আজকের শিরোনাম :

‘পরিবেশের ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাব সবচেয়ে প্রকট’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০১৮, ১৩:০৫

ঢাকা, ০৬ জুন, এবিনিউজ : নিয়মনীতির পরোয়া না করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাহাড় কাটা হচ্ছে। এ সংক্রান্ত আইন থাকলেও তা কার্যকর না হওয়ায় বেপরোয়া এক শ্রেণির মানুষ। এতে ভারসাম্যা হারিয়ে ফেলছে জীববৈচিত্র্য। প্রতিবছর পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। তার পরও থামছে না পাহাড় কাটা। মঙ্গলবার বিশ্ব পরিবেশ দিবসে পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশের ক্ষতি ও এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে একটি জনপ্রিয় দৈনিকের অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

প্রশ্ন : দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা কারণে প্রায়ই কাটা হয় পাহাড়। এগুলো বন্ধে প্রশাসন থেকে মাঝেমধ্যে উদ্যোগও নেওয়া হয়। কিছুদিন পর তা থেমেও যায়। পাহাড় কাটার ফলে কী ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় হচ্ছে?

রিজওয়ানা হাসান : পবিত্র কোরআন শরিফে লেখা আছে, আমি পৃথিবীতে সুউচ্চ পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি যাতে পৃথিবী আন্দোলিত না হয়। ভূমিকম্প প্রাথমিক যে ধাক্কাটা দেয় বড় উঁচু পাহাড় এবং টিলাগুলো তা নিতে পারে। সমতল ভূমিতে আসার আগে ভূমিকম্প ওখানেই প্রতিহত হতে পারে। পাহাড় কাটার ফলে ভূমিকম্পের ঝুঁকিটা বেড়ে যায়। দেশের বেশিরভাগ পাহাড়ই একসময় সবুজে আচ্ছাদিত ছিল। গাছপালায় ভর্তি ছিল। এই কারণে পাহাড়ের মাটিগুলো আশেপাশের ঝর্ণা কিংবা নদীতে যেতে পারত না। গাছপালা থাকার কারণে পাহাড়ে ঝর্ণা থাকত। পার্বত্য চট্টগ্রামের যে পাহাড়গুলো আদিবাসীরা ব্যবস্থাপনা করে সেগুলোতে এখনও ঝর্ণা আছে। আর যেগুলো সরকারের আওতাধীন সেগুলো হয়তো  ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে অথবা ওখানে সেগুন গাছ লাগানোর কারণে ঝর্ণাগুলো সটকে গেছে। পাহাড়কে ওয়াটার শেড বলা হয়। এখান থেকে যে ঝর্ণা প্রবাহিত হয় সেগুলোতে সবসময় পানি থাকে। যদি ঝর্ণাগুলো শুকিয়ে যায়, তাহলে একটা বিপুল জনগোষ্ঠী যারা পার্বত্য বা পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করে তাদের পানির উৎস কমে যায়। আর পাহাড় যখন ন্যাড়া করে ফেলা হয়, তখন বন উজার হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলও ধ্বংস হয়ে যায়। বন থাকলে পাহাড়ের মাটি ধুয়ে আশপাশের খাল, নদী নালা ও ছড়ায় যেতে পারে না। বনের গাছ শিকড় দিয়ে মাটি আটকে রাখে। পাহাড় কাটার ফলে এসব নষ্ট হয়ে যায়। আবার পরিবেশের যে নান্দনিক দিক রয়েছে পাহাড় কাটার কারণে সেটাও নষ্ট হচ্ছে।

এ ছাড়া পাহাড়কেন্দ্রিক অনেক সভ্যতাও আছে।  'রিও ডিকলারেশন' এবং ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলে’  মাউন্টেন ইকো সিস্টেমের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রতিবেশ ব্যবস্থা হিসেবে। একটা বন একবার ধ্বংস হলে প্রাকৃতিক উপায়ে তা ফিরে আসতে পারে; যেটা আমরা সুন্দরবনের ক্ষেত্রে দেখেছি। কিন্তু একটা পাহাড় একবার কেটে ফেললে তা আর কোনোদিনই সৃষ্টি করা যায় না। এটি এমন একটি ইকো সিস্টেম, যা একবার ধ্বংস হলে চিরদিনের মতোই হয়। 

প্রশ্ন : সামনে বর্ষাকাল। প্রতিবছরই এ সময় পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে। গত বছরও পাহাড় ধসে ১৩৭ জনের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে করণীয় কী? 

রিজওয়ানা হাসান : এ ধরনের ঘটনা নব্বইয়ের দশকেও ছিল না। ২০০৭ সাল থেকে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে। এর কারণ একটাই- নির্দয়ভাবে পাহাড় কাটা। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা পাহাড়কে ধ্বংস করা হচ্ছে। সবুজ আচ্ছাদন কাটা হচ্ছে। এমনিতে আমাদের এখানকার পাহাড় খুব শক্ত নয়। অতি বৃষ্টিতে পাহাড়ের ওপরের মাটি ধুয়ে নিচে চলে যায়। এটা ঘটছে পাহাড় ন্যাড়া করার কারণে। যারা পাহাড় কাটার সঙ্গে যুক্ত তারা গোটা পাহাড় একবারে কাটতে না পারলে একটু একটু করে কেটে নেয়। এতেও পাহাড় ধসের ঝুঁকি তৈরি হয়। আর পুরো পাহাড় কেটে ফেলতে এখন কৌশলে পাহাড়ের মাথা ন্যাড়া করা হচ্ছে, কোনোটা আবার মাঝখান দিয়ে কাটা হচ্ছে। পরে অজুহাত হিসেবে তারা বলেন, ‘মাঝখান দিয়ে পাহাড় কাটা হয়েছিল রাস্তা করতে। কিন্তু তাতে দুই পাশের পাহাড় তো মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এখনই ধসে পড়বে। তাই পুরো পাহাড় কেটে ফেলতে হবে।’

পাহাড়ধসে দুর্ঘটনা রোধে গাছপালায় আবার পাহাড় ভরে ফেলতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিরক্ষা প্রাচীর দিয়ে পাহাড়ের মাটি যাতে নিচে না আসতে পারে সেটার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো অজুহাতে পাহাড়ের আগা, মাথা, মাঝখান কাটা যাবে না। আমাদের খুব অল্পসংখ্যক পাহাড়ই অবশিষ্ট আছে। এখন যেভাবে পাহাড় কাটা হচ্ছে সেভাবে যদি চলতেই থাকে তাহলে ১০ বছর পর পাহাড়ের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। তাই এখন যা আছে সেভাবে রেখে প্রত্যেকটা পাহাড় সংরক্ষিত ঘোষণা করা উচিত। সেই সঙ্গে প্রশাসনের এটাও নিশ্চিত করা উচিত যে, তারা সত্যিই পাহাড় কাটা রোধ করতে চায়। কিন্তু বেশিরভাগ সময় প্রশাসন যখন রোধ করতে যায় তখন অর্ধেক পাহাড় কাটা হয়ে গেছে। প্রশাসনের উচিত স্থানীয় জনগণকে বলে রাখা  কাউকে পাহাড় কাটতে দেখলে তারা যেন হট নম্বরে ফোন করেন এবং তাৎক্ষণিক প্রশাসনের লোকজন যেন তাৎক্ষণিক সেখানে হাজির হন।

প্রশ্ন : আইন থাকলেও বন্ধ হচ্ছে না পাহাড় কাটা। আইনে কি কোথাও দুর্বলতা রয়েছে?

রিজওয়ানা হাসান : দুর্বলতা একটিই; সেটি হলো- আইনটি প্রয়োগ না করা।

প্রশ্ন : পাহাড় কাটা নিয়ে ঠিক কী ধরনের মামলা হয়? এ ধরনের অপরাধে শাস্তি হচ্ছে কতটা?

রিজওয়ানা হাসান : পাহাড় কাটা বন্ধে মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে পাহাড় কাটা যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত কখনও বা  শ্রমিকদের আটক করে জেলে দেওয়া হয়। পরে তারা আবার জামিন নিয়ে বের হয়। কিন্তু যাদের ইশারায় পাহাড় কাটা হচ্ছে তারা আটক হচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে পাহাড় কাটা আটকানো গেছে কয়েকটা জায়গায়। কিন্তু এই অপরাধে শাস্তি হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

প্রশ্ন : রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় দিতে উখিয়া ও টেকনাফে হাজার একর বনভূমি ও পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করা হয়েছে। এটা তো পাহাড় ধ্বংসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

রিজওয়ানা হাসান : ঘটনাটা অনেকটা আকস্মিক। ছয় লাখ লোক দুই মাসে চলে এসেছে। সরকার একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। মানবিক কারণে আমরাও তখন চুপ থেকেছি। কিন্তু তাদের যেভাবে গাছ কাটতে দেওয়া হচ্ছে বা উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং তাদের জন্য বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে না, তাতে এটা আবারও পরিষ্কার হলো যে, পাহাড়গুলো কেটে কেউ যদি মাটি নিতে পারে বা পাহাড়ের জায়গাটা সমতল হলে তাদের লাভ। বনটা উজার হয়ে গেল কী না তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। পাহাড় ও বন রক্ষা যে কারও অগ্রাধিকারের মধ্যেই পড়ে না এটা রোহিঙ্গাদের পাহাড়ে, বনে এনে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণিত হলো। হয়তো এক বা দুই মাসের মধ্যে তাদেরকে নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করা যায়নি । কিন্তু ওদের আসার অনেকদিন হয়ে গেছে। এতদিনে আন্তর্জাতিকভাবে লবিং করে কিছু সরিয়ে ফেলা উচিত ছিল। কিংবা ওদের জন্য বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না করে বনের গাছ কাটতে ওদের সম্মতি দেওয়া হয়েছে। ওদের কারণে আশপাশের মানুষের বাড়িতেও গাছপালা থাকছে না। তাৎক্ষণিক বিপর্যয়ের জন্য সরকারের দোষ নেই। কিন্তু তারপরে সরকার যদি একটু সতর্ক হতো তাহলে ধ্বংসের হাত থেকে অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি রক্ষা করা যেত্।

প্রশ্ন : দেশের কোন অঞ্চলে পাহাড় বেশি ধ্বংস হয়েছে বা হচ্ছে?

রিজওয়ানা হাসান : সিলেটের যেখানে চা বাগান আছে সেখানকার পাহাড় বাদে শহরের পাহাড় ধ্বংস হয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় এখনও পাহাড় আছে। তবে কক্সবাজার সদরের পাহাড় কেটে শেষ করে ফেলা হয়েছে। যেসব  পাহাড়ি এলাকায় শহর হয়েছে যেমন-নরসিংদী, জামালপুর- এসব জায়গার পাহাড় ধ্বংস করা হয়েছে। তবে পাহাড়ি অঞ্চলের যেখানে এখনও নগরায়ন হচ্ছে না শুধু সেখানকার পাহাড়গুলো টিকে আছে।

প্রশ্ন : সরকার কি পাহাড় কাটা বন্ধে যথেষ্ট আন্তরিক বলে আপনার মনে হয়?

রিজওয়ানা হাসান : সরকার পরিবেশ রোধের কোনো বিষয়ে গত পাঁচ-ছয় বছরে আন্তরিকতা দেখাচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।

প্রশ্ন : এই সংকট থেকে উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী?

রিজওয়ানা হাসান : দেশের সার্বিক শাসনচিত্র থেকে পরিবেশ আলাদা করা যাবে না। যেখানে কোনো ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা নেই, সেখানে পরিবেশের মতো একটা সেক্টর, যেখানে অর্থ ও সম্পদের ব্যাপার আছে সেখানে তো এটা আরও আশা করা যায় না। জবাদিহিতা না থাকায় সবচেয়ে সুবিধা ভোগ করে একট স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। তারা এখন পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান যেমন, নদী পাহাড় বন লুটেপুটে খাচ্ছে। সেগুলো তারা বৈধকরণও করছে। সরকার শুধু এসব কর্মকাণ্ডই বৈধ করছে না বরং নিজেরাও বিভিন্ন বন এলাকার মধ্য দিয়ে রাস্তা করার অনুমতি দিচ্ছে। বৈধ না হলেও বিভিন্ন জায়গায় গ্যাসের পাইপলাইন, নৌবন্দর নির্মাণের অনুমতি দিচ্ছে। সর্বোপরি, সর্বস্তরে সুশাসনের যে অভাব সেটা পরিবেশের ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রকট। যতগুলো সেক্টরে সুশাসনের অভাব, জবাবদিহিতার অভাব তার মধ্যে পরিবেশ শীর্ষে রয়েছে। কারণ অনেক বেশি অর্থের হাতছানি রয়েছে এই খাতে। যতক্ষণ পর্যন্ত সার্বিক উন্নতি না হয়, জবাবদিহিতা না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণ প্রতিবাদ করেও লাভ হবে না।  (দৈনিক সমকালের অনলাইন থেকে সংগৃহীত)

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ