আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

ঘৃণা-বিদ্বেষের রাজনীতি কি মুসলিম বিশ্বে ভারতের স্বার্থ ঝুঁকিতে ফেলছে?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২২, ১৪:২৪ | আপডেট : ০৮ জুন ২০২২, ১৪:২৬

ইসলাম ধর্মের নবীকে নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির একজন নেতা এবং দলের অন্যতম মুখপাত্র নূপুর শর্মার বিতর্কিত এক মন্তব্য নিয়ে সে দেশের মুসলমান এবং বিরোধীরা গত কয়েকদিন ধরে হৈচৈ করলেও সরকার তাতে বিন্দুমাত্র কান দেয়নি।

কিন্তু দুই দিন আগে কাতার সরকার দোহাতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়ে বিজেপি মুখপাত্রের বক্তব্য নিয়ে ক্ষমা চাওয়ার দাবি তোলার পর নরেন্দ্র মোদির সরকার নড়েচড়ে বসে। এরপর কুয়েত, বাহরাইন, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), সৌদি আরব থেকে শুরু করে এক ডজনেরও বেশি মুসলিম দেশ একে একে ক্ষোভ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। কারো কারো বিবৃতির ভাষা বেশ কড়া। আরব বিশ্বে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ্যে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কুয়েতে দোকানে ভারতীয় পণ্য বিক্রি বন্ধ করা হয়েছে।

সুন্নি ইসলামের অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান মিসরের আল আজহার আল-শরীফ তাদের এক বিবৃতিতে নবীকে নিয়ে বিজেপি নেতার বক্তব্যকে ‘সন্ত্রাসী আচরণের’ সঙ্গে তুলনা করে বলেছে যে এমন আচরণ ‘পুরো বিশ্বে ভয়াবহ সংকট তৈরির উস্কানি’।

আল আজহারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কিছু কট্টর লোকজনের ভোটের জন্য ইসলামের এমন অবমাননা উগ্রবাদের সমার্থক। এর ফলে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা এবং অবিশ্বাস জন্ম নেবে।’

ভারত নিয়ে এসব শক্ত বিবৃতি আরব বিশ্বের সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও মূলধারার প্রায় সব মিডিয়াতে প্রকাশ পাচ্ছে।

ক্ষেপেছে আরব বিশ্ব
জ্বালানি, ব্যবসা ও রেমিটেন্সের জন্য উপসাগরীয় এসব মুসলিম দেশের ওপর ভারত ভীষণভাবে নির্ভরশীল। এসব দেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কও খুবই ঘনিষ্ঠ। তারপরও দেশগুলো প্রায় একযোগে ভারতকে প্রকাশ্যে এমনভাবে নিশানা করল কেন?

এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতের সাবেক কূটনীতিক কেসি সিং বলেন, এটি বছরের পর বছর ধরে বিজেপির মুসলিম এবং ইসলাম বিদ্বেষী রাজনীতির পাল্টা প্রতিক্রিয়া।

‘এমন দুর্ঘটনা শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল মাত্র,’ বলেন কেসি সিং, যিনি উপসাগরীয় একাধিক দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

‘আপনি আপনার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি একটি গুদামে সুরক্ষিত করে রাখবেন, বিভক্তির রাজনীতি, উদ্ধত সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রদর্শন করতে থাকবেন। তারপর অন্য দেশে গিয়ে জাতীয় নেতার মত ভাব করবেন, তাদের নেতাদের সাথে কোলাকুলি করবেন এবং আশা করবেন বাস্তবতার খাতিরে তারা সবাই সব মেনে নেবে - সেটা বেশিদিন চলে না।’

সাবেক এই কূটনীতিক মনে করেন, ভারতে মুসলমানদের নিয়ে কী হচ্ছে, ইসলামি দেশগুলো তা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছিল।

‘এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে মুসলিম দেশগুলো বোকা-গাধা ... একটি স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষা ছিল মাত্র। আপনি যখন নবীকে আক্রমণ করবেন, তখন তা একটি বা দুটি মুসলিম দেশ নয়, বরং এটি পুরো মুসলিম উম্মার ওপর আক্রমণ।’

মনে করা হচ্ছে, বিজেপির নূপুর শর্মা সেই স্ফুলিঙ্গ হাতে তুলে দিয়েছেন।

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিজেপি সচেতনভাবে ধর্মীয় বিভেদ এবং মুসলিম ও ইসলাম বিদ্বেষী বিভিন্ন ন্যারেটিভ চালু করে সেগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে চলেছে। কেন্দ্রে এবং রাজ্য পর্যায়ে বিজেপি এবং দলের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কট্টর হিন্দু গোষ্ঠীর নেতা-কর্মীরা ক্রমাগতভাবে মুসলমান এবং তাদের ধর্মবিশ্বাস, জীবন-জীবিকা টার্গেট করে বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে চলেছে, যার জেরে গত আট বছরে বহু সহিংসতা-হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালে মে মাস থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র আড়াই বছরে গরু রক্ষার নামে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের হামলায় ভারতে কমপক্ষে ৪৪ জন মারা গেছে, যাদের ৩৬ জনই মুসলিম। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার-আচারও তেমন এগোয়নি বললেই চলে এবং বিজেপি নেতারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব হামলার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।

ভারতে গত বছরগুলোয় গরুর মাংস নিষিদ্ধ করা এবং মাংস বহনের সন্দেহে পিটিয়ে মারার বহু ঘটনা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজে হিজাব নিষিদ্ধ করার মতো ঘটনা নিয়ে আরব বিশ্বে মানুষজন তাদের সরকারের ভয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ না করলেও, সোশ্যাল মিডিয়াতে অসন্তোষ চেপে রাখেনি।

নবীকে নিয়ে এক বিজেপি মুখপাত্রের বক্তব্য এবং আরেক মুখপাত্রের টুইট নিয়ে আরব বিশ্বে প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতেই। এরপর হয়তো চাপের মুখে সরকারগুলো এক এক করে মুখ খুলছে।

দিল্লিতে সিনিয়র সাংবাদিক এবং কলামিস্ট স্মিতা গুপ্তাও মনে করেন যে মুসলিম দেশগুলোর এই প্রতিক্রিয়া এক রকম অবধারিতই ছিল।

‘গত আট বছর ধরে ক্রমাগতভাবে মুসলিম এবং ইসলামকে আঘাত করতে দুবার ভাবেনি বিজেপি। মানুষ মারা গেছে। প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপির শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যে এসবের বিরুদ্ধে কখনো কথা বলেননি, ঠেকানোর চেষ্টা করেননি, এবং তার পরিণতিতেই এই পরিস্থিতি" বিবিসি বাংলাকে বলেন স্মিতা গুপ্তা, যিনি ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক সম্পাদক ছিলেন।

‘প্রতিটি মানুষ, সম্প্রদায় এবং সমাজের একটা রেড লাইন থাকে। নূপুর শর্মা সেই রেড লাইন ভেঙেছেন।’

আমেরিকাসহ কিছু পশ্চিমা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রসার নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কিন্তু বিজেপির সরকার তাতে বিন্দুমাত্র কান দেয়নি।

ঝাঁকি খেয়েছে বিজেপি
প্রশ্ন হলো, এখন আরব দেশগুলোর এই প্রতিক্রিয়াকে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির সরকার কতটা আমলে নিচ্ছে?

স্মিতা গুপ্তা মনে করেন, সরকার খানিকটা ঝাঁকি খেয়েছে।

‘কথাবার্তা এবং কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে, বিজেপি এবং সরকার কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন। গত আট বছরে যে বিজেপি কোনোরকম অনুশোচনা বা দুঃখ প্রকাশের ধার ধারেনি, তারাই নূপুর শর্মাকে সরিয়ে দিল,’ বলেন গুপ্তা।

‘প্রধানমন্ত্রী মোদির সমর্থকরা মনে করেন তাদের নেতা বাইরের বিশ্বের ভীষণ জনপ্রিয়, বাইরে গিয়ে তিনি ঢেউ তোলেন। কিন্তু তারা দেখছেন ব্যাপারটি সবসময় তা নয়।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, উপসাগরীয় মুসলিম দেশগুলোতে অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও ভারত উদ্বেগের মধ্যে পড়েছে। ভারতের তেল-গ্যাসের সিংহভাগই আসে এই অঞ্চল থেকে।

উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) সাথে ২০২০-২০২১ সালে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৮৭ বিলিয়ন (৮,৭০০ কোটি) ডলার। লাখ লাখ ভারতীয় এসব দেশে কাজ করে, এবং এরা কোটি কোটি ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠায়। সে কারণেই বিজেপি নূপুর শর্মাকে মুখপাত্রের ভূমিকা থেকে সরিয়ে দিয়েছে এবং ভারতীয় মিডিয়ার খবর অনুযায়ী মুম্বাইতে তার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে একটি মামলাও হয়েছে।

সেই সাথে বিবৃতি দিয়ে বিজেপি বলেছে, তারা ‘সব ধর্মকে সম্মান করে এবং যে কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অসম্মানের নিন্দা করে’।

বিজেপির অভিভাবক সংগঠন আরএসএসের প্রধান মোহন ভগবত সম্প্রতি এক ভাষণে মন্তব্য করেছেন, ‘সব মসজিদে শিব লিঙ্গ খোঁজার প্রয়োজন কোথায়?’

বিজেপি কি বদলাবে?
তবে এসব তৎপরতাকে কি বিজেপির মধ্যে নতুন কোন বোধোদয়ের লক্ষণ হিসেবে দেখা যেতে পারে? ভারতে পর্যবেক্ষকদের কেউই অবশ্য তেমনটা মনে করছেন না। কারণ, আট বছরে ধরে যে রাজনীতির ওপর ভর করে বিজেপি অত্যন্ত শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে, শুধু মুসলিম কিছু দেশের সাথে সম্পর্কের কথা ভেবে সেই নীতি থেকে সরার সম্ভাবনা তাদের নেই বললেই চলে।

‘মৌলিক কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে করি না,’ বলেন স্মিতা গুপ্তা। "কারণ তাহলে বিজেপিই থাকবে না। নির্বাচনের জেতার জন্য তারা যে কোনও পন্থা নিতে পারে, এবং ভবিষ্যতেও নেবে।’

‘আমি ১৯৮০-এর দশকের শেষ থেকে বিজেপিকে খুব থেকে পর্যবেক্ষণ করছি। তাদের কোন বদল নেই। কৌশলগত কিছু পদক্ষেপ হয়ত দেখা যাবে। 'আমরা সবাইকে কেয়ার করি’ ধরনের বক্তব্য বিবৃতি কিছুদিন শোনা যাবে, কিন্তু বিজেপি বদলাবে না।’

ভারতে মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক দল এআইএমআইএমের নেতা এবং এমপি আসাদ উদ্দিন ওয়াইসী এনডিটিভির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ছয় থেকে সাত দিনের মধ্যে দেখতে পাবেন ওই একই মানুষগুলো আবার মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেছে।’

নূপুর শর্মার বরখাস্তের পর ভারতে ফেসবুক এবং টুইটারে - যেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং বিজেপির সমর্থকদের বিশাল প্রাধান্য - নূপুর শর্মার পক্ষে রীতিমত ঝড় শুরু হয়েছে। যেদিন নূপুর শর্মাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় সেদিনই কয়েকটি হ্যাশট্যাগে তার পক্ষে হাজার হাজার মানুষ কথা বলতে শুরু করে। তারা বিজেপি এমনকি মোদির সমালোচনা করতেও ছাড়ছে না।

এরাই বিজেপির মূল সমর্থক, এবং এদের চটানোর বিন্দুমাত্র কোনো ইচ্ছা বিজেপি নেতৃত্বের মধ্যে রয়েছে বলে কেউই মনে করেন না।

দিল্লিতে জওয়াহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদোয়াজ মনে করেন, গত আট বছর ধরে বিজেপির রাজনীতির ফলে ভারতের বৈদেশিক সম্পর্কে কোন ক্ষতি হয়নি, এবং আরব দেশগুলোর প্রতিক্রিয়াও ক্ষণস্থায়ী হবে বলে তার বিশ্বাস।

‘বিজেপির মধ্যে যথেষ্ট জ্ঞান-বুদ্ধির অভাব রয়েছে এমন দু-একজন টিভি বিতর্কে রেডলাইন ক্রস করেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিজেপি তাদের সাথে দূরত্ব তৈরি করেছে। একজন-দু'জনের বক্তব্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্পর্কে তেমন কোন প্রভাব পড়ে না,’ বিবিসিকে বে
এমন যুক্তি একেবারে ফেলে দেওয়ার মত নয়। গত আট বছরে ভারতে মুসলমানদের দুর্দশা ক্রমাগত বাড়লেও সৌদি আরব, কাতার, ইউএই'র মত প্রভাবশালী দেশ তা নিয়ে টু শব্দও করেনি। এ সময়ে বরঞ্চ মোদী সরকারের সাথে আরব এই শাসকদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে।

‘শক্তিধর হলে তাদের সাথে ব্যবসা করবেই’
এমনকি, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করে সেখানে দীর্ঘদিন ধরে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করার পরও বাকি বিশ্বের মত এসব আরব মুসলিম দেশ কোনও কথাই বলেনি, যা নিঃসন্দেহে বিজেপিকে আরও আত্মবিশ্বাসী করেছে।

স্মিতা গুপ্তা মনে করেন, গত আট বছরে বিজেপির মধ্যে এক ধরণের বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে শক্তি অর্জন করলে কেউই কিছু করতে পারবে না।

‘তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর হলে আদর্শ-নীতি নিয়ে বাইরের দেশ বেশি মাথা ঘামাবে না। সেজন্য তারা তিন ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির কথা বলে। তারা মনে করে, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর হলে মানুষ তাদের সাথে ব্যবসা করবেই,’ বলেন গুপ্তা।

‘সুতরাং বিজেপি মুখপাত্রকে সরিয়ে দেওয়ায় যদি কারও মনে হয় বিজেপি এবার বদলাবে, আমি বলব কখনই তা হবে না।’

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ