কটিয়াদীতে পাঁচশত বছরের ঢাকের হাটের ঐতিহ্য আজও অমলিন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ২০:৪৫

হাটের চারিদিকে শুধুই ঢাকিদের মহড়া। কোথাও ঢাকের আওয়াজ, কোথাও ঢাকের তালের সঙ্গে মিশেছে ঢোল, সানাই, বাঁশির সুর। নানা বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত সুরে ভিন্ন রকম উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে এই হাটে। স্থানীয়ভাবে এই ব্যতিক্রমী হাটের নাম ‘ঢাকের হাট’। প্রতি বছর দুর্গাপূজার আগে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে বসে এ হাট। আজ বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া এ হাট শেষ হবে শুক্রবার সন্ধ্যায়।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার রাজপ্রসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। উপজেলার চারিপাড়া গ্রামে ছিল ওই রাজার প্রসাদ। পূজায় ঢাক, ঢোল, বাঁশিসহ অংশ নিতে বিক্রমপুর (মুন্সিগঞ্জ) বাদ্যকরদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকি ও বাদকদল আসেন পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে উপজেলার যাত্রাঘাট নামক স্থানে। তারপর রাজা নিজে সবার বাজনা শুনে বেছে নেন সেরা দলটিকে। সেই থেকে ঢাকের হাটের শুরু। পরবর্তীতে পূজার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন জমিদারদের মধ্যে ঢাকের হাটের স্থান নির্ধারণ নিয়ে দ্বন্ধ শুরু হয়। অবশেষে যাত্রাঘাট থেকে স্থান পরিবর্তন হয়ে কটিয়াদী পুরাতন বাজারে গড়ে ওঠে ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট। স্থানীয়দের দাবি, প্রায় পাঁচশত বছর ধরে চলে আসা এটি কেবল হাট নয়, হয়ে গেছে এই অঞ্চলের সংস্কৃতির অংশও। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই ভিড় জমান এই হাটে।
জানা যায়, ঢাক ছাড়া দুর্গাপূজা বিবর্ণ, অসম্পূর্ণ। মহাষষ্ঠী থেকে বিসর্জন সবক্ষেত্রেই চাই ঢাকের আওয়াজ। তাই পূজার সময় ঢাক-ঢোলের কদর বাড়ে যায়। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে জীবিকার টানে ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকি ও বাদ্য বাদকরা আসেন এই হাটে। পাশাপাশি তাদের নিয়ে যেতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পূজার আয়োজকরাও আসেন এই হাটে। নাম ঢাকের হাট হলেও, এখানে ঢাক বা বাদ্যযন্ত্র কেনাবেচা হয় না। বাদ্যযন্ত্র বাদকেরা অর্থের বিনিময়ে কেবল পূজা চলাকালীন আয়োজকদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। কার চুক্তিমূল্য কত হবে, তা নির্ধারণ হয় বাদ্য বাদকদের দক্ষতার ওপর। সাধারণত ১২ হাজার থেকে লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যায় তাদের চুক্তিমূল্য।

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, দুর্গাপূজার আগেই ঢাকের হাটে উৎসবের সুর। শত শত বাদ্যযন্ত্রের বোল আর সুরের মুখরিত হয়ে উঠেছে আকাশ বাতাস। এই হাটে বাদ্য বাদকরা একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢাক, ঢোল, ড্রাম, বাঁশি, সানাই, ঝনঝনিসহ বাহারি বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন। বাদ্যের তালে তালে চলছে সুরেলা লড়াই। আর পূজা আয়োজকরা যাচাই করে দেখছেন, সঙ্গে চলছে দরদামও।
দোহার নবাবগঞ্জ থেকে তিনজনের একটি বাদকদলের নেতা হয়ে হাটে গেছেন বিনয় রায়। তিনি জানান, এবার পূজার আয়োজন বেশি হওয়ায় বাদকদলের চাহিদাও বেড়েছে। তার দলের পারিশ্রমিক কেউ কেউ ৪০ হাজার টাকা বলছেন, তবে তারা ৬০ হাজার টাকার কমে যাবেন না বলে তিনি জানালেন। কথা হলো আরো একজন বাদক দলের নেতার সাথে যিনি কিশোরগঞ্জ সদর থেকে মো. রোকন  ঢাক ও ঢোলের সাতজনের একটি দল নিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন, এটি তার মূল পেশা না। শখ আর বাড়তি আয়ের জন্য এসব করেন।
নরসিংদীর মনোহরদী থেকে  আট জনের একটি বাদকদলের নেতা ফারুক মিয়া জানান, এক যুগ ধরে তারা এই হাটে আসেন। তার দলের পারিশ্রমিক কেউ কেউ ৮০ হাজার টাকা বলছেন, তবে তারা ১ লাখ টাকার কমে যাবেন না বলে তিনি জানালেন।
নেত্রকোনার কেন্দুয়া থেকে বাদ্যদল বায়না করতে এসেছেন উৎপল কুমার। তিনি বলেন, “এই হাটে শ’য়ে শ’য়ে ঢাকি ও বাদককে একসঙ্গে পাওয়া যায়। বাড়তি পাওনা হিসাবে আমরা বাজনা পরখ করে নিতে পারি। তাই এই হাট থেকে প্রতি বছরই পূজার জন্য ঢাক-ঢোল বায়না করে নিয়ে যাই। এবারও এসেছি।”
কটিয়াদী উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও ঢাকের হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য বেণী মাধব ঘোষ বলেন, এ হাটের ইতিহাস ৫০০ বছরের পুরনো। প্রতি বছর দুর্গাপূজার আগে ঐতিহ্যবাহী এই ঢাকের হাটকে কেন্দ্র করে এলাকায় উৎসবে পরিণত হয়।
কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, এ হাট কটিয়াদীর ঐতিহ্য। ঐতিহ্যবাহী ঢাকঢোলের হাটটি পরিদর্শন করেছি। এ হাটে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকি ও বাদ্য বাদকরা যেমন এসেছেন, পাশাপাশি তাদের নিয়ে যেতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পূজার আয়োজকরাও এসেছেন।।
ধ্রুব/জসিম/রঞ্জন

 

 

 

 

এই বিভাগের আরো সংবাদ