আজকের শিরোনাম :

অর্থপাচার : বিদেশে পাচার হওয়া টাকা কী ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২২, ১২:৩৯

আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেট অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেছেন, তার একটি অংশ নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে। সেটি হলো বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ দেয়া।

গত এক দশকে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত দুটি শব্দ হলো কানাডার বেগমপাড়া। যদিও এ নামে কোন এলাকা নেই তারপরেও বাংলাদেশ থেকে ভিন্ন পথে টাকা নিয়ে যেসব এলাকায় কিছু বাংলাদেশি ঘরবাড়ি কিনেছেন সেগুলোরই পরিচিত গড়ে উঠেছে বেগমপাড়া হিসেবে।

অনেক বছর ধরেই কানাডায় সপরিবারে বসবাস করেন কিশোয়ার লায়লা। তিনি বলছিলেন, বিষয়টি বাংলাদেশি হিসেবে প্রতিনিয়তই তাদের জন্য বিব্রতকর।

‘আমি অনেক দিন ধরেই কানাডায় বাস করছি। অনেক কষ্ট করি। কিন্তু এখানে দেখি অনেক বাংলাদেশিই হুট করে এসে দামী বাড়ি গাড়ি কিনছেন। তারা যেসব এলাকায় থাকছেন সেটিই কমিউনিটির মধ্যে বেগমপাড়া হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে, কারণ অনেকেই বিশ্বাস করেন দেশ থেকে পাচার হয়ে আসা টাকাই এসব দামি বাড়ি গাড়ির পেছনে বিনিয়োগ করা হচ্ছে।’

তবে শুধু কানাডাই নয় বরং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জসহ নানা দেশে বাংলাদেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে- দীর্ঘকাল ধরে এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল।

যার প্রেক্ষাপটে দেশে পাচার প্রতিরোধে আইনি কাঠামোও জোরদার করা হচ্ছিল।

অথচ এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী এমন একটি প্রস্তাব করেছেন যাকে অনেকে মনে করছেন যে পাচার হওয়া অর্থ দায়মুক্তি দিয়ে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেয়া হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী আয়কর অধ্যাদেশে নতুন একটি বিধান সংযোজনার প্রস্তাব করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে যে ‘বিদেশে অবস্থিত যে কোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ যে কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না’।

এ জন্য তিনি অর্থ, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের ওপর আলাদা কর হার ধার্য করে দিয়েছেন এবং সে কর দিলেই বাংলাদেশিরা এসব অর্থ সম্পদ বৈধভাবে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে পারে।

বাজেট বক্তব্যে এ প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেছেন, তিনি মনে করেন পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে এ বিধান সহায়তা করবে।

‘দুদকের কাজে নতুন বিধান বাধা হবে না’
দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলছেন যে এ ধরনের বিধান করার আগে অর্থ মন্ত্রণালয় মানি লণ্ডারিং নিয়ে যারা কাজ করছে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি।

‘সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে মনে হয় না। ইন্টারেকশন হলো বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হতো। সেক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হতো। সরকারের উচিত ছিল ভারতে যে কালো টাকা সাদা করা বা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আইনের কি ধরনের ইফেক্ট বা আউটকাম হয়েছিল তা খতিয়ে দেখা। আসলে পাচার হওয়া টাকা পয়সা নিয়ে এতো কথা হয়েছে যে, আমার মনে হয়েছে সরকার পর্যুদস্ত হয়ে গেছে পাচার হওয়া টাকার বিষয়ে। সে কারণেই টেস্ট কেস হিসেবে হয়তো সরকার এ সুযোগ দিয়েছে।’

বাংলাদেশের আইনে অর্থ পাচার দণ্ডনীয় অপরাধ। দুর্নীতি দমন কমিশনের হয়ে অর্থ পাচার মামলা গুলোর দায়িত্বে থাকা খুরশিদ আলম বলছেন, ভারত কয়েক বছর আগে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে ভালো ফল পায়নি।

তবে বাজেটে যাই অনুমোদন হোক না কেন সেটি পাচার হওয়া অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করতে দুদকের জন্য কোনো বাধা থাকবে না বলে দাবি করেন তিনি।

‘দুর্নীতি দমন আইন ও মানি লন্ডারিং আইনগুলো বিশেষ আইন। এখন সংসদে অর্থ আইনে যাই বলা হোক ক্রিমিনাল অফেন্সের জন্য কোন সমস্যা হবে না। ট্যাক্স দিয়ে টাকা হয়তো হালাল করতে পারবেন। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনে সুযোগ আছে অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করতে ও আইনগত প্রক্রিয়া নেয়ার জন্য। সে জন্য দুদকের অর্থ পাচার মামলার ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব পড়বে না,’ বলছিলেন খুরশিদ আলম খান।

তাহলে দুদক বা অন্য কোনো সংস্থার যদি আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকেই তাহলে যিনি অর্থ পাচার করেছেন তিনি কেন সেই ঝুঁকি নিয়ে দেশে সেই সম্পদ বা অর্থের কর দিতে আসবেন সেগুলো বৈধ করে নেয়ার জন্য- সে প্রশ্ন উঠছে।

তবে এ যুক্তি নাকচ করে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন নতুন প্রস্তাব কার্যকর হলে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসবে।

‘বিভিন্ন কারণে টাকা চলে যায়। আমরা আইডিয়া করছি যে টাকা পাচার হয়ে গেছে। আমরা ফেরত আনার চেষ্টা করছি। এগুলোতে বাধা দিয়েন না। না আসলে লাভ কী হবে। সতেরটি দেশ দায়মুক্তি দিয়ে টাকা ফেরত এনেছে। আসবে এবং এটাও একটা চেষ্টা করতে হবে।’

অর্থ ফিরবে নাকি পাচার বাড়বে
গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এক্ষেত্রে একটি অগ্রগতি হয়েছে- আর তা হলো সরকার এই প্রথমবার স্বীকার করে নিলো যে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে।

এর আগে ২০২১ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রকাশ করেছিলেন বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে- তার কিছুটা সত্যতা তিনি পেয়েছেন।

এ ধরনের আটাশটি ঘটনার তথ্যও তাদের কাছে আছে এমনটি বলার পর তার বক্তব্য নিয়ে শোরগোল উঠেছিল। কিন্তু পাচার হওয়া সে অর্থ ফিরিয়ে আনতে সরকারকেও কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

অথচ এখন অর্থমন্ত্রী নিজেই কর দিয়ে পাচার করা অর্থ ও সম্পদ ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব করেছেন।

পাচারকারীদের দায়মুক্তির এ সুযোগ অর্থ পাচার প্রতিরোধে কতটা কাজ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

‘দেশ থেকে প্রেরিত অর্থের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি নানা পর্যায়ের লোকজনের যুক্ত হবার প্রবণতা তৈরি হয়। এ ধরনের সুযোগ নিয়ে তাদেরও দায়মুক্তির সুযোগ তৈরি হয়। কতটা অর্থ ফিরে আসবে তা দেখার আগে দেখতে হবে যে এ ধরণের দায়মুক্তির মাধ্যমে আইনি ও নৈতিক ভিত্তিগুলো আমরা কতটা দুর্বল করে দিচ্ছি।’

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) ২০২০ সালে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়।

তারা বলেছিল যে, ২০০৮ সালের পরে বাংলাদেশে পণ্যের মূল্য ঘোষণায় গরমিল দেখিয়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৫১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে চলে গেছে।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, এখন কর দিয়ে বৈধ করার মতো সুযোগ দিলে পাচার হওয়া অর্থ ফিরে আসবে- এটি একেবারেই অযৌক্তিক ও অন্যায় একটি চিন্তা। বরং এর মাধ্যমে অপরাধের যে দায়মুক্তি দেয়া হলো তা পাচার প্রবণতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

‘এ ধরনের প্রণোদনামূলক ব্যবস্থার টাকা ফেরত আনার চেয়ে টাকা বাইরে যাবার প্রবণতাকে উৎসাহিত করবে। একই সঙ্গে আমরা জানি যে দেশ থেকে টাকা পাচার হওয়া ঠেকাতে খুব কার্যকর ব্যবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। সেটি না থাকায় এ ধরনের প্রণোদনা কেবল টাকা পাচারকেই উৎসাহিত করবে।’

করদাতার স্বস্তি অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে?
ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে সোয়া চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

আর দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশে থেকে ১০০০ থেকে ১৫০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়।

আর বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া থেকে এখন অবধি মোট আট লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে৷

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, নতুন বিধান কার্যকর হলে করদাতারা বিদেশে অর্জিত তাদের অর্থ সম্পদ আয়কর রিটার্নে দেখানোর সুযোগ পেয়ে স্বস্তিবোধ করবেন।

তিনি বলছেন, তার মানে এই নয় যে নগদ টাকা ফেরত আনতেই হবে।

বিদেশে থাকা স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তির উপর নির্ধারিত হারে কর দিলেও তা বৈধ বলে গণ্য হবে। আর এটা করলে তারা ফৌজদারি মামলা থেকেও রেহাই পাবেন।

এতে করে করদাতা স্বস্তি পেলেও রাজস্ব কতখানি বাড়বে তা নিয়েও আছে বড় প্রশ্ন। যেমনটি বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা।

‘বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থা তখনি সুবিধা পাবে যদি আসলেই টাকাটা আসে। অল্প আকারেই হয়তো আসতে পারে, কিন্তু সেটা রাজস্বের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে তা মনে হয় না। কিন্তু এর ফলে যেটা হবে যে যারা সৎ করদাতা বা সৎভাবে ব্যবসা করে তারা একটা নেতিবাচক বার্তা পাবেন।’

কালো টাকা ফেরেনি, পাচারের অর্থ ফিরবে?
অন্যদিকে বাংলাদেশ দীর্ঘকাল ধরেই কালো টাকা কর দিয়ে সাদা করে অর্থনীতির মূল ধারায় আনার জন্য সুযোগ দিয়ে যাচ্ছিলো। যদিও তাতে খুব একটা সুফল আসেনি। রাজস্ব বোর্ড ও অর্থ বিভাগের নানা সূত্র থেকে গণমাধ্যমে যেসব তথ্য এসেছে তাতে দেখা যায় এ পর্যন্ত দেশে ষোল বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।

পাশাপাশি আয়কর আইনে নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা ও কর দিয়ে পুঁজি বাজার ও আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছিল।

এমনকি পুরনো একাধিক বছরের কালো টাকা সাদা করার সুযোগও ছিল। অথচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসেবেই স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জরিমানা দিয়ে বৈধ করার মোট টাকার পরিমাণ মাত্র প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা।

সায়মা হক বিদিশা বলছিলেন যে এসব টাকা ফিরিয়ে আনার চেষ্টাগুলো থেকে দেশের অর্থনীতি খুব একটা লাভবান হয়নি।

‘বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার কারণে খুব একটা সুবিধা বা রাজস্বতে খুব একটা পরিবর্তন আমরা দেখিনি। আবার যে টাকা বাইরে নিয়ে গেছে তিনি তো নেয়ার উদ্দেশ্যেই সেটি নিয়েছেন। ফেরত আনার জন্য নেননি। তার যেহেতু মূল উদ্দেশ্য ছিলো বাইরে নেয়া তিনি সেটি ফেরত আনবেন কেন।’

তিনি বলছেন যে এসব বিষয় আবার শুধু বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাই নয়, অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এগুলো সংশ্লিষ্ট। সেগুলো বিবেচনা করলে এটা কতটা সম্ভব হবে তাই দেখার বিষয় হবে।

বৈশ্বিক নানা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর দেশের টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ডসহ অন্তত দশটি দেশে। এর আগে সরকারের দিক থেকে এসব তথ্যকে কখনোই আমলে নেয়া হয়নি বা গুরুত্ব দেয়া হয়নি।

তবে এবার বাজেটে অর্থমন্ত্রীর নতুন প্রস্তাবের পক্ষে বলতে গিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন অনেক টাকা পাচার হয়ে গেছে এবং সে কারণেই তারা একটি সুযোগ দিচ্ছেন।

যদিও এ সুযোগের সুফল না আসে তাহলে সেটি রাখা হবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন বাজেটের পর তার দলীয় সংবাদ সম্মেলনে।

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ