আজকের শিরোনাম :

‘পরিবহনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবা খাত সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা আবশ্যক’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ মে ২০১৮, ১৩:৫৫

ঢাকা, ১৭ মে, এবিনিউজ : ড. মোয়াজ্জেম হোসেন, পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক। দায়িত্ব পালন করছেন অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক হিসেবে। ১৯৯৬ সালে পরিবহন বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করেন যুক্তরাজ্যের সাউথাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মরত আছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ট্রান্সপোর্টেশন ডিভিশনের ফ্যাকাল্টি সদস্য হিসেবে। মালয়েশিয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (এমইউএসটি) ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস প্রোগ্রামের ফ্যাকাল্টি সদস্য হিসেবেও প্রেষণে তিন বছর কাজ করেছেন। তার গবেষণার ক্ষেত্র পরিবহন ব্যবস্থা সিমুলেশন, ট্রাফিক প্রকৌশল, পরিবহনের জ্বালানি ও পরিবেশগত ইস্যু, গণপরিবহন এবং ফ্রেইট ও লজিস্টিকস। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে তার অনেক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও বহুপক্ষীয় অর্থায়নে বেশকিছু গবেষণা প্রকল্প পরিচালনার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার। সম্প্রতি দুর্ঘটনা, নগরের গণপরিবহন ব্যবস্থা, যানজট, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ নানা বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হুমায়ুন কবির 

সম্প্রতি ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় সড়কে কিছু ভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুই বাসের চাপায় একজনের হাত বিচ্ছিন্ন, অতঃপর মৃত্যু, একজনের পা বিচ্ছিন্ন, তারও মৃত্যু হয়েছে। রেন্ট-এ-কারের এক চালকের পা পিষে দেয়া হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার কারণ কী মনে করেন?

দুর্ঘটনা আগেও হয়েছে, তবে হয়তো এ রকম বীভৎসভাবে হয়নি। এখন অনেক নির্মমভাবে হচ্ছে দুর্ঘটনাগুলো এবং গণমাধ্যমের কল্যাণে তা মানুষ জানতেও পারছে। আমি ‘নির্মম’ কথাটি বলছি এ কারণে, সাম্প্রতিক সময়ের দুর্ঘটনাগুলোয় মানুষের জীবনের কোনো মূল্য-মায়া নেই কিংবা তাদের জীবন খুবই তুচ্ছ— এমন এক ভাব প্রকাশ পেয়েছে। এটি চালকদের দিক থেকে। যাত্রাবাড়ীর ঘটনাটি তো আরো ভয়াবহ, নির্মম। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ইচ্ছাকৃতভাবে পায়ের ওপর গাড়ি তুলে দেয়া হয়েছে। তার মানে হলো, চালকদের মানসিক অবস্থা এমন অবস্থায় চলে গেছে, মানুষ মেরে ফেলা, দুর্ঘটনার পরিণাম ইত্যাদি তাদের মাথায় আর ধারণ করে না। প্রশ্ন হলো, এমন মানসিক অবস্থায় তারা কীভাবে গেলেন? এর বিবিধ কারণ রয়েছে। প্রথমত. এ প্রবণতা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা। নিঃসন্দেহে একজনকে ভালো চালক হতে হলে তাকে অবশ্যই মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে। মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য এক সুশৃঙ্খলিত নিয়মের মধ্যে জীবনযাপন করতে হবে। ন্যূনতম আর্থিক সচ্ছলতা থাকতে হবে, চাকরির নিশ্চয়তা থাকতে হবে, বসবাস বা বিশ্রামের জন্য ন্যূনতম পরিবেশ থাকতে হবে এবং তার চেয়ে আরো গোড়ায় প্রয়োজন ভালো পেশাদারি প্রশিক্ষণ; যেহেতু চালকদের কাজটি পেশাদারি। আমাদের এখনকার নগরকেন্দ্রিক গণপরিবহন ব্যবস্থার চালকদের মধ্যে এগুলোর কোনোটিই নিশ্চিত করার সুযোগ নেই।

বলতে গেলে, এক. চালকদের শিক্ষা; শিক্ষা বলতে বোঝাচ্ছি প্রশিক্ষণ ও যথাযথ লাইসেন্সিং; দুই. চাকরির চুক্তি ও শর্তাবলি— এগুলোর কোনো যথাযথ মানদণ্ড নির্ধারণ করা নেই; তিন. অপারেটরদের (মালিক) একটি মানসম্পন্ন কাঠামোয় বাঁধার সুযোগ নেই। তার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে মালিকদের একটি ইজারামতো ব্যবস্থা। মালিকপক্ষ নিজেদের মুনাফাটা অক্ষুণ্ন রাখতে এ ব্যবস্থায় চালকদের বলে দেয়, ‘তিনদিন বা এক সপ্তাহ গাড়ি চালালে আমাকে এত টাকা দিতে হবে, কীভাবে দেবে সেটি জানি না; বাকিটা তোমার।’ এমন এক পরিস্থিতিতে পুরো প্রক্রিয়াটাই একটি ডাবল বিজনেসে পড়ে যায়। মালিক একটি ব্যবসায়িক টার্গেট নির্ধারণ করে চালকদের ছেড়ে দিলেন। এ অবস্থায় একজন চালক হিসেবে মালিকের টার্গেট তো পূরণ করবেনই; উপরন্তু অতিরিক্ত কিছু অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করবেন। কারণ তাকে ফ্রি করে দেয়া হয়েছে। যেখানে পুরো খাতটিই সেবা খাত; এমন এক খাতে কাউকে যদি বলা হয়— নিখাদ মুনাফা করো, অন্য কিছুর দিকে তোমার তাকানোর দরকার নেই, তখন সেবা আর সেবা থাকে না; সেটি হয়ে ওঠে মুনাফার নগ্ন ক্ষেত্র। এটি করতে গিয়ে যাত্রীদের দিকে তাকানো দূরে থাক, চালকরা নিজেদের দিকেও তাকাচ্ছেন না। হয়তো দুদিন ধরে এক নাগাড়ে গাড়ি চালাচ্ছেন, বিশ্রামের বালাই নেই। উল্লিখিত সবকিছুই চালকদের আজকের অস্বাভাবিক বা অমানবিক আচরণের জন্য দায়ী এবং এজন্য দুর্ঘটনাও বেড়ে চলেছে। তারা খারাপ মানুষ, এটি বলব না। উল্লিখিত ফ্যাক্টরগুলো তাদের আজকের এ অবস্থায় নিয়ে এসেছে।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যাত্রীদেরও তো কিছুটা দায় আছে...

যাত্রী মানে আমরা সবাই। সবাইকে দোষ দিয়ে কোনো সমাধান দাঁড় করানো যায় না। এটি হলো মৌলিক বিষয়। তাহলে এখন কী করণীয়? আমাদের এই লোকেরা ক্যান্টনমেন্ট দিয়েও তো যাতায়াত করে। এরা সিঙ্গাপুরেও চলাচল করে। তখন তো সমস্যা হয় না। তাহলে এরা ঢাকায় এলে কেন সমস্যা হয়? গুলিস্তান বা যাত্রাবাড়ী গেলে বিশেষভাবে সমস্যা আরো বেশি হয়। এর একটি কারণ আছে। সেটি হলো, মানুষ কোনো জায়গায় গেলে এর মাইক্রো এনভায়রনমেন্ট ও অবয়ব অনুযায়ী আচরণ করে। জায়গাটি নৈরাজ্যিক হলে মানুষ অস্বাভাবিক আচরণ করে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। আবার এই একই লোককে সিঙ্গাপুর বা হংকংয়ে ছেড়ে দিলে সে চিন্তা করবে কাজটি ঠিক না বেঠিক। তার বিবেকটা কাজ করবে। যেটি ফার্মগেট, যাত্রাবাড়ী বা গুলিস্তানে গেলে কাজ করবে না। এখানে সবকিছু যেহেতু বিশৃঙ্খল, সেহেতু সে নিজেকেও এর অংশ মনে করে। একটি ব্যবস্থা দাঁড় করিয়ে একটি সুশৃঙ্খল দৃশ্য হাজির করা গেলে মানুষ অর্ধেক ঠিক হয়ে যাবে। আর বাকি অর্ধেক ঠিক করার জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে কিছু বিষয় প্রবর্তন করতে হবে। গণমাধ্যমে কিছু বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। এগুলো করতেই হবে। সুতরাং ঢালাওভাবে মানুষকে দোষ দিয়ে হবে না। মানুষ খারাপ, তাই দুর্ঘটনা হয়। এটি একদম ভুয়া কথা।  

দেশে সড়ক অনুপাতে গাড়ির সংখ্যা বেশি। এটা কি দুর্ঘটনা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে?

দেখুন, অর্থনীতি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। একটি জঙ্গলে ওই কয়টা গাছই হবে, যে কয়টা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে। এর বেশি হলে কিন্তু থাকবে না; খাদ্য না পেয়ে মরে যাবে। কাজেই গাড়ির সংখ্যা বেশি মানে হলো, গাড়ির চাহিদা রয়েছে। চাহিদা থাকলে রাস্তা কেন তৈরি হচ্ছে না? এ প্রশ্নটি ঠুকে দেয়া উচিত, যারা এ কথা বলে তাদের। সড়কের অনুপাতে গাড়ি বেশি মানে চাহিদা আছে। তাহলে রাস্তা তৈরি করছেন না কেন? অনেক বছর ধরে পূর্বাচল তৈরি করা হচ্ছে, অনেক প্রকল্প নির্মাণ করা হচ্ছে, রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে না কেন? বিশ্বের যেকোনো দেশে সাত বছরের বেশি হলে তারা কোনো প্রকল্পকে আর প্রকল্প বলে না। একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়কাল বড়জোর সাত বছর। বিশ্বের কোথাও এর চেয়ে দীর্ঘায়িত প্রকল্প হয় না। আমাদের দেশে একটি মহাসড়ক নির্মাণ করতে লেগে যায় ১০ বছর। অন্য কিছু বাদ দেন। একটি ফুটপাত নির্মাণের জন্য এক বছর ধরে জনগণকে ভোগান্তি দেয়া হয়। তার অর্থ এই নয় যে, এটি করতে এক বছর লাগার কথা। পৃথিবীর এমনও দেশ আছে, যেখানে রাস্তার একটি অংশ এক রাতেই শেষ করে ফেলা হয়। সেজন্য প্রয়োজন হলে একজনের স্থলে কুড়িজন রাজমিস্ত্রি নিতে হবে। তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু সেগুলো করা হয়নি। এগুলোকে বলা হয় সুশাসন (গভর্ন্যান্স)। সরকার বা সরকারি সংস্থার কাজ হলো সুশাসন নিশ্চিত করা। সুশাসন নিশ্চিত করলে জনগণ সেবা পায়। সরকার ও সরকারি সংস্থাগুলোর সেবার দিকে নজর না থাকলে সুশাসন নিশ্চিত করবে না। আর সুশাসন নিশ্চিত না করলে ঠিকাদাররা নিজেদের মতো আচরণ করবে, তাদের লাভ খুঁজবে; বাসচালকরা তাদের মতো আচরণ করবেন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা তাদের মতো আচরণ করবেন, মুনাফা খুঁজবেন; অর্থ নয়-ছয় করবেন। সার্বিক সুশাসন ব্যবস্থার দুর্বলতায় আজকে আমরা এ পর্যায়ে পৌঁছেছি। এবং এর মাত্রাটা পরিবহন খাতে একটু বেশি। কারণ সুশাসন নিশ্চিতের জন্য যে প্রতিষ্ঠানটি উন্নয়ন করার কথা ছিল, সেটি কাগজে-কলমে সরকার তৈরি করেছে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ), কিন্তু বাস্তবে তৈরি করেনি। যেখানে ৪০০-৫০০ পেশাজীবী কাজ করার কথা, সে জায়গায় এত বড় একটি শহরের জন্য একজন মাত্র ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার, একজন পরিবহন পরিকল্পনাবিদ (ট্রান্সপোর্টেশন প্ল্যানার) রয়েছে! তাদের পক্ষে কি সম্ভব এ ১৫০-২০০ প্রাইভেট বাসের মালিকদের ওপর নজরদারি বা খবরদারি করা?

কেউ কেউ বাস ফ্র্যাঞ্চাইজি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক এটি বাস্তবায়নে কিছুটা অগ্রসরও হয়েছিলেন। এটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

সত্যি বলতে কি, পরিবহনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয় সেবা খাতে লাভ করার কোনো সুযোগ নেই। এটি হলো বটম লাইন। এখানে আমি প্রাইভেট অপারেটরদের অনুমতি দিতেই রাজি নই। আমাদের প্রাইভেট বাস অপারেটররা কেমন, সেটা সবাই ভালো করে জানে। আপনি হয়তো চার কোম্পানি দিয়ে শুরু করবেন, পরবর্তী সরকার এসে যে ২০ কোম্পানি করবে না, এ গ্যারান্টি কি কেউ দিতে পারবে? কাজেই ওই ঝামেলায় যাওয়ার জন্য আমি তৈরি নই। বিশ্বের বড় বড় পুঁজিবাদী অর্থনীতি, যারা এক পয়সাও কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছে, তারা তো নগর বাস পরিবহন ব্যক্তিখাতে ছেড়ে দেয়নি। তারা তো সরকার নিয়ন্ত্রিত কোম্পানির অধীনে রেখেছে। বাংলাদেশ কী এমন পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশ হলো যে, ব্যাপক জনগুরুত্বপূর্ণ সেবা ব্যক্তিখাতে ছেড়ে দিতে হবে? আমি এটা মনে করি না।

ডিটিসিএকে শক্তিশালী করতে হবে; যেটি হবে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাসম্পন্ন প্ল্যানিং বডি। একইভাবে আরেকটি সরকারি মালিকানাধীন অপারেটর বাস কোম্পানি উন্নয়ন করতে হবে; যেমনটি আমরা এখন মেট্রোরেলের জন্য ডিএমটিসিএল কোম্পানি করেছি। তখন হয়তো ডিবিসিএল নামে একটা কিছু হবে, যারা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে ডিটিসিএ কর্তৃক। কাজেই অপারেটর এবং প্ল্যানিং ও রেগুলেটিং বডি আলাদা হবে। দুটো এক করলে আবার সমস্যা সৃষ্টি হয়, স্বার্থের সংঘাত হয়। কারণ একজন আরেকজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতে হবে। সিউল, টোকিও, শিকাগো, লন্ডনসহ সর্বত্রই এ দৃশ্য। তাহলে কোথা থেকে একটি আজব ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, যেখানে ডিটিসিএকে কাগুজে বাঘ বানিয়ে রাখা হয়েছে! তাত্ত্বিকভাবে নগর পরিবহনে কখনো লাভ করা যায় না। কারণ এটি সেবা। এখানে ধনী, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র সব শ্রেণীর মানুষ আছে। এখান থেকে মুনাফা করা যায় না। বাসে তো ধনী লোকেরা চড়বে না। বিশ্বের কোথাও চড়ে না। এতে চড়ে নিম্ন আয়ের মানুষই। বড়জোর মধ্যবিত্ত চড়ে। এর উপরের শ্রেণীকে বাসে আনা যায় না। কাজেই সেখান থেকে ব্যবসা করলে সেটি আর কোনো দিন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দাঁড়াবে না। বড় কথা, যত বড় শহর তত বেশি এক্ষেত্রে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়। এ ভর্তুকির অংক মোট বাজেটের ৬০ শতাংশ পর্যন্তও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দিতে হয়। কারণ দেশটির গণপরিবহন ব্যবস্থা একটু অদক্ষ। এ ভর্তুকি ইউরোপে হয়তো প্রায় ৩০ শতাংশ। এশিয়ার শহরগুলোয় প্রায় ২০ শতাংশ। যেমন— সিউল, টোকিও, সিঙ্গাপুর, হংকং। এসব শহরকে গণপরিবহনের ক্ষেত্রে রোল মডেল ভাবা হয়। কাজেই তারা যদি সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি দিয়ে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত বাস পরিচালনা করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না? কোথা থেকে ২০০ অপারেটরের বাস দিয়ে রাস্তায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করে শুধু ব্যবসা ও মানুষ মেরে ফেলার এ দৃষ্টান্ত নেয়া হয়েছে? এটা আজব ব্যবস্থা। শিগগিরই এ ব্যবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি। কোনো এক দেশকে রোল মডেল ধরে এটি পরিবর্তন করে ফেলা উচিত।

ঢাকার যানজট নিরসনে বেশ কয়েকটা ফ্লাইওভার করা হয়েছে। এখন মেট্রোরেল বাস্তবায়নের কাজ চলছে। আপনি কি মনে করেন এতে কাজ হবে?

মেট্রোরেল রাস্তার উপরের যানজট কমাতে তেমনভাবে ভূমিকা রাখে না। এটি করা হয় সাধারণত তখনই, যখন সড়কে আর ধারণক্ষমতা (ক্যাপাসিটি) বাড়ানো সম্ভব না। সেক্ষেত্রে কিছু একটি করে তো গণপরিবহনের ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে, সেটি হলো মেট্রোরেল। সত্যিকার অর্থে সড়কে যানজট কমাতে হলে আমাদের মনোযোগী হতে হবে কার্যকর বাস ব্যবস্থা চালুর দিকে। কারণ বাস সড়কে থাকে, মেট্রো সড়কে থাকে না। সেটি আলাদা একটি ব্যবস্থা। ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক যখন দেখবেন তার পাশের বাসটা কার্যকর ও দ্রুতগতিতে চলে, তখন তিনি চিন্তা করবেন, বেড়ানো বাদে অন্তত কাজের সময় বাসে যাওয়া যায়। তখন যানজট অনেকাংশে কমবে। মেট্রোরেল আমরা যে কয়টা করতে পারি ভালো, সিউল কুড়িটা করেছে, টোকিওতে সংখ্যাটা তেমনই হবে। আমরা এখন একটি করছি, আরো দু-একটি করার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (ফিজিবিলিটি স্টাডির) চিন্তা চলছে; কিন্তু যেকোনো শহরের লাইফলাইন হলো বাস ব্যবস্থা। ঢাকাসহ দেশের বড় শহরের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। নগর পরিবহন উন্নয়নে প্রথম ও সহজে অর্জনযোগ্য প্রাধিকার হওয়া উচিত কার্যকর বাস ব্যবস্থা চালু। এর উন্নতি না ঘটিয়ে নগর পরিবহনের সমস্যা সমাধান করা অসম্ভব।

আমরা লন্ডনের কথা প্রায়ই শুনি, সেখানে অনেক আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো রয়েছে। তার ওপর লন্ডনের বাসগুলো মেট্রোর চেয়ে দ্বিগুণ যাত্রী বহন করে। তাহলে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাস বেশি প্রয়োজনীয়। বাস আছে বলেই মেট্রো বাকি এক-তৃতীয়াংশ যাত্রী পাচ্ছে। নইলে সেটাও পেত না। কারণ বাস থেকে নেমে ট্রেনে বা ট্রেন থেকে নেমে বাসে ওঠা গেলে ট্রেনও কিন্তু জনপ্রিয় হবে। সুতরাং আমাদেরও এদিকে যেতে হবে। সরকারকে কেউ কেউ হয়তো ভুলও বোঝাতে পারেন যে, মেট্রো কিংবা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে গেলে যানজট সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমি মনে করি, এরা পেশার প্রতি অশ্রদ্ধা (ডিজরিগার্ড) দেখিয়েছেন, অযথার্থ ও দুর্ভাগ্যজনক ধারণা দিয়েছেন। আমাদের প্রাধিকার হওয়া উচিত সাশ্রয়ী কার্যকর বাস ব্যবস্থা চালু এবং সেটি করার পর ক্যাপাসিটি বাড়ানোর জন্য মেট্রো করা উচিত এবং আমরা এটি অবশ্যই করবও।

আমাদের এখানে আগে অনেক জলপথ থাকলেও আমরা পরিবহনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সড়কনির্ভর হয়ে পড়েছি। এ প্রবণতাকে কীভাবে দেখেন?

এক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো, ব্যবসায়িক গোষ্ঠী যেকোনো বিষয় তাদের মতো করে দেখে। ঢাকা শহরের যেকোনো বাস অপারেটরের কথা ধরুন, সে কখনো চিন্তা করে এখানকার যানজট কমাতে হবে? ব্যবসা বাদে এটি তাদের মাথায় আসার কথাও নয়। যাদের মাথায় আসার কথা, সেই সংগঠনটি তো তৈরি করা হয়নি। আগেই বলেছি ডিটিসিকে কাগুজে বাঘ করে রাখা হয়েছে। আজকে যদি কম্পিউটার মডেলিং, বিশ্লেষণ, মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহসহ সব দিক থেকে সক্ষম ডিটিসিএ থাকত, তাহলে এ কথাটি তারাই বলত। আজকে ওয়াটার বাস কেন জনপ্রিয় হচ্ছে না, এসব নিয়ে তারা গবেষণা করত। আমি জানি, কেন জনপ্রিয় হচ্ছে না। কারণ একীভূতকরণ (ইনটিগ্রেশন) ঘাটতি। আপনি যদি লঞ্চ থেকে নেমে বাস না পান, তাহলে সেটি একটি বিচ্ছিন্ন রুট হলো। আর বিচ্ছিন্ন রুট কখনো জনপ্রিয় হয় না। এটিকে অবশ্যই একীভূত হতে হবে। এসব বিষয় একজন সাধারণ মানুষ বুঝবে না। বিআইডব্লিউটিসি চিন্তা করেছে একটি প্রকল্প দরকার, কাজেই সংস্থাটির মতো করেছে; যেখানে নগর পরিবহনের বিশ্লেষণটি করা হয়নি। এ কারণে আমি গুরুত্ব দিই প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায়। কারণ তারা সবকিছু একটি তাত্ত্বিক কাঠামোয় চিন্তা করবে। এটিও কিন্তু মৌলিক। কেউ যদি বলেন, ‘এটি লাগবে না, এটি করেন, সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ আমি বলি, না। আগেই বলেছি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার কথা। কারণ স্টিয়ার করার মতো কোনো সংস্থা বা সংগঠন না থাকলে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল নানা ধারণা দিয়ে পুরো বিষয়টিকে শেষ করে দেবে। এটি করছেও। আসলে পরিবহনসংশ্লিষ্ট সব সিদ্ধান্ত ওই বডি থেকে বেরোতে হবে। এমনকি দরকার পড়লে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ কর্ণধারও বলবেন না এটা সম্পর্কে। তাহলেই এখানে সুন্দর কিছু হবে। সবকিছু সমন্বিতভাবে করা হলে এখানে জলপথেরও উন্নয়ন হবে। ঢাকা শহরের নগর পরিবহনের কোনো অভিভাবক নেই। একটি রোড প্রজেক্ট বের করা, টার্মিনাল করা এসবে সবার আগ্রহ। কিন্তু এটিকে একটি সেবাপ্রদানকারী বিষয় হিসেবে উন্নয়ন করতে হলে সেক্ষেত্রে কাজটা একটু বেশি। এতে কারো আগ্রহ নেই।

ঢাকায় আন্তঃজেলার বাসগুলোর জন্য টার্মিনাল রয়েছে। কিন্তু শহরের অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী বাসের জন্য টার্মিনাল নেই। এক্ষেত্রে আপনার মত কী?

এটি খুবই দুঃখজনক। শহরে চলাচলকারী বাসগুলোর জন্য অবশ্যই টার্মিনাল দরকার। টার্মিনালে বাস আসে যাত্রী ওঠানামা করানো এবং চালক পরিবর্তন হওয়া বা করার জন্য। কোনো টার্মিনালে একটি বাস বড়জোর ২০-৩০ মিনিট থাকতে পারে। সিটি বাস হলে ১০ মিনিট। আন্তঃজেলার বাস হলে ২০-৩০ মিনিট। সেখানে চরম ব্যত্যয় হয়ে গেছে। ঢাকা শহরে বাস চালানোর জন্য ২০০ কোম্পানিকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। কোনো নেটওয়ার্ক প্ল্যান নেই, ফ্রিকোয়েন্সি প্ল্যানিং নেই। দেখা যাচ্ছে, বাসগুলো সিরিয়ালের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। এটি যখন একটি কোম্পানির আওতায় চলে আসবে তখন এ সমস্যা এমনিতেই থাকবে না। কারণ কোনো বাস রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে না— এটিই নিয়ম। বাস হয় গ্যারেজে থাকবে; আর রাস্তায় নামলে সবসময় তা চলবে। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকছে অনেক অপারেটরকে প্রতিযোগিতার সুযোগ দেয়ায়। এটি উল্টো যানজটের আরেকটি বড় কারণ। সকালবেলায় গুলিস্তান বা আজিমপুরে দেখবেন রাস্তা ব্লক করে অনেক বাস দাঁড়িয়ে আছে। এটিকে বলি বিশৃঙ্খল কাণ্ড। এটি হচ্ছে মূলত বেশি অপারেটরের কারণে। অন্যদিকে এক কোম্পানির আওতায় চললে ২ মিনিট পরপর বাস আসবে। আবার ঘুরে এসে চলে যাবে। এটি একটি সার্কিটের মতো; শুধু ঘুরছে, জায়গায় জায়গায় থামছে। ২০০ কোম্পানির বাস চললে এটি সম্ভব নয়।

গণপরিবহনের উন্নয়নে আমরা কী করতে পারি?

প্রধান টার্গেট হতে হবে কার্যকর বাস সেবা। যদিও সেটি ছোট একটি কথা, তবে তা বাস্তবায়ন করা অনেক কঠিন। এজন্য শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা লাগবে; যাদের ট্রেনিং, ম্যানেজমেন্ট, অপারেশন দেখার মতো পর্যাপ্ত সামর্থ্য আছে। সেখানে ৩০০-৪০০ ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার, পরিবহন পরিকল্পনাবিদ কাজ করবেন। তারা হবেন স্থায়ী কর্মী। দরকার হলে সরকার নগর পরিবহন ক্যাডার তৈরি করবে। তাদের গুরুত্ব দিতে হবে, লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে হবে, পর্যাপ্ত বাজেট দিতে হবে। একই সঙ্গে ফুটপাত ও টার্মিনালকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এগুলো করলে গণপরিবহনের উন্নয়ন সহজতর হবে।

ঢাকার যানজট সমস্যা সমাধানে আপনার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা কী?

আমরা মনে করি, ঢাকার যানজট সমস্যা সমাধানযোগ্য। এজন্য একটি সলিউশন ফ্রেমওয়ার্ক দাঁড় করিয়েছি। এজন্য প্রচারণা চালাচ্ছি। আমাদের টার্গেট আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকেও দাওয়াত দেব। তাদের বলব, বিভিন্ন আঙ্গিকে এটিই হলো সমাধানের পথ; এসব কাজের জন্য বিভিন্ন কিছু করতে হবে। এতে আপনাদের সমর্থন থাকবে কিনা। নিশ্চয়ই রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলে উল্লিখিত সমস্যা সমাধান কঠিন নয়। (বণিক বার্তা থেকে সংগৃহীত)

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ