আজকের শিরোনাম :

‘নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে সকল রাজনৈতিক দলের দায়বদ্ধতা আছে’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:৪৪

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অল্প কিছুদিন বাকি। সব রাজনৈতিক দলই এখন ব্যস্ত নির্বাচনী প্রচারও ইশতেহার নিয়ে। বিগত নির্বাচনগুলোতে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনী ইশতেহারে নারী উন্নয়নের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তারপরও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ থেকেই যাচ্ছে। নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে এবারের নির্বাচনী ইশতেহার কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে জনপ্রিয় একটি দৈনিকের অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন বেসরকারি সংস্থা ‘নারী প্রগতি সংঘ’-এর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর। সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো- 

প্রশ্ন : নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে নির্বাচনী ইশতেহারে নতুন করে এবার আর কী যোগ করা উচিত?

রোকেয়া কবীর : নতুন কিছু বিষয় যোগ করা যেতে পারে। যেমন-উত্তরাধিকারে নারীদের সমান অধিকার প্রদান। সেই সঙ্গে নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৩-০৪ এ সমান অধিকারের যে বিষয়গুলো অপসারণ করা হয়েছে সেগুলো আবার যোগ করা। মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়টাকে পূর্ণ মন্ত্রণালয় ঘোষণা, বাজেটে একটা সুর্নিদিষ্ট অংশ নারীর জন্য বরাদ্দ করা, নারীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। নরীর প্রতি যে কোনো রকমের বৈষম্যমূলক আইন, নীতি এবং কার্যক্রম রাষ্ট্র কিংবা অন্য যেই করুক না কেন, তাদের মনিটর করার জন্য একটা জাতীয় নারী কমিশন হওয়া দরকার বলে মনে করি। সব রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলো তাদের রাজনৈতিক ইশতেহারে বিষয়গুলো রাখবে, এটাই আমরা চাওয়া।

আরেকটা হলো, নির্বাচনী ইশতেহারে নারীর সমান অধিকার বিরোধী যে কোনো রাজনীতি, রাজনৈতিক শক্তি এবং বক্তব্য যারা দেন তাদেরকে কোনো জোটেই যেন প্রশ্রয় দেওয়া না হয়। তাদেও প্রার্থী হিসেবেও যাতে না রাখা হয়— সে ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকতে হবে।

বলা হয়, একাত্তরের যুদ্ধে ৫-৬ লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যাটা অনেক বেশি। সাধারণ পরিস্থিতিতেই প্রতিনিয়ত নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। আর ধর্ষণকে যখন যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে দেখা হয়েছে তখন যে কত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে তার প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি। এত ত্যাগের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি সেই স্বাধীন দেশে যারাই রাজনীতি, ব্যবসা কিংবা এনজিও করবেন তাদের অবশ্যই রক্তের ঋণের একটা দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। আর সেটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা মূল্যবোধ। বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত একটা সমাজ। যে সমাজের কথা বঙ্গবন্ধু তার প্রত্যেকটা রাজনৈতিক বক্তব্যে বলেছেন। আন্তর্জাতিক ফোরামেও তিনি বলেছেন— 'সারা বিশ্বে দুটি পক্ষ আছে। একটা হলো শোষক আর আরেকটা শোষিত। আর আমি শোষিতের পক্ষে।' সুতরাং শোষণ, বৈষম্যহীন সমাজের যে অঙ্গীকার সেটার প্রতি সবাইকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। 

প্রশ্ন : নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আপনার আহ্বান কী?
রোকেয়া কবীর :
দেশি, বিদেশি পর্যবেক্ষক, সুশীল সমাজের নেতা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল— সবাই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিয়ে কথা বলে ক্ষমতায় যাওয়ার সময় হলে। কিন্তু সরকার গঠন করলে সকল নাগরিকের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তারা কীভাবে তৈরি করবেন— এটা ইশতেহারে থাকা উচিত। শুধু নারীর জন্য নয়, সমাজে অন্যান্য গোষ্ঠী যারা বৈষম্যের শিকার তাদের জন্যও সবার কাজ করা উচিত। আইনের আশ্রয় নেওয়ার সমান সুযোগ, গ্রাম-শহরের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণও নির্বাচনী ইশতেহারে থাকা উচিত। মূল কথা হচ্ছে— যুদ্ধাপরাধী এবং যারা ঘোষণা দিয়ে নারী ও অন্যান্য ধর্মগোষ্ঠীর সমান অধিকার স্বীকার করে না, তাদের এ দেশে রাজনীতি করার বা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত হবে বলে মনে করি না। নির্বাচিত হওয়ার পরে সকল নাগরিকের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ কীভাবে তৈরি করবেন সেটা তাদের ইশতেহারে সর্বপ্রথম ঘোষণা করতে হবে।

প্রশ্ন : আমাদের দেশের পারিবারিক আইনগুলোতে এখনও সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব— সব ক্ষেত্রেই নারীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। নির্বাচনী ইশতেহারে এ বিষয়গুলো কতটা যোগ করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
রোকেয়া কবীর:
বৈষম্যের বীজটা রোপন হয় পরিবার থেকে, সম্পদে সমান অধিকার না থাকার কারণে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যদি তা না করা হয় তাহলে সেটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যায় না। পারিবারিক আইন এখনও ধর্মভিত্তিক রয়ে গেছে, এটা বৈষম্যমূলক। সকল নাগরিকের সমান অধিকার। নারীর জন্য সেই সমান অধিকার সমভাবে প্রযোজ্য। এটার প্রতি সব রাজনৈতিক দলের একটা দায়বদ্ধতা আছে। 

প্রশ্ন : মনিটরিং ব্যবস্থা কীভাবে পরিচালনা করা যায়?
রোকেয়া কবীর :
মনিটরিংয়েরে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের একটা ভূমিকা থাকতে পারে। যদিও বলা হয়, নির্বাচন কমিশন হলো নির্বাচন পরিচালনার জন্য। নির্বাচনের পর নির্বাচিতরা কী করবে কী করবে না, তা সাধারণত নির্বাচন কমিশনের আওতায় পড়ে না। কিন্তু মানবাধিকার কমিশনসহ অন্যান্য  কমিশন এবং সুশীল সমাজ যদি নিয়মিত নির্বাচনী ইশতেহারের বিষয়গুলো সরকার বাস্তবায়ন করছে কি-না এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এই দাবিগুলো নিয়ে কোন কথা বলছে কি-না, সেটাও মনিটর করে তাহলে একটা জবাবদিহিতা তৈরি হয়। এখানে জবাবদিহির কোনো সংস্কৃতি চালু না থাকায় বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয় না। বিশেষ করে নারী, সংখ্যালঘু, দলিত জনগোষ্ঠী এবং প্রান্তিক পর্যায়ে যারা আছেন তাদের দাবিগুলো নিয়ে, সেটা ধর্মীয় কিংবা যৌন নিপীড়নজনিত যাই হোক না কেন, খুব বেশি রাজনৈতিক দল কথা বলে না। শুধুমাত্র কিছু কিছু মানবাধিকার সংস্থা, নারী উন্নয়ন সংস্থা এটা নিয়ে কথা বলছে। 

প্রশ্ন : নারী উন্নয়ন বাস্তবায়নে কোন বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? 
রোকেয়া কবীর :
’৭৫-এর পর দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি সমাজে প্রচণ্ডভাবে ডাল পালা মেলেছে। তাদের অর্থনৈতিক শক্তি এত বেশি, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী নিয়মিত দেশে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িকতার বিপরীত চিন্তা ভাবনা প্রচার করছে সারাবছর ব্যাপী। এর বিপরীতে গণতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষতা, প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনার যে সংস্কৃতি, সমাজে সেটা গড়ে তোলার ঘাটতি রয়েছে। এখানে অর্থনৈতিক শক্তির একটা সীমাবদ্ধতা আছে বলে আমার মনে হয়। সরকার এবং অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এ বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়া।

প্রশ্ন : ২০০৮ কিংবা ২০১৪ সালে নারী উন্নয়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে বেশ কিছু বিষয় ছিল। এর মধ্যে সম অধিকার, নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন ও হয়রানি, বৈষম্য বন্ধসহ বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে নারী নির্যাতনকারীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পার পেয়ে যাচ্ছেৃ।
রোকেয়া কবীর:
ওই যে আগেই বললাম, যদি নারী বিষয়ক কমিশন হয় তাহলে এটা তারা মনিটরিং করতে পারবে। আমাদের বিচারব্যবস্থা, পুলিশের ব্যবস্থা বা নির্যাতনের বিষয়গুলো যারা দেখেন তারা সকলেই কমবেশি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার। নারীর প্রতি সহিংসতা যে সাংঘাতিক একটা ব্যাপার এটা তারা মনে করেন না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের বলতে শোনা যায়— 'সমাজে এটা হবেই। এগুলো নিয়ে বেশি নড়াচড়া করলে অসুবিধা হবে। মিটমাট করে ফেলেন।' গ্রামে যেসব মাতবররা সালিশ-নালিশ করেন তাদের মানসিকতার মতো অনেক সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও একই মানসিকতা কাজ করে। কেস নিয়ে যেসব আইনজীবী লড়বেন তাদের চিন্তা ভাবনাও তাই। নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার জন্য যদি একটা কমিশন যদি থাকে তবে তারা এসব ইস্যু সামনে আনবে। সরকারি যে ব্যবস্থাপনাগুলো আছে, যেমন- আইন, বিচার, সংসদ অথবা পুলিশের ব্যবস্থাপনা, তারা এসব মনিটর করে রিপোর্ট জমা দেবে সংসদে। 

প্রশ্ন : সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারীদের সরাসরি মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনীহা দেখা যায়। বরং সংরক্ষিত আসনেই নারীদের মনোনয়ন দিতে দলগুলোর মধ্যে বেশি আগ্রহ দেখা যায়। নারীর ক্ষমতায়নে এ ধরনের উদ্যোগ কতটা যুক্তিসঙ্গত?
রোকেয়া কবীর:
এটা দিয়ে নারীদের ক্ষমতায়ন খুব একটা হবে না। কারণ সেসব নারীকে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেয়া হবে যারা দলের কথা শুনবে। সংরক্ষিত আসনে যারা মনোনীত হয়ে আসেন তারা সংসদে উত্তরাধিকার আইন, নারীদের সম অধিকার আইন, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে কথা বলেন না। এখানে সরাসরি নির্বাচিত না হয়ে আসলে তারা কথা বলতে পারবে না। সেই সুযোগ করা দরকার। নির্বাচন কমিশনকে আমরা একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক নারীদের সরাসরি নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলাম। নির্বাচন আরপিও সংশোধন করে যদি এটা রাখা হয় এবং কিছু আসন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় লটারির মাধ্যমে নারী প্রার্থীদের জন্য, তাহলে প্রত্যেকটা দল নারী প্রার্থী দিতে বাধ্য হবে। তখন যে দল থেকেই আসুক নারীই নির্বাচিত হবে এবং সংসদে দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ হবে। জনগণের ভোটের শক্তিতে আসার ফলে জনগণের কাছে তার একটা দায়বদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে। 

প্রশ্ন : সংসদ নির্বাচনের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে রাষ্ট্রের বিভিন্ন উন্নয়ন তথা নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক কথাই উল্লেখ থাকে। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তা কতটুকু বাস্তবায়ন হয় বলে আপনি মনে করেন?
রোকেয়া কবীর :
যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন ক্ষমতায় গিয়ে তারা কী কী করবেন সেটাই হলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহার। কিন্তু সবসময়ই দেখা যাচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব বক্তব্য আছে এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তাদের যে কর্মকাণ্ড তাতে অনেক পার্থক্য রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও শক্তি এবং চিন্তা-ভাবনার সীমাবদ্ধতা আছে। কারণ নির্বাচন এলে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে যেভাবে কথা বলা হয়, সরকার গঠন করার পরে ওই দলের নির্বাচনী ইশতেহার যা ছিল সেটা কীভাবে বাস্তবায়ন করছে সেটা ফলোআপ করা এবং নিয়মিত মনিটরিং করা হয় না। যদি সেটা করে পত্র-পত্রিকায়, বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেয়া যেত তাহলে হয়তো সারা বছর রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরে একটা চাপ থাকতো। এটা শুধু সরকারি দল না, অন্যান্য দলের জন্যও জরুরি। (দৈনিক সমকালের অনলাইন থেকে নেয়া)

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ