আগামী চার দিন বিএনপিকে কারা সহযোগিতা করবে?

  সুভাষ সিংহ রায়

০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:৪৪ | আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:৩৬ | অনলাইন সংস্করণ

সুভাষ সিংহ রায়
একটা পুরোনো গল্পের কথা অনেকেই জানি। সেই গল্পের এক মানুষ ছিল, নিজেকে মহাক্ষমতাবান মনে করতেন। মহাদাপুটে সে মানুষটি একবার ঘোড়ায় চড়ে গ্রাম দেখতে বেরিয়েছিলেন। একপর্যায়ে তিনি ঘোড়াটা এক জায়গায় বেঁধে রেখে দিয়ে হেঁটে ঘুরতে গিয়েছিলেন। দুই ঘণ্টা পরে এসে দেখেন তার ঘোড়াটা নেই। তখন তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি করতে লাগলেন। আর বারবার একই কথা বলতে থাকেন, আমাকে চেনে না, গতবারও আমার ঘোড়া হারিয়েছিল। দু-তিন ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর ঘোড়াটা অবশেষে পাওয়া গিয়েছিল। তখন এক অল্পবয়সী বালক সবার সামনে ওই মহাদাপুটে লোককে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনি যে বারবার বলছিলেন গতবারও আপনার ঘোড়া হারিয়ে ছিলেন। তখন আপনি কী করেছিলেন। লোকটি উত্তর দিয়েছিলেন, কেন, হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। এ পর্যন্ত ষাটতম বার আলটিমেটাম দেওয়ার পরও জনসমর্থনহীন আন্দোলন দিয়ে বিএনপি কী করবে? নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিএনপি হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি চলে যাবে। এই দলের একই পরিণতি হয়েছিল বিগত বছরগুলোতে। একটি দেশে সবসময় একটি দল সরকার পরিচালনায় থাকবে না। কিন্তু বিরোধী দলকে দেশ ও জনগণের উন্নয়নের কাজ করতে হবে। কিন্তু কোনো দেশের বিরোধী দল বিএনপির মতো হয়; যারা মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনাকে ধারণ করতে পারে না তখন দেশের রাজনীতিতে বেমানান হয়ে যায়। পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন কয়েক বছর ধরে ২০ দলীয় ঐক্যজোট বা চারদলীয় ঐক্যজোট নেই। অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত জোট নেই আবার তখন বলা হয়েছিল যুগপৎ আন্দোলনে আছে। কিন্তু এখন তারা স্বরূপে ফিরে এসেছে। অতএব জামায়াত-বিএনপি এখন একই বৃন্তের (বিষবৃক্ষ) দুটি ফুল।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যখন দেশের ভবিষ্যৎ রূপরেখা তৈরি করেন তখন বিএনপি দেশের অস্থিরতা তৈরি কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকে। কোন কোন পদক্ষেপ নিলে দেশের ক্ষতি হবে, সেই চিন্তাই তাদের সময় ব্যয় হয়। অর্থাৎ বিএনপির ভেতরে কোনো বাংলাদেশ বোধ জাগ্রত হয় না। চলতি মাসের ২৭ তারিখে ইশতেহার ঘোষণা করার সময়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে দেশ। এই উত্তরণ যেমন একদিকে সম্মানের, অন্যদিকে বিশাল চ্যালেঞ্জেরও। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সক্ষমতা থাকতে হবে।’

দলের নির্বাচনী ইশতেহারে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট ‘সোনার বাংলা’ গড়ার অঙ্গীকার করে আবারও নৌকায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিন। আপনারা আমাদের ভোট দিন, আমরা আপনাদের উন্নয়ন, শান্তি ও সমৃদ্ধি দেব। পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত ক্ষমতাসীন দলের এবারের ইশতেহারের স্লোগান, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’।

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ‘আর্থসামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা সংবিধান ও বঙ্গবন্ধুর সমাজ উন্নয়ন দর্শনেরই প্রতিফলন’ ঘটেছে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ একটি গতিশীল ও দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মর্যাদা লাভ করেছে। জাতীয় আয়ের মানদণ্ডে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৩তম অর্থনীতির দেশ। এ সময়ে দেশের কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন পণ্য ও সেবা উৎপাদন এবং সরবরাহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি বৃহৎ অভ্যন্তরীণ ভোক্তাবাজার সৃষ্টি হয়েছে। দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। মূলত সরকারের ধারাবাহিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখে চলছে।

বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত ১৫ বছরে গড়ে ৬.৩০ শতাংশ হারে বেড়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্লোগান ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির হার ৭.৮৮ শতাংশ অর্জিত হয়। ২০২০-২১ সালে বিশ্বব্যাপী কভিড অতিমারি বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, কভিড-১৯ চ্যালেঞ্জ এবং চলমান ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধাবস্থা, বিশ্ব অর্থনীতির শ্লথগতি ও মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশের দেশজ আয়ের প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে (৩.৪৫ শতাংশ), যা অর্থনীতির সহনশীলতা ও সক্ষমতার পরিচায়ক। পরবর্তী বছরগুলোতেও বাংলাদেশ কমবেশি ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়। ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশজ আয় ১১ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ে অর্থনৈতিক কাঠামোতেও গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর ঘটেছে। জাতীয় আয়ে কৃষির অবদান প্রায় ১১ শতাংশ, শিল্পের ৩৮ শতাংশ এবং সেবা ৫০ শতাংশ হয়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশ এখন কৃষিপণ্য রপ্তানি করছে।

দুই. একদিকে বিএনপি ও তার দোসররা যেমন আগামী নির্বাচন বানচাল করার জন্যে ভয়ানক চক্রান্ত করেই যাচ্ছে । অন্যদিকে বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা বেড়েই চলছে। আর মাত্র তিন-চার দিন বাদেই নির্বাচন এবং সর্বত্র নির্বাচনী আবহ বিরাজ করবে । নির্বাচনী ট্রেন আউটার সিগন্যালে এসে গেছে; সবুজ বাতি জ্বলছে। বিএনপি ও শরিকরা নির্বাচনী ট্রেন থামিয়ে দেওয়ার অসাংবিধানিক খেলায় নেমেছে। তারা ট্রেনে নাশকতা করে মানুষ খুন করছে। আবার বলছে তারা ‘অসহযোগ (?)’ আন্দোলন করছে। তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে জনগণ তাদের সঙ্গে অসহযোগিতা করছে। জনগণ ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। গত ২৭ ডিসেম্বর ইশতেহার প্রকাশ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আমরা প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছি। সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কারণে আমাদের নির্বাচন করতে হবে। আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে নির্বাচিত সরকারের হাতে, আমরা সেটিই বিশ্বাস করি। নির্বাচনে ভয় পাওয়ার কিছু নেই জানিয়ে তিনি বলেন, এ আগুন সন্ত্রাস জ্বালাও-পোড়াও বারবার দেখেছি। এসব ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাস মোকাবিলা করেই আমরা লাল-সবুজের পতাকা হাতে বিজয়ের বন্দরে পৌঁছাব ইনশাআল্লাহ। সেই লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’ ...শেখ হাসিনা আমাদের কাছে একজন ‘ইন্সপায়ারিং লিডার’। বাংলাদেশে গত ৪৮ বছরে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতার নাম শেখ হাসিনা, গত ৪৮ বছরে সাহসী নেতার নাম শেখ হাসিনা, গত ৪৮ বছরে দক্ষ প্রশাসকের নাম শেখ হাসিনা, গত ৪৮ বছরে সবচেয়ে সফল ডিপ্লোমেটিকের নাম শেখ হাসিনা। তিনি আরও বলেন, আইআরআই তাদের গবেষণা রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষ শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে। আমরা ভয় পাব কাকে? আমাদের জনগণ ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে।

দেশবিরোধী চক্র ক্রমাগতভাবে ভোট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অনবরত অসত্য অতথ্য অপথ্য দিয়ে যাচ্ছে। কদিন আগে এক নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, ‘কোনো না কোনো জায়গায় কারও না কারও প্রার্থিতা বাতিল হবে।’ অনেকেই খতিয়ে দেখেন না, বাংলাদেশে এর আগে নির্বাচন কমিশনকে এত শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেছেন, নির্বাচনী সহিংসতা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কারও কারও প্রার্থিতাও বাতিল করা হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন জেলা ঘুরে এসেছি, আমরা কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি, তা বাস্তবায়ন হচ্ছে। আজও কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছি। আগামীকাল আরও কিছু কঠোর সিদ্ধান্তে চলে যাব। হয়তো কোনো না কোনো জায়গায়, কারও না কারও প্রার্থিতা বাতিল হবে।’ একই ধরনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আরেক ইসি রাশেদা চৌধুরী। আর সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, কোনো কেন্দ্রে যদি একটি ভোটও কারচুপি হয়, তাহলে সেই কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হবে। উল্লেখ্য যে, দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ঝিনাইদহের শৈলকুপা ও হরিণাকুণ্ডু থানার ওসিকে প্রত্যাহার করেছে ইসি। গণমাধ্যম বলছে নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, ভোট দিতে যাবেন বেশিরভাগ মানুষ। এবার প্রতিটি আসনেই নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে। এ কারণেই ইসিকেও হতে হচ্ছে কড়া। এবার নির্বাচনে বিএনপির ৮৭ প্রার্থী বিভিন্ন আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের পাঁচ উপদেষ্টা ও বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির ১৫ সদস্যসহ ৩০ জন সাবেক সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। কেন্দ্রীয় নেতারা ছাড়াও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সভাপতি, সহসভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বিএনপির ৮৭ নেতা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বহু আসনে তারা শক্ত চ্যালেঞ্জ গড়ে তুলবেন বলে মনে হচ্ছে। উপরন্তু জাতীয় পার্টি ও ১৪-দলের শরিকদের সঙ্গেও অনেক আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে উঠবে। তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএমও অনেক আসনে শক্তিশালী প্রার্থী দিয়েছে।

এসব কারণে নির্বাচন যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণই হবে, তেমনি বিপুলসংখ্যক মানুষ ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যাবেন। লেখার পরবর্তী কিস্তি প্রকাশিত হবে আগামী ৭ জানুয়ারি রোববার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন। এই তিন-চার দিন বিএনপি-জামায়াত কী ধরনের জনবিরোধী ভূমিকা রাখে, তা দেখার বিষয় হয়ে থাকবে। বেশ কদিন আগে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম লিখেছিলেন, ‘দশ বছরের মধ্যে দু-দুটি নির্বাচন বর্জন করে পৃথিবীর কোনো রাজনৈতিক দল টিকে থাকতে পারেনি। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে কি টিকে থাকতে পারবে?’ আর দেখার বিষয় হয়ে রইল আগামী তিন-চার দিন বিএনপিকে কারা সহযোগিতা করবে?

সুভাষ সিংহ রায় : রাজনৈতিক বিশ্লেষক; সাবেক সহ-সভাপতি- বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল, প্রধান সম্পাদক- সাপ্তাহিক বাংলা বিচিত্রা ও এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম।

এই বিভাগের আরো সংবাদ