের অনেক কাজে এখন মানুষের কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে ত্রুটির জায়গা হলো, এখানে এমন কিছু জিনিস শেখানো হচ্ছে যার কোনো ব্যবহার নেই। এ কারণে আমাদের একটা পুরোদস্তুর পলিসি শিফট লাগবে। সেটা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি হোক, মানবসম্পদ উন্নয়ন হোক এবং নতুন যুগের চাহিদা পূরণ হোক। 

প্রশ্ন : আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (জনমিতিক লভ্যাংশ) পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় চ্যালেঞ্জ তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব। বেকারত্ব কমাতে কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায়? 

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী : সাধারণ ধারণা, আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পাওয়ার মতো একটা বৃহৎ তরুণ শ্রমশক্তি আছে। কিন্তু কার্যত তাদের কাজেরই সুযোগ নেই। এখন সবকিছু প্রযুক্তিতে রূপান্তর হচ্ছে, এমনকি তৈরি পোশাক খাতও। নতুন এ প্রযুক্তি হ্যান্ডল করার জন্য উপযুক্ত শ্রমশক্তি লাগবে। সেটা হোক দেশের বাজার কিংবা বিদেশ। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি ব্যবহার করতে না পারলে দেশীয় পণ্য যেমন বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় ঠিকতে পারবে না, তেমনি বিদেশের বাজারে প্রযুক্তিতে দক্ষ শ্রমিক না পাঠালে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা নেয়া সম্ভব হবে না। আমাদের জনশক্তির বৃহৎ গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ, কিন্তু পুরনো ধাঁচের শ্রমিক নিচ্ছে না। এখন আমরা যদি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি না করি, তারা কিন্তু সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। যে তরুণদের ভরসায় আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পাব আশা করছি তাদের বড় অংশ কিন্তু বেকার হয়ে এদিক-ওদিক ঘুরছে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছি না। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তি পাঠাতে পারলে আমরা রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি করতে পারতাম। জাপান, এমনকি চীনের মতো অর্থনীতিতেও দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা আছে। আমরা এ সুযোগ নিতে পারছি না। 

প্রশ্ন : আমাদের রফতানি খাত হলো তৈরি পোশাক শিল্প। এখানে সাম্প্রতিক কিছু ভয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ ভয় কাটিয়ে ওঠা যায় কীভাবে?

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী : ভয় বলতে যেটা বোঝাতে চাচ্ছেন—কোনো নিষেধাজ্ঞা আসছে কিনা। মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রধান রফতানি গন্তব্য কিন্তু মাত্র দুটো। তার মানে, আমরা শুরু থেকেই কিন্তু ঝুঁকিতে আছি। রফতানি পণ্য কিংবা গন্তব্য বলেন দুটোতেই আমরা বৈচিত্র্য আনতে পারিনি। এ ঝুঁকিটা কিন্তু হঠাৎ সৃষ্ট কোনো ঘটনা নয়। রফতানি পণ্যের দিকে যদি তাকান তাহলে ৮০-৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক। আবার শীর্ষ রফতানি গন্তব্য যদি দেখেন তা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)ভুক্ত দেশগুলো। আমরা যদি যথোপযুক্ত পলিসি গ্রহণের মাধ্যমে রফতানি গন্তব্যে বৈচিত্র্য আনতে পারতাম তাহলে আমাদের ভয় কমত। ওষুধ, পাট ও চামড়াজাত পণ্যসহ অন্যান্য অপ্রচলিত পণ্য রফতানির ভলিউম বৃদ্ধি করতে পারতাম। যেহেতু রফতানি পণ্য ও গন্তব্যে বৈচিত্র্য আনতে পারিনি তাই শুরু থেকেই এ ভয়টা আছে। তবে এর সঙ্গে সম্প্রতি আরো কিছু ইস্যু যুক্ত হয়েছে। এখন বলা যায় প্রকৃত ভয়ের বিষয় থাকুক বা না থাকুক কিন্তু একটা ভয়ের আবহ তৈরি হয়েছে। এ ভয়ের আবহের নেতিবাচক প্রভাব কিন্তু উৎপাদন ও রফতানিতে পড়বে। ধরেন, কোনো গার্মেন্ট কারখানা যদি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়ে থাকে এখন আর সেদিকে যাবে না। বিদেশী কোনো বিনিয়োগকারী হয়তো বিনিয়োগে এগোবে না। কাজেই এখানে বাস্তবিক ঝুঁকি না থাকলেও ভয়টাই কিন্তু নেতিবাচক প্রভাব রাখবে, যা কাটিয়ে ওঠার জন্য কৌশলী পরিকল্পনা নিতে হবে। 

রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা, নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে সব অংশীজনের এ ভয় কাটানোর পথ অনুসন্ধান জরুরি। আমাদের প্রধান রফতানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ, তাই তাদের সঙ্গে সবসময় সহযোগিতামূলক মনোভাব ও আস্থা সৃষ্টির প্রয়াস রাখতে হবে। তা না হলে কিন্তু মনে রাখতে হবে, বনের বাঘে না খেলেও মনের বাঘে খায়। ভয় দূর করে বাজারে আস্থা ফেরাতে সব পক্ষকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। 

প্রশ্ন : আমাদের রফতানি বাজারে বৈচিত্র্যের কথা বলছিলেন। চীন ও ভারত আমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র। এ রকম বিশাল বাজার কেন আমাদের রফতানি গন্তব্য হচ্ছে না? 

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী : যত কথাই বলেন না কেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি যেভাবে কাজ করে, নিজেদের স্বার্থ দেখার পাশাপাশি বৈশ্বিক অঙ্গীকারকেও তারা বিবেচনায় নেয়। কিন্তু চীন ও ভারতের ক্ষেত্রে এমনটা দেখবেন না। যেমন ধরেন রফতানির ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা; যা আমরা চীন ও ভারতের কাছ থেকে পাচ্ছি না। তারা এমন কিছু পণ্যে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে যেখানে আমাদের চেয়ে তাদের সুবিধা বেশি। চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়টি যদি দেখি বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো বহুপক্ষীয় (মাল্টিল্যাটারাল) ঋণদাতা বা অন্যান্য উন্নত দেশের কাছে যে দ্বিপক্ষীয় সাহায্য-সহযোগিতা ও ছাড় পাই তেমনটা চীন বা ভারতের কাছ থেকে পাই না। তাদের ঋণ স্বল্পমেয়াদি এবং সুদহার চড়া। আবার অনেক ক্ষেত্রে ‍ঋণের অর্থে নির্মাণাধীন ভৌতকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব ও তাদের দেশীয় কন্ট্রাকটর দিয়ে সম্পন্ন করানোর শর্ত জুড়ে দেয়া হয়, ফলে প্রতিযোগিতামূলক দরে কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য ইতিবাচক কিন্তু চীন-ভারতের সঙ্গে নেতিবাচক। দেশ দুটো থেকে আমরা প্রচুর আমদানি করি কিন্তু রফতানি খুব কম। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর মতো চীন-ভারতের সঙ্গে রফতানি সম্পর্ক জোরদার করা বেশ কঠিন। 

প্রশ্ন : আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পা দিয়েছি। সস্তা শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা এ উল্লম্ফন দিলাম। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে এবং মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে আমাদের অর্থনীতিতে তো বৈচিত্র্য দরকার। সেক্ষেত্রে আমাদের কোন কোন খাত সম্ভাবনাময় মনে করছেন? 

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী : সম্ভাবনার কথা যদি বলেন, প্রথমে জনসংখ্যার কথা বলতে হবে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পেতে হলে ‘সংখ্যা’-কে ‘শক্তি’-তে রূপান্তর করতে হবে, তা একমাত্র সম্ভব আপস্কিলিং মাধ্যমে, রি-স্কিলিং দিয়ে হবে না। এক্ষেত্রে শুরুতেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে এবং শিক্ষায় বড় আকারের বিনিয়োগ করতে হবে। আরেকটা সম্ভাবনাময় খাত হলো সার্ভিস সেক্টর বা পরিষেবা খাত। আমাদের অর্থনীতিতে পরিষেবা খাতের অবদান কিন্তু বাড়ছে। তরুণ প্রজন্মকে যদি প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তুলতে পারি তাহলে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কিংবা আউটসোর্সিংয়ের একটি হাব হতে পারে বাংলাদেশ। যেমনটা হয়েছে ভারতের বেঙ্গালুরু। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য গন্তব্যও সম্প্রসারণ করা যায় এবং দক্ষ জনশক্তি রফতানি করা যায়। আমাদের আয়ের প্রধান দুটো উৎস কিন্তু রেমিট্যান্স ও রফতানি। দেশের বিভিন্ন খাতে আমরা যদি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে চাই তাহলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি অবকাঠামোর উন্নয়নও দরকার। এক্ষেত্রে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি প্রযুক্তি ও কৌশলগত উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে নীতি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

প্রশ্ন : আমরা তো অনেকগুলো অবকাঠামো করেছি। সেটা করতে গিয়ে বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, এটা ঋণ করে ঘি খাওয়া হলো কিনা?

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী : ১০০ বিলিয়ন ডলার ঋণের পুরোটা কিন্তু সরকারি ঋণ নয়। এতে বেসরকারি খাতের ঋণও অন্তর্ভুক্ত। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ায় এবং অনেক ঋণের কিস্তি দেয়া শুরু হওয়ায় এ প্রশ্ন সামনে আসছে। এজন্য অনেকে এসব অবকাঠামোয় বড় অংকের ঋণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। আমাদের অবকাঠামোর দিকে যদি তাকান, কেবল ভৌত অবকাঠামোর ওপর আমরা জোর দিচ্ছি। কিন্তু মানবসম্পদ উন্নয়ন, যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা, শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য সেবা ইত্যাদিতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করছি না। 

বেশকিছু অবকাঠামো করতে গিয়ে আমরা কিছু কঠিন শর্তের (হার্ড টার্ম) ঋণ নিয়েছি। সেসব অবকাঠামো থেকে যে সুবিধা পাব তা পাওয়ার আগেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হয়েছে। যেমন রূপপুর পাওয়ার প্লান্টের দিকে যদি তাকান সেটা অর্থনীতিতে অবদান রাখার আগেই কিন্তু বিশাল অংকের এ ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হবে। এজন্য এ মুহূর্তে মেগা প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে খুবই সিলেক্টিভ হতে হবে। একমাত্র নিশ্চিত উচ্চ অর্থনৈতিক রিটার্ন দেয় অথবা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখতে পারে এ রকম প্রকল্প বাছাই করতে হবে।

প্রশ্ন : আমরা যদি মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই সেখানে আমাদের মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিতে হবে। সে বিবেচনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে আমাদের বিনিয়োগ কেমন?

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী : আমাদের তারুণ্যকে কাজ দিতে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিড্যান্ড দিতে শিক্ষায় জোর দিতে হবে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষায় অংশগ্রহণ বাড়ছে কিন্তু গুণগত মানে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। আমাদের এডুকেশন যেমন লাগবে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পেতে গেলে তেমনি অনেক শিশুর মধ্যে স্টান্টিং বা খর্বাকৃতি বাড়ছে। শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জরুরি। আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এমনকি প্রতিবেশী অনেক দেশ থেকেও পিছিয়ে আছি। আবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যে ব্যয় করা হচ্ছে তার সিংহভাগ কিন্তু ব্যয় হচ্ছে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে। দেখা গেছে, প্রচুর অর্থ ব্যয় করে হাসপাতাল বানানো হলো, কিন্তু সেখানে ডাক্তার নেই, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও মেডিসিন নেই। স্কুল-কলেজের অনেক ভবন তৈরি হচ্ছে কিন্তু দক্ষ শিক্ষক নেই। আবার এ ধরনের অবকাঠামো তৈরিতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় লাগছে, নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। দেখবেন, অনেক জায়গায় ৫০০ বেড, ৭০০ বেডের হাসপাতাল উদ্বোধন হচ্ছে কিন্তু ভালো চিকিৎসক নেই, চিকিৎসাসেবা নেই।

প্রশ্ন : আমরা উন্নয়ন বলতে আসলে কি বুঝছি?

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী : আমরা কেন জানি উন্নয়ন বলতে কেবল ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নকে বুঝছি। এ কারণে একের পর এক অবকাঠামো ও স্থাপনা প্রকল্প অনুমোদন হচ্ছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এক হাজারেরও বেশি প্রকল্প আছে। এর মধ্যে ৮০-৯০ শতাংশই সঠিক ফিজিবল স্ট্যাডি ছাড়া প্রজেক্ট। দেখা গেছে, সঠিক ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়া ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়া হলো। কিন্তু প্রকল্প শেষ করতে পাঁচ বছরের জায়গায় ১৫ বছর চলে গেল। এতে প্রকল্প ব্যয় তিন গুণ বেড়ে দেড় হাজার কোটি টাকা হয়ে গেল। সময় ও অর্থ যেভাবে অপচয় হচ্ছে তা দিয়ে তিন গুণ বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব ছিল। ভৌত অবকাঠামোয় যে দক্ষ জনবল লাগবে ও ভালো পরিষেবা নিশ্চিত করতে হবে সেখানে পিছিয়ে আছি। আমরা হাসপাতাল বানাচ্ছি, কিন্তু সেখানে দক্ষ চিকিৎসক ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানাচ্ছি কিন্তু ভালো শিক্ষক নেই, ল্যাব নেই। আমরা নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করছি কিন্তু তা পরিচালনার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক নেই। বরং যে কোথাও চাকরি পাচ্ছে না সে হচ্ছে শিক্ষক। আবার প্রাথমিক স্কুল শিক্ষককে আমরা দিচ্ছি পিয়নের বেতন। প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষককে আমরা নিচের গ্রেডে রাখছি। প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের আমরা গেজেটেড ধরব কি ধরব না এ নিয়ে পাঁচ বছর ধরে বিতর্ক করছি। সরকারের প্রথাগত কাঠামো দিয়ে শিক্ষা খাত চলবে না। প্রাথমিকের, মাধ্যমিকের শিক্ষকদের বেতন কাঠামোয় যৌক্তিক পরিবর্তন আনতে হবে। ভালো শিক্ষক না হলে যেকোনো নতুন কারিকুলাম হ্যান্ডল করতে পারবে না। শিক্ষকদের যদি স্কুল থেকে বাড়িতে গিয়ে জমি চাষ করতে হয়, দোকানপাট চালাতে হয় তাহলে সে নতুন কারিকুলাম কীভাবে হ্যান্ডল করবে? কারিকুলাম নবায়ন নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছে, সেটা ভালো। কিন্তু নতুন কারিকুলাম চালানোর জন্য শিক্ষকের বেতন বাড়ানো এবং তাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করা অত্যন্ত জরুরি। নতুন যে স্কুল ভবন তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে তার ভৌত নকশা ও নতুন কারিকুলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিনা তাও মাথায় রাখতে হবে। শিক্ষকদের প্রস্তুত করতে হবে এবং ছাত্রদের হাতে প্রয়োজনীয় ইনস্ট্রুমেন্ট তুলে দিতে হবে। তা না করলে নতুন কারিকুলাম অনেকটা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার মতো হবে। 

প্রশ্ন : শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের সংযোগকে কীভাবে দেখছেন? 

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী : শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সঙ্গে পলিটিক্যাল ইকোনমি গভীরভাবে জড়িত। এক্ষেত্রে দরকার স্থানীয় সরকারের কার্যকর অংশগ্রহণ যা রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৯ ও ৬০ এবং বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকারগুলোর নিজস্ব পরিকল্পনা প্রণয়ন, তহবিল সংরক্ষণ, বাজেট ব্যবস্থাপনার বিধান থাকলেও কার্যত এসব প্রতিষ্ঠান চলছে কেন্দ্রীয় সরকারের বর্ধিত সংস্করণ হিসেবে। গ্রামে কোথায় সেতু হবে, হাসপাতাল হবে এগুলোর পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাজেট ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি হচ্ছে কেন্দ্র থেকে, কেন্দ্রীয় বাজেটের আওতায় অর্থাৎ স্থানীয় সরকারগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে মন্ত্রণালয়গুলোর অধস্তন অফিস। এতে হচ্ছে কী, এমন জায়গায় ব্রিজ তৈরি হয়েছে হয়তো সেখানে রাস্তাই নেই। প্রাথমিক শিক্ষা ও চিকিৎসার বিষয়গুলো যদি স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হতো তাহলে তা ঠিক জায়গায় হতো, প্রয়োজনমাফিক হতো। যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারগুলোর প্রকৃত ক্ষমতায়ন দরকার। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ার লক্ষ্যে স্থায়ী ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ পুনরুজ্জীবিত করা এখন সময়ের দাবি। 

প্রশ্ন : নতুন বছরে নতুন সরকার গঠন হলো। এ সরকারের কাছে কী প্রত্যাশা করছেন?

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী : আমার প্রত্যাশার জায়গা হলো, সব পাবলিক পলিসি জনমুখী হবে, ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থরক্ষা নয়, বরং বৃহত্তর জনস্বার্থ রক্ষায় তা প্রণীত ও পরিচালিত হবে। আমি আশা করব, বৃহত্তর জনস্বার্থে অর্থনৈতিক পলিসিগুলো নেয়া হবে, সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান জনকল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে নিজ নিজ আইনের অধীনে স্বাধীনভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সঙ্গে পরিচালিত হবে। অর্থ পাচার রোধ হবে, ব্যাংক খাতে মন্দঋণ কমবে, পরিচালকদের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ হবে। আর্থিক খাতের সংস্কার অতিজরুরি হয়ে পড়েছে। এ উদ্দেশ্যে ব্যাংক কমিশন গঠনের মাধ্যমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ জরুরি ভিত্তিতে নেয়া হবে। সরকারি হস্তক্ষেপের বাইরে থেকে বিভিন্ন খাতের রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ আইনের যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিতে উদ্যোগী হবে, এতে কেন্দ্রীয় সরকার অযথা হস্তক্ষেপ করবে না, বরং অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সঠিক ব্যক্তি থাকবে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাবে, নতুন বছরে এমনটাই কামনা করছি। 

 

সৌজন্যে : দৈনিক বণিক বার্তা।

এবিএন/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ