আজকের শিরোনাম :

আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে কতোটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৮:২৪

বাংলাদেশের ঢাকায় যাদের বসবাস তাদের একটা বড় অংশই এসেছেন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে। যার প্রতিটিতে রয়েছে নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা। ঢাকায় থাকা এই পরিবারগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় এই আঞ্চলিক ভাষাকে একেকভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসিন্দা উম্মে সিন্থিয়া তার মা-বাবা আর ভাইবোনদের সঙ্গে নিজ জেলার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও সন্তানের সঙ্গে সচেতনভাবেই সব সময় প্রমিত বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করেন।

কারণ তিনি বলেন যেন তার সন্তান ঢাকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং তার কথায় যেন আঞ্চলিকতার টান না থাকে।

মিসেস সিন্থিয়া বলেন, "আমরা যা করবো একটা বাচ্চা তাই শিখবে। আমরা যদি তার শুরুটাই আঞ্চলিক ভাষা দিয়ে করি। তখন কিন্তু পুরোপুরি শুদ্ধ ভাষা চর্চা করানোটা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। তখন তার বাইরে পড়ালেখা করতে গিয়ে, কাজ করতে গিয়ে ঝামেলা হবে।"

"এজন্য আমরা চেষ্টা করি বাচ্চাকে আগে প্রমিত বাংলা শেখাতে। বড় হলে আমাদের থেকে শুনে শুনে সে এমনেই আঞ্চলিক ভাষা শিখে নিতে পারবে। ওটার জন্য আলাদা কিছু করার প্রয়োজন নেই," বলেন মিসেস সিন্থিয়া।

তবে উল্টো চিত্র হাসিনা রহমানের পরিবারে। নিজ বাড়ি সিলেটে হলেও সন্তান নিয়ে এখন তিনি বাস করছেন ঢাকায়।

পরিবারের সবার সাথে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তিনি, সন্তানদেরও আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেই অভ্যাস করিয়েছেন।যেন তারা তাদের শেকড় সম্পর্কে আরও ভালভাবে জানতে পারে। সেই সঙ্গে প্রমিত ভাষা চর্চার ক্ষেত্রেও তিনি সন্তানদের উৎসাহ দিয়ে গেছেন।

"আমরা সিলেটি। বাসাতে আমরা সিলেটি ভাষাতেই কথা বলি। যেন আমার বাচ্চারা নিজেদের এই আঞ্চলিক ভাষাটাকে ধরে রাখতে পারে। এটা যেন ভুলে না যায়। যেহেতু ওদের শিকড়টাই ওইখানে। আর শুদ্ধ ভাষাও শিখাইসি যেন বাইরে সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারে। এক কথায় আমরা সিলেটি আর শুদ্ধ দুটা ভাষাই চর্চা করি।"

বিশ্বে ভাষাভাষীর সংখ্যার ভিত্তিতে বাংলার স্থান পাঁচ নম্বরে। আর বাংলাদেশে বাংলা ভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিভিন্ন জেলায় আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন।

যেগুলোর প্রত্যেকটির রয়েছে নিজস্ব শব্দকোষ ও রীতি । তাই ভাষা বিচারে সেগুলোও এক একটি স্বতন্ত্র ভাষা বলতে চান বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, আঞ্চলিক এই ভাষাগুলো, প্রচলিত মান ভাষার চাইতে অনেকটা ভিন্ন হওয়ায়, অনেক পরিবার আঞ্চলিকের পরিবর্তে প্রমিত বাংলা শেখানোর চেষ্টা করেন এবং এ কারণে আজকাল শহরাঞ্চলে বেড়ে ওঠা মানুষের অনেকেই স্থানীয় উপভাষাগুলো সেভাবে বলতে পারেন না। এর পেছনে বাজারের বড় একটা প্রভাব আছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, "বর্তমান বাজারের জন্য নিজেকে তৈরি করতে অনেকে আঞ্চলিক ভাষা এড়িয়ে চলে। এটা যে তাদের ঐতিহ্য সেটা ভুলে যায়। আবার অনেকে চান না আঞ্চলিক ভাষায় কেউ কথা বলুক।"

"মান ভাষা জানলে যে আঞ্চলিক ভাষা ভুলে যাব। আবার আঞ্চলিক ভাষা বললে যে আমরা মান ভাষা শিখতে পারবো না, এটা ঠিক নয়। তবে হ্যাঁ, এজন্য পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি পরিশ্রম করতে হবে। সেটাই অনেকে করতে চান না।" বলেন মি. ইসলাম।

সাহিত্য চর্চায় শুদ্ধ আঞ্চলিক ভাষা, বিকৃত মিডিয়া ভাষা নয়

শুধু যে কথাবার্তার চর্চায় এই আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার হয় বিষয়টা তেমন নয়। অনেক সাহিত্য, কবিতা, গান ও নাটকে যুগ যুগ ধরে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার হয়ে আসছে।

সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমানের মতো বোদ্ধারাও আঞ্চলিক ভাষায় অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন।

এই আঞ্চলিকতার কারণে বাংলা ভাষা আরও নতুন নতুন শব্দে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছে বলে মনে করেন মি. ইসলাম।

তবে তিনি এক্ষেত্রে বলেছেন শুদ্ধ আঞ্চলিক ভাষার কথা। আঞ্চলিকতার নামে ভাষার বিকৃত রূপের কথা নয়।

মি. ইসলাম বলেন, "আঞ্চলিক ভাষার সাথে মান ভাষার কোন বিরোধ নেই। আঞ্চলিক ভাষার এই বৈচিত্র্য ভাষাকে শক্তিশালী করে, সমৃদ্ধ করে। তবে আঞ্চলিক ভাষার একটা শুদ্ধ রূপ আছে, যেটা সাহিত্যে এলেও ক্ষতি নেই।"

"কিন্তু এখন যে মিডিয়ার ভাষা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আইতাসি যাইতাসি ধরণের ভাষা। এগুলো কিন্তু কোন আঞ্চলিক ভাষা নয়। এই মিডিয়ার ভাষার কারণে আঞ্চলিক ভাষাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনেকে বিভিন্ন জেলা থেকে এসে এই বিকৃত মিডিয়ার ভাষা শিখে ফেলছে।" বলেন মি. ইসলাম।

ভাষার এই শুদ্ধ আঞ্চলিক রূপ টিকিয়ে রাখতে প্রত্যেকে যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভাষার ব্যবহারে সচেতন হয়; সেইসঙ্গে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেইসঙ্গে, সংস্কৃতি-সাহিত্য চর্চা নিয়ে যারা কাজ করেন তারা এগিয়ে আসলে বাংলা ভাষার এই বৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ