আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

আম, ধান, পোল্ট্রিতে কী ক্ষতি করছে এই গরম

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:০৮

বাংলাদেশে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলা তাপপ্রবাহ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের পাশাপাশি কৃষি ও পোল্ট্রি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

সারাদেশে হিট স্ট্রোকসহ গরম জনিত কারণে প্রতিদিন প্রায় ১০ শতাংশ মুরগির মারা পড়ছে বলে জানাচ্ছে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন। ডিম উৎপাদন কমেছে প্রায় ৫ ভাগের এক ভাগ।

পুষ্ট হওয়ার আগেই গাছ থেকে ঝরে যাচ্ছে গ্রীষ্মের অন্যতম ফল আম। বোরো ধানের উৎপাদনেও বিরূপ প্রভাবের শঙ্কা আছে কৃষিবিজ্ঞানীদের।

এর মধ্যে আরও তিন দিন মেয়াদ বাড়িয়ে চতুর্থ দফায় হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদফতর।

এত উচ্চ তাপমাত্রা কীভাবে ও কী ধরনের ক্ষতি করতে পারে ফল, ফসল ও পোল্ট্রির? অত্যধিক গরমের সঙ্গে পাল্লা দিতে কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশের কৃষি খাত?

ধানগাছের ‘হিট শক’
‘মানুষ যেমন অধিক গরমে হিট স্ট্রোক করে, তেমন ধানের ক্ষেত্রে এ পরিস্থিতিকে আমরা হিট শক বলছি,’ বলছিলেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ড. আরমিন ভূইয়া।

ইনস্টিটিউটের জেনেটিক রিসোর্স অ্যান্ড সিড ডিভিশনে কর্মরত আরমিন ভূইয়া জানান, ধানগাছে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে হিট শকের মাত্রা ধরা হয়। তাপপ্রবাহ ৩৫ ডিগ্রি বা এর বেশি হলে এবং সে সময় বৃষ্টি না হলে ধানগাছে হিটশক হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

উচ্চ তাপমাত্রা থেকে বাঁচার জন্য ধানগাছ ‘নিজস্ব কুলিং সিস্টেম’ তৈরি করে।

মাঠে পানি থাকলে সেটা ব্যবহার করে উদ্ভিদটি নিজের তাপমাত্রা তিন-চার ডিগ্রি কমিয়ে রাখার চেষ্টা করে, বলেন ড. আরমিন ভূঁইয়া।

কিন্তু, তাপমাত্রা বেশি থাকলে গাছ থেকে প্রচুর পানি বেরিয়ে যায় এবং হিট শকের শিকার হয়।

বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন ধরে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির ওপরেই অবস্থান করছে। এ সময় বৃ্ষ্িট হয়নি বললেই চলে।

যে কারণে চলতি বোরো মৌসুমে ক্ষতির আশঙ্কা কৃষিবিদদের।

বাংলাদেশে মোট যে ধান উৎপাদিত হয় তার একটা বড় অংশ উৎপাদিত হয় বোরো মৌসুমে।

হিট শক ছাড়াও গরমে ধানের আরেকটি ক্ষতির আশঙ্কার নাম ‘চিটা’।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ক ম গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘যেসব খেতে ধান ইতোমধ্যেই পরিপক্ক হয়ে গেছে সেখানে চিটা হবে না। তবে, যারা একটু দেরিতে ধান রোপণ করেছেন তাদের জমিতে চিটা দেখা দিতে পারে।’

ড. আরমিন ভূঁইয়া বলেন, ধান গাছে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্বাভাবিক পরাগায়ন হয়, তখন তাপমাত্রা বেড়ে গেলে পোলেন (রেণু) শুকিয়ে পরাগায়ন ব্যাহত হয়।

‘এতে চিটার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে,’ যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক গোলাম সারওয়ার বলেন, চিটা পড়ার হার নির্ভর করবে তাপমাত্রা কত বাড়ছে বা কতদিন ধরে উচ্চ মাত্রায় থাকছে তার ওপর।

আমের জন্য গরম ভালো, তবে বৃষ্টিও চাই
গ্রীষ্মে আম, জাম, কাঠালসহ বিভিন্ন ফলের সমাহার দেখা যায় বাংলাদেশে। এসব ফলের মধ্যে বহুল সমাদৃত আমের ফলনও বিঘ্নিত হচ্ছে বৃষ্টিহীনতায়।

কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, আম পরিপুষ্ট হওয়ার জন্য বৈশাখের গরম আবহাওয়ার বিশেষ উপযোগিতা রয়েছে।

‘এপ্রিল-মে মাসে অন্যান্য বছরও তাপমাত্রা ৩৭-৩৮এ ওঠে। এবার তারচেয়ে একটু বেশি হলেও খুব একটা ক্ষতিকর হতো না যদি একই সাথে বৃ্ষ্িটও হতো,’ বলছিলেন রাজশাহীতে অবস্থিত ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুল ইসলাম।

বৃষ্টির অভাবে মাটি শুষ্ক থাকায় প্রয়োজনীয় পানি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমগাছ।

‘এতে বোটায় একটি বিশেষ স্তর তৈরি হয়, যা বোটাকে দুর্বল করে ফেলে।’

এতে অপুষ্ট অবস্থায় আম ঝরে যাচ্ছে।

শফিকুল ইসলামের শঙ্কা, দীর্ঘ তাপপ্রবাহ ও বৃষ্টির অভাবে এবার কাঙ্ক্ষিত ফলন থেকে বঞ্চিত হতে পারেন আমচাষিরা।

মুরগি মারা যাচ্ছে, ডিমও কমছে
মুরগি পালনে অনুকূল তাপমাত্রা ১৭ থেকে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু, বাংলাদেশে চলতি মাসের তাপমাত্রা এর প্রায় দ্বিগুণ।

ফলে প্রতিদিনই স্থানীয় গণমাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মুরগির মৃত্যুর খবর আসছে।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য, সারাদেশে প্রতিদিন সাত থেকে দশ শতাংশ ‘চিকেন পপুলেশন’ মারা যাচ্ছে। ডিম উৎপাদন কমেছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।

অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য অঞ্জন মজুমদার বলেন, ‘ডিম পাড়া বা পরিণত বয়সের মুরগি হিট স্ট্রোকের শিকার হয় বেশি। এতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায় অনেক।’

‘বড় মুরগি মারা গেলে প্রায় সাত-আটশ টাকার ক্ষতি হয়,’ যোগ করেন মজুমদার।

বড় খামারগুলোয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বজায় রাখা হয়। তাই তাপমাত্রার হেরফেরে সেখানে কোনো সমস্যা হয় না।

‘কিন্তু, বাজারের আশি শতাংশই প্রান্তিক খামারিদের ওপর নির্ভরশীল যাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের বিশেষ ব্যবস্থা নেই।’

বাংলাদেশ সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে জানা যাচ্ছে, অতিরিক্ত তাপের ফলে মুরগির বিপাকক্রিয়া ভালো হয় না। যার ফলে মুরগির খাদ্যের প্রতি অনীহা দেখা যায়।

ঠিকমতো খাবার গ্রহণ না করায় মুরগির বৃদ্ধি কমে যায়, ডিম উৎপাদনও হ্রাস পায়, বলেন অঞ্জন মজুমদার।

প্রতিকূল আবহাওয়া মোকাবেলার প্রস্তুতি কী?
ঠিকমতো সেচ বা পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে চলতি মৌসুমেও ফসলে গরমের প্রভাব এড়ানো সম্ভব বলে দাবি দুই ইনস্টিটিউটের দুই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার।

‘প্রকৃতির সাথে তো পেরে উঠবো না, নিজেদের ব্যবস্থাপনাটা ঠিকমতো করতে হবে। ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই দু-তিন ইঞ্চি পানি রাখতে হবে,’ বলেন ড. আরমিন ভূইয়া।

কিন্তু, ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশ কতটা উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিচ্ছে?

ড. ভূইয়া জানাচ্ছেন, ধান গবেষণা ইনস্টটিউট এ পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ১০৮টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে।

এর মধ্যে খরা সহিষ্ণু জাত যেমন আছে লবণাক্ততা সহিষ্ণুু ধানের জাতও আছে।

তাছাড়া, বোরো পরাগায়নের সময়টাকে আরেকটু এগিয়ে আনার লক্ষ্যে গবেষণা চলছে বলে জানান তিনি।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ ক ম গোলাম সারওয়ার অবশ্য বলছেন, ‘এত দিন লবণাক্ত পানি সহনশীল ফসল উদ্ভাবনই ছিল গবেষণার মূল লক্ষ্য।’

তাপমাত্রা সহনশীল শস্য নিয়ে গবেষণা এখনো আশানুরূপ নয় বলে মনে করেন তিনি।

‘কেবল গমের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা সহনশীল জাত উদ্ভাবনের গবেষণায়ই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে,’ যোগ করেন অধ্যাপক সারওয়ার।

দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ বাংলাদশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে এই কৃষিবিদ বলেন, ‘উচ্চ, নিম্ন উভয় তাপমাত্রাই সহনশীল এমন জাত যাতে উদ্ভাবন করা যায়, সে জন্য কাজ করতে হবে।’

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ