আজকের শিরোনাম :

আইএমএফ ঋণ: দেশের স্বার্থ যেন রক্ষা পায়

  আবু তাহের খান

০৯ আগস্ট ২০২২, ১১:৪৪ | অনলাইন সংস্করণ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি তাদের বিনা সুদের ‘রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবল ট্রাস্ট’ (আরএসটি) তহবিল থেকে বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার নীতিগত সম্মতি ঘোষণা করেছে। ৩ আগস্ট প্রদত্ত এক বিবৃতিতে তারা এই ঋণ দেওয়ার কথা জানায়, যার পরিমাণ ও শর্তাবলি শিগগিরই দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে এবং বস্তুত তখনই জানা যাবে বাংলাদেশকে কী পরিমাণ ঋণ কী কী শর্তে দেওয়া হবে, সেসব বিষয়। তবে প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর মেয়াদি এই ঋণ ১০ বছরের রেয়াতকালসহ মোট ২০ বছরে পরিশোধের সুযোগ থাকবে।

আইএমএফের কোনো সদস্যদেশ বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিতে পড়লে সংশ্লিষ্ট সদস্যকে আইএমএফ ঋণ দিয়ে সহায়তা করবে—এটা শুধু স্বাভাবিকই নয়, বস্তুত এটিই তার মূল প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব ও অঙ্গীকার। ফলে এরূপ ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ যে সম্প্রতি আইএমএফের কাছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চেয়েছে, তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ নিয়ে কর্তৃপক্ষীয় মহল থেকে অহেতুকই কেন একধরনের রাখঢাক ও লুকোচুরির ভাব দেখানো হলো, তা মোটেও বোধগম্য নয়। তা ছাড়া, বিষয়টি এমনও নয় যে আইএমএফের কাছ থেকে বাংলাদেশের ঋণ নেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। ১৯৭৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত আইএমএফের কাছ থেকে বাংলাদেশ ১০ দফায় মোট ১৭৬ কোটি ৯৪ লাখ মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছে, যার সর্বশেষটি নিয়েছে ২০১২ সালে। আর চলতি বছরের ঋণপ্রস্তাব চূড়ান্ত হলে এটি হবে ১১তম বারের মতো ঋণ গ্রহণ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এবার অনেকটা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েই এ ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও অতীতে বহুবারই তা নেওয়া হয়েছে অত্যন্ত ঠুনকো কিংবা স্বল্প প্রয়োজনে।

উপরিউক্ত সরল ও স্বাভাবিক বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি অপ্রয়োজনীয় ধোঁয়াশা ও ধূম্রজাল সৃষ্টি করার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে একধরনের সন্দেহ ও আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। তদুপরি বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত মজুতের বিষয়ে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএমএফের তথ্যের মধ্যে গরমিল পরিলক্ষিত হওয়ায় সেই আশঙ্কা আরও জোরদার হয়েছে এবং সেই জোরদারের মাত্রা ইতিমধ্যে এতটাই শক্ত ভিত্তি নিয়ে ফেলেছে যে, এ ব্যাপারে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেওয়াটা বেশ কঠিন হবে বলেই মনে হয়। অন্যদিকে আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ কী পরিমাণ ঋণ নেবে, তা নির্ধারণ করার জন্যও বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের প্রকৃত পরিমাণ জানাটা জরুরি। কারণ এ ক্ষেত্রে কোনোভাবেই অবমূল্যায়িত বা অতিমূল্যায়িত প্রাক্কলনের ওপর ভিত্তি করে চাহিদার পরিমাণ নির্ধারণ করা ঠিক হবে না। কেননা, আইএমএফ-ঋণের প্রতিটি ডলারই নানা কঠিন শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ। অতএব তাদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার আগে মজুতের বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত হবে বলে মনে করি।

বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে সর্বশেষ ঋণ নিয়েছিল এখন থেকে ১০ বছর আগে, ২০১২ সালে। ২০০৭-০৮ সময়কার বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার প্রায় চার বছর পর এ ঋণ নেওয়া হয়েছিল, যার পরিমাণ ছিল ২৭ কোটি ৪৩ লাখ মার্কিন ডলার। এখানে একটি বিষয় খুবই খটকাযুক্ত, ২০০৭-০৮ সময়ের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কালটি বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবেই উতরে যেতে পারলেও ২০১২-এর ভালো সময়ে এসে কেন তাকে ঋণ নিতে হলো! আর এখানেই আসে জবাবদিহি ও দেশাত্মবোধের প্রসঙ্গটি, যেসবের যথাযথ জবাব ও যুক্তি বাংলাদেশের আমলা ও রাজনীতিকেরা সব সময় ঠিকমতো দিতে পারেননি।

সে যা-ই হোক, আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ প্রথম ঋণ নিয়েছিল ১৯৭৪ সালে, যার পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ১৩ লাখ মার্কিন ডলার। আর ওই ঋণের অর্থ মূলত ব্যয় হয়েছিল খাদ্য, জ্বালানি তেল ও ওষুধ আমদানি বাবদ, যা সেই সময়ের জন্য শুধু অত্যাবশ্যকীয়ই ছিল না, ছিল জীবন রক্ষার অনিবার্যতাও। কিন্তু পরবর্তী চার দশকের বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে এমন বহু ঋণ নিয়েছে, যার একটি বড় অংশই দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম হয়নি; বরং বহু ক্ষেত্রে তা এমন সব শর্তে নেওয়া হয়েছে, যেগুলো একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের পক্ষে মেনে নেওয়া বস্তুতই অমর্যাদাকর। কিন্তু তারপরও ওই সব অমর্যাদাকর শর্ত মেনে নিয়েই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা সেসব চুক্তিতে সই করেছেন, ১৯৭৪ সালের মতো জরুরি পরিস্থিতি দেশে না থাকা সত্ত্বেও এবং অত্যন্ত কষ্টের সঙ্গে স্মরণ করতে হয়, আইএমএফের পরামর্শে বিভিন্ন সময়ে এ দেশের বহু নীতি ও আইনকানুন এবং বিধিবিধানও বদলে ফেলা হয়েছে, অথবা তাদের কথামতো নতুন নীতি, আইন বা বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে।

ঋণদানের নীতিগত ঘোষণা দেওয়ার পর পদ্ধতিগত পদক্ষেপের অংশ হিসেবেই আইএমএফ এখন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঋণচুক্তির বিভিন্ন শর্ত ও পরিমাণ নির্ধারণের জন্য আলোচনায় বসবে। স্বভাবতই এসব শর্তের আওতায় থাকবে এই ঋণের অর্থ কোন কোন কার্যক্রম, প্রকল্প ও কর্মসূচির আওতায় ব্যয় করা হবে, আমদানি করা পণ্যাদি কোন কোন দেশ থেকে আসবে, এ জন্য কোনো নিয়মকানুন বা বিধিবিধান পরিবর্তন করতে হবে কি না, কীভাবে, কত বছরে এ ঋণ পরিশোধ করা হবে ইত্যাদি বিষয়। এ-সংক্রান্ত আলোচনায় বাংলাদেশের রাজনীতিক ও আমলারা কি পারবেন আইএমএফের সঙ্গে দর-কষাকষিতে দেশের সার্বিক স্বার্থকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে যোগ্যতা, দক্ষতা ও দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রাখতে? অতীতের অধিকাংশ সময়ই তাঁরা তা পারেননি। কিন্তু তাই বলে এবারও কি তাঁরা পারবেন না?

আর্থিক বিষয়সংক্রান্ত দর-কষাকষিতে সিদ্ধান্তকে নিজেদের পক্ষে আনার জন্য বিষয়জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, চিন্তার সামর্থ্য, দূরদর্শিতা ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ব্যক্তিদের মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির প্রায় সবই হয়তো আছে। কিন্তু তারপরও সত্য এই যে এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য এগুলোর কোনোটিই যথেষ্ট নয়, যদি এসবের সঙ্গে দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি মমতা ও অনুভবের আত্মিক বোধটুকু না থাকে। বস্তুত দেশপ্রেমের এই বোধটুকুই কেবল পারে রাষ্ট্রের সব সিদ্ধান্তকে সাধারণ মানুষের স্বার্থের অনুগামী করে তুলতে। আর এটি আইএমএফের ঋণের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি সত্য রাষ্ট্রের আর দশটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলাতেও। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কি তা বোঝেন?


সৌজন্যে : দৈনিক আজকের পত্রিকা।

এই বিভাগের আরো সংবাদ