কে এই নাথান বম? বান্দরবানে বম পার্টির উদ্দেশ্য কি? পেছনে কারা?

  চিররঞ্জন সরকার

২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৪৩ | অনলাইন সংস্করণ

নাথান বম
পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলোর মধ্যে যারা সবদিক থেকেই পিছিয়ে আছে তাদের মধ্যে বম সম্প্রদায় একটি। এদের আবাসস্থলও বেশ গহীনে। বম পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নাম। বমরা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বলে মনে করা হয়। ‘বম’ শব্দের অর্থ হলো বন্ধন। জীবনের যাবতীয় কর্ম, শিকার পর্ব, নৃত্যগীত, পানাহার, দেবতার উদ্দেশে যজ্ঞ নিবেদন সবকিছুই একত্র হয়ে সম্মিলিতভাবে সম্পাদন করার রীতি থেকে ‘বম’ বা ‘বন্ধন’-এর ধারণাটি এসেছে। বান্দরবান জেলার রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও সদর থানা এবং রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি থানায় মোট ৭০টি গ্রামে বম জাতির বসবাস। বমদের সঙ্গে বাংলাদেশের মূলস্রোতের মানুষের যোগাযোগ ও জানাশোনা অতি সামান্যই। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বান্দরবানে রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি ও বান্দরবান সদর উপজেলায় বর্তমানে বম জনসংখ্যা ১১ হাজার ৬৩৭ জন। তাঁদের বেশির ভাগের বসবাস রুমা উপজেলায়। এই বমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিসমূহের মধ্যে বিভিন্ন বিচারে প্রান্তিকদের মধ্যেও প্রান্তিক অবস্থানে, তাদের মধ্যে সাক্ষরতার হারও খুব কম। 

তাদের অব্যাহত আর্থসামাজিক প্রান্তিকায়নের প্রেক্ষাপটে বঞ্চনাজনিত হতাশা, ক্ষোভ, না-পাওয়ার বেদনাবোধ তীব্র ছিল। সেই বঞ্চনা ও ক্ষোভকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে তাদের একত্রিত করেছেন, তাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া যুবক নাথান লনচেও বম। প্রথমে তিনি এলাকার উন্নয়ন ও পরিবেশপ্রতিবেশ রক্ষার জন্য একটি এনজিও গড়ে তুলেছেন। পরে গড়ে তুলেছেন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন। পাশাপাশি কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)-র শীর্ষ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই সশস্ত্র সংগঠনটির অব্যাহত চাঁদাবাজি, খুন, ডাকাতির ঘটনায় পাহাড়ি অঞ্চল নতুন করে অশান্ত হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে নাথান বম ইতিমধ্যে তিনি দেশবিদেশে আলোচিত হয়েছেন। বান্দরবানে দিন দুপুরে কেএনএফের পর পর দুটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার পর নাথান বম পলাতক রয়েছেন। 

নাথান বমের উত্থানের কাহিনি
নাথান বম ছাত্রজীবনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে যুক্ত ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) ছাত্রসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) ঢাকা মহানগর শাখা ও কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সক্রিয় সদস্যও ছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে যুক্ত হন জনসংহতি সমিতিতে।

২০০৮ সালে রুমার ইডেন পাড়ায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামের একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন নাথান বম। কেএনডিও পার্বত্যাঞ্চলের সুবিশাল বনাঞ্চলকে সবুজায়ন, পশু-পাখি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংরক্ষণ সহ তাঁর জনহিতকর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিল। রুমার ইডেন পাড়ায় অবস্থিত ওই এনজিওর অফিসে একটি লাইব্রেরিও প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্থানীয় সেনাকর্মকর্তারা লাইব্রেরিটি উদ্বোধন করেন। 

সব কিছু ভালোয় ভালোয় চলছিল। এক পর্যায়ে নাথান বম কুকি-চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। প্রথমদিকে তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পরিচালনা করে। এরপর ভারতের মনিপুর ও মিয়ানমারের চিন রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। সেই থেকে গঠন হয় সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। 
মূলত সন্তু লারমার জেএসএস থেকে বের হয়ে বম জাতিগোষ্ঠীর কিছু সদস্যকে নিয়ে নাথান বম সশস্ত্র সংগঠনটি তৈরি করেন। যে কারণে এটি বম বাহিনী বা বম পার্টি হিসেবেও পরিচিত।

বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আবেগকে ব্যবহার
নাথান বম যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে (এখন চারুকলা অনুষদ) পড়াশুনার সুযোগ পায়, তখন তা নিয়ে বম সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে গর্বের কমতি ছিল না। সেই নাথানই এখন বম সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য বিপদ ডেকে এনেছেন। সশস্ত্র সংগঠন এবং চাঁদাবাজি, খুন, ব্যাংক ডাকাতির বেআইনি কাজ করে নিজে যেমন বিপদের মুখে পড়েছেন, একইসঙ্গে বম সম্প্রদায়কেও বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। বেশির ভাগ বম মানুষ নাথানের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও, তাদের দেখা হচ্ছে সন্দেহের চোখে। 

নাথাম বম অবশ্য রাতারাতি নেতা হননি। সে ছাত্রজীবন থেকেই পাহাড়ি রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল। সে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের স্থানীয় নেতা ছিলেন। নাথানের মধ্যে এক ধরনের উচ্চাশা ছিল। একইসঙ্গে জীবনযুদ্ধে তাকে চাকমা-মারমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছিল। এই প্রতিযোগিতায় নাথান টিকতে পারছিল না। ফলে নাথানের রাগ বা ক্ষোভ গিয়ে পড়তে থাকে চাকমাদের ওপর। এই ক্ষোভ থেকেই নাথান পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। কেননা এটা জনসংহতি সমিতি বা জেএসএসের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। আর চাকমারাই মূলত এর নিয়ন্ত্রণে।

ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও হতাশা নাথান বমকে সবচেয়ে বেশি পরিচালিত করে। ছাত্রত্ব শেষ করার পর সে জাতিসংঘের একটি সংস্থায় চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর এই সংস্থাটি পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য কাজ করছিল। সেটা ২০০৩ সালের কথা। কিন্তু সেই চাকরিটা তার হয়নি। চাকরিটা পেয়েছিল কয়েকজন চাকমা যুবক। সে সময় নাথানের ধারণা জন্মেছিল কেবল বম সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে এবং চাকমা না হওয়ার কারণে তার চাকরিটা হয়নি।

এরপর সবকিছু ছেড়েছুড়ে নিজের এলাকায় চলে যান নাথান। নামেন পর্যটন ব্যবসায়। একটা রিসোর্ট করেন নিজের এলাকায়। কিন্তু সেই ব্যবসাও বেশিদিন টেকেনি। এরপর ২০০৮ সালে কুকি চিন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি এনজিও গড়ে তোলেন। স্থানীয়দের ধারণা, তখন থেকে নাথান অন্য পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন তিনি। এনজিও গড়ার পর হয়তো তিনি কোনো জায়গা থেকে টাকা পেয়েছিলেন, যা দিয়েই সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তুলেছেন। 

কেএনএফ শুরুতে পাহাড়ে ৯টি উপজেলা নিয়ে নতুন রাজ্যের দাবি তোলে। একপর্যায়ে তা থেকে সরেও আসে কুকি চিন। নতুন করে দাবি তোলে স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল করার। দাবির ক্ষেত্রে সংগঠনের অবস্থানের পরিবর্তন হলেও দুটি তিনটি বিষয়ে তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেগুলো হলো পাহাড়ের প্রথম দল জেএসএস এবং আঞ্চলিক পরিষদের বিরোধিতা আর চাকমা বিদ্বেষ। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে চাকমারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে তারা এগিয়েও। তিন পার্বত্য জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক পদ হলো চিফশিপ এবং হেডম্যান। এদের বেশির ভাগই চাকমা, নয়তো মারমা সম্প্রদায়ের। এ জন্য পাহাড়ে বাঙালি বাদে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী সংগঠন, ইউনিয়ন, উপজেলা এবং ব্যবসা, এনজিও, প্রশাসনিক সব পদে হয় চাকমা, নয় মারমা জনগোষ্ঠীর লোকজনের প্রাধান্য। পাহাড়ে যে আন্দোলন হয়েছে, পাহাড়িদের অধিকারের জন্য যে সংগ্রাম হয়েছে, সেটা শুধু চাকমা বা মারমারাই করেনি। পাহাড়ের সবাই করেছে। অথচ সুবিধাগুলো বলা যায় কেবল একটি–দুটি জনগোষ্ঠীই নিয়ে নিচ্ছে। অন্যরা অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। এ নিয়ে চাকমা ও মারমা ছাড়া অন্য গোষ্ঠীগুলোর ক্ষোভও আছে। এ ক্ষোভকেই নাথান বম যথাযথভাবে ব্যবহার করেছেন। বঞ্চনার চিত্র সামনে এনে বম-যুবাদের সশস্ত্র হতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। 
কবি বলেছেন, ‘টোটা ও রজনীগন্ধ্যা একই বৃন্তে কখনো ফোঁটে না, যে হাতে ভোজালি ওঠে, সে হাতে কখনো কবিতা ওঠে না।’ কিন্তু না, নাথান বোমের ক্ষেত্রে কথাটি অসত্যে পরিণত হয়েছে। সে পুরোদস্তুর একজন সৃজনশীল মানুষ। 

১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর সহশিল্পী নিম্মী দেওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের মহাজনপাড়া এলাকার লারমা স্কয়ারে এম এন লারমার একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। তখন হিল আর্টিস্টস গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। নাথানদের নির্মিত লারমার আবক্ষ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয় ২০০০ সালে। এরপর শিল্পী হিসেবে তাঁর খ্যাতি বাড়ে। তিনি লেখালেখি করতে শুরু করেন।

২০১৫ সালে ইউরোপের শিল্পাঙ্গন ও আর্ট স্কুলসমূহে শিল্পচর্চা করেন। নেদারল্যান্ডস সহ কয়েকটি আর্ট প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেটসহ ডিপ্লোমা অর্জন করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিত্রশিল্পীদের তাঁর সম্পর্কোন্নয়ন হলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ কর্তৃক আয়োজিত আর্ট কন্টেস্টেও অংশগ্রহণ করেন এবং পুরস্কৃত হন।

তিনি বম জনগোষ্ঠীর প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ-প্রণেতা ও এথনোগ্রাফার। ২০০২ সালে বম জনগোষ্ঠীদের সাহিত্য সংরক্ষণ ও চর্চার জন্যে সাহিত্য সংগঠন ‘বম লিটারেচার ফোরাম (বিএলএফ) প্রতিষ্ঠা করেন। কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন।

২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন নাথান। মনোনয়নপত্র বাতিল হলে শেষ পর্যন্ত তাঁর আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ হয়নি। 

প্রশ্ন উঠেছে, প্রত্যন্ত এক এলাকায় থেকে কীভাবে এই সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলার রসদ পেলেন নাথান বম? তাঁর শক্তির উৎস কোথায়? এখন তিনি কোথায়ই–বা আছেন?
পাহাড়ে নানা সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পাহাড়ি জেলায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা অবশ্য নতুন নয়। স্বাধীনতার আগে থেকেই এখানে এখানে বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল। একসময় ভারতের মিজোরামের বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ বান্দবানের পাহাড়ে আস্তানা গেড়ে তাদের তৎপরতা চালাত। 

১৯৭৫ সালের পর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। তাদের সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী নামে পরিচিত ছিল। দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা এই সশস্ত্র আন্দোলন শেষ হয় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হওয়ার পর। সশস্ত্র লড়াইয়ের এ সময়ে গরম বাহিনীসহ পাহাড়ে ছোট ছোট কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টি হয়। তবে তারা বেশি দিন টেকেনি। চুক্তির পর চুক্তিবিরোধী পাহাড়ি তরুণদের একটি গোষ্ঠী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলে। তাদের সঙ্গে জেএসএসের সংঘাত আজও থামেনি।

এর মধ্যে ২০০৭ সালে জেএসএসের একটি অংশ মূল দল থেকে বের হয়ে জেএসএস (লারমা) নামে আরেকটি সংগঠন গড়ে তোলে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময় ম্রো ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি) নামের একটি দল গড়ে ওঠে বান্দরবানের আলীকদমে। খুন, অপহরণসহ নানা সন্ত্রাসী কাজে জড়িয়ে পড়ে দলটি। এরপর ২০১৫ সালের নভেম্বরে দলটির ৭৯ জন সদস্য একযোগে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর দলটির তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। ওই বছরই আলীকদমে ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর কিছু তরুণ সদস্যকে নিয়ে আরেকটি সশস্ত্র দল গঠিত হয়। এর প্রধান রুংজুমা ত্রিপুরা প্রতিবেশী একটি দেশে চলে গেছেন বলে এলাকায় প্রচার আছে। ওই দলেরও এখন কোনো তৎপরতাও নেই।

২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে আরেক দল গড়ে ওঠে। ইউপিডিএফের কর্মীদের হত্যা ও হামলার মধ্যে দিয়েই দলটির প্রকাশ ঘটে। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আগে বান্দরবানে ‘মগ পার্টি’ নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা শুরু হয়। মারমা জাতিগোষ্ঠীর কিছু সদস্য এ দল গঠন করে বলে স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে। সর্বশেষ আত্মপ্রকাশ করে কেএনএফ।

কেএনএফের উত্থান, অপতৎপরতা ও বিস্ময় 
পার্বত্য চট্টগ্রামে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সশস্ত্র শাখা শান্তি বাহিনী। দুই দশক ধরে চলা এই লড়াইয়ে নানা সহিংসতার ঘটনা ঘটে। কিন্তু এ সময় পার্বত্য তিন জেলার কোথাও দিনদুপুরে প্রকাশ্যে শান্তি বাহিনী ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে, এর কোনো নজির নেই। তাই সম্প্রতি বান্দরবানের দুই ব্যাংকের তিন শাখায় পর পর দুইদিন কেএনএফের ডাকাতির ঘটনা এবং একেবারে নির্বিঘ্নে দুর্বৃত্তদের চলে যাওয়ার বিষয়গুলো বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। 
আত্মপ্রকাশের পর দুই বছরে অন্তত নয়টি বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে কেএনএফ। গত বছর কেএনএফের সন্ত্রাসীদের চারটি হামলার ঘটনায় পাঁচ সেনাসদস্য নিহত হন। 

আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সঙ্গে সংঘর্ষে গত বছর রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাংপাড়া এলাকায় আটজন এবং রুমা উপজেলার মুয়ালপিপাড়া একজন নিহত হন। এ ছাড়া গত বছরের ৮ মে রোয়াংছড়ি উপজেলা পাইংখিয়ংপাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগের একজন নেতাসহ বম জনগোষ্ঠীর তিনজন এবং ২০২৩ সালের ২২ মার্চ একই উপজেলার রামথারপাড়ায় থংচুল বম নামের এক কারবারিকে (পাড়াপ্রধান) গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০২২ সালের ২১ জুন রাঙামাটির বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় সন্ত্রাসীরা তিন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। এই হামলাও কেএনএফ চালিয়েছে বলে মনে করা হয়। 

কেএনএফের লাগাতার অপতৎপরতার মুখে তাদের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয় ২০২৩ সালের মে মাসে। এই অভিযান চলাকালেই ২০২৩ সালের ৩০ মে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ গঠিত হয়। এর প্রধান বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা। ওই বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে কমিটির সঙ্গে কেএনএফের কয়েকবার ভার্চ্যুয়াল বৈঠকও হয়। পরে গত নভেম্বরে ও এ বছরের ৫ মার্চ কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সরাসরি দুটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। ২২ এপ্রিল সেই আলোচনায় আবার বসার কথা ছিল। কিন্তু এর আগেই পাহাড়ের দুই ব্যাংকের তিন শাখায় ডাকাতি করে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। এখন শান্তি আলোচনার উদ্যোক্তারাও আর এ উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যেতে চান না। তাই পাহাড়ে এক অনিশ্চয়তা, ত্রাসের আবহ তৈরি করেই রইল কেএনএফ।

যদিও এই ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। এই কমিটি কারা গঠন করল, কেন করল, কাদের অনুমোদন নিয়ে করল, সে ব্যাপারেও অনেক অস্বচ্ছতা রয়েছে।
কোনো গোষ্ঠী যদি নতুন কোনো রাজ্য দাবি করে, তাদের কোনো বঞ্চনা থাকে, তবে তাদের এসব উপস্থাপন করার কথা রাষ্ট্র বা সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে। কিন্তু কেএনএফের বেলায় একটা ভিন্ন বিষয় দেখা গেছে। তা হলো, তারা সেই ২০২২–এর শুরুর দিক থেকে ফেসবুকে পাহাড়ের ৯ উপজেলা নিয়ে পৃথক রাজ্যের ঘোষণা দেয়। তাদের ফেসবুক পেজে সরকারের কোনো দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নয়, সমস্ত ক্ষোভ আঞ্চলিক পরিষদ, জেএসএস এবং চাকমাদের ওপর চাপায়। এই তিনটি ছাড়া তাদের ঘৃণার আর কোনো জায়গা ছিল না। বিভিন্ন মহল্লায় হামলা চালিয়ে চাকমাদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার নানা বার্তা তারা দিতে থাকে। 

২০২২–এর অক্টোবরে জঙ্গিগোষ্ঠীকে সহযোগিতার অভিযোগ উঠলে কেএনএফের বিরুদ্ধে র‌্যাবের বিশেষ অভিযান শুরু হয়। এর মধ্যেই গত বছরের মে মাস থেকে শুরু হলো শান্তি আলোচনার উদ্যোগ। এরপর ‘রাজ্যের’ দাবি ছেড়ে কেএনএফ ছয় দফা দিয়ে নতুন আবদার করল বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি নিয়ে পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রণয়নসহ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল দেওয়ার। এই অঞ্চলের নামও তারা দিয়ে দেয়, ‘কুকি–চিন টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল’ বা কেটিসি।

কেএনএফের সঙ্গে আলোচনার জন্য গঠিত শান্তি কমিটির কাছে নতুন ছয় দফা তুলে ধরে কেএনএফ। তাদের শর্ত, ‘কেটিসির যাবতীয় দাপ্তরিক কার্যাবলি কোনোভাবেই পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ বা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের আওতাধীন থাকিবে না।’ এখানেই শেষ নয়। কেএনএফ চায়, কেটিসির চেয়ারম্যান হবেন পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থাপনাকেও পাল্টে দিতে চায় কেএনএফ। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম সুদীর্ঘকাল ধরে চাকমা, বোমাং ও মং সার্কেলে বিভক্ত। তিন সার্কেল প্রধান বা রাজা সরকারের হয়ে রাজস্ব আদায় করেন। বাংলাদেশের ৬১ জেলা থেকে ভিন্ন এখানকার ভূমি ব্যবস্থাপনা আর সেটা আইনত স্বীকৃত। কিন্তু কেএনএফ চায়, ভূমিতে সার্কেল প্রধান বা মৌজার হেডম্যানদের কোনো ক্ষমতা থাকবে না।

কেএনএফের তৎপরতা দেখে খুব সহজেই অনুমান করা যায় এর পেছনে বড় কোনো স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ইন্ধন আছে। পার্বত্য চুক্তির মূল চেতনাকে নস্যাৎ করে দেওয়াই এসব গোষ্ঠীর মূল কাজ। সংখ্যাগরিষ্ঠ পাহাড়িরা পার্বত্য চুক্তির যেমন পক্ষে, আবার আঞ্চলিক পরিষদসহ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও তাদের আস্থা কম নয়। এমন পরিস্থিতিতে ‘চাকমা’ কর্তৃত্বের অভিযোগ তুলে কেএনএফ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতার সঙ্গে ভারতের মণিপুরের কুকিদের সঙ্গে স্থানীয় মেইতেইদের সঙ্গে চলমান সশস্ত্র বিরোধ, মিয়ানমারের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর অব্যাহত সংঘাতকে দূরে রাখার অবকাশ নেই। কাজেই কেএনএফের তৎপরতার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশকে নিয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের খেলা কিন্তু থেমে নেই। কেএনএফ এই গোষ্ঠীর নতুন কোনো এজেন্ডা কিনা, সেটা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। 

সশস্ত্র আন্দোলন দাবি আদায়ের স্বীকৃত পথ নয় 
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে রাজনৈতিক সংকটের শুরু সেই স্বাধীনতার পর থেকেই। ধীরে ধীরে তা একপর্যায়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। প্রায় চার দশকের এই সংঘর্ষে বারবার পাহাড়ের বুক চিড়ে বয়ে গেছে রক্ত আর হিংসার ধারা।      

১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সরকারের করা পার্বত্য শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে সহিংসতার অবসান ঘটবে বলে আশায় বুক বেঁধেছিলেন পাহাড়ের ১৩টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। যদিও পরের প্রায় আড়াই দশকে তা হয়নি। নানা সমীকরণ ও বিভেদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সহিংসতায় বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে পাহাড়; ঝরেছে অজস্র প্রাণ।  
তবে হ্যাঁ, নিশ্চিত মৃত্যু কিংবা কারানির্যাতনের ভয়কে তুচ্ছ করে ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠীর কিছু যুবক কেন অস্ত্র হাতে তুলে নিল এটাও খুঁজতে হবে। তাদের বঞ্চনার কারণগুলো দূর করার ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। যারা বিপথে রয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তবে অনেকেই বম জনগোষ্ঠীর সবাইকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করছে। কুকি-চিন সদস্যরা বম জনগোষ্ঠীর হলেও এতে বমরা সবাই জড়িত নয়। এটা আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকেই বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। আর শুধু কুকি-চিন নয়, পাহাড়ে আরও বিভিন্ন সশস্ত্র দল রয়েছে। এগুলোর ব্যাপারেও সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।

প্রসঙ্গত, সশস্ত্র আন্দোলন করে খুব সহজে হয়তো দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, নাম কামানো যায়, কিন্তু আখেরে কী খুব একটা লাভ হয়? আমাদের এ উপমহাদেশে সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি এবং তাদের আন্দোলন কিন্তু খুব একটা সফল হয়নি। সেই অনুশীলন গ্রুপ থেকে শুরু করে নকশাল, সর্বহারা কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামে জেএসএস কিংবা ইউপিডিএফের আন্দোলনের কথা আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। আন্দোলনকারীরা কখনো গণসমর্থন পায়নি। কারণ মানুষ হত্যাকে কখনো যুক্তি দিয়ে জায়েজ করা যায় না। আর যুগে যুগে রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে সশস্ত্র আন্দোলনকারীদের দমন করেছে। সশস্ত্র বিপ্লবীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়ে, কিংবা গুলি খেয়ে মরেছে। কেউ কেউ জেলখানায় যুগের পর যুগ ধরে নির্যাতন ভোগ করেছে। সশস্ত্র গ্রুপগুলো নিজেরা মারামারি করেও মরেছে। অস্ত্রের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। আর সশস্ত্র রাজনীতির সঙ্গে যারা যুক্ত তারা কখনোই অন্যের মত ও পথকে গ্রহণ করতে পারে না। তার নিজের মতটিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার চেষ্টা করে। আর মতের মিল না হলেই তারা একে অপরকে শেষ করে দিতে চায়। নকশাল ও সর্বহারারা যত মরেছে পুলিশের গুলিতে, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি মরেছে নিজেরা গোলাগুলি করে। 

আমাদের মতো দেশে সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে তুলে আন্দোলন করা সহজ কাজ নয়। কেননা আমাদের ছোট্ট একটু দেশ। বান্দরবান ছাড়া গভীর কোনো জঙ্গল ও পাহাড়ও নেই। মানুষের মধ্যে বঞ্চনার পাশাপাশি লোভ ও সুবিধাবাদিতা প্রবলভাবে বিরাজমান। একজন দালালি করে যদি ধন-সম্পদের মালিক হতে পারে, সুখেশান্তিতে বিসবাস করতে পারে, তাহলে আরেকজন ত্যাগ স্বীকারের আগ্রহ পায় না। আমাদের দেশের মানুষকে খুব অল্প টাকায় কেনা যায়। একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে লাগিয়ে দেওয়ায় খুব সহজ কাজ। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে এত বঞ্চনা, এত না পাওয়ার যন্ত্রণা, অপমান, তারপরও তারা বহুধা বিভক্ত। পাহাড়ে কোনো সংগঠনেরই একক আধিপত্য নেই। একের বিরুদ্ধে অপরকে লেলিয়ে দিয়ে, লোভ দেখিয়ে, সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পাহাড়ি সংগঠনগুলোকে বহুধাবিভক্ত করা হয়েছে। এখন সহজেই তাদের নিয়ন্ত্রণ ও শাসন করা যায়। ‘ভাগ করো এবং শাসন কর’  ব্রিটিশদের সেই অমোঘ কৌশল যুগে যুগে শাসকরা ব্যবহার ও প্রয়োগ করেছে। এবং সুফলও পেয়েছে। তাই নাথান বমের সশস্ত্র আন্দোলন যে টিকেব না, এটা খুব সহজেই বলা যায়।
জোর দিতে হবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে 

তবে শেষ কথা হলো, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সকল পক্ষকে মনোযোগী হতে হবে। পাহাড়ের সমস্যাগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। দীর্ঘ সশস্ত্র লড়াই এর পর পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর সঙ্গে  বাংলাদেশ সরকারের শান্তিচুক্তি সই হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর। তারপর অতিক্রান্ত হয়েছে ২০ বছরেরও বেশি সময়। কিন্তু এই চুক্তির কতোটা বাস্তবায়ন হয়েছে সেটা নিয়ে আছে বড় ধরনের বিতর্ক। সরকার পক্ষ বলছে, বাস্তবায়নের কাজ চলছে। কিন্তু পাহাড়িদের অভিযোগ- চুক্তিতে তাদেরকে যেসব অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছিলো তার অনেক কিছুই তারা এখনও পায় নি। 

ভূমি পাহাড়ের অন্যতম সমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামে এ সমস্যার বড় কারণ ১৯৮০–এর দশকে তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় অন্তত চার লাখ সমতলের বাঙালির অভিবাসন। পাহাড়ি মানুষের যুগ যুগের আবাসস্থলে অনেক বাঙালির বসতি গড়ে তোলা হয়। এতে পাহাড়ের ভূমি সমস্যা জটিলতর হয়ে পড়ে। ভূমি কমিশন গঠনের দুই যুগ পরও একজনের ভূমি সমস্যারও সমাধান হয়নি। পাহাড়ের যেকোনো জাতিগোষ্ঠীর মানুষকেই ভূমির এই জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু কেএনএফ বলছে, তাদের কল্পিত কেটিসিতে যেকোনো পাহাড়ি ও বাঙালি নতুনভাবে বসতি স্থাপন করতে পারবে। এমনকি দেশের যেকোনো অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বাঙালি এসে জমি কিনতে পারবে! এভাবে তারা দৃষ্টি আকর্ষণ ও অভিবাসী জনগোষ্ঠীর সমর্থন পাবার চেষ্টা করেছে। ভূমিবিরোধে নাকাল পাহাড়ে কেএনএফের এই প্রস্তাব কাদের স্বার্থ বিবেচনা করে দেওয়া, প্রশ্ন সেখানেই।

তিন পার্বত্য জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক পদ হলো চিফশিপ এবং হেডম্যান। এদের বেশির ভাগই চাকমা, নয়তো মারমা সম্প্রদায়ের। ইউনিয়ন, উপজেলা এবং ব্যবসা, এনজিও, প্রশাসনিক সব পদে হয় চাকমা, নয় মারমা জনগোষ্ঠীর লোকজনের প্রাধান্য। এ নিয়ে চাকমা ও মারমা ছাড়া অন্য গোষ্ঠীগুলোর ক্ষোভ রয়েছে। এই ক্ষোভ নিরসনের চেষ্টা করতে হবে। পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীগুলোকে কীভাবে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সামনে টেনে আনা যায়, তার সূত্র বের করতে হবে। 

পাহাড়িদেরকে স্বশাসন দেওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল যে তারা নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে। কিন্তু সেরকমটা হয়নি। সরকার এটাকে দেখছেন শুধুমাত্র প্রশাসনিকভাবে। চুক্তি অনুসারে একটি মন্ত্রণালয় হওয়ার কথা, মন্ত্রণালয় হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদ হওয়ার কথা, সেটা হয়েছে। ভূমি কমিশন গঠনের কথা ছিলো, সেটাও গঠিত হয়েছে। কিন্তু এসব তেমনভাবে কাজ করতে পারছে না। 

শান্তিচুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৭ সালের পরের বছরই গঠিত হয়েছিল আঞ্চলিক পরিষদ। এবং বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি- এই তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। কিন্তু তারপর থেকে গত দুই দশকে এসব পরিষদে একবারেরও জন্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। শুরুতে যাদেরকে সেসব পরিষদে বসানো হয়েছিল তারাই এখনও এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

এসব পরিষদের নির্বাচন হওয়ার কথা স্থানীয় ভোটারদের হাতে। কিন্তু সেই ভোটারদের তালিকাও তৈরি হয়নি। কারা ভোটার হবেন এবং কারা হবেন না- এনিয়েও রয়েছে বিরোধ। 
ভূমির মালিকানা সমস্যারও সমাধান হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে জমির মালিকানা নিয়ে আছে বিশেষ কিছু আইন। ব্রিটিশ আমলের সেসব আইন অনুসারে ভূমির মালিকানা প্রথাগতভাবে সেখানে যারা বসবাস করে আসছে সেসব পাহাড়ি মানুষের। এসব ভূমির মালিকানার কোনো দলিলপত্র নেই তাদের কাছে। কিন্তু পরে বাঙালিদেরকে যখন সেখানে নিয়ে গিয়ে তাদের জন্যে বসতি গড়ে দেওয়া হলো তখন শুরু হলো ভূমি নিয়ে বিরোধ, যাকে দেখা হয় সঙ্কটের মূল কারণ হিসেবে।

এই সমস্যা সমাধানের জন্যে ২০০১ সালে গঠিত হয়েছিল ভূমি কমিশন। কিন্তু গত ২৩ বছরে তারা একটি বিরোধেরও নিষ্পত্তি করতে পারেনি। শুরুতে যে আইন তৈরি করা হয়েছিলো সেটা নিয়েও ছিল অনেক সমস্যা। দেড় দশক পাল্টাপাল্টি বিতর্কের পর সেই আইনের সংশোধন হয়েছে ২০১৬ সালে। কিন্তু সেই আইন কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তার জন্যে যেসব রুলস বা বিধিমালার প্রয়োজন সেগুলো এখনও তৈরি হয়নি।

চুক্তিতে ছিল যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছ'টি ক্যান্টনমেন্ট থাকবে। কিন্তু এর বাইরে সেখানে অস্থায়ী যতো ক্যাম্প আছে সেগুলো সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু পাহাড়িদের অভিযোগ- চুক্তি অনুযায়ী সেসব করা হয়নি।

পাহাড়ি সংগঠনগুলোর হিসেব অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে চারশোরও বেশি অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। কিন্তু তাদের অভিযোগ যে এসব ক্যাম্পের মাত্র ৩৫টি প্রত্যাহার করা হয়েছে। তারা এও অভিযোগ করছে যে নতুন করেও সেনা ক্যাম্প স্থাপন হয়েছে।

শান্তিচুক্তি হওয়ার পর থেকে পাহাড়িদের সংগঠনগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে প্রায়শই সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায় এবং তাতে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে। চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার হতাশা থেকে এসব সংগঠন ভেঙে যাচ্ছে। ইচ্ছে করেই এই বিরোধ সৃষ্টি এবং তা জিইয়ে রাখা হচ্ছে। 

 একইসঙ্গে বাড়ছে বাঙালিদের বসতি ও পাহাড়ি-বাঙালি অবিশ্বাস। সত্তরের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দরিদ্র লোকজনকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। চার দশকেরও বেশি সময় পর পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ও বাঙালির সংখ্যা এখন প্রায় সমান সমান।

এই বাঙালিদেরকে বলা হয় সেটেলার। প্রত্যেককে পাঁচ একর করে জায়গা দেওয়ার কথা বলে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাদের উপর একের পর এক হামলার পর তাদের জন্যে আলাদা করে তৈরি করা হয়েছে গুচ্ছগ্রাম। পরে গুচ্ছগ্রামেও হামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে অবিশ্বাসও প্রকট। বাঙালিদের সংগঠনের দাবি পাহাড়িদের সংগঠন নিষিদ্ধ করা হোক। আর পাহাড়িদের দাবি এসব বহিরাগত বাঙালিদের সরিয়ে তাদেরকে যেখান থেকে আনা হয়েছে সেখানে তাদেরকে 'সম্মানজনকভাবে' পুনর্বাসন করা হোক।

শুধু তাই নয়, উন্নয়নের ক্ষেত্রেও পার্বত্য জেলাগুলো বঞ্চনার শিকার হয়েছে। সারা দেশে যেভাবে উন্নয়ন হয়েছে সেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন হয়নি। দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে উন্নয়নের জন্যে সেখানে যে বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করার কথা ছিল সেরকমও হয়নি। পাহাড়ি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের মতামতের ভিত্তিতে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না। 

লেখক: কলামিস্ট।

এই বিভাগের আরো সংবাদ