আজকের শিরোনাম :

‘আমি লকডাউনের বিরোধী, গত বছর যেটা হয়েছে সেটা ইউজলেস’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ১০:২৯

ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম
এক সপ্তাহ ধরে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। করোনার ডেল্টা ধরনের পাশাপাশি অধিকতর সংক্রামক ওমিক্রন শনাক্ত হচ্ছে। করোনা সংক্রমণের বর্তমান অবস্থা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কী হতে পারে, তা নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেছেন করোনা প্রতিরোধ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ক। সাক্ষাৎকারটি এবিনিউজ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:

প্রশ্ন : সংক্রমণের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এটা কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে? কখন আবার কমতে শুরু করবে বলে আপনার মনে হয়?
ডা. নজরুল ইসলাম : জানুয়ারির শুরুতে ২ শতাংশের কম ছিল। গতকাল তা বেড়ে ৩২.৩৭ শতাংশ হয়েছে। এর শেষ কোথায় বলতে পারছি না। আমাদের এখানে ডেল্টা এখনো পুরোপুরি যায়নি। ডেল্টার অনেকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে ওমিক্রন। কিন্তু ঠিক কতটুকু দখল করেছে, এটা আমরা জানতে পারছি না। এটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে কিংবা কখন কমবে, কমার কারণ কী হবে, তা আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা তথ্যের ওপর নির্ভর করেই বিশ্লেষণ করি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে রোগ নির্ণয়ের জন্য অনেক ল্যাব আছে। কিন্তু সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত ল্যাব নেই। আমাদের দেশে এখনো ওমিক্রনের জিনোম সিকোয়েন্সিং নিয়ে সেভাবে কাজ হয়নি। ফলে বুঝতে পারছি না এই সংক্রমণ ওমিক্রনের জন্যই কি না বা এর কতটুকু ওমিক্রন।

প্রশ্ন : আপনি একসময় বলেছিলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা, রাইনোভাইরাস, অ্যাডোনাভাইরাসসহ আমাদের এখানে অন্য ভাইরাস সক্রিয় থাকার কারণে শীতে করোনার সংক্রমণ কমে, গরমে বাড়ে। এ নিয়ে বিশদ গবেষণা করার কথা ছিল।
ডা. নজরুল ইসলাম : আসলে অর্থাভাবে কাজটা এগোয়নি। মাসখানেক আগে অর্থ ছাড় হয়েছে বলে জেনেছি। কিন্তু এখনো হাতে পাইনি। হাতে পেলেই রি-এজেন্টসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনে কাজ শুরু করে দেব। তবে করোনা সংক্রমণ কম থাকার সময় কাজটা করতে পারলে ভালো হতো।

প্রশ্ন : আগেরবারের তুলনায় এবার সংক্রমণ বাড়লেও হাসপাতালে ভর্তির হার কম। কারণ কী?
ডা. নজরুল ইসলাম : কারণ ওমিক্রনে ক্ষতির মাত্রাটা কম বলে মনে হচ্ছে।

প্রশ্ন : বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারির শেষে শুরু হলো ওমিক্রন। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : অনেকেই অনুমান করছেন। তবে আমি এত তাড়াতাড়ি আশাবাদী হতে পারছি না। কারণ ডেল্টার সিভিয়ারিটি বেশি এবং সংক্রমণ হার কম। ওমিক্রন লেস সিভিয়ার। কিন্তু সংক্রমণ হার অনেক বেশি। ডেল্টার সিভিয়ারিটি এবং ওমিক্রনের সংক্রমণ হার—নতুন কোনো ধরনে এ দুটির সমন্বয় থাকলে এবং তা যদি কোনো ব্যক্তির শরীরে আক্রমণ করে, তাহলে তো মহাবিপদ।

প্রশ্ন : সরকার তো দুই সপ্তাহের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিল। আপনারা কি এ ধরনের কোনো সুপারিশ করেছিলেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : না। এটা সরকার নিজেই করেছে। আমার মনে হয়, অবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করার জন্য এটা করা হয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। এসব নিয়ে কয়েক দিন পর আবার আমাদের বসার কথা রয়েছে।

প্রশ্ন : কিন্তু কারিগরি কমিটির সুপারিশ ছাড়া সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল! মেলা, শপিং মল, রেস্তোরাঁসহ বাকি সবই তো খোলা। এটা কি সাংঘর্ষিক নয়?
ডা. নজরুল ইসলাম : হ্যাঁ। এ নিয়ে খুব কথাবার্তা হচ্ছে। আমাদের আলোচনার মধ্যেও এসেছে। শিশুদের কথাই যদি চিন্তা করি, তাহলে তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা স্কুল। আমরা যদি স্কুল খোলা রাখি, তাহলে বাচ্চারা অন্তত ভালো পরিবেশে থাকতে পারে। স্কুল বন্ধ করে দিলে বাচ্চারা মেলায় যাবে। বেড়াতে যাবে। হোটেল-রেস্তোরাঁয় যাবে। সে ক্ষেত্রে আরো ক্ষতি হবে। ফলে বাচ্চাদের স্কুল খোলা রাখাই ভালো। কারণ স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি ঠিকঠাক রাখার একটা সুযোগ আছে। যেটা মেলায়, শপিং মলে বা রেস্তোরাঁয় নেই। তাই ব্যক্তিগতভাবে আমি স্কুল খোলা রাখার পক্ষে। সেই সঙ্গে দ্রুত শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনাও জরুরি।

প্রশ্ন : সংক্রমণের হার কোন পর্যায়ে গেলে আসলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার দরকার হতে পারে বলে মনে করেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : যখন দেখব শিশুদের সংক্রমণ বেড়ে গেছে, তখনই শুধু এটা চিন্তা করব। যদি দেখি সংক্রমণ ২০ থেকে ২৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে হচ্ছে। শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ নেই বললেই চলে, তাহলে বলব, স্কুল খোলা থাকুক। আরেকটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশের পরিবেশকেও সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করতে হবে। আশপাশের বাদাম, চানাচুর কিংবা ফুচকাওয়ালাদের সামনে যেন ভিড় জমতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।   

প্রশ্ন : এখন পর্যন্ত শিশুদের আক্রান্তের হার কেমন?
ডা. নজরুল ইসলাম : খুব কম।

প্রশ্ন : টিকাদানের গতি কিছুটা কমে গেছে বলে কি মনে হয়?
ডা. নজরুল ইসলাম : টিকা ব্যবস্থাপনা এখন পর্যন্ত ভালো। টিকা আছে অনেক। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে মনে হয় কিছুটা ঢিলেমি আছে। আজকে এক জায়গায় গিয়ে দেখলাম দুপুর ২টা পর্যন্ত টিকা দেওয়ার কথা। কিন্তু দেড়টার আগেই টিকা দেওয়ার বুথ বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকটায় কর্তৃপক্ষের নজর দিতে হবে। যথেষ্ট টিকা এসেছে। কিন্তু সময়মতো দিতে না পারলে সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাবে। ফলে টিকা প্রয়োগের ব্যাপারে আরো মনোযোগ দিতে হবে।

প্রশ্ন : আগেও বলেছিলেন, আপনি লকডাউনের বিরোধী। দেশে সামনে লকডাউন দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে তখন কী হবে?
ডা. নজরুল ইসলাম : আমি এখনো লকডাউনের বিরোধী। আমাদের এখানে যা হয় সেটা কিন্তু লকডাউন নয়। লকডাউন কথাটা আমরা বুঝি না। লকডাউন বলতে কী বোঝায় সেটা সরকারের পরিষ্কার করা উচিত। লকডাউনে গত বছর যে জিনিসটা হয়েছে সেটা ইউজলেস। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। দিন আনে দিন খাওয়া মানুষ না খেয়ে থাকে। রিকশাওয়ালার পিঠে বাড়ি পড়ে। এ ছাড়া লকডাউনে অন্য কোনো কাজ হয় না। যে লকডাউন গতবার হয়েছে এমন লকডাউন যেন আর না হয়।

প্রশ্ন : কিন্তু সংক্রমণের হার বাড়লেও স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদাসীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
ডা. নজরুল ইসলাম : মানুষকে সচেতন করাটা বিরাট চ্যালেঞ্জের কাজ। সরকার, বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমসহ সবাই সচেতন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু অনেকে সচেতনভাবেই উদাসীন। উপেক্ষা করে। কিন্তু এটা উপেক্ষার জিনিস নয়। খুব সিরিয়াসলি নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ভ্যাকসিন নিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই আমরা করোনা জয় করতে পারব।

প্রশ্ন : করোনার মুখে খাওয়ার ওষুধ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে?
ডা. নজরুল ইসলাম : এ সম্পর্কে আমি মন্তব্য করতে রাজি নই।

প্রশ্ন : বুস্টার ডোজ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। ধরুন, আগে কেউ মডার্নার টিকা নিয়েছেন। বুস্টার ডোজে তাঁকে যদি সিনোফার্ম বা অন্য কোনো কম্পানির টিকা দেওয়া হয় তাতে কি চিন্তার কারণ আছে?
ডা. নজরুল ইসলাম : না। এতে কোনো অসুবিধা নেই।

প্রশ্ন : এই মুহূর্তে নীতিনির্ধারকদের করণীয় কী?
ডা. নজরুল ইসলাম : তড়িঘড়ি নয়, খুব বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

প্রশ্ন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ডা. নজরুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।


সৌজন্যে: দৈনিক কালের কণ্ঠ।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ