আজকের শিরোনাম :

‘উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চর্চার অনেক উন্নতি হয়েছে’

  সাইফুর রহমান তপন

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:৪১ | আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:৪৩ | অনলাইন সংস্করণ

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বাংলাদেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তিনি উচ্চ আদালতে বিচারপতি থাকাকালে প্রায় পুরো সময়ে বাংলায় রায় দিয়ে নজির স্থাপন করেছেন, যা এখনও কোনো কোনো বিচারপতি অনুসরণ করে চলেছেন। খায়রুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও যুক্তরাজ্যের লিংকনস-ইন থেকে বার অ্যাট ল ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে জেলা জজ আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করে ১৯৭৬ সালে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন তিনি। ২০১০ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি হন এবং ওই বছরই প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। তার জন্ম ১৯৪৪ সালে; মাদারীপুরে। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিচে তুলে ধরা হল।  সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন সাইফুর রহমান তপন।

প্রশ্ন: উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় যারা দিয়েছেন তাদের মধ্যে প্রথম হলেন বিচারপতি আমীরুল ইসলাম চৌধুরী...

খায়রুল হক: উনিই পাইওনিয়ার। বিচারপতি এ আর এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী শুধু রায় না; ছোট ছোট আদেশও বাংলায় দিতেন।

প্রশ্ন: এর পর তো বিচারপতি কাজী এবাদুল হক।

খায়রুল হক: উনিও দু-একটা রায় দিয়েছেন; বেশি না। বিচারপতি হামিদুল হকও দু-একটা দিয়েছেন। এ রকম আরও কয়েকজন দিয়েছেন। এর পর আর কাউকে তেমন পাই না।

প্রশ্ন: এখানেই আমার প্রশ্ন। ১৯৯৯ সালের পর উচ্চ আদালতে কোনো রায় বাংলায় হয়নি। এর পর ২০০৭ সালে আপনি বাংলায় রায় দেওয়া শুরু করেন।

খায়রুল হক: ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি।

প্রশ্ন: এবং অবসরগ্রহণ পর্যন্ত ২০০টি রায় বাংলায় দেন।

খায়রুল হক: এর থেকেও বেশি হবে। দেখুন, জরুরি হলে চটপট ইংরেজিতে দিতে হয়। জরুরি কোনো বিষয় না হলে আমি প্রায় সব রায়ই, যেমন ত্রয়োদশ সংশোধনীর মতো বিশাল রায়ও বাংলায় দিয়েছি। সেটা কিন্তু অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য। কারণ সঠিক বা বেঠিক হোক- আমাদের এখানে বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া কঠিন। দু'নম্বর এবং এর থেকেও কড়া হচ্ছে, রায় নিজের হাতে লিখতে হয়। কারণ আমাদের বেঞ্চ অফিসাররা বাংলায় ডিকটেশন নিতে পারেন না। এর ফলে ত্রয়োদশ সংশোধনীর পুরো ৪০০ পাতার রায় আমাকে নিজের হাতে লিখতে হয়েছে। কারণ প্রথম দু-চারটা রায় দেওয়ার পর আমার কাছে যখন নিয়ে এসেছে চূড়ান্ত করার জন্য, তখন আমি নিজেই রায় বুঝতে পারছি না। রায়ের সাবজেক্ট ম্যাটারটা যে কী- সেটাই আমি ধরতে পারছি না। তখন বুঝলাম- না, ডিকটেশন দিয়ে কাজ হবে না। নিজের হাতে লেখা শুরু করলাম।

প্রশ্ন: দেখা যাচ্ছে, উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার ভূমিকাটা একটু ব্যতিক্রম। এতে উদ্বুদ্ধ হলেন কীভাবে?

খায়রুল হক: আমরা তো আগের প্রজন্মের মানুষ। ৫২'র কথাটা আমাদের মাথায় ঝকঝক করে। সারাবিশ্বের ইতিহাসে ভাষার জন্য কেউ প্রাণ দেয়নি বাঙালি ছাড়া। তাদের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়াটা আমার কাছে যুক্তিসংগত মনে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধটা তো হয়েছে এ বাংলা ভাষার ধারাবাহিকতায়, ছয় দফার ধারাবাহিকতায়, স্বায়ত্তশাসনের ধারাবাহিকতায়। এসব কিছুর ধারাবাহিকতায় আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ তথা এক দফা চেয়েছি- ১ মার্চ ১৯৭১ সালে। তখন আর ছয় দফাও নাই, স্বায়ত্তশাসনও নাই; একটাই দফা। সেটার মূল জিনিসটাই ছিল জয় বাংলা। আপনি দেখবেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় মাঝেমধ্যে একেবারে খাস ফরিদপুরের ভাষা বলেছেন।

প্রশ্ন: আপনিও তো প্রথমদিকে ইংরেজিতে রায় দিতেন।

খায়রুল হক: সেটা হাইকোর্ট রুলের কারণে। আবার সংবিধানে লেখা আছে বাংলার কথা। কোনো প্রধান বিচারপতিও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেননি। এর মধ্যে জনকণ্ঠে পরপর তিন দিন তিনটা নিবন্ধ প্রকাশ হলো সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরও প্রধান ছিলেন। নিবন্ধ তিনটি পড়ার পর আমি কনভিন্সড হলাম- ইংল্যান্ডেও রায় প্রথমে দেওয়া হতো লাতিন ভাষায়। ইংল্যান্ডের রাজারা ফরাসি ভাষায় কথা বলতেন। আর পণ্ডিতি ভাষা ছিল; যেমন এখানে ছিল সংস্কৃত, সেখানে লাতিন। যেহেতু জজ সাহেবদের পণ্ডিত বলেই মনে করা হয়, তারা লাতিন ভাষায়ই রায় দিতেন। পরবর্তী সময়ে কিছু জজ সাহেব ফরাসি ভাষায় দিতেন, তবে ইংরেজি ভাষায় কেউ রায় দিতেন না। কারণ ইংরেজি ভাষাটা ছিল কৃষকদের ভাষা, শ্রমিকদের ভাষা। ১০৬৬ সালে উইলিয়াম দি কনকোয়ারার ইংল্যান্ড দখল করে রাজা হলেন। তার মাতৃভাষা ফ্রেঞ্চ। তিনি তো ফ্রেঞ্চ ভাষাতেই কথা বলতেন। আমি অনেক খুঁজেও বের করতে পারিনি- কে প্রথম ইংরেজিতে রায় দিয়েছিলেন। আমার একটা আর্টিকেল আছে। সেখানে দেখিয়েছি, অন্তত ৩০০ বছর লেগেছে ইংরেজি ভাষায় পূর্ণাঙ্গ রায় দিতে। আমাদের দেশেও অনেকটা এগিয়েছি আমরা বাংলায় রায় লিখতে।

প্রশ্ন: তারপর বাংলায় রায় দেওয়া শুরু করলেন?

খায়রুল হক: ওই তিনটা নিবন্ধ পড়ার পরে আমি সব জড়তা ঝেড়ে বাংলা ভাষায় রায় লেখা শুরু করলাম। যা থাকে কপালে! তখনও কিন্তু আমার অনেক জ্যেষ্ঠ সহকর্মী আমাকে বলেছেন, কী করছেন এসব পাগলামি! যারা একটু বিদেশ থেকে লেখাপড়া করে এসেছেন তাদের কেউ কেউ বললেন, আপনার এ বাংলায় রায় কে পড়বে? আমি বলেছি, যাদের জন্য রায় দিচ্ছি তারা পড়বে! আমাদের রায় পড়ার জন্য ইংলিশ জাজদের সময় নাই। কাজেই যারা উপকৃত হতে পারে তাদের জন্যই লিখি বাংলা ভাষায়।

প্রশ্ন: কিন্তু আপনার এ পদক্ষেপের পরে আদালতে বাংলা ভাষার চর্চা যতটা বিস্তৃত হওয়ার কথা ছিল, তা কিন্তু হয়নি। এখানে বাধাটা কোথায়?

খায়রুল হক: বাধাটা হচ্ছে, আমি ডিকটেশন দিলে ডিকটেশন নেওয়ার লোক নাই। দুই নম্বর হলো, বাংলা প্রতিশব্দের অভাব। আমি 'ক্লেইম ইনটু কনফ্লিক্ট' শব্দগুলোর প্রতিশব্দ খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গিয়েছিলাম। এর পর এক দিন কোর্টে এটা নিয়ে কথা বলছিলাম। তখন এক সাংবাদিক বললেন- স্যার, 'সাংঘর্ষিক' কথাটা কেমন হয়? তখন আমি বললাম, বাহ! সুন্দর শব্দ তো! সেই সাংবাদিক ছিলেন মিজানুর রহমান খান।

প্রশ্ন: বিচারপতি কাজী এবাদুর রহমান লিখেছেন; আদালতের বেশিরভাগ আইনজীবী বাংলার পক্ষে। তিনি বলেছেন, ঢাকা ল রিপোর্টস বাংলায় অনুবাদ করে আইনজীবীদের মধ্যে দেওয়ার পর দ্রুত তা বিক্রি হয়ে যায়। আবার কোর্টের একটা রায় বাংলার পক্ষে দেওয়ার পর ৫০০ আইনজীবী এর বিরুদ্ধে পিটিশন দিলে এক হাজার আইনজীবী পাল্টা পিটিশন দেন...

খায়রুল হক: রায়টায় কিন্তু ইংরেজি ভাষা নিষিদ্ধ করা হয়নি। বলা হয়েছে, আপনি বাংলায় রায় দিন বা পিটিশন দিন তাতে অসুবিধা নাই; তবে ইংরেজিতে রায় দিতে পারবেন না বা পিটিশন দিতে পারবেন না- তা বলা হয়নি। আরেকটা কথা- অনেক সময় সুবিধার জন্য আমরা অনেক কথা বলি। কিন্তু ইংরেজি রায় বাংলায় অনুবাদ করা ঠিক নয়। কারণ রায় পবিত্র। এর একটি ডট আপনি পরিবর্তন করতে পারবেন না, যদি না ঊর্ধতন আদালত নির্দেশনা দেন। যেটা আপনি করতে পারেন, রায়ের একটা সারসংক্ষেপ বাংলায় দিতে পারেন। আপনিও দেখবেন বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে বা ইংরেজি থেকে বাংলায় করার পর একই অর্থ দাঁড়ায় না।

প্রশ্ন: আইনজীবীদের মধ্যে যদি বাংলার পক্ষে এমন অবস্থান থাকে, তাদের মধ্য থেকেই তো বেশিরভাগ বিচারপতি নিয়োগ পান। তাহলে আদালতে বাংলার চর্চা দিনে দিনে ব্যাপক হচ্ছে না কেন?

খায়রুল হক: না; তা একমাত্র কারণ হতে পারে না। কারণ আমি তো নিজে হাতে বাংলায় রায় লিখেছি। বিশ্বাস করুন, বাংলায় একটা রায় লিখতে যতটুকু সময় লাগে; ইংরেজিতে ততক্ষণে চারটা রায় লেখা যায়। হরদম ডিকশনারি খুঁজতে হয় তো। আর ওই মুহূর্তে ভালো বাংলা অভিধানও ছিল না। এ জন্যই ল কমিশনে এসে একটা অভিধান বানিয়েছি আমি। আপনি হয়তো দেখেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ অভিধানটি রেফার করেছেন। সবাই খুব প্রশংসা করেছেন এর। এর নাম আইন শব্দকোষ। আমাদের কাজে লাগে এমন অনেক ইংরেজি শব্দ এতে আমরা ঢুকিয়েছি। তাতে এখন সুবিধা হওয়ার কথা। তবে সবচেয়ে বড় বাধা হলো মনস্তত্ত্ব।

প্রশ্ন: অনেকে ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্বকে দায়ী করেন আদালতে বাংলা চর্চা কম হওয়ার পেছনে।

খায়রুল হক: আসলেই তাই। আমাদের যদি ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স থাকে যে, আমি বাংলায় লিখলে অমুক সাহেব মনে করবেন- আমি ইংরেজি জানি না বলেই বাংলায় লিখছি। আমি হয়তো লেখাপড়াই জানি না। এ জিনিসটা কিন্তু অনেকের মধ্যে কাজ করে। তবে এটা আমি পাত্তা দিইনি। আত্মবিশ্বাস ছিল, সাদাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি করে এসেছি। ভাঙাচোরা হলেও ইংরেজি কিছু জানি। কুইন্স ইংলিশ বলতে পারব- তা কখনও দাবি করিনি; করতে পারব না; করার প্রয়োজনও নাই। কারণ ওটা আমার মাতৃভাষা না। ইংরেজি ভাষায় ভুল করলে এটা দোষের কিছু হবে না। তবে বাংলা ভাষায় ভুল করলে খারাপ দেখা যাবে। আপনি যদি মনস্থির করেন, অসুবিধা হওয়ার কথা না। তবে খুব সতর্ক থাকতে হয়। কারণ রায় লিখতে গিয়ে যদি কোনো ভুল শব্দ ব্যবহার হয় বা কোনো আইনের উদ্ধৃতি ভুল হয়, তাহলে আমাকে প্রবল সমালোচিত হতে হবে।

প্রশ্ন: দেশের আইনগুলোকে বাংলা করার কথা কয়েক বছর ধরে শোনা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি কী?

খায়রুল হক: আমরা ল কমিশন থেকে আইন অনুবাদের চেয়ে নতুন আইন বেশি তৈরি করছি। যেমন-ভূমি আইনটি ইংরেজি ছিল; আমরা এটা বাংলায় করেছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ইংরেজি আইনটা বাংলা করার চেয়ে নতুন করে বাংলায় তৈরি করা হলে সেটা বাংলায় যেমন হলো তেমন যুগোপযোগীও হলো। আবার সাক্ষ্য আইনটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা একদিকে এর ভাষান্তর করছি, আবার নতুন কিছু বিষয় ঢুকিয়ে দিচ্ছি। এতে এটা আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে।

আর আইন ধরে ধরে বাংলা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এ কারণে হবে না; ইংরেজ আমলে যে ধরনের আইন হয়েছে; আমরা নিজেরাও খতিয়ে দেখেছি, সেগুলো ভাষান্তর করা খুব দুরূহ। ওই রকম করে ইংরেজির গ্র্যাভিটিটা বাংলায় আনা যাবে না। তবে কেউ হয়তো বলতে পারেন- আপনি পারেন না তো পারেন না; আমরা তো পারি। আমি তাদের অনুৎসাহিত করছি না। তবে যেসব অনুবাদ আমাদের হাতে আসে, সেখানে আইনের গাম্ভীর্যটা যে ধরনের হওয়া উচিত সেটা প্রতিফলিত হয় না।

প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চর্চার ভবিষ্যৎ কী দেখছেন?

খায়রুল হক: আমি হাইকোর্টের জাজ হয়েছিলাম ১৯৯৮-এ। আর রিটায়ার করেছি ২০১১-এ। এর মধ্যে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে এবং আমি চলে আসার পরও অনেক উন্নতি হয়েছে। ইংরেজদের দেশে ইংরেজি ভাষায় রায় লিখতে যদি ৩০০ বছর লাগে তাহলে আমরা ৫০ বছরে খুব একটা খারাপ করিনি। আমরা আশা করব, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

প্রশ্ন: ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

খায়রুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।

 


সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ