কোনদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত

  আলাউদ্দিন মল্লিক

২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৩:০৮ | অনলাইন সংস্করণ

আলাউদ্দিন মল্লিক
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যে কোনো নতুন সামরিক আগ্রাসনের জন্য মস্কোকে চড়া মূল্য দিতে হবে বলে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো।  ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার বিপুল সৈন্য (প্রায় এক লক্ষ) সমাবেশের সম্ভাব্য উদ্দেশ্য নিয়ে পশ্চিমা সামরিক জোটটি কঠিন সতর্কবার্তা  দেয় বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।  প্রতিক্রিয়ায় রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ও পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ন্যাটো যদি মস্কোতে কয়েক মিনিটের মধ্যে আঘাত হানতে সক্ষম এমন ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেইনে বসায় তাহলে রাশিয়াও পাল্টা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।

রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখল 
ইউরোপের কৃষ্ণ সাগরের উত্তরে ক্রিমিয়া উপদ্বীপটি ২০১৪ সালের ফেব্রূয়ারি  থেকে মার্চ মাসের মধ্যে রুশ ফেডারেশন দ্বারা অন্তর্ভূত হয় এবং তখন থেকে এটি দুটি রুশ ফেডারেল বিষয় হিসাবে পরিচালিত হয় - ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্র এবং সেভাস্তোপোলের যুক্তরাষ্ট্রীয় শহর। ২০১৪ সালের ২২-২৩ ফেব্রুয়ারি , রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন সুরক্ষার পরিষেবা প্রধানদের সাথে সারারাত বৈঠক করেন পদচ্যুত ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের মুক্তির বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। বৈঠক শেষে পুতিন মন্তব্য করেছিলেন যে "আমাদের অবশ্যই ক্রিমিয়াকে রাশিয়ায় ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করতে হবে"। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ক্রিমিয়ার শহর সেভাস্তোপলে রুশপন্থী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি, ইনকিনিয়া ছাড়াই মুখোশধারী রুশ সেনাবাহিনী ক্রিমিয়ার সুপ্রিম কাউন্সিল (সংসদ) দখল করে এবং ক্রিমিয়া জুড়ে কৌশলগত স্থানগুলি দখল করে নেয়, যার ফলে ক্রিমিয়ার রুশপন্থী আকসিয়ানোভ সরকার প্রতিষ্ঠা হয়।  এই সরকার ক্রিমিয়ার গণভোট পরিচালনা এবং ক্রিমিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয় ১৬ মার্চ ২০১৪ সালে। রাশিয়া ক্রিমিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ ফেডারেশনের দুটি ফেডারেল বিষয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে ১৮ ই মার্চ ২০১৪ সালে।

উত্তেজনার নেপথ্যে
উত্তরাধিকার সূত্রে  ইউক্রেন ক্রমান্বয়ে জার রাশিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত রাশিয়ান ফেডারেশনের  প্রেসিডেন্ট ইয়েলিৎসিন ১৯৯১ সালে তৎকালীন কমিউনিস্ট সোভিয়েত নের্তৃত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সময় ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। দেশটির এই ঘোষণা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে একটি বড় ভূমিকা রাখে। স্বাধীন ইউক্রেন ক্রমেই তার রাশিয়ান সাম্রাজ্যিক উত্তরাধিকার ত্যাগ করে মস্কোর বদলে পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে। ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের ছিলেন রুশপন্থী।  তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি প্রত্যাখ্যান করলে দেশজুড়ে শুরু হওয়া গণবিক্ষোভের জেরে ২০১৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন। নতুন নেতৃত্ব ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে তাদের ভবিষ্যৎ তৈরী করতে কাজ করতে থাকলে  ক্রিমিয়া উপত্যকা দখল করে নেয় রাশিয়া। এছাড়া দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করে মস্কো।

ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যস্থতায় ২০১৫ সালের একটি শান্তি চুক্তি বড় ধরনের যুদ্ধ অবসানে সাহায্য করেছিল। কিন্তু একটি রাজনৈতিক সমাধানে উপনীত হওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ২০২১ সালের গোড়ার দিকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের মাত্রা বেড়ে যায়। অন্যদিকে সীমান্তে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো হয়। তৈরি হয় যুদ্ধংদেহী অবস্থা। সীমান্তে নতুন করে রুশ সেনা সমাবেশের কারণে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। 

সংঘাত এড়ানো
রাশিয়ার সম্ভাব্য ইউক্রেন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ন্যাটোর মিত্ররা প্রস্তুত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইউক্রেন আর তাইওয়ানের গুরুত্ব সমান নয়।  যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও সঙ্গীরা চীনের দক্ষিণ চীন সাগরে যেকোনো আগ্রাসন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রস্তুত। এর মানে এই নয় যে ইউক্রেনে যা কিছু তাই করার অধিকার পেয়ে গেছে রাশিয়া। বিশ্বব্যবস্থায় একটা নীতি আছে। কোনো দেশের আরেক দেশে আগ্রাসন চালানোর অনুমতি নেই, জোর করে সীমানা বদলেরও সুযোগ নেই। ন্যায্যতার প্রশ্নের চেয়েও বড় এই নীতি। এর আলোকে ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করা এবং রাশিয়ার ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের যেতে পারে। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে তেল নির্ভর রাশিয়ার ভঙ্গুর অর্থনীতির ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।

পুতিন  ইউক্রেনকে বৃহত্তর রাশিয়ার  অংশ বলে মনে করেন।  সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া শতাব্দীর প্রধান ভূরাজনৈতিক বিপর্যয় হিসেবে তিনি বিশ্বাস করেন এবং ইউক্রেনকে সংযুক্ত করে  সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকার আংশিক হলেও ফিরিয়ে আনাতে তিনি বদ্ধপরিকর। গত শতকের নব্বইর দশকের শুরুতে সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পতনের পর অতল খাদে পতিত রাশিযা এবং তার জনগন আজ বিশ্বের দরবারে যে নতুন মর্যাদার স্থানটি পেয়েছে - তার একক অবদানটি পুতিনের।  মুদ্রাস্ফিতি, বেকারত্ব আর চূড়ান্ত হতাশার মধ্য থেকে দেশটিকে বের করে আনার পর তার এই উচ্চাকাংখা পূরণের অভিলাষ হতেই পারে। 

আশা করা যায়, হামলা করলে কঠোর মূল্য চোকানোর হুমকি এবং মুখ রক্ষার জন্য কিছু ছাড় দেওয়ার—এই নীতি পুতিনকে তাঁর সৃষ্ট সংকট থেকে সরিয়ে নিয়ে আসবে। যদি তাতে কাজ না হয়, তাহলে প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যকার গ্যাস পাইপলাইনসহ রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। ন্যাটোকে আরও শক্তিশালী করা এবং ইউক্রেনকে অতিরিক্ত অস্ত্র, পরামর্শ ও বুদ্ধি জোগানোর এটাই সময়।

ইউরোপের নতুন সমীকরণ
শুক্রবার (১৭.১২.২০২১)   ‘সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের'  জন্য  রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর কাছে পূর্ব ইউরোপ ছাড়ার চরমপত্র সহ নিরাপত্তা সংক্রান্ত বেশকিছু দাবি জানিয়েছে ।  তবে রাশিয়ার দাবি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো মেনে নেবে, এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আলোচনা শেষ হওয়ার আগেই দাবি প্রকাশকে আন্তর্জাতিক কূটনীতির একটি অস্বাভাবিক পদক্ষেপ হিসাবে দেখা হচ্ছে।

রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ সাংবাদিকদের বলেছেন, "রাশিয়া ও পশ্চিমাদের সম্পর্ক পুনর্গঠনে নতুন করে কাজ শুরু করতে হবে।" তিনি যোগ করেন, ‘‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে পদ্ধতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আক্রমণাত্মক করে তুলেছে, তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক। ওয়াশিংটন এবং তার ন্যাটো মিত্রদের অবিলম্বে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে৷  অনির্ধারিত মহড়া, সামরিক জাহাজ ও বিমান চলাচল এবং ইউক্রেনের ভূখণ্ডে সামরিকায়ন বন্ধ করতে হবে৷''  রাশিয়া  সবসময় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে আগ্রহী উল্লেখ করে আলোচনার স্থান হিসাবে জেনেভার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন স্পষ্ট করে বলেছেন তিনি কখনো ইউক্রেনকে “রুশ বিরোধী” হতে দেবেন না এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য পদ দেবার ন্যাটোর অভিপ্রায়কে রাশিয়া স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ন্যাটো একটি “রেডলাইন” অতিক্রম করেছে।  ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে ইউক্রেন নিজেকে ক্রমাগত হুমকির মধ্যে বলে মনে করে। বিশ্লেষকদের মতে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন ও ক্রিমিয়া দখলে নেবার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক দ্বন্দ্বমূলক অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশেষকরে শীতল যুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা ঝুঁকি ও সংকটের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকগণ।

রাশিয়ার অস্ত্র ব্যবসা

১. বিমান এবং বিমান প্রতিরক্ষা

রাশিয়ার ঐতিহ্যবাহী সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি শক্তি বিমান এবং বিমান প্রতিরক্ষায় রয়েছে সিস্টেম রাশিয়া বিস্তৃত ফাইটার/গ্রাউন্ড অ্যাটাক এয়ারক্রাফট (FGA) রপ্তানি করে; আক্রমণ এবং পরিবহন হেলিকপ্টার; এবং স্বল্প-মাঝারি- এবং দীর্ঘ-পাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। উপরন্তু, বিভিন্ন বিমান এবং হেলিকপ্টার ইঞ্জিন, পাশাপাশি একাধিক ধরণের এয়ার-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্রগুলি আকর্ষণীয় থাকে গ্রাহকদের এই সিস্টেমগুলির মধ্যে অনেকগুলিই লিগ্যাসি সিস্টেমের আপগ্রেডেড সংস্করণ, তবে এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে রাশিয়ার উৎপাদিত সবচেয়ে উন্নত অস্ত্র।

২.ফাইটার/গ্রাউন্ড অ্যাটাক এয়ারক্রাফট
রাশিয়ার সর্বাধিক বিক্রিত দুটি রপ্তানি হল সোভিয়েত যুগের মিগ-29 এবং সু-27 এফজিএ।  রাশিয়ার সবচেয়ে উন্নত এফজিএ হল Su-35S। চতুর্থ প্রজন্মের মাল্টি-রোল ফাইটার হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।  রাশিয়া MiG-35 তৈরি করছে, একটি চতুর্থ প্রজন্মের ফাইটার। এছাড়াও, রাশিয়া দুটি নতুন পঞ্চম-প্রজন্মের ফাইটার বাজারজাত করছে।

৩. হেলিকপ্টার
রোসোবরন রপ্তানি অনুসারে, রাশিয়া গত ১০ বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের হেলিকপ্টার রপ্তানি করেছে। রাশিয়ান মডেল, যেমন Mi-8/17, বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত হেলিকপ্টারগুলির মধ্যে কয়েকটি। অনেক নতুন ডিজাইন হল লিগ্যাসি ডিজাইনের আধুনিক সংস্করণ। রাশিয়া রপ্তানির জন্য Ka-52 রিকনেসান্স/আক্রমণ, Mi-28NE আক্রমণ, Mi-35M পরিবহন/আক্রমণ, Mi-171Sh এবং Mi-17-V5 পরিবহন, Ka-226T লাইট ইউটিলিটি, এবং Mi-26T2 ভারী পরিবহন হেলিকপ্টার বাজারজাত করে।

৪. এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম
বিমানের পরে, বিমান প্রতিরক্ষা সিস্টেমগুলি রাশিয়ার সর্বাধিক রপ্তানি করা সিস্টেম। রাশিয়ার দীর্ঘ-, মাঝারি- এবং স্বল্প-পরিসরের সিস্টেম রয়েছে, যা মূলত আলমাজ-আন্তে (একটি কোম্পানি) দ্বারা উত্পাদিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সাপেক্ষে)। বেশিরভাগ বিশ্লেষক রাশিয়ান বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কার্যকর এবং উচ্চ মানের বলে মনে করেন। 87 রাশিয়ার দূরপাল্লার সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে S-300PMU1/2, S-400, Antey-2500, এবং Antey-4000 এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম।  রাশিয়া তার সর্বশেষ ডিজাইন, S-500 রপ্তানির জন্য বিপণন করছে, যেটির পরীক্ষা চলছে। মাঝারি পরিসরের জন্য, রাশিয়া Buk-M2E এবং Buk-M3, 9K317ME ভাইকিং-এর একটি রপ্তানি সংস্করণ রপ্তানি করে। রাশিয়া প্যান্টসির-S1/M এবং Tor-M2E.92 সহ একাধিক স্বল্প-পরিসর বা পয়েন্ট-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও রপ্তানি করে।

৫. সাঁজোয়া যান
রাশিয়া বিস্তৃত ট্যাঙ্ক, IFV, সাঁজোয়া কর্মী বাহক (APCs) এবং অন্যান্য সাঁজোয়া যান রপ্তানি করে। এর সবচেয়ে জনপ্রিয় ডিজাইনগুলির মধ্যে একটি হল T-72 প্রধান যুদ্ধ ট্যাঙ্ক (MBT) এর একটি আধুনিক সংস্করণ। রাশিয়া রপ্তানির জন্য তার সর্বশেষ ট্যাঙ্ক, T-90 S/MS অফার করে। IFV-এর জন্য, রাশিয়া বিদ্যমান ডিজাইনের নতুন এবং আধুনিক সংস্করণ বাজারজাত করে, যেমন BMP-2M, BMPT-72, এবং BMP-3/3F। APC-এর জন্য, রাশিয়া বহুদিনের BTR-80 এবং আপগ্রেড করা BTR-82A, একাধিক নতুন সাঁজোয়া যান, যেমন Tigr এবং Typhoon গাড়ির অফার করে। রাশিয়া তার পরবর্তী প্রজন্মের সর্বজনীন যুদ্ধের প্ল্যাটফর্ম, আরমাটা তৈরি করছে। আরমাটার মডুলার নির্মাণ সহজতর উত্পাদন এবং রক্ষণাবেক্ষণ সক্ষম করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। আরমাটা সিরিজের মধ্যে রয়েছে T-14 MBT, T-15 IFV, 2S35 Koalitsia-SV স্ব-চালিত আর্টিলারি, VPK-7829 Bumerang, এবং Kurganets-25 IFV/APC।

৬. নেভাল সিস্টেম
রাশিয়া ফ্রিগেট, কর্ভেট, সাবমেরিন এবং উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সহ বিভিন্ন ধরনের নৌ ব্যবস্থা রপ্তানি করে।98 এটি উন্নত সেন্সর এবং রাডার, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, জাহাজ-বিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র এবং উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও রপ্তানি করে। রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে সাবমেরিন তৈরি ও নির্মাণ করেছে।  রাশিয়ার সবচেয়ে বিপণিত নৌ রপ্তানির একটি হল প্রজেক্ট 636 বর্ষাভ্যঙ্কা ডিজেল-ইলেকট্রিক অ্যাটাক সাবমেরিন।

পুতিনের সুপার উইপন
২০১৮ সালে পুতিনের বক্তৃতায় RS-28 Sarmat আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ICBM) (NATO রিপোর্টিং নাম SS-X-29 বা SS-X-30) অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেন। অ্যাভানগার্ড  মিসাইল সিস্টেম পুরানো এবং নতুনকে একত্রিত করে: একটি সোভিয়েত-যুগের RS18A (SS-19 ‘Stiletto’) ICBM  এবং নতুনটি Yu-71 HGV । ২০০২ সালে অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল (ABM) চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সরিয়ে নিলে সোভিয়েত যুগের অ্যালবাট্রস গবেষণা প্রকল্পের পুরুজ্জীবন ঘটিয়ে  অ্যাভানগার্ড সিস্টেমের উদ্ভব ঘটে ২০১৫-১৬ সময়কালে। পসেইডন পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত মনুষ্যবিহীন আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল (UUV) । ২০১৮ সালে সিস্টেমটির নাম পরিবর্তন করে পোসেইডন হিসাবে নামকরণ করার করা হয়।  পুতিনের মতে, পসেইডন হল একটি বহুমুখী UUV যা 'প্রচলিত বা পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে পারে, যা তাদেরকে বিমান গ্রুপ, উপকূলীয় দুর্গ এবং অবকাঠামো সহ বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম।  

২০১৮ সালে পুতিন বুরেভেস্টনিক( 9M730 Burevestnik;SSC-X-9 'Skyfall') স্থল থেকে উৎক্ষেপণ করা, পারমাণবিক শক্তি চালিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র সম্পর্কে  বলেছিলেন যে বুরেভেস্টনিকের অভিনবত্ব এবং অপারেশনাল ইউটিলিটি তার সীমাহীন পরিসরে রয়েছে, যা ক্ষেপণাস্ত্রটিকে যে কোনও প্রতিপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়াতে সক্ষম করবে। 9-S-7760 কিনজল  বায়ুচালিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ALBM) হল একমাত্র উপ-কৌশলগত ব্যবস্থা।  সির্কন (3M22 Tsirkon; SS-N-33) জাহাজ থেকে উৎক্ষেপণ করা হাইপারসনিক অ্যান্টি-শিপ ক্ষেপণাস্ত্রে।

যুক্তরাষ্ট্রের অসহায়ত্ব 
বিগত বৎসরগুলোতে রাশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রেতা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। নতুন প্রজন্মের কৌশলগত অস্ত্রগুলো এস আর -৪০০(SR-400), ভরসাভিয়াঙ্কা (Varshavyanka)  ডিজেল-ইলেকট্রিক অ্যাটাক সাবমেরিন, T-72  যুদ্ধ ট্যাঙ্ক (MBT), T-14 MBT, T-15 IFV, 2S35 Koalitsia-SV স্ব-চালিত আর্টিলারি, দূরপাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম (S-300PMU1/2, S-400, Antey-2500, এবং Antey-4000 ), Mi-8/17 হেলিকপ্টার, মিগ-29 এবং সু-27 এফজিএ যুদ্ধবিমান, ফাইটার/গ্রাউন্ড অ্যাটাক এয়ারক্রাফট (FGA)  ব্যবস্থা এখন সবচেয়ে বেশি বিক্রিত যুদ্ধ সামগ্রী।  

অর্থনীতিতে বিগত বৎসরগুলোতে চীনের কাছে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র।  জাপানি আর চীনা ঋণের উপর এখন মার্কিন অর্থনীতি টিকে আছে।  প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে গত শতকের শেষ দশকে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে টেক্কা দিতে পারলেও এখন তার ভারকেন্দ্র এ দেশের হাতে নেই।  ইন্টারনেটের ফাইভ-জি এখন চীনের নেতৃত্বে অগ্রসর হচ্ছে।  

এমনকি যে গণতন্ত্রের নামে সারা পৃথিবীর উপরে ছড়ি ঘোরানোর মার্কিন কৌশল আর কর্যকরী হচ্ছে না।  সর্বশেষ ডেমোক্রেসি সামিট ২০২১ যা কয়েকদিন আগে (৯-১০ ডিসেম্বর ২০২১) ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হল তা নিয়ে শুরু হতে আজ পর্যন্ত কম কাঁদা ছোড়াছুড়ি হয়নি।  এই সমাবেশটি গণতান্ত্রিক দেশগুলির নেতা হিসাবে বিশ্ব মঞ্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে পুনরুদ্ধার করার একটি প্রচেষ্টার হিসেবেই বিজ্ঞজনেরা দেখছেন। চীন এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ইউরোপ, ভারত এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবাদ হয়েছে - মার্কিন গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে। মার্কিন গণতন্ত্রের আশু সংস্কার সময়ের দাবি হিসেবে উঠে এসেছে বিভিন্ন আলোচনায়।  আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর পরাজয় তাদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে।  বিশ্বে মার্কিন মোড়লীপনার শেষ হিসেবেই বিজ্ঞজনেরা ঘটনাটিকে দেখছেন।  

পরিশেষে  
মার্কিন সাহায্য যে ইউক্রেনকে রাশিয়ার আগ্রাসন হতে রক্ষা করতে পারবে না - ইটা খুবই পরিষ্কার।  ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা একটি কার্যকরী পদক্ষেপ বিবেচিত হতে পারে।  তবে আমাদের বিবেচনায়, এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা ন্যাটো যত বেশি জড়িত হবে তত ইউক্রেনের স্বাধীন থাকার সম্ভাবনা কমবে। তাদের সক্রিয় সামরিক ভূমিকা হয়ত রাশিয়ার আগ্রাসন কিছু সময়ের জন্য পিছিয়ে দেবে; তবে শেষ পর্যন্ত রাশিয়াই বিজয়ী হবে।  আর যদি  ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অর্থনৌতিক  নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ইউক্রেনকে তার ব্যাপক জনগণকে সম্পৃক্ত করে নিজেদের অর্থনীতিকে শক্ত করার জন্য সহযোগিতা করে যায়, তাহলে ইউক্রেন তার স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারবে।  অন্যথায়, অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ পরাজয় হওয়ার সাথে সাথে ইউক্রেন তার স্বাধীনতা হবে - যেমনটি পরাক্রশালী সোভিএট্ ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল এমনকি কোনো কোনো দেশের সীমানা বদলে গিয়েছিল। 

 

লেখক: প্রধান সমন্বয়ক, আমরা ৯৯ শতাংশ (আপহোল্ড ৯৯)।

এই বিভাগের আরো সংবাদ