আজকের শিরোনাম :

স্প্যানিশ ফ্লু'র মতো করোনা মহামারীও কি বিস্মৃত হবে?

  সায়েন্টিফিক আমেরিকান

১৮ আগস্ট ২০২০, ১৩:১১ | অনলাইন সংস্করণ

১৯২৪ সালে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা দুই খণ্ডে তখন পর্যন্ত ২০ শতকের ইতিহাস প্রকাশ করেছিল। ৮০ জনের বেশি লেখক- অধ্যাপক, রাজনীতিবিদ, সেনা এবং বিজ্ঞানীরা এ কর্মযজ্ঞে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। যদিও ১৩০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ের কোথাও ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর কোনো উল্লেখ নেই, যা কিনা পাঁচ বছর আগে ৫০ মিলিয়ন থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছিল। পরবর্তী দশকগুলোতেও ইতিহাসের বইগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনায় কেবল নোট হিসেবে এটির উল্লেখ করে।

বেশ কিছুদিন আগ পর্যন্ত জনপরিসরে মহামারীটি বিংশ শতাব্দীর অন্যান্য ঘটনার তুলনায় অজ্ঞাত থেকে গিয়েছিল। অন্যদিকে স্মৃতিস্তম্ভ ও ফেডারেল ছুটির দিনের মাধ্যমে দুটি বিশ্বযুদ্ধকে স্মরণ করা হয়। এমনকি অনেক জনপ্রিয় জাদুঘর এবং ব্লকবাস্টার সিনেমা বানানো হয়েছিল টাইটানিক ডুবে যাওয়া এবং চন্দ্র অভিযান নিয়ে। কিন্তু ১৯১৮ সালের ফ্লু বা স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে তেমন কিছুই হয়নি।

অবশ্য মহামারীটি পুরোপুরিভাবে ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অনেকেই আজ জানে যে এটা ঘটেছিল। তবে এ ঘটনা আমাদের সামাজিক আখ্যানে খুব অল্প জায়গাই দখল করতে পেরেছে।

ইতিহাসবিদ গে বেইনার বলেন, আমাদের একটি বিভ্রম আছে। আমরা বিশ্বাস করি যে যদি একটি ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয় এবং যদি তা অনেক অনেক মানুষকে প্রভাবিত করে, এটি যদি বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে, যদি অনেক মানুষ এতে মারা যায়, তাহলে সেটি অনিবার্যভাবে মনে রাখা হবে। এটা আসলে পুরোপুরি এভাবে কাজ করে না এবং স্প্যানিশ ফ্লু হলো সত্যিকার অর্থে তেমন সতর্কবার্তা।

বেইনার ১৯১৮ সালের মহামারী নিয়ে বই সংগ্রহ শুরু করেন ২০ বছর আগে থেকে। দীর্ঘ সময় ধরে এটি খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছিল। কিন্তু বিশ্ব কভিড-১৯-এর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর, তিনি এই সম্পকির্ত বাস্তব-অবাস্তব সব গল্পের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। আগে ১৯১৮ সালের মহামারীর সঙ্গে নতুন মহামারীকে তুলনা করা হতো মৃত্যুর হার, মাস্কের কার্যকারিতা এবং সামাজিক দূরত্বের বিধি মেনে চলা এবং সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাবের আলোকে। ফলে ২০২০ সালের মার্চ মাসেই স্প্যানিশ ফ্লুর ইংরেজিভাষী উইকিপিডিয়া পেজটিতে ভিউ হয়েছে রেকর্ড ৮.২ মিলিয়নের বেশি।

১৯১৮-এর ফ্লুুকে বৈশ্বিকভাবে ভুলে যাওয়া এবং তার চলমান পুনরাবিষ্কার প্রক্রিয়া সামষ্টিক স্মৃতির বিজ্ঞান সম্পর্কে একটি ধারণা প্রদান করে।

সামষ্টিক স্মৃতি কী?

বিশ শতকের গোড়ার দিকে সমাজবিজ্ঞানী মাউরিক হ্যালবাচস দ্বারা প্রবর্তিত সামষ্টিক স্মৃতিবিষয়ক অধ্যয়ন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক বিজ্ঞানের পরিসরে ব্যাপক আগ্রহ অর্জন করেছে।

ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী হেনরি রোডিগার সামষ্টিক স্মৃতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, কীভাবে আমরা একটি গোষ্ঠীর অংশ হিসেবে নিজেদের স্মরণ করি তা আমাদের পরিচয়কে গঠন করে। গোষ্ঠী বলতে উদাহরণস্বরূপ জাতি, রাজনৈতিক দল এবং ধর্মীয় সংঘকে বোঝানো হয়।

ঐতিহাসিক ঘটনার ক্ষেত্রে সম্মিলিত স্মৃতিকে অধ্যয়ন করার জন্য গবেষকরা প্রায়ই ওপেন-রিকল পদ্ধতি ব্যবহার করেন। যেমন রোডিগার ও তার সহকর্মী জেমস উইর্টশ আমেরিকান এবং রাশিয়ানদের কাছ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দশটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নাম জিজ্ঞেস করেন। আমেরিকানরা প্রায়ই পার্ল হারবার আক্রমণ, জাপানে বোমা মারা এবং হলোকাস্টের ঘটনাকে উদ্ধৃত করেছে। বেশির ভাগ রাশিয়ান বলেছে, স্তালিনগ্রাদে লড়াই, কুরস্কের যুদ্ধ ও লেনিনগ্রাদে অবরোধের কথা। দুটি পক্ষই বলেছে এমন ঘটনা হচ্ছে ডি-ডে। যেসব ঘটনা শক্তিশালীভাবে প্রতিটি দেশের মানুষ স্মরণ করে, গবেষকরা বলেন, অতীতকে মনে করার ক্ষেত্রে এটি প্রতিফলিত করে জাতির আখ্যানের কাঠামোকে।

এ ধরনের গবেষণা ইঙ্গিত দেয় ১৯১৮ সালের ফ্লুর বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে মানুষ কী জানে সে সম্পর্কে। উইর্টশ বলেন, যতদূর আমি জানি, কেউ এটা করেনি। যদি আপনি একটা জরিপ করেন, আপনি কিছুই পাবেন না। এমনকি কভিড-১৯-এর সঙ্গে তুলনায়ও আগের মহামারী সম্পর্কে অল্প কিছু মানুষ কেবল বিশদভাবে উল্লেখ করতে পারে।

উইর্টশের মতে, সম্মিলিত স্মৃতি অনেকাংশে সুস্পষ্ট সূচনা, মধ্য ও শেষের ওপর নির্ভর করে। তিনি বলেন, যদি এমন কোনো জ্ঞানীয় যন্ত্র যা কিনা সর্বব্যাপী ও প্রাকৃতিক তা হলো আখ্যান। তার মতে, সব মানব সংস্কৃতিই আখ্যান ব্যবহার করে।

যেসব দেশ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্ত ছিল বৈশ্বিক দ্বন্দ্ব একটি স্পষ্ট অ্যাখ্যান প্রদান করে, যেখানে নায়ক, ভিলেন, জয়, পরাজয়ের ব্যাপার আছে। এ অবস্থা থেকে একটি অদৃশ্য শত্রু যেমন ১৯১৮ সালের মহামারী সামান্যই আখ্যানের ধারণা দেয়। যার স্পষ্ট কোনো উৎস ছিল না, একাধিক ঝড়ে স্বাস্থ্যবান মানুষকে হত্যা করেছে এবং বুঝে ওঠার আগেই দূরে সরে গিয়েছিল। এমনকি সে সময় বিজ্ঞানীরা জানতেনও না এই ভাইরাস কোনো জীবাণু নয়, বরং ফ্লুর কারণে হয়েছিল। বেইনার বলেন, এটা ছিল আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের বড় ব্যর্থতা। এটাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কোনো আখ্যানমূলক স্কিমা তৈরি না হওয়ায় মহামারীটি পাবলিক ডিসকোর্স থেকে হারিয়ে গিয়েছে।

মিডিয়ার ভূমিকা

১৯১৮ সালের ফ্লুর উত্থানের সঙ্গে সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন ব্যাপকভাবে তা কাভার করে। মেগ স্পাট নামে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের এক লেকচারার বলেন, মার্কিন মিডিয়া এটাকে বায়োমিলিটারিস্টিক ভাষায় বর্ণনা করে। অনেক আর্টিকেল এই পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করে মানুষের সঙ্গে রোগের লড়াই হিসেবে। কিন্তু তা ভুক্তভোগী ও বেঁচে যাওয়াদের অভিজ্ঞতা সামান্যই এসেছে। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে রোগটির প্রভাব ম্লান হয়ে গিয়েছিল।

এদিকে কোনো আইকনিক চিত্র সামনে না এলেও স্বতন্ত্র ব্যক্তিরা অবশ্যই স্মরণ করবে কীভাবে কভিড-১৯ তাদের এবং তাদের পরিবারকে প্রভাবিত করেছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল ১৯১৮ সালের ফ্লুর ক্ষেত্রেও। ১৯৭৪ সালে ঐতিহাসিক রিচার্ড কোলিয়ের একটি বইয়ে লিখেন, সামষ্টিক স্মৃতি প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয় সে সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুসারে।

১৯১৮ সালের পর এটিই প্রথম মহামারী নয়। বিংশ শতাব্দী আরো ফ্লু মহামারী দেখেছে, যা ১৯৫৭ ও ১৯৬৮ সালে সংঘটিত হয়েছিল। বেইনার বলেন, দুটি ক্ষেত্রেই ফ্লু স্মৃতি ফিরে এসেছিল। মানুষ তখন উদাহরণ ও চিকিৎসা খুঁজতে শুরু করে।

সৌজন্যে - বণিক বার্তা

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ