আজকের শিরোনাম :

‘মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিদিন কেঁদেছি’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২২, ১১:২০

লুবনা মরিয়ম
লুবনা মরিয়ম। একজন নৃত্য গবেষক ও নৃত্যশিল্পী। ‘সাধনা’ (আ সেন্টার ফর দ্যা অ্যাডভান্সড অব সাউথ এশিয়ান কালচার) নামের একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তিনি।  মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী ক্যাম্পে শরণার্থীদের সেবা শুশ্রুষার কাজে সহায়তা করতেন। শরণার্থী ক্যাম্পের এতিম শিশুদেরও দেখাশোনা করতেন। 'মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা'র সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পেও। সম্প্রতি ওই সময়ের স্মৃতি, কর্মকাণ্ড ও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের মুখোমুখি হন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তাসলিমা তামান্না। সাক্ষাৎকারটি এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন? সেই সময়ের কথা...

লুবনা মরিয়ম : ঢাকাতেই ছিলাম পরিবারের সঙ্গে। যুদ্ধ তো হঠাৎ করে শুরু হয়নি। অনেকদিন ধরেই আন্দোলন হচ্ছিল। আমরা আন্দোলন করছিলাম অধিকার আদায়ের জন্য। হলফ করে বলতে পারি, ৯৯ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানি কখনও ভাবেনি স্বাধীন একটা দেশের জন্য যুদ্ধ করতে হবে। এমনকী ৭ মার্চ ভাষনের পরও আমাদের মনে হচ্ছিল সেটা কোনো আলাপ আলোচনার পূর্ব শর্ত। কিন্তু ২৫ মার্চের পর আমরা বুঝতে পারলাম, বর্বর একটা দেশের আর থাকা যায় না। একাত্তর আমার কাছে কোনো স্মৃতি নয়। যখনই একাত্তর নিয়ে কথা বলি মনে হয়, গতকালের ঘটনা। একাত্তর আমার কাছে একটা ট্রমা। কম বয়সের যদি কোনো ট্রমা হয়, সেটা সবসময় বর্তমান হয়ে থাকে।

প্রশ্ন : আপনার বাবা বীর উত্তম লে. ক. কাজী নূরুজ্জামান যখন যুদ্ধে যান তখন কোথায় ছিলেন?

লুবনা মরিয়ম : মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ১৭, বড় বোন নায়লার ১৮, আর ভাইয়ের ১৫ বছর। ওই বয়সে আমরা আসলে কী করব সেটা আমাদের বাবা-মাই নির্ধারণ করতেন। বাবা যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন আত্মীয়স্বজন আমাদের রাখতে চাইল না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাবার নাম ঘোষণা করার পর তারা সবাই ভয় পেলেন। আমাদের অজপাড়াগাঁয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। জুনে ওয়াহিদ ভাই আমাদের টাঙ্গাইলের একটা গ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে এলেন। বাবা তখন বহরামপুরের লালগোলা মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে ছিলেন। আমাদের জন্য আগরতলায় এসে বাবা অপেক্ষা করছিলেন। পরে তার সঙ্গে আমরা মালদহ যাই। সেখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।

প্রশ্ন : সেখানে গিয়ে কী করলেন?

লুবনা মরিয়ম : আমার মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সুলতানা জামান বসে থাকার মানুষ ছিলেন না। তিনি তৃণমূল কর্মী ছিলেন। ওই সময় নদীয়ার কল্যাণীতে সবচেয়ে বড় উদ্বাস্ত্ত শিবির ছিল। ভারতীয় লেখক মৈত্রেয়ী দেবীর সংস্থা সেই উদ্বাস্তু শিবিরে কাজ করছিল। হাজার হাজার মানুষ ছিল সেখানে। অনেকেই অসুস্থ হচ্ছিলেন। তাদের ভ্যাকসিন দেওয়া, ডাক্তার নিয়ে আসা চলছিল। তখন মা বললেন, ঠিক আছে আমিও আমার দুই মেয়েকে নিয়ে কল্যাণীতে কাজ করব। পরে সেফ দ্য চিলড্রেনের আরেকটা ছোট হাসপাতালেও আমরা কাজ করতে লাগলাম। যখন ড. সানজীদা খাতুন শুনলেন আমরা কল্যাণীতে আছি, তখন তিনি গান গাওয়ার জন্য নায়লাকে (বড় বোন) ডাকতেন। যখনই কোনো বড় অনুষ্ঠান থাকত নায়লা বাসে করে কলকাতা চলে যেত। এছাড়া মৈত্রেয়ী মাসি 'কল্যাণী'র অনাথ শিশুদের নিয়ে 'খেলাঘর' নামে একটা আশ্রম করলেন । আমরা ওখানেও কাজ শুরু করলাম। অনাথ শিশুদের দেখাশোনা করা, পড়াশোনা করানো সব কিছুই করতাম।

লুবনা মরিয়ম

প্রশ্ন : মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থায় যুক্ত হলেন কীভাবে?

লুবনা মরিয়ম : যুদ্ধকালীন মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা'র শিল্পীরা ট্রাক নিয়ে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে গান করতেন। সংগঠনটি কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই গিয়ে গান করে সবাইকে উৎসাহ, উদ্দীপনা জোগাতে। জুন-জুলাইয়ের কোনো এক সময় ট্রাকটা কল্যাণীতে আসে। তখন নায়লা বলল, তারা বহরমপুরের লালগোলায় একটা মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে যাচ্ছে। লালগোলা ছিল বাবার সেক্টর। বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি অনেকদিন, তাই সেদিন ট্রাকে উঠে গেলাম। কল্যাণী থেকে বহরমপুর গেলাম ট্রেনে। বহরামপুরের আশেপাশে যেসব শরণার্থী ক্যাম্প ছিল সেখানে গেলাম 'শিল্পী সংস্থা'র সঙ্গে। তারপর সোজা গেলাম লালগোলা মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে। এটা পাঁচদিনের ব্যাপার ছিল। তবে রাতে আমরা কখনও ট্রাকে থাকিনি। গেস্টহাউস বুকিং করা ছিল। সেখানে থেকেছি। মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থায় আমি ছিলাম না। যেহেতু আমি গান জানি না, তাই চুপ করে থাকতাম। তবে তাদের গানে সবাই উদ্ধুদ্ধ হতো এটা দেখে ভালো লাগত।

প্রশ্ন : যুদ্ধের সময়ের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা...

লুবনা মরিয়ম : যুদ্ধকালীন ট্রমা এই পর্যায়ের ছিল যে, স্বাধীনতার পর  বাবা বলতেন টেবিলে বসে একাত্তরের ঘটনা আলাপ হবে না। কারণ তার তিন ছেলেমেয়ে গভীরভাবে শোকাহত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিদিন কেঁদেছি। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের সেবা, অন্যদিকে ঢাকা থেকে খবর আসছে রুমীকে ধরে নিয়ে গেছে। আশফাকুল সামাদ মারা গেছে- এরকম দৈনিক খবর আসত।

আমার ভাই নাদিমের বয়স তখন ১৫ বছর। সে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গ্রেনেট ছুড়ছে, রাইফেল চালাচ্ছে। পড়ুয়া বাচ্চা ছেলে একটা । সে হঠাৎ করে যুদ্ধ করছে আর আমরা এত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম অথচ যুদ্ধ করতে পারছি না।  আমাদের একটু ঈর্ষাই হতো। ওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম কেমন লাগে? নিশ্চয়ই খুব রোমাঞ্চকর? নাদিম উত্তর দিয়েছিল ভয় লাগে।

দেশ স্বাধীন হলে কী হবে, আমাদের কত বন্ধুবান্ধব চলে গেল আমাদের চোখের সামনে। ১৪ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দায় যে যুদ্ধ হলো তাতে সাব সেক্টরের কমান্ডার মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ভাইসহ ৪০ জন নিহত হন। শহীদদের মধ্যে শুধু জাহাঙ্গীর ভাইকে সোনা মসজিদে দাফন করা হয়েছিল। তাকে বীরশ্রেষ্ঠ মর্যদা দেওয়া হয়েছে। বাকি ৩৯ জন সৈনিকের নাম কেউ জানে না। তাদের কোথায় দাফন করা হয়েছে তাও জানে না। এমনই অভাগা দেশ আমাদের।

প্রশ্ন : যে প্রত্যয় নিয়ে একাত্তরের যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, তা কতটা পূর্ণ হয়েছে বলে মনে করেন?

লুবনা মরিয়ম : আমরা যুদ্ধ করে একটা দেশ পেয়েছি, এই গর্ব বোধটা নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে এই দেশ। আমরা যে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছি সেই গর্ববোধ তাদের মধ্যে নেই। অথচ নাদিমের মতো সাধারণ ছেলেরা নয় মাস ধরে যুদ্ধ করেছে। এই প্রজন্ম পোস্ট আইডোলজিক্যাল। তাদের মধ্যে জানার চেষ্টা নেই। প্রশ্ন করার প্রবণতা নেই।

তবে আমি নৈরাশ্যবাদী নই, আশাবাদী। আমি মনে করি, যে যেখানেই কাজ করুক তাতে যদি সততা আর আন্তরিকতা থাকে নিশ্চয়ই দেশের উন্নতি হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে যারা রাজনীতি করেন তারা সবটাকে গুলিয়ে ফেলেন।

প্রশ্ন : দেশ গড়তে বর্তমান প্রজন্মর উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী?

লুবনা মরিয়ম : এই প্রজন্মের কাছ থেকে আমি নিজেই অনেক কিছু শিখেছি। আমরা একটা যুগে বসবাস করেছি। আমরা মুসলমান না বাঙালি তা নিয়ে বিভক্তি ছিল। কিন্তু বতর্মান প্রজন্মের মধ্যে এই দ্বিধা নেই। সবাই বাঙালি। এই প্রজন্ম লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে। এই প্রজন্মের মধ্যে গভীরভাবে দেশকে চেনার চেষ্টা দেখি। এটা আমার মেয়ের (আনুশেহ আনাদিল) কাছে শিখেছি। নিশ্চয়ই প্রত্যেকটা প্রজন্ম এগোতে থাকবে। তবে পোস্ট আইডেলজিক্যাল বা নিজের স্বার্থ দেখা এখন বৈশ্বিক সমস্যা। সেটা উতরে যদি  নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা যায় তাহলে দেশ নিঃসন্দেহে এগিয়ে যাবে।

 

সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ