আজকের শিরোনাম :

বিবিসির প্রতিবেদন

ছয় মাসে হামাসকে কতটা নির্মূল করতে পেরেছে ইসরায়েল

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:১২

গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় বিমান হামলা শুরু করে ইহুদিবাদী ইসরায়েল। এরপর ২৮ অক্টোবর শুরু করে স্থল অভিযান। টানা ছয় মাস ধরে ওই উপত্যকাকে অবরুদ্ধ করে রেখে বর্বর আগ্রাসন চালাচ্ছে ইহুদিবাদী সেনারা। এতে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৩৩ হাজার ১৭৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। এছাড়াও আহত হয়েছে ৭৫ হাজার ৮৮৬ জন। ছয় মাসের এই যুদ্ধে গাজার বড় অংশই ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানকার বাড়ি-ঘর, মসজিদ, হাসপাতাল কোনও কিছুই হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। পুরো গাজায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

ইসরায়েল বলছে, তারা হাজার হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে এবং গাজার তলদেশে সুড়ঙ্গের বিশাল নেটওয়ার্ক ধ্বংস করেছে, যা হামাস হামলা চালাতে ব্যবহার করছিল।
ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) পাবলিক বিবৃতি এবং সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলো এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব দাবি করেছে সেগুলোরও তথ্য প্রমাণ যাচাই করে বিবিসি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখানো হয়েছে আসলে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হামাস?

কতজন হামাস নেতা নিহত হয়েছে?
৭ অক্টোবরের আগে গাজায় হামাসের প্রায় ৩০ হাজার যোদ্ধা ছিল বলে ধারণা করা হয়েছিল। আইডিএফ কমান্ডারদের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য বলা হয়েছে।

হামাসের অনেক ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যেমন ইসমাইল হানিয়াহ, যাকে ওই গোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান নেতা বলে ধরা হয়, তিনি বিদেশে থাকেন। তবে এর অনেক সামরিক নেতৃত্ব কাঠামো গাজার অভ্যন্তরে রয়েছে বলে মনে করা হয়।

এক সাম্প্রতিক বিবৃতিতে আইডিএফ বলছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তারা প্রায় ১৩ হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে, যদিও তারা এই সংখ্যাটি কীভাবে গণনা করেছে তা জানায়নি।

ইসরায়েলও কিছু হামাস নেতার নাম প্রকাশ করে দাবি করেছে যে তাদের হত্যা করা হয়েছে। অক্টোবর থেকে এভাবে মোট ১১৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই যুদ্ধের প্রথম তিন মাসে নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এই বছরের মার্চ পর্যন্ত গাজায় হামাসের কোনও সিনিয়র নেতা নিহত হওয়ার খবর জানায়নি। গত ২৬ মার্চ আইডিএফ বলেছে, তারা হামাসের সামরিক শাখার ডেপুটি কমান্ডার মারওয়ান ইসাকে হত্যা করেছে।

তাকে ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেডদের একজন বলে ধরা হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যাদের হত্যা করা হয়েছে এর মধ্যে তিনিই ছিলেন সশস্ত্র গোষ্ঠীটির সবচেয়ে সিনিয়র নেতা।

যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তাদেরও ধারণা যে মারওয়ান ইসাকে হত্যা করা হয়েছে, তবে হামাস এই তথ্য নিশ্চিত করেনি।

হামাসের সিনিয়র নেতা হিসেবে আইডিএফ এমন সব ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করে হামলায় নিহত হওয়ার দাবি করেছে, তারা আসলেই হামাসের সদস্য কিনা তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

এই ক্যাটাগরিতে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মুস্তাফা থুরায়া। জানুয়ারিতে তাকে বহনকারী গাড়িতে হামলা চালানো হয়। তখন তিনি দক্ষিণ গাজায় একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছিলেন।

নিহত হামাস সদস্যদের তালিকায় যেসব নাম একাধিকবার এসেছে সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। গাজার বাইরে হামাসের রাজনৈতিক নেতা সালেহ আল-আরৌরি জানুয়ারিতে বৈরুতের দক্ষিণ উপশহর দাহিয়েহতে এক বিস্ফোরণে মারা যান। ওই হামলার জন্য ইসরায়েলকে প্রধানত দায়ী করা হয়।

বিবিসি যেসব বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলেছে তারা জানিয়েছেন যে, ইয়াহিয়া সিনওয়ারসহ গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠীটির অনেক বিশিষ্ট নেতা এখনও বেঁচে আছেন বলে ধারণা করা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ক সিনিয়র বিশ্লেষক মাইরাভ জোনসজেইন বলেছেন, আইডিএফ হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছেও ঘেঁষতে পারেনি।

জোনসজেইন বলেন, তাদের একটা প্রতীকী উদ্দেশ্য হচ্ছে হামাসের মূল নেতাদের ধরা এবং ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ থেকে হামাসকে সরিয়ে দেওয়া। কিন্তু এগুলোর কোনওটিই এখনও অর্জন করা সম্ভব হয়নি।

গাজায় কতজন জিম্মি আছে?
ইসরায়েলের সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ৭ অক্টোবর ২৫৩ জনকে জিম্মি করেছিল হামাস ও অন্যান্য গাজাভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী। এদের মধ্যে ১০৯ জনকে বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসেবে বা পৃথক চুক্তিতে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সামরিক অভিযানে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সরাসরি উদ্ধার করেছে তিনজনকে। ১২ জন জিম্মির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে তিনজন আইডিএফ অভিযানে নিহত হয়েছে বলে স্বীকার করেছে ইসরায়েল। এখনও যেসব জিম্মি জীবিত আছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে তাদের মধ্যে কনিষ্ঠ জিম্মির বয়স ১৮ এবং সবচেয়ে বয়স্ক যিনি তার বয়স ৮৫ বছর।

বাকি ১২৯ জন জিম্মির মধ্যে অন্তত ৩৪ জন মারা গেছেন বলে ইসরায়েল জানিয়েছে। হামাস জানিয়েছে, আইডিএফ এর বিমান হামলার কারণে মৃত জিম্মির সংখ্যা আরও বেশি। কিন্তু এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে না।

হামাস হামলা চালিয়ে যাদের জিম্মি করেছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ দুই জিম্মি হলেন এরিয়েল এবং কেফির।

অপহরণের সময় তাদের একজনের বয়স ছিল চার বছর এবং আরেকজনের মাত্র নয় মাস। তাদের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক কতটা ধ্বংস করেছে ইসরায়েল?

হামাস বলছে, তাদের টানেল ৫০০ কিলোমিটার প্রসারিত, যদিও এটি যাচাই করা সম্ভব নয়। হামাসকে নির্মূল করার অংশ হিসেবে, ইসরায়েল গাজার নিচে বিস্তৃত টানেলের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা তারা পণ্য আনা নেওয়া এবং লোকজনকে সরানোর কাজে ব্যবহার করে থাকে।

আইডিএফ-এর মুখপাত্র জোনাথন কনরিকাস অক্টোবরে বলেছিলেন, গাজা উপত্যকাকে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য একটি স্তর এবং তারপরে হামাসের জন্য আরেকটি স্তর হিসেবে ভাবুন। হামাস যে দ্বিতীয় স্তরটি তৈরি করেছে আমরা সেই দ্বিতীয় স্তরে যাওয়ার চেষ্টা করছি।

হামাস এর আগে বলেছে, তার টানেল নেটওয়ার্ক ৫০০ কিলোমিটার (৩১১ মাইল) প্রসারিত, যদিও স্বাধীনভাবে এটি যাচাই করার কোনও উপায় নেই। বিবিসি আইডিএফের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছে যে কয়টি টানেল আছে এবং মোট টানেল নেটওয়ার্কের কতটা তারা ধ্বংস করেছে।

এর উত্তরে, তারা বলেছে যে তাদের বাহিনী গাজায় সন্ত্রাসী অবকাঠামোর একটি বড় অংশ ধ্বংস করেছে। আইডিএফ মাঝে মাঝে হামাসের সুড়ঙ্গে ঢুকে প্রমাণ দেখিয়েছে যে তারা এমন অনেক সুড়ঙ্গ খুঁজে বের করেছে।

উল্লেখ্য করা যেতে পারে, নভেম্বরে আইডিএফ গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালের নিচে একটি টানেল নেটওয়ার্কের অংশের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে। তারা দাবি করছে যে, এই স্থানটি হামাস তাদের কমান্ড সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করতো।

ইসরায়েলি বাহিনী কতটা সুড়ঙ্গের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে এর পুরো নেটওয়ার্কের পরিধি নির্ধারণের চেষ্টা করেছে বিবিসি ভেরিফাই। এজন্য ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ২৬ মার্চের মধ্যে গাজার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামে রেফারেন্সিং টানেল নিয়ে আইডিএফ এর সব বার্তা পর্যালোচনা করেছে।

এর মধ্যে ১৯৮টি বার্তায় সুড়ঙ্গ খুঁজে পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি তারা টানেল এবং টানেল শ্যাফট অর্থাৎ টানেলের বাইরের মুখের সন্ধান পেয়েছে।

আরও ১৪১টি বার্তায় দাবি করা হয়েছে যে, আইডিএফ একটি টানেল ধ্বংস বা গুড়িয়ে ফেলেছে। তাদের বেশিরভাগই সুনির্দিষ্ট বিশদ বিবরণ বা নির্দিষ্ট অবস্থান দেয়নি। তাই আইডিএফ যে নেটওয়ার্কটি উন্মোচিত করেছে বা ধ্বংস করেছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।

গাজার মাটির নিচের গোলকধাঁধার বেশ কয়েকটি অংশ রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে সুড়ঙ্গের রুট এবং বিভিন্ন আকারের কক্ষ, সেই সঙ্গে সুড়ঙ্গের যে অংশটি পৃষ্ঠের সাথে মিলিত হয়েছে একে টানেল শ্যাফট বলা হয়।

বিবিসি ভেরিফাই যে বার্তাগুলো বিশ্লেষণ করেছে তার মধ্যে ৩৬টি হামলায় চারশটিরও বেশি টানেল শ্যাফটের ধ্বংস করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

যাইহোক, পুরো সুড়ঙ্গের সাথে একটি শ্যাফটকে তুলনা করাটা বিভ্রান্তিকর হবে বলে জানিয়েছেন ড. ড্যাফনে রিচমন্ড-বারাক। তিনি ইসরায়েলের রেইচম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। ভূগর্ভস্থ যুদ্ধের বিশেষজ্ঞ তিনি। তার মতে, টানেল শ্যাফট গুড়িয়ে দিলেও এর ভেতরে সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্কটি অক্ষত থাকে। তিনি বলেন, আমি মনে করি না যে আমরা এই যুদ্ধে সুড়ঙ্গগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হতে দেখেছি। 

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ