আজকের শিরোনাম :

‘বঙ্গবন্ধুর সততা, সংগ্রাম ও সাহস শিশুদের শেখাতে পারছি না’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২২, ১৭:৪১

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন
১৯৭৩ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রধান উপদেষ্টা। এর আগে তিনি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮-২০০১ সালে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন মেয়াদে সোনালী ব্যাংক, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন সূচিত হলেও ১৯৬৬ সালের পর জনপ্রশাসনে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এই অর্থনীতিবিদ ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের জন্ম ১৯৪২ সালে হবিগঞ্জে। 'চতুর্থ শিল্পবিপ্লব' তার সর্বশেষ প্রকাশিত অনুবাদ গ্রন্থ।  সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারটি নিচে তুলে ধরা হল। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন শেখ রোকন।

প্রশ্ন: আপনি বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখেছেন। জন্মদিনটি তিনি কীভাবে কাটাতেন?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: বঙ্গবন্ধু তার জন্মদিন পালনে সবাইকে নিরুৎসাহিত করতেন। তিনি স্বাভাবিক দিনের মতো কাজকর্ম করতেন। গণভবনে যেতেন। সরকারি বা দলীয় কোনো কর্মসূচি থাকলে সেখানে যোগ দিতেন। জন্মদিন উপলক্ষে আলাদাভাবে আড়ম্বরপূর্ণ কিছু করতেন না। আমাদের বলতেন- আমি যাদের প্রতিনিধি, সেই গাঁও-গেরামের, চাষাভুষা মানুষ; যাদের গায়ে ঘামের গন্ধ, যারা ভীরু পদক্ষেপে চলাফেরা করে; তারা কখনও জন্মদিন পালন করে না। আমি শেখ মুজিবেরও জন্মদিন পালনের দরকার নেই। বঙ্গবন্ধু বলতেন, আমি গরিব দেশের গরিব প্রধানমন্ত্রী। ফরাস, তারা কেউ আমার কাছে আসলে তাদের কাজটা আগে করে দিবি। বড় লোকদের দিয়ে বৈঠকখানা ভরানোর জন্য আমি দেশ স্বাধীন করিনি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের এই সাধারণ জনগোষ্ঠীকে বঙ্গবন্ধু অনেকবারই 'দুখী মানুষ' আখ্যা দিয়েছেন। একবার আপনি আমাকে বলেছিলেন- দুখী মানুষের জন্য দ্বার অবারিত রাখতে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগের প্রথম দিনই আপনাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: ধন্যবাদ, বিষয়টি মনে রাখার জন্য। নিয়োগ পাওয়ার পর প্রথম সাক্ষাতেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- লুঙ্গি পরা, খেটে খাওয়া মানুষগুলো আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আটকাবি না। স্যুট-কোট পরা আমলারা তাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। এ জন্য ছাত্রলীগের বদলে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে তোকে নিয়ে এনেছি। এই কৃষক-শ্রমিক, দুখী মানুষের জন্যই আজ আমি বঙ্গবন্ধু- মনে রাখবি।

প্রশ্ন: স্বাধীনতার পর প্রথম জন্মদিনে খানিকটা আনুষ্ঠানিকতা ছিল সম্ভবত।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: স্বাধীন বাংলাদেশে তার প্রথম জন্মদিনটি ছিল কর্মমুখর দিন। সেদিন ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। তার সম্মানার্থে দিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছিলেন- ভবিষ্যতে আর কখনও দিনটিতে ছুটি থাকবে না। ওই দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষে তাকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে থাকতে রাজি হননি।

প্রশ্ন: ১৯৭৫ সালের ১৭ মার্চে তার জন্মদিন কীভাবে পালিত হয়েছিল?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: স্বাধীনতার পর প্রতি জন্মদিনেই আমরা আনুষ্ঠানিক আয়োজনে সম্মতি দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে জোরাজুরি করতাম। আবার প্রতিবছরই ওই দিন বিভিন্ন ধরনের মানুষ তার সঙ্গে দেখা করতে আসত। ফলে তিনি না চাইলেও ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে মানুষের ভিড় হতো। সবমিলিয়ে আমাদের জোর-জবরদস্তিতে ৭৫ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপারে নিমরাজি হয়েছিলেন। তবে শর্ত দিয়েছিলেন, শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাবেন। বলেছিলেন, তোরা নিজেরা যা পারিস করবি। কিন্তু আমি যেন ঘর থেকে বের হয়ে প্রথমে শিশুদের দেখতে পাই। মনে আছে, ওইদিন অনেক শিশু এসেছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকে ছড়া, গান, কবিতা শুনিয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাদের সময় দিয়েছিলেন। গল্প করেছিলেন, শিশুর মতো মিশে গিয়েছিলেন।

প্রশ্ন: আর কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: প্রতিটি জন্মদিনে অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম খুব সকালে বাগানের এক তোড়া তাজা ফুল দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতেন। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়টি পছন্দ করতেন। আরেকজনকে বঙ্গবন্ধু খুব পছন্দ করতেন। কচি-কাঁচার মেলার দাদাভাইকে। জন্মদিনে তিনিও আসতেন শিশুদের নিয়ে। পঁচাত্তরেই কোনো এক দিন, জন্মদিন উপলক্ষে নয়, কচি-কাঁচার মেলার শিশুদের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। শিশুদের সঙ্গে মিশে খুব মজা পাচ্ছিলেন। নির্ধারিত সময়ের চেয়েও অনেক বেশি সময় কাটিয়েছিলেন।

প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ ও সংগ্রাম, সেটা কি স্বাধীনতা-পরবর্তী শিশুদের মধ্যে সঞ্চারিত করা গিয়েছিল?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: শুধু শিশুরা নয়; বঙ্গবন্ধু ছিলেন যুবক, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ- সব বাঙালির নয়নের মণি। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি, তাদের কাছে তার স্মৃতি মনের মুকুরে আঁকা আছে। হিমালয়সম উচ্চতার এই মহানায়ককে একবার যে দেখেছে, তার পক্ষে ভুলে যাওয়া কঠিন। বঙ্গবন্ধু শিশুদের পছন্দ করতেন; শিশুরাও তাকে খুব পছন্দ করত। তখন শিশু-কিশোররা, তরুণরা বড় হয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো হতে চাইত। কিন্তু ৭৫-পরবর্তী নানা প্রপাগান্ডা, অপপ্রচার চালানো হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। ৭৫-পরবর্তী শিশুরা তাই বঙ্গবন্ধুকে না জেনেই বড় হয়েছে। এখন সমাজে যে নেতিবাচক পরিস্থিতি দেখা যায়; বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে শিশুদের বঞ্চিত করার ফল এটা।

প্রশ্ন: আওয়ামী লীগ সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এখন জাতীয় শিশু দিবস। তারপরও কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও সংগ্রাম শিশুদের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরা গেছে?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: দুর্ভাগ্যের বিষয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সততা, সংগ্রাম ও সাহস শিশুদের যথাযথভাবে শেখাতে পারছি না আমরা। তারা দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজ, দখলদার, ডাকাতদের দেখে দেখে বড় হচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা জঞ্জাল ঢুকেছে। সরকার শিশুদের দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করে, সেটা ঠিকমতো বাস্তবায়ন হয় না। শিশুরা শিখবে কীভাবে? বঙ্গবন্ধুকে জানবে কীভাবে?

প্রশ্ন: কাদের কারণে এ পরিস্থিতি?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: ধান্দাবাজদের কারণে। তারা দলের মধ্যে ও সরকারের মধ্যে ঢুকে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তারা মেকি কান্না করে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সততা ও আদর্শ ধারণ করে না। বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে; আওয়ামী লীগ ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকদের সঙ্গে ছবি তোলে। তারপর সেটা দিয়ে ধান্দাবাজি করে। আমি দেখে দেখে অবাক হই, ক্ষুব্ধ হই- বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে গিয়েও তারা চাঁদাবাজি করে! বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে নিজেদের আখের গোছায়।

প্রশ্ন: এই পরিস্থিতিতে কী করতে হবে?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: শিশুদের কাছে ইতিহাসের মোটা বই নিয়ে গেলে হবে না। তাদের কাছে শিল্প, সাহিত্য, কবিতা, গান, চলচ্চিত্র, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে যেতে হবে। সেগুলোর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরতে হবে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন খেলার পোকা। শিশুদের কাছে খেলাধুলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর এই দিকটি তুলে ধরতে হবে। স্থূলভাবে নয়; সৃজনশীলভাবে তুলে ধরতে হবে। শিশুরা যদি বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, তাহলে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে উঠবে।

প্রশ্ন: আপনারা যারা বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখেছেন, তারা কি শিশুদের কাছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিতে পারেন?

মেহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: আমরা সাধ্যমতো করছি। আজকে আমি লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে লেকচার দিতে গিয়েছিলাম। সেখানে বিভিন্ন ক্যাডারের ২৪১ জন কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের কাছেও কথাগুলো বলেছি। বলেছি, আমরা যারা বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি, তারা ভাগ্যবান। কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে, আমার মতো দুই-একজন দিয়ে হবে না। ধান্দাবাজের সংখ্যা হাজারে হাজারে। বঙ্গবন্ধুর কাছে আমরা সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। এখন তোষামোদির প্রতিযোগিতায় আমরা ফেল করে যাচ্ছি।

প্রশ্ন: তাহলে সমাধান কী?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের এখনই সতর্ক হতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে যারা সরাসরি দেখেছে, তেমন মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাদের নিয়ে এখনই জেলায় জেলায় শিশুদের কাছে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম, সাহস, আত্মত্যাগের কথা শিশুদের সামনে তুলে ধরতে হবে।

প্রশ্ন: এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: আপনাকেও শুভেচ্ছা।


সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ