কীভাবে ঘনিষ্ঠ হলেন পুতিন ও এরদোয়ান? ‘বেমানান’ এ সম্পর্ক কত শক্ত?
অনলাইন ডেস্কপ্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২২, ১৩:১১
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করার পর রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে একঘরে করতে উঠে পড়ে লেগেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং দেশটি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো।
কিন্তু সেই চেষ্টা সফল করতে জোটের যে সদস্য দেশটির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেই তুরস্ক তাতে বাদ সাধছে। মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা মানতে অস্বীকার করেছে তারা।
এমনকি যে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু তালিকার শীর্ষে, সেই ইরানের আতিথ্য গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করতে তেহরান গেছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।
স্পষ্টতই, গত কয়েক বছর ধওে বিশেষ করে ২০১৬ সাল থেকে পুতিনের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠতা তিনি তৈরি করেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তা জলাঞ্জলি দিতে রাজি নন এরদোয়ান।
কিন্তু রাশিয়া ও তুরস্কের সম্পর্কের যে ইতিহাস, যে মাত্রার স্বার্থের দ্বন্দ্ব এখনো এই দুই দেশের মধ্যে রয়েছে, তাতে পুতিন ও এরদোয়ানের এই ঘনিষ্ঠতা নিয়ে এখনো অনেক পর্যবেক্ষক চোখ কপালে তোলেন।
সিরিয়ায় রুশ ও তুর্কি সৈন্যরা এখনো কার্যত মুখোমুখি। সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রেসিডেন্ট আসাদকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দিতে তুরস্ক রাজি নয়। বরং সিরিয়ার আরও এলাকা দখলের পরিকল্পনা করছে তারা।
২০১৫ সালে সিরিয়ায় তাদের সীমান্তে রুশ একটি যুদ্ধবিমানকে গুলি করে নামিয়েছিল তুরস্ক, যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
আজারবাইজানে দেশ দুটো ভিন্ন দুই শিবিরে। নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে যুদ্ধে তুরস্কের সাহায্য নিয়ে আজারবাইজান যখন আর্মেনিয়াকে কোণঠাসা করতে শুরু করে, তখন রাশিয়া হস্তক্ষেপ করে যুদ্ধবিরতি চাপিয়ে দেয়।
রাশিয়া লিবিয়ায় অস্ত্র, টাকা-পয়সা দিয়ে পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণকারী মিলিশিয়া নেতা খালিফা হাফতারকে সাহায্য করছে। অথচ তুরস্ক সমর্থন করছে ত্রিপলীর সরকারকে।
পুতিন ও এরদোয়ানের ‘বেমানান’ সম্পর্ক কীভাবে
কিন্তু তারপরও পুতিন ও এরদোয়ানের মধ্যে এই সম্পর্ক কীভাবে তৈরি হলো এবং কীভাবে তা টিকে থাকছে, এই প্রশ্ন উঠছে। লন্ডনে রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা-ধর্মী সাময়িকী ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান সম্পাদক এবং মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক সামি হামদি বলেন, এই ‘বেমানান’ সম্পর্কের মূলে কাজ করছে ‘যুক্তরাষ্ট্র ফ্যাক্টর’। “মস্কো এবং আঙ্কারার মধ্যে এখন যে মাখামাখি তাকে আমি ‘স্বার্থ সিদ্ধির জন্য একটি বিয়ে’ হিসেবে দেখি। এই দুটো দেশকেই আমেরিকা বেশ কিছুদিন ধরে একঘরে করার চেষ্টা করছে। ফলে প্রত্যাখ্যাত দুই পক্ষ কাছাকাছি হয়ে স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছে।” সিরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে পুতিন ও এরদোয়ানের সাথে আমেরিকার বড় রকমের টক্কর শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপকে একবারেই মানতে পারেনি আমেরিকা। পরে সিরিয়ার সীমান্ত অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট কুর্দি মিলিশিয়াদের সরিয়ে নিয়ে একটি ‘সেইফ জোন’ তৈরির জন্য তুরস্কের দাবি যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করলে খেপে যান এরদোয়ান। হামদি বলেন, নিজেদের ভিন্ন সামরিক-রাজনৈতিক অভিলাষ থাকা স্বত্বেও আমেরিকার চাপের মুখে পড়া এই দুই দেশ নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মধ্যে অভিন্ন স্বার্থ খুঁজে পায়। ফলে, ২০১৫ সালের নভেম্বরে তুরস্ক সিরিয়ায় রুশ যুদ্ধবিমান গুলি করে নামালেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। ওই ঘটনার পরপরই, ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থান থেকে রক্ষা পাওয়ার পর এরদোয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। কারণ, এরদোয়ান সন্দেহ করেন অভ্যুত্থানের পেছনে পশ্চিমাদের ইন্ধন ছিল। ন্যাটো জোটের একটি দেশের নেতা হয়েও অভ্যুত্থানের পর যে দেশটিকে এরদোয়ান প্রথমে যান, সেটি ছিল রাশিয়া। আঙ্কারা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক এতটাই চটে যায় যে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি উপেক্ষা করে রুশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ কেনার চুক্তি করেন এরদোয়ান। ন্যাটো জোটের একটি সদস্য হয়েও রাশিয়ার কাছ থেকে এমন কৌশলগত অস্ত্র কেনার নজির সৃষ্টি করেন তিনি। রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা
সেই সঙ্গে বেড়েছে রাশিয়ার ওপর তুরস্কের অর্থনৈতিক নির্ভরতা। তুরস্কের গ্যাসের চাহিদার ৪৫ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। জ্বালানি তেলের চাহিদার ৩৫ শতাংশ আসে সেখান থেকে। রুশ গমের ওপরও তুরস্ক বেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এছাড়া সংখ্যার বিচারে তুরস্কে এখন রুশ পর্যটকরা ১ নম্বরে। রাশিয়ার ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করার পেছনে এই অর্থনৈতিক নির্ভরতাও কাজ করেছে সন্দেহ নেই। তবে সামি হামদি মনে করেন, তুরস্ক ও রাশিয়ার সম্পর্কের মূলে রয়েছে রাজনীতি। তিনি বলেন, “ইউরোপের অনেক দেশের মত জ্বালানির জন্য তুরস্কও রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু এরদোয়ান ও পুতিনের সম্পর্কের প্রধান তাড়না রাজনৈতিক বা ভূ-রাজনৈতিক।” “রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে তুরস্ক আমেরিকার সঙ্গে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করছে। আবার অতটা কাছাকাছি হচ্ছে না যাতে তার গায়ে রাশিয়ার মিত্র দেশের তকমা লাগে,’ বলেন হামদি। সেই কারণে, ইউক্রেনকে খোলাখুলি সামরিক ড্রোন বিক্রি করছে তুরস্ক- যে ড্রোন রুশ ট্যাংক ধ্বংস করছে। ইউক্রেনের অনুরোধে কিছুদিন গম-ভর্তি রুশ জাহাজ আটকও করেছে তারা। পুতিন নাখোশ হবেন জেনেও সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের নেটোতে নেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তুলে নিয়েছেন এরদোয়ান। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টও সমানভাবে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ককে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করছেন বলে মনে করেন সাদি হামদি। ‘ন্যাটোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশের সাথে এই দহরম-মহরম আমেরিকার গায়ে হুল ফোটানোর জন্য পুতিনের হাতে বড় একটি হাতিয়ার। নেটোতে ফাটল রয়েছে এমনটা দেখানোর বড় সুযোগ।’ এরদোয়ান ডকট্রিন
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান একটি নির্দিষ্ট বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তুরস্ককে বৃহত্তর ভূ-রাজনীতির একটি খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। তিনি সংঘাত-পূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, মধ্যস্থতাকারীর প্রস্তাব নিয়ে হাজির হচ্ছেন। ‘তুরস্কের স্বার্থ রক্ষায় দুপক্ষের হয়েই খেলার চেষ্টা করে চলেছেন এরদোয়ান ... এটিই তার বিদেশী নীতির ট্রেড মার্ক,’ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির অধ্যাপক কারাবেক আকোইউনলু। ‘ন্যাটার সঙ্গে তিনি থাকছেন, কারণ ন্যাটোর সদস্যপদ তাকে রাশিয়া বা ইরানের মতো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দেয়। একইভাবে, ন্যাটোর প্রতি বৈরিভাবাপন্ন কিছু দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে ন্যাটোতে দর কষাকষিতে তা কাজে লাগাচ্ছেন।’ তার তেহরানে যাওয়া এবং সেখানে আমেরিকার দুই প্রধান শত্রু প্রেসিডেন্ট রাইসি ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে দেখা করা এরদোয়ানের সেই কৌশলেরই বহিঃপ্রকাশ। সম্পর্ক টিকবে?
কিন্তু মস্কো-আঙ্কারা সম্পর্কের ভিত্তি কতটা শক্ত? সম্ভাব্য ঝুঁকি কোথায়? এরদোয়ান বা পুতিন কখন কোথায় বিগড়ে যেতে পারেন? সম্প্রতি লন্ডনের গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউস আয়োজিত এক ওয়াবিনারে প্রশ্নের উত্তরে তুরস্ক বিশেষজ্ঞ ড. বেইজা উনাল বলেন, সিরিয়া নিয়ে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক হঠাৎ চটে যাওয়া খুবই সম্ভব। সিরিয়ার উত্তরে কুর্দি মিলিশিয়াদের তাড়াতে নতুন সামরিক অভিযান নিয়ে গত বেশ কিছুদিন ধরে কথা বলছে তুরস্ক। কিন্তু ওই এলাকায় রুশ সেনা মোতায়েন রয়েছে। ফলে পরিস্থিতি যে কোনো সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ২০২০ সালেও সিরিয়ায় রুশ বিমান হামলায় ৩৩ জন তুর্কি সৈন্য মারা গেছে। তেহরানে বসে ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়ার নেতারা সেই সংকটের গ্রহণযোগ্য এক পথ খোঁজার চেষ্টা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া, ড. উনাল বলেন, কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার সামরিক গতিবিধি নিয়ে তুরস্কের উদ্বেগ রয়েছে। ‘কৃষ্ণসাগরের উষ্ণ পানির দিকে রাশিয়ার চোখ নিয়ে তুরস্ক বহুদিন ধরে সন্দিহান। সেখানে রাশিয়া প্রভাব বিস্তারের বেশি চেষ্টা করলে তুরস্ক সহ্য করবে না।’ অবশ্য ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিরোধ-সংঘাত-মতভেদ আয়ত্ত্বের মধ্যে রাখার সচেতন চেষ্টা করছে মস্কো এবং আঙ্কারা। দুই নেতা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। তবে সামি হামদি বলেন, পুতিন ও এরদোয়ানের সম্পর্ক একেবারেই স্বার্থ-ভিত্তিক। তার মতে, এরদোয়ান খুব বেশি রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হতে চান না, রাশিয়াকে তিনি বিশ্বাসও করেন না। একইভাবে রাশিয়ারও এরদোয়ানের ওপর খুব ভরসা নেই। ‘এই সম্পর্ক একেবারেই পারস্পরিক স্বার্থ-নির্ভর। দুজনেরই এখন দুজনকে দরকার। যতক্ষণ না আমেরিকার সাথে এরদোয়ানের সম্পর্ক ভালো হচ্ছে, তিনি পুতিনের কাছাকাছি থাকবেন। পুতিনের জন্যও ব্যাপারটি একই রকম। ভালো কোন বিকল্প তৈরি হলে সম্পর্ক আলগা হতে সময় লাগবে না।’ এবিএন/এসএ/জসিম
কিন্তু তারপরও পুতিন ও এরদোয়ানের মধ্যে এই সম্পর্ক কীভাবে তৈরি হলো এবং কীভাবে তা টিকে থাকছে, এই প্রশ্ন উঠছে। লন্ডনে রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা-ধর্মী সাময়িকী ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান সম্পাদক এবং মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক সামি হামদি বলেন, এই ‘বেমানান’ সম্পর্কের মূলে কাজ করছে ‘যুক্তরাষ্ট্র ফ্যাক্টর’। “মস্কো এবং আঙ্কারার মধ্যে এখন যে মাখামাখি তাকে আমি ‘স্বার্থ সিদ্ধির জন্য একটি বিয়ে’ হিসেবে দেখি। এই দুটো দেশকেই আমেরিকা বেশ কিছুদিন ধরে একঘরে করার চেষ্টা করছে। ফলে প্রত্যাখ্যাত দুই পক্ষ কাছাকাছি হয়ে স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছে।” সিরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে পুতিন ও এরদোয়ানের সাথে আমেরিকার বড় রকমের টক্কর শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপকে একবারেই মানতে পারেনি আমেরিকা। পরে সিরিয়ার সীমান্ত অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট কুর্দি মিলিশিয়াদের সরিয়ে নিয়ে একটি ‘সেইফ জোন’ তৈরির জন্য তুরস্কের দাবি যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করলে খেপে যান এরদোয়ান। হামদি বলেন, নিজেদের ভিন্ন সামরিক-রাজনৈতিক অভিলাষ থাকা স্বত্বেও আমেরিকার চাপের মুখে পড়া এই দুই দেশ নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মধ্যে অভিন্ন স্বার্থ খুঁজে পায়। ফলে, ২০১৫ সালের নভেম্বরে তুরস্ক সিরিয়ায় রুশ যুদ্ধবিমান গুলি করে নামালেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। ওই ঘটনার পরপরই, ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থান থেকে রক্ষা পাওয়ার পর এরদোয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। কারণ, এরদোয়ান সন্দেহ করেন অভ্যুত্থানের পেছনে পশ্চিমাদের ইন্ধন ছিল। ন্যাটো জোটের একটি দেশের নেতা হয়েও অভ্যুত্থানের পর যে দেশটিকে এরদোয়ান প্রথমে যান, সেটি ছিল রাশিয়া। আঙ্কারা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক এতটাই চটে যায় যে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি উপেক্ষা করে রুশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ কেনার চুক্তি করেন এরদোয়ান। ন্যাটো জোটের একটি সদস্য হয়েও রাশিয়ার কাছ থেকে এমন কৌশলগত অস্ত্র কেনার নজির সৃষ্টি করেন তিনি। রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা
সেই সঙ্গে বেড়েছে রাশিয়ার ওপর তুরস্কের অর্থনৈতিক নির্ভরতা। তুরস্কের গ্যাসের চাহিদার ৪৫ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। জ্বালানি তেলের চাহিদার ৩৫ শতাংশ আসে সেখান থেকে। রুশ গমের ওপরও তুরস্ক বেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এছাড়া সংখ্যার বিচারে তুরস্কে এখন রুশ পর্যটকরা ১ নম্বরে। রাশিয়ার ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করার পেছনে এই অর্থনৈতিক নির্ভরতাও কাজ করেছে সন্দেহ নেই। তবে সামি হামদি মনে করেন, তুরস্ক ও রাশিয়ার সম্পর্কের মূলে রয়েছে রাজনীতি। তিনি বলেন, “ইউরোপের অনেক দেশের মত জ্বালানির জন্য তুরস্কও রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু এরদোয়ান ও পুতিনের সম্পর্কের প্রধান তাড়না রাজনৈতিক বা ভূ-রাজনৈতিক।” “রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে তুরস্ক আমেরিকার সঙ্গে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করছে। আবার অতটা কাছাকাছি হচ্ছে না যাতে তার গায়ে রাশিয়ার মিত্র দেশের তকমা লাগে,’ বলেন হামদি। সেই কারণে, ইউক্রেনকে খোলাখুলি সামরিক ড্রোন বিক্রি করছে তুরস্ক- যে ড্রোন রুশ ট্যাংক ধ্বংস করছে। ইউক্রেনের অনুরোধে কিছুদিন গম-ভর্তি রুশ জাহাজ আটকও করেছে তারা। পুতিন নাখোশ হবেন জেনেও সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের নেটোতে নেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তুলে নিয়েছেন এরদোয়ান। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টও সমানভাবে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ককে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করছেন বলে মনে করেন সাদি হামদি। ‘ন্যাটোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশের সাথে এই দহরম-মহরম আমেরিকার গায়ে হুল ফোটানোর জন্য পুতিনের হাতে বড় একটি হাতিয়ার। নেটোতে ফাটল রয়েছে এমনটা দেখানোর বড় সুযোগ।’ এরদোয়ান ডকট্রিন
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান একটি নির্দিষ্ট বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তুরস্ককে বৃহত্তর ভূ-রাজনীতির একটি খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। তিনি সংঘাত-পূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, মধ্যস্থতাকারীর প্রস্তাব নিয়ে হাজির হচ্ছেন। ‘তুরস্কের স্বার্থ রক্ষায় দুপক্ষের হয়েই খেলার চেষ্টা করে চলেছেন এরদোয়ান ... এটিই তার বিদেশী নীতির ট্রেড মার্ক,’ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির অধ্যাপক কারাবেক আকোইউনলু। ‘ন্যাটার সঙ্গে তিনি থাকছেন, কারণ ন্যাটোর সদস্যপদ তাকে রাশিয়া বা ইরানের মতো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দেয়। একইভাবে, ন্যাটোর প্রতি বৈরিভাবাপন্ন কিছু দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে ন্যাটোতে দর কষাকষিতে তা কাজে লাগাচ্ছেন।’ তার তেহরানে যাওয়া এবং সেখানে আমেরিকার দুই প্রধান শত্রু প্রেসিডেন্ট রাইসি ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে দেখা করা এরদোয়ানের সেই কৌশলেরই বহিঃপ্রকাশ। সম্পর্ক টিকবে?
কিন্তু মস্কো-আঙ্কারা সম্পর্কের ভিত্তি কতটা শক্ত? সম্ভাব্য ঝুঁকি কোথায়? এরদোয়ান বা পুতিন কখন কোথায় বিগড়ে যেতে পারেন? সম্প্রতি লন্ডনের গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউস আয়োজিত এক ওয়াবিনারে প্রশ্নের উত্তরে তুরস্ক বিশেষজ্ঞ ড. বেইজা উনাল বলেন, সিরিয়া নিয়ে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক হঠাৎ চটে যাওয়া খুবই সম্ভব। সিরিয়ার উত্তরে কুর্দি মিলিশিয়াদের তাড়াতে নতুন সামরিক অভিযান নিয়ে গত বেশ কিছুদিন ধরে কথা বলছে তুরস্ক। কিন্তু ওই এলাকায় রুশ সেনা মোতায়েন রয়েছে। ফলে পরিস্থিতি যে কোনো সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ২০২০ সালেও সিরিয়ায় রুশ বিমান হামলায় ৩৩ জন তুর্কি সৈন্য মারা গেছে। তেহরানে বসে ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়ার নেতারা সেই সংকটের গ্রহণযোগ্য এক পথ খোঁজার চেষ্টা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া, ড. উনাল বলেন, কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার সামরিক গতিবিধি নিয়ে তুরস্কের উদ্বেগ রয়েছে। ‘কৃষ্ণসাগরের উষ্ণ পানির দিকে রাশিয়ার চোখ নিয়ে তুরস্ক বহুদিন ধরে সন্দিহান। সেখানে রাশিয়া প্রভাব বিস্তারের বেশি চেষ্টা করলে তুরস্ক সহ্য করবে না।’ অবশ্য ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিরোধ-সংঘাত-মতভেদ আয়ত্ত্বের মধ্যে রাখার সচেতন চেষ্টা করছে মস্কো এবং আঙ্কারা। দুই নেতা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। তবে সামি হামদি বলেন, পুতিন ও এরদোয়ানের সম্পর্ক একেবারেই স্বার্থ-ভিত্তিক। তার মতে, এরদোয়ান খুব বেশি রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হতে চান না, রাশিয়াকে তিনি বিশ্বাসও করেন না। একইভাবে রাশিয়ারও এরদোয়ানের ওপর খুব ভরসা নেই। ‘এই সম্পর্ক একেবারেই পারস্পরিক স্বার্থ-নির্ভর। দুজনেরই এখন দুজনকে দরকার। যতক্ষণ না আমেরিকার সাথে এরদোয়ানের সম্পর্ক ভালো হচ্ছে, তিনি পুতিনের কাছাকাছি থাকবেন। পুতিনের জন্যও ব্যাপারটি একই রকম। ভালো কোন বিকল্প তৈরি হলে সম্পর্ক আলগা হতে সময় লাগবে না।’ এবিএন/এসএ/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ
