আজকের শিরোনাম :

হারিয়ে যাওয়া এক মুক্তিযোদ্ধার গল্প

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০১৮, ২০:২৭ | আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০১৮, ২০:৩৭

হারিয়ে যাওয়া এক মুক্তিযোদ্ধার নাম মো: আব্দুল কদ্দুস। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হলেও; বীরমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকায় নাম নেই। অথচ তাঁর আছে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল আতাউল গণি ওসমানীর অরিজিনাল সনদ।

এছাড়াও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং সহযোদ্ধা হিসেবে ১১নং সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল তাহেরের প্রত্যয়নপত্র আছে। জামালপুর-শেরপুর জেলার প্রথম অপারেশনে অংশ নেয়া ৭জনের মধ্যে তিনিও একজন। মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত হতে অর্থ লেনদেন এবং অনেক তীক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভূক্ত হতে অর্থ লেনদেনকে ঘৃনার চোখে দেখেছেন। মনের ক্ষোভ-দু:খ নিয়ে দেশ স্বাধীনের পরও টানা ৪৬ বছর অভিমান করে নিজে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়টি গোপন রেখেছেন। তাঁকে নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন।

কদ্দুস জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া গ্রামের মরহুম ভানু মন্ডলের ছেলে। ১৯৫১ সালে ৬অক্টোবর তাঁর জন্ম।

নিজেকে আড়াল করে থাকার একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হারিয়ে যান টানা ৪৬ বছর। অবশেষে সন্ধান পান সহযোদ্ধা আবুলের। পরে অপরাপর সাথীদের খবর নিতেই জানেন আরেক সহযোদ্ধা মজিবর ফারাজী ও আসাদুল্লাহর মৃত্যুর খবর। এ সময় তাদের মাঝে নেমে আসে এক শোকগাঁথা অশ্রুহার। যেন দীর্ঘদিন পর ফিরে পাওয়া টাইটানিকের নায়ক-নায়িকার মহামিলনের হৃদয় বিদারক দৃশ্য।

কথোপকথন হয় দেশ রক্ষায় ত্যাগের কথা। মান অভিমানের অবসান ঘটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য ২০১৭ সালে অনলাইনে আবেদন করেছিলেন। ইতোমধ্যেই বাছাই কমিটি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কদ্দুসকে স্বীকৃতির জন্য উর্ধ্বতন মহলে প্রেরণ করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে তিনি বলেন-১৯৬৭ সালে আমি জামালপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে নকল নবিশের চাকরীতে যোগদান করে লেখাপড়ার খরচ যোগাই। ১৯৭১ সালে আমি জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজের বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। সারাদেশ থমথমে। যুদ্ধ শুরু হবে হবে ভাব। ইতোমধ্যেই পাকসেনারা জামালপুরে শেল নিক্ষেপ করল। শহরজুড়ে আতংক। আমি জামালপুরের বগাবাইদ নিজ বাসায় থাকি।

শহর ছেড়ে জন্ম স্থান ঘোষেরপাড়ায় যাই। বঙ্গবন্ধু ভাষণের মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্ধুদ্ধ হই। মে মাসে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি, আসাদুল্লাহ (পরবর্তীতে কমান্ডার), কাহেতপাড়ার শাহজাহান সংঘবদ্ধ হলাম। তখনো আমাদের ইউনিয়নের কেও মুক্তিযুদ্ধে যায় নাই। রাতের অন্ধকারে পায়ে হেটে ডিগ্রিরচর-সারমারা হয়ে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে প্রবেশ পথে বিএসএফ’র হাতে আটক হই। মহেন্দ্রগঞ্জ থানায় একরাত আটকে রাখা হয়। সন্দেহমূলক আমাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। থানায় আরো অনেক বাঙ্গালীকে আটক থাকতে দেখি।

পরদিন সকালে মেলান্দহের আ: হাই বাচ্চু মিয়া, মাদারগঞ্জের করিমুজ্জামান তালুকদার, ইসলামপুরের রাশেদ মোশারফ (পরবর্তীতে ভূমিমন্ত্রী) এবং জামালপুরের আ: হাকিম আটককৃতদের খবর নিতে থানায় যান। তারা আমাদের সনাক্ত করে শরণার্থী ক্যাম্পে নিলেন। শরণার্থী ক্যাম্পে ২দিন থাকি। এ সময় এই লিডাররা বিএসএফ’র সাথে মিটিংএ বসলেন। মিটিং হয় বিএসএফ’র ডাকবাংলোতে। সেখানে আমরাও শতাধিক লোক উপস্থিত ছিলাম। সিদ্ধান্ত হল বিএসএফ’র ক্যাম্পের পূর্ব পাশের পাহাড়ের টিলা পরিস্কার করে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। বিকেল ৬টার দিকে তাঁবু আসল।

বিএসএফ’রা গাড়ি দিয়ে ৩টি পাতিল, চাল-ডাল-লবন-মরিচ দিয়ে গেল। রাতে সেখানেই থাকলাম। পরদিন সকালে জঙ্গল পরিস্কার করতেছি। এ সময় কচু পাতা রংয়ের বড় একটি সাপ মারা পড়ল। খবর পেয়ে বিএসএফ’র হাবিলদার ধন বাহাদুর সনাক্ত করলেন; এটি বিষাক্ত সাপ। ওই দিনই ধনবাহাদুর ঘোষণা দিলেন; আগামী কাল আমাদের অস্ত্র ট্রেনিং করাবেন। পরদিন ১৭ মে/৭১। ৫০/৬০ জন জোয়ানদের রিক্রুট করালেন। কিন্তু আমার ২সাথীর মধ্যে শাহজাহানের বয়স কম থাকায় তাকে বাড়িতে ফেরৎ পাঠানো হল। ট্রেনিং করালেন ভারতের ধনবাহাদুর এবং বাঙ্গালী সার্জেন্ট বজলুর রশিদ। তাঁর বাড়ি মাদারগঞ্জে। প্রায় ২০/২৫ দিন ট্রেনিং চলে। আমাদের থ্রি-নট থ্রি রাইফেল মার্ক-৪, হ্যান্ড গ্রেনেট ট্রেনিং করানো হয়।

ট্রেনিং চলাকালে পরিচয় হয় সহযোদ্ধা মেলান্দহের আবুল হোসেন, মজিবর ফারাজী, আ: রেজ্জাক, ইসলামপুরের সুলতান, নূরুল হক, জামালপুরের আলতাফুর রহমান, মাদারগঞ্জের মুক্তা, হিরু, আজিজ, তাপস, হুরমুজসহ আরো অনেকের সাথেই। এ সময় জানতে পারি আমাদের আগে প্রথম ব্যাচ ট্রেনিং করে চলে গেছে। আমরা দ্বিতীয় ব্যাচের।

প্রথম অপারেশ:
ট্রেনিং শেষে সম্ববত: ২৩ জুন/৭১। ইসলামপুরের মানিকুল ইসলাম মানিক, চন্দ্রার আলম, ধনবাড়ির রইচ ক্যাম্পে এসে মেলান্দহের কে আছেন? খুজলেন। মেলান্দহের আমি, আবুল হোসেন, আসাদুল্লাহ, মজিবর ফারাজীসহ আরো অনেকেই পরিচয় দিলাম। তাঁরা আমাদের ক্যাম্পে রেখেই হাবিলদার ধনবাহাদুরের সাথে কথা বলতে গেলেন। ধনবাহাদুর আবার ক্যাপ্টেন নিয়োগীর সাথে কথা বল্লেন।

ক্যাপ্টেন নিয়োগী জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার দাগী-বানিপাকুরিয়ার রেলওয়ের ৭নং ব্রিজ ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত দিলেন। ফিরে এসে তাঁরা আমাকে এবং আবুল হোসেন, মজিবর ফারাজী, আসাদুল্লাহ ৪ জনকেই বাছাই করলেন। ক্যাম্পের পশ্চিম দিকে বর্ডার এলাকা আরেক ডিগ্রিরচর আছে। সেখান থেকে মানিকুল ইসলাম মানিক, আলম, রইচ উদ্দিন এবং আমাদের ৪ জনকে সাথে নিয়ে সন্ধ্যায় নৌকাযোগে রওয়ানা দিলেন। বের হবার আগে ক্যাপ্টেন নিয়োগী বোমা বিস্ফোরণের জন্য নিয়ম কানুন হাতে কলমে বুঝিয়ে দিলেন। রইচ উদ্দিন বোমা সেটিং ও বিস্ফোরণের বিষয়ে দক্ষ ছিলেন। রইচকে পেয়ে আমরা সাহসী হলাম। আমাদের টিমে হাতিয়ার ৩টি এবং বোমা দেয়া হলো ৪টি। লোক সংখ্যা ৭জন।

পথিমধ্যে সাথী আবুল হোসেনের ক্লাসম্যাট বালুরচরের আব্দুল্লাহর বাড়িতে একরাত অবস্থান করলাম। পরের দিন সেখান থেকে ব্রিজ ভাঙ্গার জন্য আবুল, মজিবর ফারাজী, আলম ও আমি রেখি করতে আসি। ওই রাতেই আমরা বোমা সেট করে ব্রিজ ভাঙ্গি। এটি জামালপুর জেলার প্রথম সফল অপারেশন। ক্যাম্পে এসে জানতে পারি এই সফল অপারেশনের খবরটি বিবিসিতে প্রচার হয়েছে।

অপারেশন শেষে আমি ও আসাদ বাড়িতে চলে আসি। বাকিরা ক্যাম্পে চলে যায়। বিলম্বে ক্যাম্পে আমরা ঝাড়কাটা নদী থেকে শরণার্থীদের নৌকায় ভারতের উদ্দেশ্যে ২য় বার যাত্রা করি। কিছুদুর যাবার পর ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩টি নৌকা টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। আমাদের ও তাদের পরিচয়ের জন্য নৌকাগুলো মুখোমুখি হয়।

মুক্তিযোদ্ধার নৌকায় আমার সঙ্গী ছাত্র সরিষাবাড়ির আমিনুর তালুকদারকে দেখে খুশি হলাম। নৌকায় বর্তমান আশেক মাহমুদ কলেজের প্রফেসর শফিকুল ইসলামও ছিলেন। তাঁরা বল্লেন-আমাদের সাথে চলো। পথিমধ্যে শফিকুল ইসলামের হাতিয়ারটি আমাকে দিয়ে দিলেন এবং তিনি টাঙ্গাইলে নাগিয়ে তাঁর নিজ গ্রাম কাহেতপাড়ায় চলে গেলেন। আমি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে টাঙ্গাইল যুদ্ধের উদ্দেশ্যে গেলাম। কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন-আমিনুর নিজেই।

কিছুদুর যাবার পর দেখি ভূয়াপুরের মাটিকাটা এলাকায় যমুনা নদীর পাশে দু’টি জাহাজ আটকা পড়েছে। জাহাজ দু’টি পাকিস্তান সরকারের। আমরা জাহাজ দু’টির খবরদারিতে থাকলাম। জাহাজে বাঙ্গালী কর্মচারী মারফত জানতে পেলাম-পাকিস্তানী জাহাজটি যুদ্ধের জন্য অস্ত্র নিয়ে যাবার পথে জাহাজ দু’টি যমুনার চরে আটকা পড়েছে।

এ খবর জানার পর জাহাজে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেই। এরপর জাহাজের তলা ছিদ্র করে যমুনায় তলিয়ে দেই। খবর পেয়ে পরের দিন পাকসেনারা এলাকায় বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে লাগল। ওদিকে জাহাজ ধ্বংশ করেই হেমনগরের দিকে চলে আসি। আমাদের সঙ্গে সিরাজুল হকও। তিনি পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের স্বাস্থ্য উপ-মন্ত্রী হয়েছিলেন। আমিনুর ও আলম কোম্পানীর অনেকেই হেমনগরে আশ্রয় নিয়েছি। একপর্যায়ে পাকসেনারা হেমনগর জমিদার বাড়িতে আক্রমন করলো। টানা এক ঘন্টা পাকবাহিনীর সাথে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকসেনাদের হতাহতের খবর পাইনি। তবে আমাদের সাথী নালিতাবাড়ির আহমদ সুফি আহত হন। যুদ্ধ থেমে গেলে কিছু যোদ্ধা আহত সুফিকে নিয়ে ভারতে চলে গেলেন।

আমি ও সিরাজুল হকসহ ১০/১৫জন সহযোদ্ধা সরিষাবাড়ির রঘুনাথপুরের লুৎফর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। সেখানে তিন দিন থাকার পর সিরাজুল হক আমাকে ও খন্দকার জালাল উদ্দিনকে একটি মাইন দিলেন। মাইনটি জামালপুর গোরস্থানে সেট করার নির্দেশ দিলেন। তখন জামালপুর থেকে দেওয়ানগঞ্জগামী রেলগাড়ি দিয়ে পাকবাহিনীরা যাতায়াত করতো। উদ্দেশ্য মাইন দিয়ে পাকবাহিনীর বহর উড়িয়ে দিতে হবে। সরিষাবাড়ি থেকে মাইন নিয়ে বগাবাইদ সিরাজুল হকের মামা এমদাদুল হক খানের বাসায় রাত যাপন করি।

সিরাজুল হকের ছোট ভাই আজিজুল হক সওদাগরের সহায়তায় আব্দুল মজিদ শেখ, মীর ফরহাদ, চন্দ্রার লায়নকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করি। তাদের পরামর্শক্রমে রাতেই গোরস্থানে মাইন সেট করি। তাড়াহুড়া করে মাইন পুঁতা হয়। কিন্তু ভুলবশত: মাইনের উপরের ক্যাপটি লাগানো হয় নি। ফলে পাকবাহিনীর গাড়ির বহর চলাকালে মাইনটি বিস্ফোরিত হল না।

এরপর ভারতের মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে ফিরে গেলাম। ক্যাম্পে বিলম্বে যাবার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর আমাকে নতুন করে রিক্রট করা হল। পরদিন কর্ণেল তাহেরের অধিনে ধানুয়া কামালপুরে যুদ্ধে প্রেরণ করা হল। প্রতি দলে ৩০ জন করে মোট ৪দলে বিভক্ত করে সৈন্য পাঠানো হলো। আমরা থাকলাম এমেশ্বাস পার্টিতে। কামালপুরে ভোর থেকেই সম্মুখ যুদ্ধ চলছিল। প্রায় ১ঘন্টা যুদ্ধ চলে। আতংকের মধ্যে হতাহতের হিসেব নেয়ার সুযোগ নেই। সকালে ক্যাম্পে চলে আসি।

পরের দিন আমিনুর কোম্পানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাঠানো হলো। যুদ্ধ সাথী ছিল ৩০ জন। ওই দিন ৬ডিসেম্বর/৭১। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার খবর পেলাম। নির্দেশ এলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করার। এরপর নাছির কোম্পানী, মুক্তা কোম্পানীসহ বিভিন্ন কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করে জামালপুরমুক্ত করার মিশন নিয়ে যাত্রা করি। মিত্রবাহিনীর সহায়তায় সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবেলা করে ১১ডিসেম্বর জামালপুরমুক্ত হলো।

দেশ স্বাধীনের পর আমাদের জামালপুর স্টেডিয়ামে ক্লোজ করা হয়। সেখানে একসপ্তাহ থাকার পর ক্যাপ্টেন মান্নানের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে যার যার বাড়িতে চলে যাই। এরপর আবার নকলনবিশে যোগদান করি। ব্যক্তি জীবনে তিনি ২ মেয়ের জনক। বড় মেয়ে কাবেরি জান্নাত কান্তা ইংরেজীতে মাস্টার্স পাশের পর ইঞ্জিনিয়ার ফেদৌস আহমেদ সুমনের কাছে বিয়ে দেন। ছোট মেয়ে কামনাতুন্নাহার কনক বিএ অনার্সে পরিক্ষার্থী।

এবিএন/শাহ জামাল/জসিম/রাজ্জাক

এই বিভাগের আরো সংবাদ