আজকের শিরোনাম :

কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি কাশ্মীর

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৩:৫১

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিখণ্ডিত হিমালয়ান রাজ্য কাশ্মীরের জন্য ২০১৯ সালটি নাটকীয় রাজনৈতিক অগ্ন্যুৎপাতের এক সময় হিসেবে এসেছে। সেই উত্তেজনা শিখরে ওঠে আগস্ট মাসে, যখন ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের আইনে পরিবর্তন আনে ভারত সরকার, ফলে হতবাক হয়ে যায় পুরো বিশ্ব।

তবে কাশ্মীর এমন একটি অঞ্চল যা বরাবরই উত্তেজনার কারণ। ১৯৪৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন অবসানের পর থেকে কাশ্মীর নিয়ে তিন দফা যুদ্ধ করেছে ভারত ও পাকিস্তান। আশির দশকের পর থেকে দফায় দফায় পাকিস্তানের সমর্থনপুষ্ট ইসলামপন্থি আন্দোলনের ঘটনা ঘটেছে, যাতে নিহত হয়েছে অন্তত ৭০ হাজার মানুষ।

কেন ২০১৯ সাল অঞ্চলটির জন্য এত অস্থিরতার?
পাকিস্তানভিত্তিক জইশ-ই-মুহাম্মদ জঙ্গি গ্রুপ সংশ্লিষ্ট একটি হামলার মধ্য দিয়ে বছরটি শুরু হয়েছিল। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামার ২২ বছর বয়সী এক তরুণ সেনাবাহিনীর একটি কনভয়ে বিস্ফোরক নিয়ে আত্মঘাতী হামলা চালায়, যাতে নিহত হয়েছিল অন্তত ৪০ জন সেনা সদস্য। এক বছর আগে থেকে নিখোঁজ ছিল ওই তরুণ। হামলার পরপরই তরুণের ভিডিও পোস্ট করে হামলার কৃতিত্ব দাবি করে জইশ-ই-মোহাম্মদ।

এ হামলার পরে ১৯৭১ সালের পর আবার সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তান ভূখণ্ডে অভিযান পরিচালনা করে ভারত। ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় জেট বিমান বালাকোট অঞ্চলে উড়ে গিয়ে, তাদের ভাষায়, জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রশিক্ষণ শিবিরে বোমা ফেলে।

এ হামলায় ভারতের অন্ততপক্ষে দুইটি বিমান বিধ্বস্ত হয় এবং একজন ভারতীয় পাইলটকে আটক করে পাকিস্তান। এটা পাকিস্তানকে বিশেষ সুবিধা এনে দেয়। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর ফলে বালাকোট সংঘর্ষের সময় ভারতীয় পাইলটকে আটক করতে পারা পাকিস্তানকে বেশ সুবিধাজনক অবস্থান এনে দেয়।

তা সত্ত্বেও, ‘শুভেচ্ছার নিদর্শন’ হিসেবে আটক পাইলটকে দ্রুত ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তান। এই পদক্ষেপকে বিদেশের কিছু মহল প্রশংসা করলেও, অনেকে একে দেখেছেন উত্তেজনা বৃদ্ধি হওয়া ঠেকাতে পাকিস্তানের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে, যে জন্য দেশটির সামরিক বাহিনী প্রস্তুত নয়।

পাকিস্তান আরও একধাপ এগিয়ে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জঙ্গি গ্রুপগুলোর দপ্তর বন্ধ করে দেয়। স্পষ্টতই ভারতের হুমকির মুখে আন্তর্জাতিক মতামত সন্তুষ্ট করার জন্য এ পদক্ষেপ নেয় দেশটি।

এর মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি- ডানপন্থি হিন্দু জাতীয়তাবাদী একজন নেতা- পুলওয়ামা এবং বালাকোট অভিযান, উভয় ঘটনাকে দেশে তার নির্বাচনী প্রচারণায় সমর্থন আদায়ের জন্য ব্যবহার করেন এবং তিনমাস পরের সাধারণ নির্বাচনে বিশাল জয় লাভ করেন।

তার এ বিজয়ের ডানায় ভর করেই গত আগস্ট মাসে তিনি কাশ্মীরকে একীভূত করার পদক্ষেপ নেন, যা তাকে পার্লামেন্টে অপ্রতিদ্বন্দ্বীর ক্ষমতা এনে দেয়।

কিন্তু আবারও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একই ধরনের কোনো পাল্টা জবাব আসে না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বরং মিছিল আর কাশ্মীরের সমর্থনে বিবৃতি দেয়ার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেন।

পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র এর মধ্যে ঘোষণা দেন যে, সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানে সেনারা জাগ্রত অবস্থায় রয়েছে এবং শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের লাইন অব কন্ট্রোলে পাকিস্তানি সেনা চৌকিগুলোয় সফর করার ছবি প্রকাশ করেন।

তবে পাকিস্তানের যেসব জাতীয়তাবাদী গ্রুপগুলো ভারতীয় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জনসমর্থন তৈরির চেষ্টা করছিল, তাদের নিরুৎসাহিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ।

জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভকারীরা যখন অক্টোবর মাসে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীর থেকে ভারত শাসিত কাশ্মীরে প্রবেশের চেষ্টা করে, তাদের ঠেকিয়ে দেয় পাকিস্তানের সেনারা। বিক্ষোভকারীরা দাবি করছিলেন যে, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাশ্মীরের যে কোনো স্থানে যাতায়াত করার অধিকার তাদের রয়েছে।

সাবেক সাংবাদিক এবং কাশ্মীরের অধিকার আন্দোলন কর্মী জুলফিকার আলী বলছেন, ‘আমরা কঠোর একটি স্থানে আটকে গেছি। ভারত সবসময়েই কাশ্মীরের জনগণের শত্রু, কিন্তু পাকিস্তানও তাদের সাথে ঠিক আচরণ করেনি।’

দশকের পর দশক ধরে কীভাবে বিরোধ তৈরি হয়েছে?
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার আগে কাশ্মীর ছিল একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য, যার শাসক ছিলেন একজন হিন্দু রাজা। কিন্তু যখন ভারত ভাগ হয়ে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হলো, তখন কোন পক্ষেই যোগ না দিয়ে কাশ্মীরের রাজা স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই যখন পাকিস্তান দেশটির উত্তর পশ্চিম এলাকা থেকে রাজার শাসন উচ্ছেদ করতে সশস্ত্র আদিবাসী যোদ্ধাদের পাঠায়, তখন প্রথম এখানে সহিংসতার শুরু হয়। বাধ্য হয়ে কাশ্মীরের রাজা ভারতের সঙ্গে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

সংঘর্ষের ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দুই ভাগ হয়ে যায় কাশ্মীর। পাকিস্তান পরবর্তী সময় এর একটি ছোট অংশ চীনকে দিয়েছিল।

ভারতের তখন ক্ষমতায় ছিল কিছুটা উদার নীতির কংগ্রেস পার্টি, যারা কাশ্মীরের রাজাকে একীভূত হতে বাধ্য না করে বরং ১৯৪৮ সালের জুন মাসে পুরো কাশ্মীর জুড়ে একটি গণভোট আয়োজনের অনুরোধ নিয়ে জাতিসংঘে যায় - যাতে দেশটির জনগণ ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত জানাতে পারে যে, কোনো দেশের সঙ্গে তারা যেতে চায়।

তবে দেশভাগের পর উত্তর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈরিতার কারণে এ রকম কোন গণভোট আয়োজন করতে দুই পক্ষ একমত হতে পারেনি। এর মধ্যে ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্র অব্যাহত থাকে, কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা চলে যায় সামরিক বাহিনীর হাতে, যা কাশ্মীরের বিরুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

১৯৬৫ সালে ভারতবিরোধী এক আন্দোলনের সময় কাশ্মীরের গ্রামবাসীদের পোশাকে হাজার হাজার নিয়মিত সেনা সদস্যকে পাঠায় পাকিস্তান। ফলে দ্বিতীয়বারের মতো ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়, যাতে পাকিস্তান পরাজিত হয়।

১৯৮০-এর দশকে হাজার হাজার প্রশিক্ষিত ইসলামপন্থী জঙ্গি সদস্যদের ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ভেতরে পাঠায় পাকিস্তান, যারা সেখানে দশকের পর দশক জুড়ে সন্ত্রাস কায়েম করে রাখে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে নাইন ইলেভেন হামলার পরে তাতে লাগাম পড়াতে বাধ্য হয় পাকিস্তান।


নতুন ধরনের জাতীয়তাবাদ কি শুরু হতে পারে?
ক্ষুদ্র আকারে এবং চোখের আড়ালে হলেও কাশ্মীরে জঙ্গি কর্মকাণ্ড অব্যাহতই থাকে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপের প্রধান এবং কাশ্মীরের একজন আইনজীবী ড. নাজির জিলানী এ জন্য পাকিস্তানের নেতৃত্বকে দায়ী করেন, যারা কাশ্মীর ইস্যুতে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাবনাও আনতে পারেনি।

তবে অন্য অনেকে বলছেন, পাকিস্তানের নেতৃত্ব অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে, কাশ্মীর ইস্যুতে একমাত্র সমাধান হতে পারে পাকিস্তানের সঙ্গে রাজ্যটির একীভূত করা। উদার জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী একটি স্বাধীন কাশ্মীরের ধারণাকে গ্রহণ করতে পারবে না ইসলামী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী পাকিস্তান।

‘যখন ১৯৭০ দশকে কাশ্মীরের একাংশে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার চালু করে পাকিস্তান, তখন সেখানে অংশ নেয়া প্রার্থীদের একটি প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষর করতে হতো যে, তারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকবে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে,'' বলছেন আফ্রাসিয়াব খাত্তাক, পাকিস্তানের স্বাধীন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক প্রধান ও একজন আইনজীবী ও রাজনীতিক।

ফলে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে জাতীয়তাবাদীদের জন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, যারা পাকিস্তান ও ভারত, উভয় দেশ থেকেই মুক্ত স্বাধীন কাশ্মীর চান।

তিনি বলছেন, ‘আশির দশকে কাশ্মীরে জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট (জেকেএলএফ) নামের একটি উদার জাতীয়তাবাদী গ্রুপকে প্রথমদিকে সমর্থন দিয়েছিল পাকিস্তান, যেন তারা ভারতের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন শুরু করতে পারে। কিন্তু সেটা ছিল একটি হিসাবি পদক্ষেপ। ১৯৬৫ সালে তারা লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু যখন জনআন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, ইসলামাবাদ দ্বিতীয় চিন্তা করতে শুরু করে এবং তাদের ইসলামপন্থী বাহিনীগুলোকে ভারত ও জেকেএলএফ, উভয় লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার জন্য পাঠায়।

তা হলে নতুন বছরে ভারত, পাকিস্তান ও কাশ্মীরের জন্য কী অপেক্ষা করছে?
যেভাবে কাশ্মীরে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে এবং গত চার মাস ধরেই অব্যাহত রয়েছে, তা বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো।
খাত্তাক বিশ্বাস করেন, কাশ্মীরকে একীভূত করে নেয়ার ফলে নতুন করে কাশ্মীরের জাতীয়তাবাদের উত্থান হতে পারে। তার সফলতা নির্ভর করবে যে কারা তাদের জিহাদি পরিচয়ের বাইরে গিয়ে আন্দোলনটি করতে পারে।

জুলফিকার আলী একমত পোষণ করে বলছেন, ‘কাশ্মীরের বাসিন্দারা উপলব্ধি করতে পারছে যে, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তারা বাইরের শক্তির ওপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না। তারা এটাও বুঝতে পারছে যে, তাদের এই আন্দোলন হতে হবে পুরোপুরি নিজস্ব এবং অহিংস। যেহেতু বেশিরভাগ জাতীয়তাবাদী নেতা হয় ভারতের কারাগারে অথবা বিদেশে, তরুণদের মধ্যে থেকে নতুন এক নেতৃত্ব বেরিয়ে আসতে পারে।
খবর বিবিসি বাংলার

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ