আজকের শিরোনাম :

উনসত্তরেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রাসঙ্গিক : আবদুল মান্নান

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০১৮, ১৩:৩১

ঢাকা, ২৩ জুন, এবিনিউজ : উনসত্তর বছর পূর্ণ করল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই দিনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিগত দিন ও বর্তমানের সব ত্যাগী নেতাকর্মীকে জানাই উষ্ণ অভিনন্দন। দলের অন্যতম প্রবাদপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। দলের দুর্দিনের কাণ্ডারি শেখ হাসিনা, যাঁর নেতৃত্বে শুধু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নয়, দেশ আরোহণ করেছে উন্নয়নের এক নতুন সোপানে, তাঁর প্রতি রইল টুপিখোলা অভিবাদন। উপমহাদেশের যে কয়টি পুরনো রাজনৈতিক দল এখনো সক্রিয় আছে, তার মধ্যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি আর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অন্যতম। ১৯০৬ সালে জন্ম হয়েছিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ। চারটি দলেরই জন্ম, বেড়ে ওঠা আর রাজনৈতিক জীবন, অর্জন ও সাফল্য-ব্যর্থতার ইতিহাস ভিন্ন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গোড়াপত্তন করেছিলেন ইংরেজ বেসামরিক আমলা অ্যালেন অক্টোবিয়াস হিউম ১৮৮৫ সালে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা ভারত দখলের প্রক্রিয়া শুরু করে। পরবর্তী সময় ১০০ বছর তারা ছলে-বলে-কৌশলে পুরো ভারতবর্ষ দখল করে নেয়। তাদের সেবা করার জন্য সৃষ্টি করে স্বল্পশিক্ষিত একটি কেরানি শ্রেণি। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের (ভারতের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ) পর ধীরে ধীরে ভারতীয়দের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটে। শিক্ষায়-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া ভারতীয়রা, বিশেষ করে বিত্তবান ও ভূমি মালিক জমিদার শ্রেণির ভারতীয়দের সন্তানরা স্কুল-কলেজে লেখাপড়া শুরু করে। ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠা হয় কলকাতা, মুম্বাই ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৭৫ সালে স্যার সৈয়দ আহম্মদ পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ (পরে আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি)। খুব দ্রুত ভারতে, বিশেষ করে উত্তর ভারত ও বঙ্গে সৃষ্টি হয় একটি পেশাদার শ্রেণি। এদের মধ্যে আইন ও চিকিৎসাসেবা  অন্যতম। একই সঙ্গে ধীরে ধীরে আমলাতন্ত্র ও প্রশাসনে বেশ কিছু ভারতীয় মেধার বলে নিজেদের জন্য স্থান করে নেন।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই পেশাদাররা এ সময় নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কিছুটা হালকাভাবে সংগঠিত হতে শুরু করেন। বলা যেতে পারে, হালকাভাবে তাঁরাই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম দেন। চতুর ইংরেজরা বুঝতে পারল তাদের নিজেদের আয়ত্তে রাখতে নিজেদের উদ্যোগে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে তাদের সেখানে জড়ো করতে পারলে ভবিষ্যতে তারা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে যাবে না বা সিপাহি বিদ্রোহের মতো কোনো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাও থাকবে না। পরবর্তী সময় সেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস হয়ে ওঠে ভারতের স্বাধীনতার মূল কণ্ঠস্বর। কংগ্রেসের নেতৃত্বেই ভারত স্বাধীন হয়। কংগ্রেস এখনো ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন। ১৯৪৭ সাল-পরবর্তী সময় স্বাধীন ভারতে সবচেয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। দলটি বর্তমানে অনেকটা নেতৃত্বের দুর্বলতায় ভুগছে। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের পর ১৯২০ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি যাত্রা শুরু করে। তবে কমিউনিস্ট পার্টি রাজনৈতিক দলের চেয়েও বেশি ছিল কমিউনিস্ট মতবাদ প্রচার করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম। ১৯০৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ, ঢাকার নবাব পরিবারের উদ্যোগে। স্যার সলিমুল্লাহ ছিলেন এর অন্যতম উদ্যোক্তা। ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ হলে তা বাংলার উচ্চবিত্ত আর জমিদার শ্রেণি সহজে মেনে নিতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক। বঙ্গের বেশির ভাগ জমির মালিক ছিলেন হিন্দু জমিদাররা, আর প্রজা ছিল মুসলমানরা। মুসলিম লীগ যদিও নবাব পরিবার ও উচ্চবিত্তদের একটি প্ল্যাটফর্ম ছিল, তারা বাংলা ভাগের সমর্থক ছিল। কারণ তারা মনে করেছিল হিন্দু জমিদারদের স্থান তারাই দখল করতে পারবে। তাদের চিন্তায় মোটেও বাঙালি মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ ছিল না। ১৯১১ সালে বাংলাকে বিভাজনের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। এরপর মুসলিম লীগের নেতৃত্ব চলে যায় উত্তর ভারতের ‘খানদানি’ উচ্চবিত্ত রাজরাজড়া আর রইসদের হাতে। তারাও মুসলিম লীগকে ব্যবহার করে তাদের ভাষায় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। জন্ম হয় মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির দাবিতে পাকিস্তান আন্দোলনের। আসল উদ্দেশ্য মূলত শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া নিম্নবিত্ত মুসলমানদের শোষণ করা। হিন্দু জমিদারদের স্থলে মুসলমান জমিদারদের স্থলাভিষিক্ত করা।

যেহেতু পূর্ববঙ্গেই মুসলিম লীগের  জন্ম সেহেতু মুসলিম লীগ সব সময় বঙ্গে শক্তিশালী ছিল। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে, যেটিকে বলা হয় পাকিস্তানের পক্ষে রেফারেন্ডাম, সেই নির্বাচনে সারা ভারতবর্ষে শুধু অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়। এর কারণ ছিল, বাংলার মুসলমানরা মনে করেছিল পাকিস্তানের জন্ম হলে তাদের ভাগ্য খুলে যাবে। বর্তমান পাকিস্তানের কোনো প্রদেশই তখন মুসলিম লীগের পক্ষে সমর্থন জানায়নি। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসিম, শেরেবাংলা এ কে ফজজুল হকসহ পরবর্তী সময় যাঁরা আওয়ামী লীগের জন্ম দিয়েছিলেন তাঁরা সবাই মুসলিম লীগকে জয়ী করতে নিরলস পরিশ্রম করেছিলেন, যদিও তাঁদের একটা জোরালো দাবি ছিল অবিভক্ত বাংলা একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হোক। তখন শেখ মুজিব কলকাতায় একজন রাজপথের সাধারণ কর্মী ছিলেন। স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা অনেকটা জিন্নাহর অদূরদর্শিতার কারণেই সম্ভব হয়নি। বাঙালি মুসলমানরা তার পরও হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে এক পাকিস্তানের ধারণাটা মেনে নিয়েছিল, যদিও এটি ছিল ১৯৪০ সালে লাহোরে উত্থাপিত মুসলমানদের জন্য একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টির ঘোষণার পরিপন্থী। মেনে নিয়েছিল এই কারণে যে তাদের ধারণা ছিল পাকিস্তান স্বাধীন হলে তার পূর্বাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যেরও পরিবর্তন হবে। কিন্তু তাদের ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের বড়লাট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা এসে ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু, যা কি না পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ছয় ভাগ মানুষের ভাষা। এটি করা হয়েছিল ভারত তথা উত্তর প্রদেশ থেকে আসা উর্দুভাষীদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। জিন্নাহর এই ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, যাদের মধ্যে তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবও ছিলেন। বস্তুতপক্ষে ১৯৪৮ সালেই শুরু হয় বাঙালির জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের সূত্রপাত। আন্দোলন করতে হলে চাই সংগঠন। তরুণ ছাত্রনেতা সৃষ্টি করলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ইতিহাসের আলোয় ছাত্রলীগই ছিল সাতচল্লিশ-পরবর্তী সময় সরকারবিরোধী প্রথম ছাত্রসংগঠন। ১৯৪৯ সালের ২২ জুন  জন্ম হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আর সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। তিনজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের একজন শেখ মুজিব। শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায় ও সেই লক্ষ্যে পাকিস্তানের এই অংশসহ প্রত্যেক প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন।

১৯৪৯ সালে যে দলটি যাত্রা শুরু করেছিল সেই দলটি নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে আজ বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। যেই দলটির জন্মলগ্নে শেখ মুজিব জড়িত ছিলেন, পরবর্তী সময় তিনি হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু, বাংলার বন্ধু এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা। এই দলটি পাকিস্তান আমলে নিষিদ্ধ হয়েছে একাধিকবার। ভেঙেছেও একাধিকবার। ১৯৫৪, ১৯৫৬ বা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয় লাভ করেও হয় ক্ষমতায় যেতে পারেনি অথবা ক্ষমতায় গেলে তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। স্বাধীন বালাদেশে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন সাড়ে তিন বছর। সেই সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপিরাবের হত্যা করার পর দেশ আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বর্তমানে তাঁরই নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বের জন্য উন্নয়নের এক রোল মডেল। এটি সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের আস্থা আর তার একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর কারণে।

১৯৬৬ সালে যখন বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন, তখন ভেতর থেকেই তার বিরোধিতা হয়। দলের সভাপতি আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ দল থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর ছয় দফার ব্যাপারে আপসহীন থাকেন। সেই ছয় দফাই হয়ে ওঠে বাঙালির নবজাগরণের নতুন সোপান। পাকিস্তান সেনা শাসক জেনারেল আইয়ুব খান বলেন, ছয় দফা হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার বড় ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর নামে রুজু করা হয় দেশদ্রোহী মামলা, যা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত।  এই মামলার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ১৯৬৯ সালের ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের তোড়ে উড়ে যায় তথাকথিত সেই ষড়যন্ত্র মামলা। মুক্ত হন বঙ্গবন্ধু। হয়ে ওঠেন শুধু বাঙালির নয়, সারা বিশ্বের নির্যাতিত গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা। বলা যেতে পারে, তাঁর ছায়াতলে তখন সারা পাকিস্তানের রাজনীতি আর ভবিষ্যৎ। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই মনে করা হতো পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপ্রতিরোধ্য। বাস্তবে সেই ১৯৫৪ সাল থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর তার আমলাতন্ত্র জনগণের শাসক হয়ে বসেছিল। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের হর্তকর্তা বিধাতা ছিল সেই দেশের সেনাবাহিনী। সেই সেনাবাহিনীকে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। সেনা শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের নির্বাচন ঘোষণা করেন। এটি ছিল পাকিস্তানের উভয় অংশে অনুষ্ঠিত প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন। বিজয়ীদের একমাত্র দায়িত্ব পাকিস্তানের জন্য এমন একটি সংবিধান রচনা করা, যা ইয়াহিয়া খানের মনঃপূত হয়। এ জন্য জারি করা হয় ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক’ নামের এক ফরমান। সংবিধান জেনারেল সাহেবের পছন্দ না হলে তিনি তা ছিঁড়ে ফেলে দেবেন। জেনারেল সাহেব বলে কথা! অনেকে বললেন, এই ফরমানের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া হবে আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী। তখন পাকিস্তানের অন্যতম রাজনৈতিক দল মওলানা ভাসানীর ন্যাপ। মওলানা বললেন, এই নির্বাচন তিনি বর্জন করবেন। স্লোগান তুললেন, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো’, ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। বঙ্গবন্ধু বেশ আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে বললেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার হবে ছয় দফাভিত্তিক। একবার সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় লাভ করলে ইয়াহিয়ার সেই ফরমান তিনি ছুড়ে ফেলে দেবেন। বললেন, ‘আমার শক্তি এই দেশের জনগণ, বন্দুকের নল নয়।’ পাকিস্তান সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ইয়াহিয়াকে অনেক হিসাব-নিকাশ করে জানাল, আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে বড়জোর ৮০টি আসনে জিতবে, আর ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৬০ থেকে ৭০টি আসনে বিজয় লাভ করবে। শেষ পর্যন্ত পিপলস পার্টির হিসাবটা ঠিক হয়েছিল। আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় ১৬৯টি আসনের মধ্যে জিতেছিল ১৬৭টি আসনে। ভেস্তে গেল সব হিসাব-নিকাশ আর ষড়যন্ত্র। তারপর ৯ মাস ধরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

বাংলাদেশে যখনই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয় লাভ করেছে, সরকার গঠন করেছে, তখনই বাংলাদেশের মানুষ লাভবান হয়েছে। আর যখন ক্ষমতায় ছিল না তখন শুধু দেশের মানুষ নয়, দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সত্তরের নির্বাচনের পর এই দেশের মানুষ একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সাড়ে তিন বছর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়াতে শিখেছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরবর্তী ২১ বছর জিয়া ও এরশাদের শাসনামলে দেশ অন্ধকার থেকে অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। পরবর্তী পাঁচ বছর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু-উত্তর বাংলাদেশে প্রথমবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে দেশ আবার উন্নয়নের সড়কে উঠতে পেরেছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে। ২০০১ সালে আবার বেগম জিয়া ক্ষমতায় এলে তখন সত্যিকারভাবে বাংলাদেশ একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তর হয়। দেশে উত্থান হয় আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের। দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। গ্রেনেড মেরে প্রতিপক্ষের নেতাকে হত্যাচেষ্টার সংস্কৃতি চালু হয়। বিশ্বের কাছে তখন বাংলাদেশের পরিচয় দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের স্বর্গরাজ্য। ২০০৮ সালে আবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। এখন বাংলাদেশ সারা বিশ্বে একটি উন্নয়নের মডেল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় লাভ করেছে। জয় করেছে সমুদ্র আর আকাশ। মধ্যম আয়ের দেশের প্রথম সোপানে পা রেখেছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এই মুহূর্তে বিশ্বের কাছে শুধু একজন প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি একজন অনুকরণীয় রাষ্ট্রনায়ক। নিয়মিত ডাক পড়ে ধনী রাষ্ট্রগুলোর সভায় তাঁর দেশের উন্নয়নের গল্প শোনাতে। এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে জনমানুষের সমর্থন নিয়ে অওয়ামী লীগকে আগামীতেও ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করতে হবে। তবে একটু শঙ্কার কথা না বললেই নয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত। আর তা হচ্ছে দলে অনুপ্রবেশকারী, যারা আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের তোয়াক্কা করে না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য দলের নাম বিক্রি করে নিজের আখের গোছানো। ধান্ধাবাজি এদের একমাত্র পেশা। সংক্রামক এ ব্যাধিটি শুধু যে মূল দলে আছে তা নয়, দলের প্রতিটি অঙ্গসংগঠনেও এই ব্যাধির সংক্রমণ ঘটেছে। সময় থাকতে সচেতন না হলে বিপদ অনিবার্য। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জয়ন্তীতে প্রার্থনা করি, তাদের আগামী দিনের পথচলা সব রকমের বাধামুক্ত হোক। স্বাধীনতার  নেতৃত্বদানকারী এই দলের হাত ধরেই পালিত হোক স্বাধীনতার ৫০ বছর ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ। বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে উঠে যাক। কাজটা অসম্ভব নয়। শুধু অনুপ্রবেশকারীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে আর দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্ত হতে হবে। জয় বাংলা। (কালের কণ্ঠ)

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

এই বিভাগের আরো সংবাদ